মোনঘর, ৭০ দশক এবং জুম পাহাড়ের রেনেসাঁ
2129
থেং-থেং, থেং-থেং, থেং-থেং
থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং, থেং…
থেএং, থেএএংং, থেএএএংং।
আবহমানকালের জুমপাহাড়ে তখন সবে ভোরের আলোক ফুটতে থাকে। আশা জাগানিয়া ভোরকে সাক্ষী রেখে রাঙামাটি শহরের পশ্চিম উপকন্ঠের এক কোণায় বহুবছর যাবৎ প্রতিদিন ঠিক এভাবেই রুটিন করে একটি ঘন্টা বেজে ওঠে।
ঘন্টা’র উপর যখন শেষ বাড়িটি পড়ে “থেএএএএএংং”, সেই শেষ ধ্বনিটি মিলিয়ে যেতে না যেতেই বিশাখা ভবন, প্রজ্ঞা ভবন, সিদ্ধার্থ ভবন, জ্ঞানশ্রী ভবন, মৈত্রী ভবন, করুণা ভবন, আলোক ভবন, দীপ্তি ভবন, কৃঞ্চকিশোর ভবন, শান্তি ভবন থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সংহতি আশ্রিত কন্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হতে থাকে –
“বুদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি
ধম্মং স্মরণং গচ্ছামি
সংঘং স্মরণং গচ্ছামি”
এরপরে তারা মনযোগ মাখানো কথামালায়, নিবিড় স্বতন্ত্র ধ্বনি এবং প্রবল আবেগের সুর মিশ্রিত শিহরণে গেয়ে চলে –
“আমা জাগা আমা ঘর
আমা বেগ’ মোনঘর
সুঘে-দুঘে ইধু থেই
বেক্কুন আমি ভেই ভেই”
বলছিলাম হিল চাদিগাঙ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোনঘরের কথা। উপরের কলিগুলো মোনঘরের প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত যার বাংলা অর্থ –
“আমাদের জায়গা, আমাদের ঘর
আমাদের সবারই মোনঘর
সুখে-দুখে থাকি যেথায়
মোরা সবাই ভাই ভাই”
বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও কবি সুগত চাকমা (ননাধন) রচিত ও বাবু ফনীন্দ্রলাল ত্রিপুরা সুরারোপিত এই গানটি প্রতিদিন ভোরে মোনঘর পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীরা প্রাতঃসংগীত হিসেবে গায় এবং এর মাধ্যমেই ভোরের আলো ফুটার সাথে সাথে কর্মচঞ্চল হয়ে পড়ে পাহাড়ের কোলে নিবিড় আলোছায়ায় ঘেরা “মোনঘর শিশু সদন” ক্যাম্পাস।
“মোনঘর” কেবল একটি শিশু সদন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, একটি চেতনার নামও বটে, আমিও সেই চেতনার এক গর্বিত গ্রাহক ও অংশীদার। প্রিয় মোনঘর, সশ্রদ্ধ প্রণতি!
চাঙমা “মোন” এর বাংলা অর্থ পাহাড়। সাধারণভাবে মোন-এর উপর ঘর বা পাহাড়ের উপর ঘর-ই হচ্ছে “মোনঘর”।
পাহাড়ের বহুল পরিচিত ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ কেন “মোনঘর” হলো তার পিছনে নিশ্চয়ই একটা যথার্থ ভাবনা বা ব্যাখ্যা নিহিত রয়েছে।
প্রসঙ্গত ফিরে যেতে হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক ইতিহাস-এর নিকট।
চেঙে, মেইনী, হাজলং, বরগাঙ (কর্ণফুলী), সাংগু, মাতামুহুরী, রেইংখ্যং, গোমতি, থেগা, সত্তা, শলক, সাজেক, মাজলঙ, সিজক প্রভৃতি ছোটবড় ছড়া/নদী বিধৌত পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলার সমন্বয়ে এক অখন্ড ও অবিচ্ছিন্ন ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সমষ্টি।
এতদঅঞ্চলের ভৌগলিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ও আবহমানকালের সামাজিক বিবর্তনের প্রেক্ষাপট এবং বিকাশের গতি ও ইতিহাস বাংলাদেশের মূল ভূ-খন্ডের সামগ্রিক বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাস, গতি এবং বৈশিষ্ঠ্য থেকে বহুদিক দিয়েই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র।
ঐতিহাসিককাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে পাংখো, খুমী, লুসাই, মুরং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খেয়াং, চাক, ত্রিপুরা, চাকমা প্রভৃতি ছোট ছোট আদিবাসী জাতিসমূহ যাদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা-ধর্ম, সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি।
বৈচিত্রময় ভাষা-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এসব ছোট ছোট জাতিসমূহের মধ্যে বলিষ্ঠ সামাজিক মূল্যবোধ এবং প্রথাভিত্তিক নিজস্ব আইন-কানুনও প্রচলিত রয়েছে।
বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রত্যেক জাতির নিজস্বতা ও বৈচিত্র্য থাকলেও ছোট ছোট এই জাতিসমূহের মধ্যে একটা সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে জুমচাষ। “জুম” এবং “জুমচাষ”-কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এসব জাতিসমূহের জীবন-জীবিকা, প্রথা-বিশ্বাস, রীতি-নীতি, কৃষ্টি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ।
সামাজিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং প্রচলিত আইন-কানুন সবকিছুর মূলেও নিহিত রয়েছে জুম ও জুমচাষ ভিত্তিক জীবন-প্রণালী এবং সমাজ-সাংস্কৃতিক কাঠামো।
