মেনলে ম্রো: পার্বত্য পুরাণের স্বপ্নবীজ
1394
এক.
মিথ বা পুরাণ প্রসঙ্গ উঠলেই চেতনায় জেগে ওঠে অদ্ভুত উল্লাস ভারাক্রান্ত বেদনা, অনির্বচনীয় প্রেমানুভূতি, ধুন্ধুমার যুদ্ধের ঘোড়া ও আর্তনাদ, তামা লোহা ও পিতল নির্মিত অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানিতে দুই বা ততোধিক বিবাদমান পক্ষ-বিপক্ষের রক্তক্ষয়ী কুরুক্ষেত্র বা ট্রয়ের ময়দান।
অন্যদিকে কারবালার প্রান্তরে প্রতারিত মহামতি ইমাম হোসেনের অশ্রু ও রুধির মাখা অবয়বের কথা ভেবেও কতোবার শিউরে উঠেছি সহমর্মিতায় আর অভিসম্পাতে জর্জরিত করেছি ইয়াজিদ ও তার দুরাত্মা পরিষদকে, তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইমাম হোসেন ট্র্যাজিডিতে অশ্রুসজল পক্ষপাত আজও অন্তর থেকে ধুয়ে-মুছে না-গেলেও ওই বিধূর কারবালা কাহিনির নির্যাসকে বিনির্মাণ করে একালের পরিপ্রেক্ষিতে পারিনি উপস্থাপন করতে না গদ্যে, না পদ্যে।
কারণ ইসলামের মৌল তাৎপর্যের সঙ্গে পৌরাণিকতায় স্বীকৃতি নেই। সে কারণে কল্পনা বিস্তার ও তার স্বকল্পিত শৌর্যবীর্য, এমন কি মায়ামমতার মর্মদ্রবী ছবি আঁকা এখানে কিঞ্চিৎ ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি।
পৌরাণিক কাহিনি ও তার বিবিধ বর্ণাঢ্য উপাচারে আমার অপরিমেয় আসক্তি এখনও বেশ দুর্বার বলেই সাম্প্রতিককালের একটি অতি বাস্তব ঘটনার গ্রিক পুরাণের একটি উপকাহিনীর এক ঝলক প্রতিফলন লক্ষ করে পুরাণ ও বাস্তবতার মিথোষ্ক্রিয়ায় আরও আস্থাবান হলাম।
২০১১ এর নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তিন নারীর একজন ৩৯ বছর বয়সী লেমাহ বোয়িই লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় সংঘটিত সহিংস কর্মকান্ডের কট্টর সমালোচক ছিলেন।
সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ নারী ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষ সকল মহিলাকে ঐক্যবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার মিশন ছিল পুরুষেরা সহিংস ঘটনা ঘটালে স্ত্রীরা স্বামীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক পরিহার করবেন।
২০০২ সালে লাইবেরিয়া মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নারীদের ঐক্যবদ্ধ করে এমনই এক অভিনব কর্মসূচি চালু করেন লেমাহ বোয়িই। হুবহু এ রকমই এ ঘটনার উল্লেখ পাই গ্রিক পুরাণে। মহান নাট্যকার অ্যারিস্টোফানিস এর ‘লিসিসট্রেটা’ নাটকে। [রচনাকাল: ৪১১ খ্রি. পূ.]
এ নাটকের মৌল অভিপ্রায়ও যুদ্ধবিরোধী তথা শান্তিবাদী। এখানে নাট্যকার নায়িকা লিসিসট্রেটার নেতৃত্বে সমগ্র গ্রিসের রমণীকূলকে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ করেন। নাটকে মহিলারা স্থির করেন যে, পুরুষেরা যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে না এলে তাদের যৌনমিলনে তারা আর সময় দিবে না।
শান্তি স্থাপনে এটাই ছিল তাদের একমাত্র হাতিয়ার। সে যা হোক, পুরাণের ওই ঘটনার সঙ্গে বাস্তবতার এমন আপতিত সাদৃশ্য দেখে অর্থাৎ লিসিসট্রেটাকে লেমাহ বোয়িইর মধ্যে দেখতে পেয়ে নিশ্চয় অনেকেই খানিকটা অবাক হয়েছেন।
এখানে প্রাসংগিক বিবেচনায় ওই নাটকের কিছু অংশ, যেখানে লিসিসট্রেটা ও সমবেত মহিলাদের সংলাপ উল্লেখিত বিষয়টা পরিষ্কারভাবে উম্মোচিত হয়েছে, তার খানিকটা উদ্ধৃত করছি:
লাম্পিটো : কিন্তু মহিলাদের এই সম্মেলন কে ডেকেছে, এখন সেই কথা বল।
লিসিসট্রেটা : আমি ডেকেছি।
লাম্পিটো : আমাদের কাছে তুমি কী চাও, সেটা বল।
ক্লিওনিসে : হ্যাঁ ভাই, সেটা বল। কি জরুরী বিষয় তুমি আমাদের সবাইকে জানয়াতে চাও?
