ম্রো জনগোষ্ঠী প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথা

Jumjournal
Last updated Dec 22nd, 2019

1193

featured image

ম্রো পরিচিতি

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পঞ্চম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো ম্রো জনগোষ্ঠী। মূলতঃ বান্দরবান সদর উপজেলা, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা, আলীকদম উপজেলায় এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলার ভার্জ্যাতলী মৌজায় ম্রোরা বসবাস করে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর মোট লোকসংখ্যা আনুমানিক ত্রিশ হাজার।

ম্রো প্রথাগত আইনের উৎস

ম্রো জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন প্রধানতঃ তাদের সমাজের সুপ্রাচীন প্রথা, রীতিনীতি ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং আদি লোকবিশ্বাস এ সকল উপাদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

মূলতঃ বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের তুলনায় সংখ্যাগত ভাবে যতো ছোটই হোক না কেন তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও গোত্রগত শৃঙ্খলা এবং শাসন সংহত রাখতে সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য বিশেষ কিছু নিয়ম, রীতিনীতি ও প্রথা তারা অনুসরণ করে।

সুপ্রাচীনকাল হতে আদিবাসী সমাজের স্মৃতি ও শ্রুতি নির্ভর এ সকল রীতিনীতি ও প্রথাকে সমাজের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন রূপে সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের তাগিদে গ্রন্থনা করা হলো, যার প্রথাগত আইনী গুরুত্ব অপরিসীম।

মূলত: বোমাং সার্কেল চীফ হলেন ম্রো জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায় নির্ধারক ও প্রতিবিধানকারী। ব্রিটিশ শাসন আমলের পূর্ব হতে রোয়াজা বা পাড়া প্রধান বা সমাজপতির মাধ্যমে ম্রো সমাজের যাবতীয় সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধের নিষ্পত্তি এবং প্রতিবিধান হয়ে আসছে।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় কার্বারী, হেডম্যান ও সার্কেল চীফ এই তিনটি স্তরের সামাজিক বিচার কাঠামো আইনতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।

ম্রো জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনের পাশাপাশি সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা ভোগ যেমন করে তেমনি সামাজিক শাসন, রীতিনীতি এবং  ‍শৃঙ্খলা সহ নিজেদের কৃষ্টি ঐতিহ্য রক্ষার্থে কিছু সামাজিক বিধি নিষেধও মেনে চলে।

একই সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি আনুগত্য পেকে উদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি অনুসরণের দ্বারা ম্রো জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের উদ্ভব হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় সৃষ্ট কার্বারী, হেডম্যান, সার্কেল চীফ এই তিন স্তরের সামাজিক আদালত হতে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত ও প্রতিবিধানের দ্বারা তাদের প্রথাগত আইনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

তাই ম্রো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের ভূমিকা তাদের সামাজিক শাসন-শৃঙ্খলা ধরে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে এভাবে- ‘আইন অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, প্রজ্ঞাপন ও অন্যান্য দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতা সম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতি’।

প্রথাগত আইন সম্পর্কে অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যায় যা কিছুই থাকুক না কেন সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুসারে প্রথাগত আইন অবশ্যই বাংলাদেশে প্রচলিত সকল ধরণের আইনের সমকক্ষ।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের বিচার ব্যবস্থা

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমা সার্কেলে আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন চাকমা চীফ/চাকমা রাজা; বোমাং সার্কেলে আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন বোমাং চীফ/বোমাং রাজা; মং সার্কেলের চাকমা ব্যতীত আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন মং চীফ/মং রাজা।

