মৃত্যুলোকের স্বরূপ সন্ধানে, জীবনের জয়গানে
704
নশ্বর এ পৃথিবীতে আমাদের জন্ম,আমাদের অস্তিত্ব যেমন সত্য মৃত্যুও তেমনি একটি সত্য। অন্তত আমাদের এই মানুষদের জন্য। কেননা এই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষেরই তাদের জীবন-মৃত্যু, জীবনের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করার সামর্থ্য রয়েছে,আর রয়েছে সত্যকে উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান।
কিন্তু অন্য জীবের ক্ষেত্রে তা নেই। যদিও প্রতিটি জীবেরই আপন প্রাণের প্রতি মায়া রয়েছে,রয়েছে ভালোবাসা। কিন্তু এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করার সচেতন কিংবা অবচেতন কোনো বোধ মানুষ ব্যতিত অন্যকোনো প্রাণীর মধ্যে নেই। তাই বলা হয়ে থাকে মানুষের চিন্তার সামর্থ্যই মানুষের জন্য অনেক দুঃখের কারন।কেননা মানুষের চিন্তা করার সামর্থ্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে।আর যে বিষয়সমূহ মানুষকে প্রভাবিত করে তার একটি মৃত্যুচিন্তা।
প্রত্যেকটি মানুষই কোনো না কোন ভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়।আসলে মানুষের কাছে মৃত্যু জিনিসটা চিরকালই রহস্যময়। যে জিনিস অজানা,যে জিনিস সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারনা নেই সে জিনিস সম্পর্কে মানুষ বরাবরই ভীত এবং সে জিনিস নিয়েই মানুষ সবচেয়ে কৌতুহলী। অথচ আর সবকিছুর মতোই মৃত্যুও একটি স্বাভাবিক বিষয়।
কিন্তু মানুষের চিন্তার সক্ষমতা এ বিষয়টিকে করে তুলেছে আরো জটিল,আরো রহস্যময়। একেক জন একেক রকম ভাবে তাদের চিন্তা-কল্পনায় মৃত্যুকে একেক রকম ভাবে রূপ দান করে। এই স্বাভাবিক মৃত্যুকেও তাই আমরা মানুষেরা অস্বাভাবিক করে তুলেছি।
অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অর্থে মৃত্যুকে ভয় পায় না। বাস্তবে তারা মৃত্যুর পর তাদের স্ব- অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্বের প্রশ্নকে ভয় পায়।কারন এটাই আমাদের অজানা। এজন্যই হাজার বছর ধরে অসংখ্য চিন্তাবিদ আর ধর্মীয় লেবাসধারী মানুষ মৃত্যু পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করাকে বেছে নিয়েছে।
যে ভয়কে আসলে আমরা মৃত্যুভয় হিসেবে দেখি তা হলো আমাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অজানা আশঙ্কা। তাই মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কোনো যথার্থ কারন নেই। আর যেসব কারনে মৃত্যুকে আমরা ভয়ের দৃষ্টিতে দেখি তা আসলে অমূলক। এ সম্পর্কে সক্রেটিস যথার্থই বলেছেন ‘’ মৃত্যুকে ভয় করার অর্থ হচ্ছে অজানাকে জানি বলারই সামিল।
কেননা আমরা জানিনা মৃত্যু ভালো কি মন্দ “। তাসত্ত্বেও এ ভয়কে আমরা অতিক্রম করতে পারিনা, কারন জন্ম পরবর্তী সময়ে এ ভয়ের ধারনাগুলো আমাদের মধ্যে তিলে তিলে প্রথিত করা হয়েছে। যাকে সর্বাংশক্রমে দূর করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই জীবন ও মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার চেষ্টাও একটা সাধনা।