লিসিসট্রেটা : বলছি, কিন্তু আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও।
ক্লিওনিসে : জিজ্ঞেস কর।
লিসিসট্রেটা : তোমাদের সন্তানের পিতারা যে তোমাদের ছেড়ে দূরে যুদ্ধক্ষেত্রে দিন কাটাচ্ছেন, সে জন্য কি তোমাদের দুঃখ হয়না? তোমরা কি বিষন্ন ও বিমর্ষবোধ কর না?
ক্লিওনিসে : আজ পাঁচ মাস ধরে আমার স্বামী থ্রেসে, ইউক্রাটিসের তদারক করে বেড়াচ্ছেন।
মিরহাইনে : দীর্ঘ সাত মাস আগে আমরা স্বামী বাড়ি ছেড়ে পাইলসে গেছেন।
লাম্পিটো : আর আমার স্বামীর কথা? কোনো রণাঙ্গন থেকে বাড়ীতে ফিরতে না ফিরতেই আবার ঢাল-তলোয়ার তুলে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
লিসিসট্রেটা : আর একটা প্রেমিকের ছায়া পর্যন্ত নেই। যেদিন মাইলেশীয়রা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেদিন থেকে আমি একটা আট ইঞ্চি যন্ত্র পর্যন্ত দেখিনি। আমাদের মতো বেচারি বিধবাদের সন্তানরা কোন পথ নেই…এখন বল, এই অবস্থায় আমি যদি যুদ্ধ শেষ করবার একটা পন্থা বের করতে পারি তবে তোমরা সবাই আমাকে সমর্থন করবে তো?
ক্লিওনিসে : তাবৎ দেবীদের নামে শপথ করে বলছি, আমি করব, যদি আমাকে আমার পোশাক বন্ধক দিয়ে সেই একই দিনে মদ খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দিতে হয়, তবুও করব।
মিরহাইনে : আমিও করব। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার হলে আমি টেগেটাস পাহাড়ের চূড়ায় পর্যন্ত উঠতে রাজী আছি।
লিসিসট্রেটা : তাহলে এবার আমার গৃঢ়-গোপন কথাটি আমি তোমাদের কাছে প্রকাশ করব। প্রিয় ভগ্নিগণ, আমরা যদি আমাদের স্বামীদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করতে চাই তবে আমাদের বিরত থাকতে হবে.
ক্লিওনিসে : কি থেকে বিরত থাকতে হবে? বল, বল।
লিসিসট্রেটা : কিন্তু তোমরা কি তা করবে?
মিরহাইনে : করব, করব, যদি এর জন্যে মরে যেতে হয়, তবু করব।
লিসিসট্রেটা : আমাদের সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে পুরুষ সঙ্গ থেকে। ….. না, ও রকম করে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ কেন? তোমরা কোথায় যাচ্ছ সবাই? তাহলে ঠোঁট কামড়াচ্ছো তোমার, মাথা নাড়াচ্ছো? তোমাদের চেহারা এত পাংশু আর বিষন্ন হয়ে গেল কেন? কেন চোখে অশ্রুকণা? এসো, বল তোমরা এটা করবে? হ্যাঁ কিংবা না? ইতস্তত করছো তোমরা?