পাহাড়ের উপর জুমচাষের মাধ্যমেই এসব জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে হিল চাদিগাঙ বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বাধ্য সন্তান হয়ে প্রকৃতির সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিককাল থেকেই ছোট ছোট এই ১১টি জাতির আবাসস্থল।
এছাড়াও বর্তমানে কিছু অহমিয়া বা আসাম, গুর্খা এবং সাঁওতাল বসতি-র সন্ধানও পাওয়া যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে। তাদেরকে হিসেবে ধরলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪টি আদিবাসী জাতির বসবাস রয়েছে।
যাই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করা ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী এই ছোট ছোট আদিবাসী জাতিগুলো পাহাড়ের উপর জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। জুমচাষ করতে হয় পাহাড়ে।
জুমচাষীরা পাহাড়ে যে জুম করে সেই জুমকে দেখাশোনা করা, ফসল এর মৌসুমে ফসল সংগ্রহ প্রভৃতির জন্য অস্থায়ী একটি ঘর তৈরী করা হয়। এটাই হচ্ছে মোনঘর।
এখানে বলাবাহুল্য যে স্থায়ী বসতির জন্য “জুমঘর” বা “মোনঘর” নির্মাণ করা হয় না, কেননা জুম এর ফসল তোলার কাজ শেষ হয়ে এলেই জুমচাষী “জুমঘর” বা “মোনঘর” থেকে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। জুম করা হয় গ্রামের কিছুটা দূরে।
উর্বর ভূমি চিহ্নিত করে ঘন বাঁশঝার বা নিবিড় বনজঙ্গল সাফ করে গ্রামের অদূরে জুম চাষ করা হয়। চৈত্র মাসের (ইংরেজী এপ্রিল) শুরু বা মাঝামাঝিতে জুম চাষের জায়গা নির্বাচন করে তা পরিষ্কার করা হয়। কেটে ফেলা বনজঙ্গল চৈত্র মাসের শেষদিকে আগুনে পোড়ানো হয়।
বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসের দিকে জুমভূমি ফসল বুনার জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠে। এসময় জুমে ফসল বুনা হয়। আষাড়-শ্রাবণে জুমে নিড়ানি দিতে হয়, এসময় জুমে নতুন ফসলকড়ি আসতে থাকে। শতাব্দীর চিরহরিতে যেন মুড়িয়ে যায় প্রিয় জুমভূমি।
ভাদ্র-আশ্বিন মাস জুম থেকে ফসল তোলার মৌসুম। পাকা ধানের সোনালী আভায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে প্রিয় জুমপাহাড়।
দখিনা মৃদু হাওয়ায় দুলতে থাকে নানান শস্য। হরেক রকম শস্যে ভরে থাকা জুমে তখন জুমচাষীরা মনের সুখে প্রকৃতির সাথে কথোপকথন জমিয়ে দেয়।
ঐতিহ্যবাহী নানান গানের সুর ধরে জুম্ম রমণিরা। সব কষ্ট ভুলে ফসলের আগমনে মন জুড়িয়ে যায় জুমচাষীর।
পাহাড়ে পাহাড়ে তখন ধ্বনিত হতে থাকে হেঙগরঙ, ধুধুক, শিঙে বা পুলুঙ এর সুর ও তাল। জুমচাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জুমে সাময়িক বা অস্থায়ীভাবে নির্মিত জুমঘরকেই চাঙমা ভাষায় মোনঘর বলা হয়ে থাকে।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৮ শতকে ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসক ছিলেন, তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন – পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট ছোট জাতিসমূহের মধ্যে সংখ্যার বিচারে অধিক চাঙমারা বসবাস করে পাহাড়ের পাদদেশে ছড়ার ধারে।
ঠিক সেভাবেই মারমা, তঞ্চঙ্গাদের গ্রামগুলোও গড়ে উঠে নদী বা ছড়াকেন্দ্রিক। তাই গ্রাম থেকে জুম কখনো কখনো অনেক দূরে হয়। সবকিছুর সুবিধার্থে ফসল আহরণ পর্যন্ত জুমে একটা অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে সেখানে কিছুদিনের জন্য বসবাসও করতে হয় কখনো কখনো।
এটাই চাঙমা ভাষায় মোনঘর বা জুমঘর। লুসাই, খেয়াং, খুমী, ম্রো, বম প্রভৃতি জাতিসমূহ তুলনামূক উঁচু পাহাড়ে গ্রাম গড়ে তুলে। ম্রো’রা সবথেকে উঁচু পাহাড়গুলোতেই সাধারণত বসবাস করে। কিন্তু তারাও গ্রাম থেকে অদূরেই জুম তৈরী করে।
তাই জুমঘর বা মোনঘর এর “কনসেপ্ট” বা ধারণাটা সবার ক্ষেত্রেই মূলত একই। ত্রিপুরারা জুমকে বলে হোওক এবং জুমঘরকে বলে গাইরিঙ। মারমারা জুমকে বলে ওয়া। ম্রো’রা জুমকে বলে উহয়া।
এভাবেই প্রত্যেকটি জাতি জুম এবং জুমঘরকে আলাদা আলাদা নামে ডাকলেও জুম এবং জুমঘরের সাথে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন এর স্বরুপ প্রত্যেকটা জাতির ক্ষেত্রেই এক এবং অভিন্ন।
বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই জুম এবং জুমঘরের সাথে জুম্মদের জনজীবন নিবিড় যোগাযোগ ও বন্ধনে জড়িয়ে থাকে।
কাঠামো এবং চেতনা উভয়দিক থেকেই পার্বত্য অঞ্চলের বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মোনঘর” এর নামকরণও ঠিক এরকম ধারণা থেকেই।