মৃত্যুর সাথে সাথে একজন মানুষ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। তার চেতন ও অবচেতন অংশ শূন্যে মিলিয়ে যায়। হয়তো কোনো কিছুর মধ্যে সে ডুবে যায়, যাকে গভীর ঘুমের সাথে তুলনা করা যায় , যার কোনো জাগরণ নেই। মানুষ যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে , ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে তখন তার মধ্যে কি ভয়ের কোনো চেতনা কাজ করে ? উত্তর হচ্ছে না ।
কেননা মৃত্যুর সাথে সাথে সকল চেতনার সমাপ্তি ঘটে।চেতনাহীন কোনো জড় দেহে ভয়ের উদ্ভব ঘটা সম্ভব নয়। যতক্ষন এ দেহে চেতনা বসবাস করবে,মানব মনের ক্রিয়া প্রতিক্রয়া কাজ করবে ভয় ততক্ষণ পর্যন্তই আমাদের সঙ্গী। আর মৃত্যুর সাথে সাথেই অবসান ঘটবে সব কিছুর। মূলত সকল দুশ্চিন্তার মূল অজানার সাথেই নিহিত, তাই এ মৃত্যুকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
তবে মৃত্যুর পরেও যে কিছু নেই, বরং মৃত্যুর সাথে সাথে চিরাচরিত স্বাভাবিক জীবনের একটি পরিসমাপ্তি ঘটবে এই বোধ যদি তৈরি হয়, তখন জীবনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার সামর্থ্য তৈরি হবে। দূর হবে মৃত্যুভয়। আর ভয় তখনই থেমে যায় যখন তার অসম্পূর্ণতাকে গ্রহণ করে, সীমাবদ্ধতাগুলো মেনে নেয় এবং এই মহান স্বীকৃতির মাধ্যমে মৃত্যুভয় তখন পরাজিত হয়।
“ কিছুই না “ বা শূন্যতার মধ্যে অসীমকে ধারন করার মাধ্যমে এমন এক অনুভূতির জন্ম হয় যা মানুষের বাস্তবতাবোধকে আরো পাকা পোক্ত করে তোলে। মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল ভয় বেদনাকে নিয়ন্ত্রনে রাখে। অবশেষে একজন আত্মানুসন্ধানীর গন্তব্য গ্রহণ করা হল প্রকৃত নির্ভিক মানুষে পরিনত হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। তার মধ্যে তখন আর সবকিছুর মতো মৃত্যুকেও
স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
আপনি হয়তো একজন সম্রাট ,পৃথিবীর উপর রাজত্ব করছেন, তবুও আপনি ভয় পান। ছায়ার মত মৃত্যুভয় আপনাকে অনুসরণ করে। আপনার সহায়-সম্পদ-বল , ক্ষমতার বিশালতা ও জাঁকজমকের মধ্যেও মৃত্যু্ভয় আপনাকে কাবু করে। মৃত্যুভয়ের কাছে আপনার নিজেকে খুব দরিদ্র ও অসহায় লাগে। অন্যের জীবন নেওয়ার ক্ষমতা আপনার আছে, তবুও আপনি নিজের মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে পারছেন না।
রাজা এবং সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট থেকে বড় মৃত্যু শেষ পর্যন্ত সবাইকেই পরাজিত করে। কারন সমস্ত উপাদান শেষ পর্যন্ত এই অন্তিম সত্যের মুখোমুখি হবে। বাস্তবে আপনি নিজের মতো জানেন বা মনে করেন এমন হয়তো একজন মানুষ আছেন যার জন্য আপনার এ মূল্যবান জীবন এখনো আছে।
আসলে আমরা কারো জন্যই বেঁচে থাকি না , বাঁচি শুধুমাত্র নিজেদেরই জন্য। এমনকি পুনর্জন্ম যদি সত্যি হত, তবে আপনি পূরবর্তীদের কোনো চেতনা ছাড়াই একজন নতুন ব্যক্তি হিসেবেই ফিরে আসতেন। তাই, আপনার জন্ম ও মৃত্যুর দুটি খুঁটির মাঝে আপনার অনন্য সচেতন অস্তিত্বের ক্ষেত্র রয়েছে ; আপনি শ্বাস নিন , হাঁটুন , খান এবং একজন অনন্য ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করুন। দেখবেন সেখানে আপনার অস্তিত্ব ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুই খুঁজে পাবেন না।