ক্লিওনিসে : আমি পারব না। যুদ্ধ চলতে থাকুক।
মিরহাইনে : আমিও পারব না। চলতে থাকুক যুদ্ধ। লিসিসট্রেটা (মিরহাইনেকে উদ্দেশ্য করে) : আর তুমি রূপসী চাঁদা মাছ, তুমিও এ কথা বলছ, যে একটু আগে নিজেকে দ্বিখন্ডিত করার কথা বলেছিলে?
ক্লিওনিসে : অন্য আর যা কিছু বল, শুধু ও কথা বল না। তোমার ইচ্ছে হলে আমাকে অগ্নিবলয় ঝাঁপ দিয়ে পার হয়ে যেতে বল, কিন্তু লক্ষ্মী লিসিসট্রেটা, সারা দুনিয়ার মধুরতম জিনিস থেকে আমাদের তুমি বঞ্চিত কর না।
লিসিসট্রেটা (মিরহাইনের দিকে তাকিয়ে) : আর তুমি?
মিরহাইনে : হ্যাঁ, আমিও ওদের সঙ্গে একমত। তার চেয়ে আমিও বরং অগ্নিকুণ্ড ঝাঁপ দিয়ে পার হয়ে যাব।
লিসিসট্রেটা : হায় দায়িত্বজ্ঞানহীন জঘন্য নারীজাতি। আমাদের নিয়ে ট্র্যাজিক নাটক রচনা করে কবিরা ভালোই করেছেন। প্রেম আর রতিক্রিয়া ছাড়া আমরা আর কোন কাজের যোগ্য নই। কিন্তু ভাই, তুমি সুকঠোর স্পার্টার মেয়ে, তুমি যদি আমার সঙ্গে যোগ দাও, তাহলে এখনো সব রক্ষা করা যাবে। আমি মিনতি করছি আমাকে সাহায্য কর , আমাকে সমর্থন দাও।
লাম্পিটো : কাজটা খুব কঠিন , ভাই। দুই দেবীর দোহাই দিয়ে বলছি, সত্যি কঠিন। একটা শক্ত-সমর্থ পুরুষ ছাড়া নিশিযাপন করা সত্যি কঠিন। কিন্তু তবুও সবার আগে শান্তির স্থান ।
লিসিসট্রেটা : লক্ষ্মীটি, তুমিই আমার সেরা বন্ধু, একমাত্র তোমার কথামতো সম্পূর্ণভাবে পুরুষ সঙ্গ থেকে বিরত থাকি তাহলে কি তাড়াতাড়ি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে?
লিসিসট্রেটা : অবশ্যই হবে। আমরা শুধু গালে রং মেখে, স্বচ্ছ এ্যামোরগস সিল্কের হালকা। পোশাক পরে, নিখুঁতভাবে লোম নির্মূল করে আমাদের সখাদের সঙ্গে দেখা করব, আর ওরা তাদের হাতিয়ার তুলে আমাদের শয্যাগমনের জন্য পাগল হয়ে উঠবে এবং তখনই সময় হবে তাদের প্রত্যাখ্যাত করবার, আর আমি সুনিশ্চিত যে তখন তারা ঝটিতি শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।
লাম্পিটো : হ্যাঁ, লোকে যেমন মেনেলেয়াসের কথা বলে, হেলেনের নিরাভরণ বক্ষ দেখে যেমন তার তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, ঠিক সেই রকম।
ক্লিওনিসে : কিন্তু যদি , স্বামীরা আমাদের ফেলে রেখে চলে যায়?
লিসিসট্রেটা : তাহলে ফেরেকরাটিস যেমন বলেন, কুকুর মেরে খাল ছাড়িয়ে ‘ নিতে হবে আমাদের, বসে।
ক্লিওনিসে : বাজে কথা। এইসব প্রবাদ বাক্য শুধু, কথার কথা। … কিন্তু স্বামীরা যদি আমাদের নেহাৎ গায়ের জোরে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়?