জুমে যেভাবে একসাথে হরেক রকমের ফসল চাষ করা হয়, সেভাবেই মোনঘর শিশু সদন-এ পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা ভাষাভাষী শিশুরা বড় হয়ে ওঠে একে অপরের সাথে নিবিড় আত্মীয়তার সম্পর্কে।
সেখানে প্রয়োজনীয় পড়াশুনার পাশাপাশি তারা খুঁজে পায় ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন এবং সমাজ ও জাতীয় জীবনে বিকশিত হওয়ার শিক্ষা।
এখানে বম, খুমী, মুরং বা ম্রো শিশুর সাথে পাশপাশি বেড়ে ওঠে ত্রিপুরা, চাকমা বা মারমা শিশু। খেয়াং মেয়ের সাথে খেলা করে পাংখোয়া মেয়ে। চাক ছেলের সাথে ভাব জমায় লুসাই ছেলে।
কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, এই প্রতিষ্ঠান কচি কচি জুম্ম শিক্ষার্থীদের মৌলিক মূল্যবোধ গঠন এবং মনন গড়ে তুলতেও প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়। মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হওয়ার অণুপ্রেরণা যোগায়।
জীবনাচারে শৃঙ্খলা, ন্যায়, ঐক্য ও সংহতি কেন প্রয়োজন সেই বোধ জাগিয়ে তুলে মোনঘর। মোনঘর স্বপ্ন বুনে এবং চেতনার রঙ ছড়িয়ে দেয় এক পাহাড় থেকে আরেক পাহড়ে, এক জুম থেকে আরেক জুম এ, সমগ্র হিল চাদিগাঙ জুড়ে। মোনঘর এর এ পথচলা অবিরাম গতিশীল থাকুক।
মোনঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলাধীন “পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম” এর প্রতিষ্ঠাতা সদ্ধর্মাদিত্য শ্রীমৎ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর তিন গুণধর শিষ্য তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা, ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের তিন আলোকবর্তিকা শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাথের,
শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং শ্রীমৎ শ্রদ্ধালংকার মহাথের অসীম ধৈর্য ও কঠোর পরিশ্রমে তিলে তিলে পাহাড়ে শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বাতিঘর এই প্রতিষ্ঠানটিকে গড়ে তুলেন।
প্রসঙ্গত, এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পাহাড়ের এই তিনজন শিক্ষাদূত একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজহিতোষী ও সমাজসংস্কারক এবং ধর্মীয় গুরু। তিনজনেই সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন পার্বত্য ভিক্ষু সমাজকে।
১৯৫৮ সালে রাজগুরু প্রয়াত অগ্রবংশ মহাথেরর হাতে প্রতিষ্ঠিত “পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ” পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিক্ষু সমাজকে সংগঠিত করে সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছিলো।
শ্রীমৎ বিমলতিষ্য মহাথের, প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং শ্রদ্ধালংকার মহাথের মহোদয় বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘকে নানাভাবে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
দেশ-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ এবং অবহেলিত, বঞ্চিত আদিবাসী মানুষের কথা তুলে ধরতেও এই তিনজন মানবহিতৈষীর আত্মত্যাগ পাহাড়ের আপামর জনমানুষের হৃদয়ে নিশ্চয়ই চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
ঢাকা’র বনফুল শিশু সদন, ভারতের কলকাতার বোধিচারিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন যথাক্রমে প্রজ্ঞানন্দ মহাথের এবং বিমলতিষ্য মহাথের।
শ্রদ্ধালংকার মহাথের রাঙ্গামাটির ভেদভেদীতে গড়ে তুলেছেন সংঘারাম বৌদ্ধ বিহার। তিনি একাধারে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা বিশারদও বটে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একসময় ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিলো। সেসময় ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি-১৯০০ প্রণয়ন করে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত এলাকা (Excluded Area) হিসেবে মর্যাদা দেয়।
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা চলে যায় এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের সাথে অর্ন্তভূক্ত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সেসময়কার সামন্তীয় নেতৃত্ব পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী সঠিক ভূমিকা রাখতে না পারায় ছোট ছোট আদিবাসী জাতিসমূহের ভবিষ্যত বিকাশের পথ অনেকটা সংকটের মুখে পড়ে যায়।
অস্তিত্বের সংকটে নিমজ্জিত জুম্ম জনগণকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় সেসময় স্নেহকুমার চাকমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুবকরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে এবং অমুসিলম অধুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সাথে সংযুক্তির দাবী জানায়।
