মুরুং নাকি ম্রো এই দুই নাম কি একই জাতির ভিন্ন পরিচয়?

Jumjournal
Last updated Sep 1st, 2021

2411

featured image

নৃ-তাত্বিক পরিচয়ের এই দুই নাম নিয়ে দীর্ঘদিন একটা দোদূল্যমানতা লক্ষণীয়। ম্রো জাতি আমাদের পাহাড়ে প্রথম বসবাসকারী তথা First Dwellers ১১টি জনজাতি মানুষদের অন্যতম।

বান্দরবান জেলাতেই তাদের বাস। সাধারণত গহীন এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করে তারা। আবাসের দুর্গমতা, শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা ও আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন কারণে ম্রোরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হলেও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা ও স্বাতন্ত্রিক জীবনাচারের কারণে খুবই সরলমনা এই জাতি ভিন্নতর সংস্কৃতির মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও কৌতুহলের বিষয়ও বটে।

তাইতো এই জাতিদের জীবন, আচার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দেশের সমতল থেকে শুরু করে ইউরোপ -আমেরিকা থেকে এসে কেউ কেউ গবেষণা করে। এই জাতির নাম নিয়ে ক্ষুদ্র এই আলোচনার বিশেষ কারন হলো, তাদেরকে কেউ ডাকে ম্রো নামে, আবার কেউ কেউ ডাকে মুরুং নামে।

কেউ কেউ লিখিছে -MRU. কালে কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আসা গবেষণাকারীদের মধ্যে এই নাম দুটির ব্যবহার আমার কাছে উল্লেখযোগ্যভাবে কৌতুহল হয়ে রয়েছে।

সমতল বা ভিনদেশ থেকে এসে যারা গবেষণা করে শুধু তারা নয়, খোদ বান্দরবানে সংবাদপত্র সহ অন্যবিধ লেখালেখি করে তাদের কলমের ভাষায়ও ম্রোদেরকে মুরুং লিখতে বা ডাকতে দেখা যায়। স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, এরূপ ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকাটা কতটুকু সংগত?

আমরা যদি একটু পিছন তাকায়, তবে দেখা যায়, ফ্রান্সিস বুখানন, টিএইচ লুইন, জি এইচ লোফলার, কন্সটা, সিলিন ইত্যাদি নামে ইউরোপীয় পর্যটক, লেখক ও গবেষকগণ পাহাড়ের জাতিসত্বা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন, লেখাজোকা করেছেন। বর্ণিত নামের বাইরেও হয়তো আরো একাধিক নামে ভিনদেশীগণ কাজ করেছে বা করে থাকতে পারে যা আমি তাঁদের নাম ধাম জানি না।

এটুকু জানি তাদের বড় অংশই কাজ করেছেন, লিখেছেন এই ম্রো জাতিকে নিয়ে। ওসব লেখাজোকাতে এই ইউনিক জাতির পরিচয় কি নামে উচ্চারিত হয়েছে তার সবটাও অবশ্য আমার জানা নেই।

পুরাতন লেখকদের মধ্যে বিশেষত খ্রীষ্টিয় ১৬/১৭শ শতকের লেখকদের মধ্যে কিন্তু বিভ্রান্তি লক্ষণীয়। তারা মুরুং এবং ম্রো উভয় নাম ব্যবহার করেছেন। দেশীয় লেখকদের মধ্যেও সমরূপ প্রবণতা লক্ষণীয়। যেমন, ৬০/৭০ দশকের লেখক জনাব আ: সাত্তার এর লেখা The Sylvan Shadow তেও বোধয় বিভ্রান্তি আছে।

তাছাড়াও স্থানীয় লেখকদের মধ্যেও এই বিভ্রান্তি চোখে পড়ে এখনো। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৪ মার্চ ২০১৮ তারিখ মধ্যরাতে আলিকদমের কুরুকপাতার এক ম্রো পরিবার বার্মায় যাওয়ার পথে ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার রিপোর্ট সম্পর্কিত লেখায় বান্দরবানেরই একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল যার নাম –‘পার্বত্য বার্তা’ নিহত একজন ও বাকী ৫জনের পরিচয় লিখেছে মুরুং।

আমার প্রধান প্রশ্ন দুটি:

১। ম্রো নামে জাতি থাকলেও মুরুং নামে আদৌ কোনো জাতিসত্বার নাম আছে কি না?