লিসিসট্রেটা : তাহলে ওদের ইচ্ছের কাছে হার মানবে, কিন্তু চরম বিতৃষ্ণার সঙ্গে। ওরা যখন জোর করে ও কাজ করে তখন তারা তার মধ্যে কোন আনন্দ পায় না। তাছাড়া ওদের যন্ত্রণা দেবার হাজার পথ আছে। না , না, কোন ভয় কর না। ওরা ওই খেলায় তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়বে। মেয়ে যদি তাতে সত্যিকার অংশ না নেয় তাহলে ওর মধ্যে পুরুষের কোন তৃপ্তি নেই।
ক্লিওনিসে : ঠিক আছে, তুমি যদি মনে কর যে এটাই একমাত্র উপায়, তাহলে আমরা রাজী।
[কবীর চৌধুরীর অনুবাদে ব্র্যাক প্রকাশনা জুন ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত; পৃ. ১৩-১৭]
দুই.
মিথতাত্বিক যোসেফ ক্যাম্পবেল বলেন: “মিথের জন্ম তখন, যখন আমাদের আদিপিতারা শিকারের পর আগুনের চার পাশে বসে শিকারের ঘটনা নিয়ে গল্প করত এবং উল্লেখ করতো সেই অদৃশ্য লোকের যেখানে মৃত শিকার চলে গেছে আবার ফিরে আসার জন্য।
সেই অদৃশ্য লোকের কোথাও বাস করেন পশুপতি – যিনি একাদিক্রমে জন্ম মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করেন অধিপতিদের এবং তাদের জীবন ধারণের জন্য পাঠান পশুর দল। তিনি যদি পশু প্রেরণে ব্যর্থ হন তো পিতারা অভুক্ত থাকে।
এভাবে আদিম সমাজ বুঝতে পারে যে শিকার সংসারের মধ্যে জীবন তাৎপর্য। এই বিরাট রহস্য নিয়েই গড়ে ওঠে মিথ। শিকার এবং শিকারির মধ্যে স্থাপিত এক রহস্যময় সম্পর্ক। অন্য জগতে্র বাসিন্দা হিসেবে শিকারকে ভালোবাসতে থাকে শিকারী এবং বারবার ফিরে আসার জন্য সন্মান ও খাতির করতে থাকে।
এমন এক অদ্ভুত যাদুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে, তারা উভয়েই মৃত্যু, সৎকার ও পুনরুত্থানের এক চিরায়ত অতীন্দ্রিয়, চক্রে বাধা পড়ে যায়।
সৃষ্টি হয় টোটেমের এবং বিভিন্ন ধরনের ট্যাবুর। বর্তমানে আমরা যাকে ধর্ম বলি তার প্রাথমিক প্রবণতাকে পিতৃপুরুষ গুহার দেওয়ালে চিত্রাংকনের মাধ্যমে বাচনিক সাহিত্যের রূপ দেয়।
[খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের অনুবাদে ‘মিথের শক্তি’ (ভূমিকাংশ : ছয়-সাত); প্রকাশ: অক্টোবর ১৯৯৫, ঢাকা]
ক্যাম্পবেলের এই মিথদর্শন আদিমানবের জীবনযাপন, তাদের মনোজগতের নানা বিকার ও বিচরণকে খোলাসা করে। তাতে আমরা হৃদয় ও প্রাণের স্পর্শ পেয়ে জীবনের যোগসূত্র খুঁজে পাই। এ প্রবণতা মানুষ মাত্রেরই প্রকৃতিগত।
এভাবেই আমাদের কৌতুহল জাগে, বাংলাদেশের আদিবাসী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মিথের উপস্থিতি বা আলোছায়াময় মিথিক্যাল বাস্তবতা ও বাস্তবতার মিথিক্যাল চালচলন বিষয়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ১১ টি ক্ষুদ্র, নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস, তাদের মধ্যে সেই অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ পৌরাণিক দেবদেবী বা গভীর প্রতীকের মূর্তি বা ভাবমূর্তির অস্তিত্ব তেমন না থাকলেও যোসেফ ক্যাম্পবেল কথিত মিথিক্যাল অধিবিদ্যা বা পরাবাস্তবতার ওই জগত থেকে তারা বিযুক্ত নয়।