তারা রাঙ্গামাটি শহরে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে দিয়ে ভারতীয় পতাকাও উত্তোলন করে। অবশ্য এসকল প্রচেষ্টা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ তখন অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং অন্ধকারে নিমজ্জিত পিছিয়ে পড়া ঘুমন্ত অসহায় সমাজে বসবাস করছে।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগামের প্রধান নদী বরগাঙ বা কর্ণফুলীর মোহনায় স্থাপন করে কাপ্তাই বাঁধ। এতে চাকমা রাজবাড়ীসহ পুরাতন রাঙ্গামাটি শহর এবং হাজার হাজার গেরস্তের ঘরবাড়ি-খেত-ভিটেমাটি ডুবে যায় অথৈই পানিতে।
হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা এবং অরুনাচল প্রদেশে। ধ্বংস হয়ে যায় সমৃদ্ধ একটি জনপদ।
বদলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পূর্ণ ভূ-প্রকৃতি এবং জনমিতি। পুরনো রাঙ্গামাটি শহরকে মনে করে চাকমা রাজপরিবারের সদস্য এবং রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন প্রভাষক কুমার সমিত রায় আক্ষেপের আবহে লিখেছেন –
হেল্লে আধিক্যে স্ববনে দেকখোং
পুরোন রাঙামাত্যে
তুত্তে বোইয়ের বার, শিমেই তুলো উড়ি যার
স্ববনে দেকখোং বরগাঙর পার।
(গতকাল হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম পুরাতন রাঙামাটি
প্রবল এলোবাতাসে শিমুলতুলা উড়ে যায়, স্বপ্নে দেখলাম বরগাঙ এর পার)
এরপরের কলি –
ভাজি উট্টে ভুইয়ানি, ভাজি উট্টে ঘরান মর
চিগোন কালর সমাজ্জেগুন বালুচরত খারা অদন
(ভেসে উঠেছে ধানখেতগুলো, ভেসে উঠেছে ঘরটি আমার
বালুর চরে খেলা করে ছোট্টবেলার সাথীরা আমার)।
পার্বত্য চট্টগ্রামের গণমানুষের জন্য মরণফাঁদ সর্বগ্রাসী কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে সেসময় জনমত গড়ে তুলে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ১৯৭২ সাল, সবে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের সময় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানে জুম্ম জনগণের বেঁচে থাকার জন্য সাংবিধানিক অধিকার চাইলেন। লারমার দাবীকে প্রত্যাখ্যান করা হলো।
জুম্ম জনগণের ভবিষ্যত আরেকবারের জন্য অনিশ্চয়তা ও সংকটের দিকে ধাবিত হলো। এমন বাস্তবতায়, ১৯৭২ সালে এম এন লারমা, বীরেন্দ্রকিশোর রোয়াজা, জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) প্রমুখ এর নেতৃত্বে গড়ে উঠে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
সমিতির নেতারা নেমে পড়লেন জাতীয় সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজে। গ্রামে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো। সামন্তীয় বেড়াজালে অথর্ব হয়ে পড়ে থাকা জুম্ম জনসমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম চষে বেড়ালেন জনসংহতি সমিতির নেতারা।
সমগ্র জুম্ম সমাজে সংগ্রামী এক নতুন দিনের আশা। দিকে দিকে আন্দোলনের কথা ছড়াতে লাগলো।
এভাবেই আমরা দেখি ৭০ দশকে জুম্ম জাতীয় জীবনে সবদিক থেকেই এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। ৭০ দশককে বলা হয়ে থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রেঁনেসার যুগ।
এ সময়েই সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারাটা ভিত্তি পেয়েছে এবং সঠিক প্রবাহে গতিশীল থেকে বেগবান হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের আগ্রাসনে হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জুম্ম সমাজের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হয়েছিল।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সেসময়কার তরুণ ছাত্রসমাজ সমাজ পরিবর্তনে কান্ডারীর ভূমিকা নিতে পেরেছিলো। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। প্রায় সমসাময়িক ভাবে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা পায় মোনঘর শিশু সদন।
পরবর্তীতে মোনঘর প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে থাকা একঝাঁক সৃষ্টিশীল জুম্ম তরুণ গড়ে তোলেন জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত জুম ঈসথেটিক কাউন্সিল বা জাক পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে অপরিসীম ভূমিকা রাখে।
রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ, শিক্ষার প্রসার সবদিকেই একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন দেখা যায় এই দশকে। এই জাগরণটা বেশ কিছুকাল ধারাবাহিক থেকেছে এবং তা সম্ভব হয়েছে অতিঅবশ্যইভাবে জুম্ম তরুণ সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে।
কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, কী সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, কী শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে সব জায়গাতেই জুম্ম তরুণদের স্বতস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণই ছিল এসময়কার সমাজ-রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।
বলাই বাহুল্য যে, লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মাধ্যমে শুরু হওয়া রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের সমান্তরালে ৭০ দশকে “মোনঘর” এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো শিক্ষা-সাহিত্য-সমাজ-সাংস্কৃতিক রেঁনেসার ভিত্তিভূমি হিসেবে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে, দীঘিনালায় বোয়ালখালী পার্বত্য চট্টল অনাথ আশ্রমে থাকাকালীন সময়ে মোনঘর এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন শ্রী সন্তু লারমা।
এম এন লারমা এবং সন্তু লারমা উভয়েই বেশ কিছুকাল দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। এক অর্থে বলা চলে মোনঘরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল জুম ইসথেটিক কাউন্সিল বা জাক। জাক এর প্রথম নাম ছিলো রাঙ্গামাটি ঈসথেটিক কাউন্সিল।
জাক প্রতিষ্ঠার মূলে যারা ভূমিকার রেখেছিলেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং এখনো অনেকে আছেন। মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে।
“বার্গী” কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কবি সুহৃদ চাকমাকে আধুনিক চাকমা কবিতার জনক বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের অন্যতম স্তম্ব। চাকমা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় তিনি নতুন অনেক কিছুই যোগ করেছেন।
ভাষা নির্মাণ, বিষয়বস্তু, শব্দশৈলীতে নতুনত্ব এনে চাকমা কবিতা রচনাক্ষেত্রে তিনি নিয়ে এসেছিলেন নতুন গতি ও স্টাইল। পার্বত্য চট্টগ্রামের গানের জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান, আধুনিক চাকমা সাহিত্যের অন্যতম পথিক কবি সুহৃদ চাকমা,
“গাঙ’-র নাঙ লোগাঙ” কবিতার রচয়িতা কবি মৃত্তিকা চাকমা, “হিল চাদিগাঙর পজ্জন” শোনানো সংস্কৃতিকর্মী ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, “তে এব” কাব্যগন্থের রচয়িতা কবি শিশির চাকমা এরা সবাই মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন এবং এখনো অনেকে আছেন।
একদিকে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম অন্যদিকে মোনঘর, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বা পরবর্তীতে জুম ইসথেটিক কাউন্সিল এর মাধ্যমে ধর্ম-শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা প্রায় সমান্তরালেই প্রবাহিত হতে পেরেছিলো বলেই ৭০ আর ৮০-র দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সবদিক থেকেই একটা জাতীয় জাগরণের বীজ রোপিত হতে পেরেছিল।
যাই হোক, যেমনটা বলছিলাম – মোনঘর কেবল একটা শিশু সদন নয়, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। মোনঘর একটি চেতনার নাম, জুম্ম জাতীয় জীবনের চেতনার বাতিঘর। পার্বত্য চট্টগ্রামের এমন কোন উপজেলা নেই যেখান থেকে এই প্রতিষ্ঠানে গরীব-ছিন্নমূল ও অসহায় জুম্ম ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে না।
নাইংক্ষ্যংছড়ির চাকপাড়ার চাক শিশু, থানছি-র ম্রো পাড়ার ম্রো শিশু, রুমার কোন জুমিয়া বম পরিবারের সন্তান, রোয়াংছড়ির মারমা মেয়ে, বিলাইছড়ির পাংখোপাড়ার পাংখো ছেলে, চন্দ্রঘোনার খেয়াং ছেলে কিংবা থেগা-সত্তা পারের চাঙমা জুমিয়া ঘরের সন্তান অথবা
মহালছড়ির ‘রুক্কেং’ বা দীঘিনালার ‘ফাগন্দি ভুই’ চাষী ঘরের অনাথ ছেলে, সকল ছিন্নমূল- গরীব ও অসহায় জুম্ম শিশুদের জন্য যেন নিরাপদ এক আশ্রয়স্থল এই মোনঘর।
মোনঘর প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত নির্মাণটা নাকি গড়া হয়েছিলো কলকাতার রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের আদলে। সত্যিই, ফুরমোনের পূর্ব পাদদেশ হয়ে নেমে আসলে রাঙামাটি শহরের এককোণায় ছায়া নিরিবিলি পরিপাটি সুন্দর একটি গ্রাম রাঙাপান্যের বুক জুড়ে প্রতিষ্ঠিত মোনঘর ক্যাম্পাসটি যেন প্রকৃত অর্থেই এক শান্তির আবাসস্থল।