২। কোনো জাতির নাম যদি অন্যদের কর্তৃক দু-ভাবে ডাকা হয় বা পরিচিতি পায়, তবে আন্তর্জাতিক রীতি মোতাবেক বা নৃ-তত্বের বিচারে সংশ্লিষ্ট জাতির মানুষ কি নামে নিজেদের পরিচয় দেয় সটাই হবে আসল নাম বা ডাক, তাই নয় কি?

তিন মুরুং ও মেনলে- অন্যান্য ম্রো!

প্রসংগত একটা বিষয় উল্লেখ্য, মধ্য সত্তর বা ৮০ দশক থেকে পাহাড়ীদের মধ্যে নামের শেষে জাতিসত্বার টাইটেল যোগ করার প্রবণতা বা রীতি শুরু হয়। যেমন অম্লান চাকমা, রাজুময় তঞ্চঙ্গ্যা, জয়দেব রোয়াজা, মলয় ত্রিপুরা, মংসানু মারমা ইত্যাদি।

তারই ধারাবাহিকতায় কিনা জানিনা, আমার জানার মধ্যে বান্দরবানের এক পরিবারের ৩ জন শিক্ষিত ম্রো তাঁদের নামের সাথে মুরুং টাইটেলটা লেখেন। একজনের নাম চিম্ময় মুরুং, জীবময় মুরুং এবং অন্যজন জ্যোতির্ময় মুরুং।

উক্ত ৩ জনের মধ্যে শেষোক্ত দুজনই এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার এবং সম্ভবত সবাই আপন ভাই। এই তিনজন বাদে অদ্যাবধি কোনো ম্রো ব্যক্তির নামের শেষে মুরুং টাইটেল লিখেছে বলে আমার জানা নেই। ইদানিং এ জাতির কয়েকেজন তরুণ তরুণী উচ্চ শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে।

এমনকি কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে এসেছে। তাদের সবার নামেও টাইটেল একমাত্র ‘ম্রো’ লেখা হয় বলে জানা যায়। এখানে আরো উল্লেখ্য যে, ম্রোদের মধ্যে আগে থেকেই স্বাতন্ত্রিক ভাষা থাকলেও কোনো বর্ণমালা ছিলো না।

৮০ দশকে মেনলে নামক এক বিদ্বাণ ও মিস্টিরিয়াস যুবক তাদের বর্ণমালা আবিস্কার করেন। ঐ যুবকের নামের টাইটেলও বিভিন্ন লেখা-লেখিতে ম্রো শব্দটিই পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য এই মেনলে ম্রো তাদের বর্ণমালা ও লোকরীতি ‘ক্রামা’ আবিস্কারের পর অন্তর্ধান হয়ে যায়। ম্রোরা বিশ্বাস করে তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং তাঁদের সামাজিক পরিবর্তনে তিনি ত্রাতা হয়ে আরো আবির্ভূত হবেন।

Menle Mro - Inventor of Krama alphabet (Missing)_credit: unknown
Menle Mro – Inventor of Krama alphabet (Missing). Credit: unknown

ম্রুং ও মুরুং কন্ট্রাস্ট!

এখানে আরো একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, মারমাদের ডাকের মধ্যে ‘মুরুং’ না থাকলেও ‘ম্রুং’ শব্দটি আছে। এই ম্রুং টা কিন্তু ম্রো নয়, ত্রিপুরা। অর্থাৎ মারমারা ত্রিপুরাদেরকে ম্রুং বলে ডাকে।

বস্তুত, মারমারা অন্য নানা জাতিদের ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা আলাদা নাম ব্যবহার করে তেমনি পাহাড়ে অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম জাতিদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। যদি কয়েকটি উদাহরণ দিই:

ইউরোপীয়/উত্তর আমেরিকার সাদাদের ডাকা হয় – লুফ্রু বা ফলং। আফ্রিকানদের ডাকা হয় – লুমে:, চাকমাদের ডাকা হয় – সাক, তঞ্চঙ্গ্যাদের ডাকা হয় – দৈংনাক, বম-পাংখোয়া-লুসাইদের ডাকা হয় – লাংগে আর ত্রিপুরাদের ডাকা হয় #ম্রুং (Mroong)। মজার ব্যাপার হলো, ম্রোদের আলাদা কোনো নাম বা ডাক নেই! স্রেফ একটা নাম, ম্রো।