কেননা এটা মানব মাত্রেরই নিয়তি, সে চেতন কি অচেতন, যেভাবেই হোক না কেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বপ্রাণবাদী ম্রো, খুমিদের জীব জন্তু, পশুপাখির আচার আচরণ, চালচলন, ভাব-ভঙ্গি ইত্যাদি নানা কেচ্ছা-কাহিনী, কিংবদন্তির, গল্প গাথার প্রচলন থাকলেও নিজেদের ভেতরকার উদ্যোগ আয়োজনে তার কোন প্রমাণিকতা নেই।
যার যৎসামান্য অস্তিত্ব তবু পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই ধৃত-লিখিত হয়েছে ব্রিটিশ কলোনিয়ালকালে। তার বেশির ভাগই আবার তাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা অবলোকন ও বিচার-বিশ্লেষণে সীমায়িত।
অন্য দিকে চাকমা ও মারমা সমাজ বৌদ্ধদর্শনে বিশ্বাসী ও সমর্পিত বলে গৌতমের পুরাণ পুরাণপ্রমিত তাৎপর্যপূর্ণ জাতক কাহিনী ও তার ধর্মীয় বা দার্শনিক আদেশ উপদেশ প্রশ্নাতীত অনুগত প্রকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থাপনা, মঠ, মন্দির, ক্যাঙ, গড়ে তুলে সেই সবের পরিচর্যা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করাকে জীবনের ধ্রুব সংহতি বলে মেনে নিয়েছেন।
আবার এই দুই সম্প্রদায়ের রয়েছে ভাষা পোশাক-আশাক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিতে বিস্তর ব্যবধান। ত্রিপুরা, খিয়াঙ, পাঙখো, লুসাই, বম এই পাঁচ আদিবাসী জনগোষ্ঠী খ্রিস্টধর্মে ব্যাপক হারে দীক্ষিত হওয়ার কারণে তাদের মনোজগতে সৃষ্টি হয়েছে দেশজ ও খ্রিস্টীয় জীবনবীক্ষায় সংমিশ্রিত বিবিধ জটিল পরিপ্রেক্ষা।
সর্বপ্রাণবাদী পিতৃপুরুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে উদাসীন এদের মধ্যে রয়েছে বিস্মরণের দুর্ভেদ্য কুহেলিকা। জেসাস-নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক এই অপাপবিদ্ধ মহতের প্রতি শুভ্র যাজক সম্প্রদায়ের পদ্ধতিগত অনুশীলন তাদের ভেতর ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে রোদন বোধনের একধরনের জাগতিক স্বচ্ছলতা, সেখানে ভূমিজ জীবন ও অনুষঙ্গের প্রতি মমতা কিছুটা অবান্তর বৈকি।
অন্যদিকে মারমাঘেঁষা চাক জনগোষ্ঠী ও চাকমাঘেঁষা তনচংগ্যা জনগোষ্ঠী ‘বড়’র পিরিতি বালির বাঁধ’ জেনেও ধর্মবিশ্বাসের (বৌদ্ধ ধর্মমত) সাযুজ্যের কারণে মহামুণি গৌতম ও তার চেতনার দুঃখমুক্তি ও নির্বাণের আলোয় জীবনকে পর্যবেক্ষণ করছে কেবলই অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন সোপান হিসেবে। এ যাত্রায় অতীত যার ভেতরের বিভিন্ন অলিন্দে বসত করে ঐতিহ্যের জ্ঞান ও সৌন্দর্য ধ্যান, তার কুলুজি ঠিকুজির সন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া সহজ বিষয় তো নয়।
তিন.