পুরো মোনঘর ক্যাম্পাসটি ঘিরে রেখেছে নানা প্রজাতির বৃক্ষের সমারোহ। কৃঞ্চচুড়া, বড় বড় কাঠাল, আম, নিম, কড়ই, মেহগনি, বহেরা, চামার, হরিতকি প্রভৃতি বৃক্ষে ছেয়ে যাওয়া মোনঘর শিশু সদন ক্যাম্পাসটিতে বিদ্যালয়ভবন, খেলার মাঠ, বড় একটি পুকুর ছাড়াও রয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবসিক ভবনসমূহ।
জ্ঞানশ্রী, প্রজ্ঞা, দীপ্তি, মৈত্রী, করুনা প্রভৃতি ভবনগুলোর নাম দেখলেই বোঝা যায় পরম করুণাময় বুদ্ধের মৈত্রীময় দর্শনও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম একটি দর্শন।
মোনঘরে আমি পড়াশুনা করেছিলাম ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। আমি আবাসিক এবং অনাবাসিক উভয়ভাবেই মোনঘর এর শিক্ষার্থী ছিলাম। কিছুদিনের জন্য ছিলাম সেসময়কার মোনঘরের শাখা স্কুল বলে পরিচিত ঢাকাস্থ বনফুল শিশু সদনেও।
মোনঘর নিয়ে এবং মোনঘরকে ঘিরে ভালো মন্দ হাজারো স্মৃতি আমার মানসপটে এখনো নিত্য খেলা করে বেড়ায়।
আমার সমগ্র জীবনবোধে মোনঘরে পড়াকালীন ভালো-মন্দের মিশেলে গড়া অভিজ্ঞতাগুলোই সঞ্চিত পুঁজি যা বিনিয়োগ করে আমি কর্ষণ করে যেতে চাই আমার নিজের জুম।
মোনঘরে পড়ার সময় আমি বিশাল “ঢেঙ” ছিলাম। আমার সমসাময়িক মোনঘর সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই এরকমটাই জানা। তারপরেও প্রতিটা শিক্ষক-শিক্ষিকা যেন অসীম মমতায় আমাকে আগলে ধরে রাখতে চাইতেন।
প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথেই আমার কমবেশি ব্যক্তিগত নৈকট্য বা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো, যদিও আমি স্বভাবসুলভ ভালো বা মেধাবী ছাত্রদের মতোন শৃঙ্খলাপরায়ন বা নিয়মিত ছাত্র ছিলাম না বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অত্যধিক ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম না।
তারপরেও কেন যেন মোনঘরের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে স্নেহ করতেন, আমার যত্ন নিতেন।
সেই ছোটবেলা থেকেই আমায় স্নেহ করতেন প্রয়াত কবি সুহৃদ চাকমার সহধর্মীনি অর্চনা দিদিমনি। প্রচন্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী এই শিক্ষিকার স্নেহ আমার স্কুলজীবনের এক বড় প্রাপ্তি।
পাহাড়ের জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী রণজিৎ দেওয়ান স্কুরবেলাই কেবল নয়, এখনো পর্যন্ত আমার অন্যতম বড় মেন্টর। ক্লাশ নাইন এ উঠার পরে বিজ্ঞান, কলা এবং ব্যবসায় শিক্ষা যেকোন একটি বিভাগ পছন্দ করতে হয়।
আমি নাইনে উঠলে বেছে নিয়েছিলাম কলা বিভাগ, কেননা আমি গৈরিকা দিদিমনির কাছে ইতিহাস শিখতে চেয়েছিলাম। দীপ্তা দিদিমনি পড়াতেন ভূগোল। বিএসসি স্যার বা অমল তালুকদার স্যারকে মোনঘরের ছাত্ররা খুবই ভয় পেতেন।
একবার তিনি হঠাৎ আমাকে বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব কক্ষে ডেকে পাঠালেন। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। যেয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার আসতে পারি? চেয়ারে বসিয়ে আমার জীবন গঠনের জন্য যেসব উপদেশ এবং নির্দেশনা দিলেন কোনদিন ভুলব না। মৃত্তিকা স্যার পড়াতেন বাংলা।
একবার ক্লাশ শেষে তিনি যখন ক্লাশ থেকে বেরিয়ে যাবেন সেসময় পথ আগলে বললাম, “স্যার, রোমান্টিক হয়ে গেছি ইদানিং, কবিতা লিখতে ভালো লাগে, একটু পড়ে দেখে রিভিউ জানাবেন”! ক্লাশ এইটে বৃত্তি পরীক্ষার বিশেষ প্রস্তুতি কোচিং করাতেন ঝিমিত ঝিমিত স্যার।
আমি কোচিং ক্লাশে নিয়মিত অনুপস্থিত। কোথায় যায়, কী করি কেউ বলতে পারে না! আমার উপর বিরক্ত প্রায় প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা এমনকি ভবন হোস্টেল সুপার ভিক্ষুরাও।
আসলে বিষয়টা হয়েছে কী, মোনঘর ডাইনিং হলের বাবুর্চিদের সাথে আমার কীভাবে কীভাবে যেন ভাব জমে যায়, আর আমি বাবুর্চিদের সাথে “ধুন্দো আমুলি” হয়ে উঠি। অ
র্থাৎ “ডাবা” বা হুক্কায় অভ্যেস আমার সেই ক্লাশ এইটে! তাই ধুন্দো (হুক্কা) খাওয়ার লোভে স্কুল ক্যাম্পাস থেকে অদূরে বাবুর্চিদের আবাসস্থল গ্রামের দিকে চলে যেতাম একা একা, অবশ্য আমার সঙ্গে থাকতো সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু বা শরৎচন্দ্রের উপন্যাস।
তাছাড়া বৃত্তি কোচিং করতো কেবল নির্বাচিত মেধাবী শিক্ষার্থীরা। অথচ আমি ঘুরতে ভালোবাসতাম ক্লাশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে। কিন্তু তারা তো আর কোচিং করে না।
ক্লাশের ঢেঙমার্কা ছেলেপিলেরা আমি ছাড়া যে অচল! তাদের সাথে নিয়ে প্রায়শই, কোন আইডিয়া নিয়ে হানা দিতাম পার্শ্ববর্তী কারো বাগানে। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, এ বাগান থেকে ও বাগান। এমনটাই ছিলো আমার মোনঘর জীবন!