সে যাই হোক , যখন আমাদের জীবন শেষ হবে তখনও আমাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা কর্তব্য।অসম্পূর্ণতার বাস্তবতাকে প্রাকৃতিক আদেশ হিসেবে উপলব্ধি করতে পারার সক্ষমতাই জীবনে সত্যিকারের সাহস যোগায়। যখন আপনার সত্যিকারের সাহস থাকবে তখন আপনি আপনার মৃত্যুকে ভয় বা অনুশোচনা ছাড়াই আলিঙ্গন করবেন। যখন আপনি আপনার মৃত্যুকে প্রাকৃতিক স্বাভাবিক
বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেন এবং মেনে নেন আপনার অসম্পূর্ণতাকে , তখন আপনি যদি মহান সম্রাট এবং রাজা হন কিংবা ভিক্ষুকও হন আপনার মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা কাজ করবেনা।
কোনো জিনিসের অসম্পূর্ণতা বুঝতে পারা আমাদের জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শেখায় এবং জীবনকে করে তোলে অমূল্য। যার মূল্য হয়তো কখনো নির্ধারন করা সম্ভব না। যেমন আমরা মানুষকে ভালোবাসি এবং ভালোবাসি নিজেকে কারন মানুষের আয়ু এত কম যে তা শীঘ্রই সমাপ্ত হতে চলেছে। যারা সচেতন তারা জানে যে প্রিয় মানুষদের সাথে থাকার সময় তাদের জন্য সীমিত। তাই এভাবেই প্রতিটি মূহূর্ত পবিত্র হয়ে ; বসন্তের মত জীবনের সব কিছুই মাধূর্য্যময় হয়ে ওঠে। আর
সম্পর্কগুলোও হয়ে ওঠে সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান। যেমন বসন্তের মত সুন্দর , উষ্ণ কিন্তু সময় সীমিত।
বস্তুত আমাদের অস্তিত্ব শুধু জন্ম মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যেও বিশাল একটি ক্ষেত্র আছে সেটি হলো আমাদের জীবন। আর মৃত্যুই যদি সকল সুখ-দুঃখের পরিসমাপ্তি হয় তবে তাকে ভয় পাওয়ার আর কী কারন থাকতে পারে ? যাই হোক, যখন আপনি এখনও আছেন তখন আপনাকে সম্পূর্ণভাবে বাঁচতে শিখতে হবে এবং তা আপনার অনন্য ব্যক্তিত্বকে নষ্ট না করেই।
যখন কেউ মৃত্যু সম্পর্কিত এ অজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করে তখন এটি তার স্বাভাবিক চিন্তা ও বোধকে ব্যহত করে। মৃত্যুকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয় আমরা বরং একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করতে পারি। বরং সাথে চেষ্টা করতে পারি এ অমূলক ভয়কে দূর করার এবং বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার।
কেননা আমরা এই জীবনের পরে আর কখনো একই জোড়া চোখ দিয়ে একে অপরকে দেখতে পাবোনা এবং এটা জেনে এমনকি শত্রুদের সাথেও একে অপরের সাথে শান্তি স্থাপন করার প্রয়োজন বোধ সৃষ্টি হবে। আর জীবনের দৈর্ঘ্য খুব ছোট বলেই হয়তো তা সবার কাছেই এত প্রিয়। পরিশেষে আমাদের এটা মনে রাখা চাই আপনি বা আমি বেঁচে আছি অসীম অনন্তকালের মধ্যে মাত্র
একবারই । এটা কতটা মূল্যবান আর আমি বা আপনি কতটা অনন্য !!!
লেখকঃ বিপুল চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।