বস্তুত মিথের সৃষ্টিকর্তা তো মানুষই। মর্তের মানুষ তার সীমাবদ্ধ ও সীমিত জীবনধারাকে কল্পনার ঐশ্বর্য ও চেতনার সমৃদ্ধি দিয়ে যেখানে পৌঁছে দিতে চায়। সেই ভাবলোকের প্রচ্ছদ পটই মিথ।
সেখানে পাশ্চাত্যের মনীষী দেবরাজ জিউসকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অতীব ক্ষমা ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে।প্রাচ্যের হিন্দুপুরাণে দেবরাজ ইন্দ্রকেও দেখি একই অভিব্যক্তির অভিসন্দর্ভরূপে।
গ্রিক ও হিন্দুপুরাণ মনিষী চিন্তা কাঠামোর সর্বোচ্চ ইমরাত, অত্যুচ্চ মিনার। এখানে রোমক পুরাণের কথাও আসতে পারে। তবে আমার প্রায়শ মনে হয়, সামান্য ব্যতিক্রম বাদে রোমক পুরাণ গ্রিক পুরাণেরই অনুবর্তী, হিন্দু পুরাণও অনেক তাই।
গ্রিক পুরাণে যিনি ওদিসিয়ুস, রোমক পুরাণে তিনিই তো ইউলিসিস। আবার পুরাণের এমন মোহময় আধিপত্য যে, তাকে ভিত্তি করে সংবেদী শিল্পীর হাতে রচিত হতে দেখা যায় অবিস্মরণীয় সব সাহিত্যকীর্তি, চিত্রকর্ম, নাটক, গান। যেমন: হোমারের ইলিয়াড, ওডিসি, জেমস জয়েসের ইউলিসিস রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, শাপমোচন, বুদ্ধদেব বসুর তপস্বী ও তরঙ্গিনী, জন মিলটনের প্রমিথিউস আনবাউন্ড, নজরুলের পূজরিনী, রক্তাম্বরধারিণী মা, বিঞ্চুদে’র উর্বশী ও আর্টেমিস।
বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডার থেকে পুরাণকেন্দ্রীক সৃষ্টিকর্মের অসংখ্যা দৃষ্টান্ত এ প্রসঙ্গে জড়ো করা যায়। বস্তুত পুরাণ বা মিথ মানুষের প্রাণময় যে প্রয়াসসমূহকে নিত্য সজীব ও সঞ্চরণশীল রাখতে প্রয়াসী তা আপাত বিচারে বোধগোম্য না হলেও কল্পনা ও ভাবসৌন্দর্যের ভেতরে দিয়ে বাস্তববোধ ও জিজ্ঞাসাকে এমন আলোকিত ও আলোড়িত করে যে আখেরে তা জীবনকেই সর্বদিকে ছড়িয়ে দেয়। মিথের মহিমা ও গরিমা এখানেই।
চার.
বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ের পাদদেশে ম্রো (মুরুং) জনগোষ্ঠির একাংশের বসবাস। ১৯৯৫ সালে ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের জরিপ মতে বন্দরবান জেলায় ৫৯,৭৪৮ জন ম্রো সদস্য রয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ি এলাকাটি বান্দরবান সদরের অদূরবর্তী। এখানে বসবাসরত স্রো জনগোষ্ঠির সদস্য সংখ্যা ৫,২২৩ জন (ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের জরিপ, ১৯৯৫)।
অন্তমূখী ও রক্ষণশীল স্বভাবের এ জনগোষ্ঠি তাদের গোত্রীয় বিধি বিধানের প্রতি অবিচল আস্থা পোষণ করে। ম্রো জীবনধারার দীর্ঘদিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সত্যের সমর্থন মেলে। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, আলো ঝলমল পরিবেশ প্রতিবেশে ম্রোরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না।
চিম্বুক পাহাড় থেকে মাত্র কয়েক কিঃমি দূরত্বের বান্দরবান সদরে নেহাৎ বৈষয়িক প্রয়োজনের দাবি ছাড়া তাদের যাতায়াত তেমন নেই বললে চলে। এছাড়া ওই পাহাড়টিকে ঘিরে সুবিন্যস্ত সড়ক নেটওয়ার্ক।
বান্দরবান শহরে প্রবেশ এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কে উপনীত হতে চিম্বুক পাহাড় খুব পরিচ্ছন্নভাবেই নজরে আসে।
এ চিম্বুক অঞ্চলেরই একটি ম্রো অধ্যুষিত গ্রাম পোড়া পাড়া। আদিকাল থেকে সর্বপ্রাণবাদী আচার-আচরণে অভ্যস্ত ম্রোদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।