একবার ঝিমিত স্যার একান্তে অফিসকক্ষে ডেকে পাঠালেন, বললেন “দেখ পুত্র, বিধায়ক এর নাম শুনেছো? ক্লাশে তুমি কি অমনোযোগী, তোমার চেয়ে ঢের পাজি ছিলো এই বিধায়ক! সবাই যখন ক্লাশে, সে তখন থাকতো গাছের মাথায় বাঁশি হাতে।
এখন সে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিদেশে পড়তে গেছে। দেশ-জাতির কাজ করতেছে। তুমিও চাইলেই নিজের জন্য সবার জন্য অনেক ভালো কিছু করতে পারবে। ভালোভাবে আগে পড়াশোনাটা শেষ করে নাও।”
তিনি আরো বললেন, “কীর্তি নিশানের নাম শুনেছো? সে এখন ইউএনডিপির হেড হয়ে কীভাবে মানুষের উপকার করছে দেখ, মোনঘরের সন্তান হিসেবে তোমাদের উপরও একসময় দ্বায়িত্ব বর্তাবে সমাজের কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখার।”
খোকন বিকাশ বড়ুয়া স্যার, অরুপণ স্যার, জটিল স্যার, সুদর্শী স্যার কারো কথায় তো ভুলে যাওয়ার নয়। সেকেন্ড স্যার বা নীহার কান্তি স্যার এর কথা মনে আছে হালকা। ইংরেজী গ্রামার পড়াতেন। একবার একটা ভুল ধরলেন।
কোন একটা বিষয়ে “Here in” লিখেছিলাম, বললেন “চেষ্টা গুরিলে ইংরেজীতে অনেক ভালো গুরি পারিবে য়ে, হালিক মনে রাকিতে হইবে যে Here এর সাথে কখনো in হইবে না য়ে। আরেকবার পুড়ি ফেলাইলে নম্বর কাটি দিবো য়ে”।
লতিকা দিদিমণির কথা বিশেষ মনে করতে হয়। আমরা যখন ক্লাশ নাইনে সেবছর তিনি বিদায় নিবেন। তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব নিলাম আমাদের ব্যাচ। পুরো অনুষ্ঠানের দ্বায়িত্ব আমাদের। বলা যায় আমার জীবনের প্রথম কোন আনুষ্ঠানিক “সাংগঠনিকতা”।
সেসময় আমি আবার ছিলাম রাঙ্গাপানি মিলন বিহারে শ্রামণ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দ্বায়িত্বও ছিলো আমার। বিদায় সম্ভাষণ পত্রটাও আমিই লিখেছিলাম।
আমার বন্ধু অনুত্তম যখন বিদায় সম্ভাষণ পত্রটি পড়ছিলেন, তখন লতিকা দিদিমনির চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝড়ছিলো, আর আমি মনে মনে পুলকিত বোধ করছিলাম, যাহ শালা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর লিখেছি!