প্রত্যেক জাতির জন্য মারমাদের আলাদা ডাক কেনো বা কোন প্রেক্ষাপটে তৈরী হলো যেমন আমার জানা নেই, তেমনি ম্রোদের জন্য আলাদা কেনো ডাক নেই সেটাও জানা নেই। এই বিষয়টা জানার জন্য অনেক আগে কোনো এক অগ্রজ বন্ধুর সাথে আলোচনায় জেনেছি, আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে আগমনের সময় মারমাদের সাথে ম্রোদের নাকি একটা ডিস্প্যুট বা বিবাদ বা ইস্যু তৈরী হয়েছিলো।

পরে, মারমাদের এক দলনেতার পূত্র তখনকার ম্রো দলনেতা (অথবা রাজা)’র কন্যার সাথে বিবাহ সম্পর্কের পর নাকি এই দুই জাতির সম্পর্কে ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছিলো। তবে কাহিনীটি স্রেফ বলার জন্য বলা নাকি ফ্যাক্ট সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় নি। পরবর্তীতে আমার অন্য দ্বিতীয় এক বন্ধু-সূত্র কোনো একদিন জানিয়েছিল এ ঘটনাটা আসলেই ফ্যাক্ট এবং তিনি প্রাচীন কোনো পত্রগ্রন্থে সেটি পড়েছিলেন।

Usui clan of Tripura (Mroong in Marma) Kraitoi offshore Feb 2018. Image: Kong
Usui clan of Tripura (Mroong in Marma) Kraitoi offshore Feb 2018. Image: Kong

উপসংহার:

উক্ত নোটের ইতি লাইন দুটি বিষয়ের আলোকে শেষ করতে চাই।

প্রথমত: উপরের আলোচনার বাইরে, আধুনিক কালে স্বনামধন্য হিস্টোরিয়ান জার্মান এক লেখক মি. জি.এফ.লোফলার ম্রো জাতির জীবনযাত্রা নিয়ে লেখা বইটিতে যেহেতু MRO শব্দটিই ব্যবহার করেছে;

দ্বিতীয়ত: মুরুং নামে সত্যিকারে অন্য জাতিসত্বার অস্তিত্ব যদি না থাকে, বিভিন্ন লেখকের বিভ্রান্তির কারনে অবচেতন ভাবে যদি ম্রোদের ক্ষেত্রে মুরুং অভিধাটি ব্যবহৃত হয় থাকে, সর্বোপরি, সমস্ত ম্রোরা একটামাত্র টাইটেল ‘ম্রো’ই ব্যবহার করে, সবার উচিৎ হবে উক্ত জাতিকে একটা নামেই ডাকা। সেটা হলো ‘ম্রো’/MRO.

*উল্লিখিত তথ্যসমূহে অথবা বর্ণনায় কোনোরূপ অসংগতি বা প্রমাদ চিহ্নিত হলে ফিডব্যাক কাম্য।


লেখকঃ Kong Chai, লেখাটি উনার ফেসবুক নোট থেকে নেওয়া হয়েছে, উনার ফেসবুক আইডি লিঙ্ক এখানে
মূল লেখাঃ এখানে

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply
You must be logged in! Login Now?
Ruiton Mro
Ruiton Mro

ম্রো ভাষায় ‘ম্রো’ শব্দের অর্থ মানুষ। কিন্তু মুরং, মুরুং শব্দের অস্তিত্ব ম্রো ভাষায় নেই। আমার ধারণা মুরং, মুরুং শব্দদ্বয় দ্বিতীয় ব্যক্তির আখ্যায়িত।

লক্ষ্য করুন: আমি যদি বলি-আমি ম্রো।
বাক্যটির এই অর্থে প্রকাশ পায়- আমি মানুষ।
কিন্তু আমি যদি বলি- আমি ম্রোচ্য। তাহলে বাক্যটি তার স্বীয় অর্থে প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ ম্রোচ্য জাতিসত্তার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ পাবে।

Mar 23rd, 2020 12:49 PM