খ্রিস্টীয় মিশনারিদের অক্লান্ত প্রয়াসে এ অঞ্চলে নানা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডও চলছে। আবার ম্রোদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও কম নয়। তবে তারা প্রচলিত বৌদ্ধধর্মীয় কৃত্যসমূহ পালনে তেমন আগ্রহী নয়।
পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশশীল পারমী এসব নীতিমালা তারা জানে না। অন্যদিকে বৃক্ষপুজা, পাথর পূজা, প্রাণিহত্যা এসব আদি প্রথায় রয়েছে তাদের প্রবল আগ্রহ।
এ রকম এক অব্যবস্থিত ও আপনমুগ্ধ সমাজে ওই পোড়া পাড়ায় আবির্ভূত হন এক সাধুপু্রুষ-তার নাম মেনলে ম্রো। ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে সাধু মেনলে ম্রোদের মধ্যে তার অনুধ্যানলদ্ধ এক নতুন ধর্মমত প্রচারে ব্রতী হন ম্রো জনতার মধ্যে সংহতি ও একাত্ববোধ জাগাতে, সততা ও নিষ্ঠার চর্চায় তাদের উদ্বুদ্ধ করতে এ সাধক যে নতুন ধর্মমত প্রচলনের উদ্যোগ নেন, সেটির নাম ‘ক্রামা’।
সর্বপ্রাণবাদ, খ্রিস্টীয় অভীক্ষা, বৈষ্ণবধর্মের সারাৎসার এসবের মিশ্রণে ক্রামা ধর্মমতের নীতি আদর্শসমূহ গড়ে ওঠে। এ আসলে ভাব বা চেতনা জগতের আন্দোলন।
এ ধর্মের বাণী ম্রো জনতার ঘরে ঘরে ও হৃদয়ের নিভৃত নিলয়ে পৌঁছাতে হলে চাই ভাষামাধ্যমের সহযোগ। সমস্যা দেখা গেল এখানেই। ম্রোদের মধ্যে ভাববিনিময়ের পরস্পরাগত বাচিক ঐতিহ্য থাকলেও তার জন্যে ছিল না কোনো বর্ণরূপ।
তাই ক্রামার প্রচার-প্রসার ও তা নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালনে মেনলে উদ্ভাবন করলেন ম্রো বর্ণমালা। তা দিয়ে লিপিবদ্ধ হল ক্রামার সূক্তসমূহ। পাশাপাশি চলল ওই বর্ণমালা শেখানোর জন্যে ম্রো পল্লীতে স্কুল প্রতিষ্ঠার লড়াইও।
এভাবে পাহাড়ের কন্দরে অজ্ঞানতার গাঢ় অন্ধকারে ডোবা ম্রো সন্তানদের মধ্যে তিনি এ ধর্মের ভিত্তি রচনায় অবিরল শ্রম দিলেন। ম্রোদের অনেকে যেমন দীক্ষা নিল এ নতুন ধর্মমতে, অনেকেই তেমনি প্রথার আনুগত্যে রইল বিরোধিতায়।
তারপরও বলা যাবে, নানামত ও পথের ঝঞ্জায় দিশেহারা আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠির আত্মপরিচয় বিনির্মাণে এ হল তাদের নিজস্ব ধর্ম নির্দেশিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতায় বিদ্যমান বিচিত্র ধর্ম ও অভিভূত, ও অস্তিত্বলুপ্তির গিরিখাদে নিমজ্জমান পথ ও লক্ষ্যের দিকে চালিত হতে প্রণোদনা যোগালেন।
সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে মেনলে ম্রো পার্বত্য আদিবাসীমহলে একজন অবিস্মরণীয় সমাজ সংস্কারক। নিজ জনগোষ্ঠির চেতনাগত বিশৃঙ্খল অবস্থায় তিনি এনে দিলেন সংহতির আলোকবর্তিকা।
জীবনকে দিলেন নতুন আকার ও আকৃতির মুখমন্ডল। পশ্চাৎপদ ম্রো সমাজে ক্রামাধর্মের অভিষেক ঘটিয়ে তিনি ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহত্তের স্পন্দন হয়ে উঠলেন। দীন ই-ইলাহির মহামতি আকবর বাদশা কিংবা ব্রাহ্মধর্মের পুরোধা রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে মেনলে ম্রো কাতারবন্দি হতে পারেন তাই অনায়াসেই।
মেনলে অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে বিদ্ধান ও ধনবান কোনটাই ছিলেন না। ছিলেন সহজাত প্রতিভাসম্পন্ন প্রকৃতির নিবিড় সন্তান। ওই সহজাত প্রজ্ঞা দিয়ে আজন্ম মুক্ত প্রকৃতির অভিসারী মানুষগুলোকে সংঘবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিকতায় ফিরিয়ে আনার মেনলে সূচিত কাজটি সুকঠিন। আর কঠিন বলেই এ সত্য।
সত্যের এ সঠিক অনুধাবনার জন্যেই ক্রামার অনুসারীরা মেনলেকে মহাজ্ঞানীর মর্যাদায় স্মরণ করে। তার কীর্তিময় সত্তার প্রতি অর্ঘ দেয় হৃদয়ের সুরভিত ফুল।
পাঁচ.