মোনঘর এর বার্ষিক প্রকাশনা ছিলো “মোনসদক” এবং “মোনকধা”। ছাত্র-শিক্ষক সবাই লিখতেন। স্কুলবার্ষিকীটার নাম ছিলো প্রত্যাশা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা খুঁজে পাওয়া যাবে সেই প্রকাশনাগুলো থেকে।
স্থানীয় বা বিভাগীয় এবং কি জাতীয় পর্যায়ে এ্যাটলেটিক্স, খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন সবক্ষেত্রেই মোনঘরের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর কুড়িয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য পুরষ্কার। জেলাপর্যায়ে আন্ত:স্কুল খেলাধুলার সবকেক্ষেত্রেই প্রায় চ্যাম্পিয়ন মোনঘরের এ্যাটলেটরা।
বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের স্কুলপর্যায়ের ডিসপ্লে প্রদর্শনীতে সবসময়ই সেরা। মাসিক দেওয়াল পত্রিকা বের হতো ভবনভিত্তিক। আমি সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণীতে থাকার সময় করুণা ভবন এর দেয়ালপত্রিকা “করুণা”-র সম্পাদক ছিলাম।
অবশ্য ভবনের সুপার মহোদয় চাইতেন যে “তথাকথিত মেধাবী এবং ভালো” মার্কা অন্য একজন সম্পাদক হোক। কিন্তু আমজনতার রায় আমার পালে হাল দিতো এই আর কী! কত স্মৃতি, কত কথা! মোনঘর, প্রাণের মোনঘর। মোনঘর, আকুতির মোনঘর। মোনঘর, প্রণতির মোনঘর। প্রিয় মোনঘর, সশ্রদ্ধ বন্দনা।
সেই ভোর বেলায় ঘন্টাধ্বনি দিয়ে মোনঘরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। সকাল ৯টার দিকে সকালের পেটপুজো “আলুমার্কা” বিখ্যাত সেই “ঘন্দ” দিয়ে। এরপরে বিকেল ৪.০০ টা পর্যন্ত স্কুল। এরপর বৈকালিক বন্দনা।
বৈকালিক বন্দনাশেষে বিকেল ৫.০০ টার দিকে যখন পেট ‘কাউক কাউক’ করে তখন বহুল কাঙ্খিত বিখ্যাত সেই “ভাতের ঘন্টা” বেজে উঠে।
হাতের তর্জনী বা মধ্যমা দিয়ে স্টিল বা মেলামাইনের প্লেটগুলো বিশেষ কোন অলিম্পিক প্রদর্শনীর মতো ক্যারিশমেটিকবাবে ঘুরাতে ঘুরাতে মোনঘর ডাইনিং হলের দিকে শতশত ছেলেমেয়ের এগিয়ে যাওয়া বা কারো কারো অস্থির দৌড়! এই তো মোনঘরের জীবন। মোনঘরে বিকেল নেমে আসে আবারো ঘন্টা নিয়ে!
এরপর নিকষ কালো রাতিতে মোনঘরের চৌসীমানাকে প্রহরা দেয় যে প্রহরীরা, তারা নিয়ম করে প্রতি ঘন্টায় বাজিয়ে যান সেই “থেং” ধ্বনিটি।
৮ টা বাজলে ৮টি থেং, ১০ টা বাজলে ১০টি থেং, ১২ টা বাজলে ১২টি থেং। এই থেং থেং ঘন্টাধ্বনিটা আমাদের সবাইকেই জাগিয়ে তুলে, সারারাত ধরে সতর্ক রাখে এবং ভোরের আলোক নিয়ে আসে।
শতাব্দীর অজস্র কোলাহলের ভিড়ে মোনঘরের এই থেং থেং ধ্বনিটাই হয়ে উঠুক জুম পাহাড়ের বেঁচে থাকার গান, সংহতির সুর এবং নতুন ভোরের প্রারম্ভিকা…
“আমা জাগা আমা ঘর
আমা বেগ’ মোনঘর”!
বিশেষ দ্রস্টব্য: এই লেখাটি মোনঘর শিশু সদন এর পুনর্মিলনী-৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘মোনকধা’ নামক স্মারকগ্রন্থে প্রকাশিত। লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে জুমজার্নালের পাঠকদের জন্যও নিবেদন করলাম। মোনকধা-য় প্রকাশিত লেখাটিতে দু’একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে গেছে। যেমন – জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সেখানে চাথোয়াই রোয়াজার নামও উল্লেখ আছে। বস্তুত চাথোয়াই রোয়াজা ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ থেকে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের সে নির্বাচনে জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেসময় জনসংহতি সমিতির নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন এম এন লারমা জিন্দাবাদ, চাথোয়াই রোয়াজা জিন্দাবাদ, জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ (তথ্য-মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম, হিমাদ্রী উদয়ন চাকমা, ২০০৯)। আবছা স্মৃতি থেকে চাথোয়াই বাবুকে জেএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করেছি। এখানে তা সংশোধন করা হয়েছে। মোনঘর থেকে বারবার তাগাদা আসার কারণে আমার পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে লেখাটি তৈরী করতে হয়েছে বিধায় অনেক তথ্যে যথাযথ তথ্যসূত্র উল্লেখ করতে পারি নি বা আমি নিজেও যাচাই করার সযোগ পাই নি। আবার আমার পাঠানো লেখার কিছু তথ্য এবং বাক্যে মোনকধার সম্পাদক শশাঙ্ক দা কিছু সংশোধনী দিয়েছেন। তাই লেখাটির তথ্যগুলোর পাশাপাশি লেখাটির মূল স্পিরিটটাই প্রাসঙ্গিকভাবে বিবেচ্য। কোনপ্রকার ত্রুটি থাকলে দুঃখিত!
লেখক : সুলভ চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।