গ্রিক পুরাণে একটি গল্প আছে এমন, পৃথিবীর মানুষকে চির অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতে দেখে স্বর্গবাসী দেবতা প্রমিথিউসের মনে ভাবনার উদ্রেক হল। তিনি চাইলেন দেবতাদের একচ্ছত্র দখলিস্বত্ব থেকে কিছু্টা আলো মর্তের মানবের কাছে পৌছাবেন।
কিন্তু কী করে তা সম্ভব? দেবরাজ জিউসের কড়া নজরদারি থেকে স্বর্গের আলো পৃথিবীতে নিয়ে যাওয়া সাংঘাতিক ঝুকির ব্যাপার বৈকি। প্রমিথিউস জিউসের অজান্তে তার ভোরবেলাকার আলোর নথের নিচে খড়ের গাদা বিছিয়ে রাখলেন।
রথচালনার স্ফুলিঙ্গ থেকে তাতে আগুন লাগলে সেই অগ্নিমশাল পৃথিবীর মানুষের হাতে পৌঁছালেন প্রমিথিউস। এ আলোতে পৃথিবীবাসীরা জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন এলেও প্রমিথিউসের ললাটে জুটল চরমতম দন্ড।
এ অপরাধে তিনি হলেন দেবলোক থেকে বিতাড়িত। অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায় হলেন বন্দী। জিউস শাস্তি দিলেন প্রমিথিউসের হৃৎপিন্ড খুবলে খাবে ভয়ালদর্শন দুই ঈগল দিনভর। সন্ধ্যায় সেই হৃৎপিন্ড যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত হবে।
পরদিন আবার ও তার কলজে খুবলে খাবে ওই পাতকী ঈগল জোড়া। এই বিস্তীর্ণ বেদনার ভার বহনকারী তারপরও আলোর দেবতা, মুক্তির অগ্রদূত। যদিও মিথীয় চরিত্র, এমন কি প্রমিথিউস মানুষ না হওয়া সত্ত্বেও।
ম্রো সমাজে মেনলে ম্রোও ওই প্রমিথিউস। পিছিয়ে থাকা মানুষের চেতনাগত অন্ধকার তাড়াতে ক্রামা ধর্মমত ও ম্রো বর্ণমালার উদ্ভাবনে তিনি প্রমিথিউসতুল্য বিপ্লবী।
দেবতা প্রমিথিউসের মতো মেনলেও নির্বাসিত হলেন, তবে নিরবে, নিভৃতে। আপন দণ্ডে। ক্রামা ধর্মমত প্রচার ও ম্রো বর্ণমালা উদ্ভাবনের পর এ দুয়ের জনগাহ্যতা সৃষ্টির প্রয়াসে তিনি যখন পাহাড়ের পল্লি থেকে পল্লি চষে ফিরছেন, সে রকম এক সময়ে তার অন্তর্ধানের খবর ছড়িয়ে পড়ে পাহাড় জুড়ে।
ম্রো আদিবাসী সমাজ বিশ্বাস করে, মেনলে ফিরে আসবেন আরও গভীর ও কার্যকর ক্রামাধর্মীয় সূক্তের সম্ভার নিয়ে….।
এভাবেই নিস্নবর্গীয় অবহেলিত সমাজে একজন মেনলে ম্রোর মধ্যে জেগে থাকে পার্বত্য পুরাণের স্বপ্নবীজ…..।
হাফিজ রশীদ খান, কবি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক; আলাম – ২০১২ইং, (বনযোগীছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতি, বনযোগীছড়া, জুরোছড়ি, রাঙামাত্যা)
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।