তাঁদের অধীনস্থ সার্কেলে তাদের অধীনস্থ আদালতগুলিই হলে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী সমাজের জন্যও সর্বোচ্চ (আদিবাসী) আদালত। তারা স্ব স্ব সার্কেলের আদিবাসীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচার করে থাকেন এবং স্ব স্ব মৌজার হেডম্যানদের বিচারের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে তাদের আদালতে আপীল করা হলে সে বিচারও করে থাকেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেলে চীফ রাজাদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে ডেপুটি কমিশনারের আদালতে আপীল করা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সার্কেলে চাকমা চীফ রাজার অধীনস্থ মৌজাগুলিতে স্ব স্ব মৌজা হেডম্যান হলেন ঐ মৌজার আদিবাসী সমাজের মুখ্য বিচারক। তিনি তার আদালতে নিজে এবং প্রয়োজনে তাঁর মৌজাস্থ বিভিন্ন গ্রামপ্রধান কার্বারীদের সমাজপতিদের (বিশেষ কোনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে তাদের সমাজপতিদের যেমন- লুসাই, পাংখোয়া, বমদের লাল প্রমুখদের) সহযোগিতায় সামাজিক বিচারাদি সম্পন্ন করেন।

অধিকন্তু তাঁর পরিচালনাধীন মৌজার গ্রামপ্রধান কার্বারীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তার আদালতে কোনা আপীল পেশ করা হলে তার বিচার করে থাকেন।

হেডমান আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ/রাজার আদালতে আপীল করা পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌজাগুলির অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি সংশ্লিষ্ট গ্রামপ্রধান কার্বারী তার আদালতে কোনো অভিযোগ হলে তার বিচার করেন; প্রয়োজনে হেডম্যানের নিকট প্রেরণ করেন।

বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যে সকল গ্রামে কার্বারী অনুপস্থিত সেখানে বসবাসকারী ঐ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজপতিগণ সামাজিক বিচারাদি সম্পন্ন করে থাকেন।

ম্রো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন প্রয়োগের অধিক্ষেত্র

বাংলাদেশে ম্রো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের অধিক্ষেত্র হিসেবে মূলতঃ চাকমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য। যে সকল আইনের আওতায় ম্রো সমাজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা বা বিরোধসমূহের নিষ্পত্তি হচ্ছে এবং হয়, তা নিম্নরূপঃ

ক) ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪০নং বিধি;

খ) ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন সংশোধনী (২০০৩ সনের ৩৮নং আইন) আইনের ৪(৪) ধারা;

গ) তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (১৯৮৯ সনের ১৯, ২০ ও ২১ নং আইন)-এর ৬৬ ধারামতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি বিষয়ক সামাজিক বিচার এবং ১ম তফশীলের ২৩নং কার্যাবলীর অধীনে;

ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ২২(ঙ) ধারার আওতায় (ক্ষমতাবলে) ম্রো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনকে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে সমম্বয় ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ম্রো জনগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ ও প্রযোজ্য হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন (২০০১ সনের ৫৩নং আইন) এর ৬নং ধারামতে (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিস্পত্তি করা (খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী, ক্ষেত্রমতে সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল।

ম্রো ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন যার উপর প্রযোজ্য নয়:-

ক) যদি তিনি ঘোষণা বা সামাজিক আচার-আচরণে ম্রো পরিচিতি ত্যাগ করেন;

খ) ম্রো কোনো পুরুষ বা মহিলা যদি ধর্মান্তরিত ও জাতিচ্যুত হয়ে ভিন্ন জনগোষ্ঠী হতে স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণ করেন এবং ম্রো সামাজিক রীতিনীতি ও প্রচলিত প্রথা পরিহার করেন।

মূলত: (১) অনগতভাবে যিনি ম্রো তথা ম্রো পরিবারে বা সমাজে জন্মগ্রহণকারী,

(২) পিতা ম্রো জনগোষ্ঠীর সদস্য, (৩) একজন ম্রো পুরুষের ঔরসে ও একজন ম্রো মহিলার গর্ভজাত ভূমিষ্ট সন্তান কিংবা অবৈধ সন্তানও ম্রো বলে গণ্য হয়।

ব্যাখ্যাঃ ম্রো জনগোষ্ঠীভুক্ত একজন আদিবাসী পুরুষের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিই ম্রো পরিচয়ের অধিকারী। ম্রো জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত কোনো পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সামাজিক পরিচিতি ম্রো বলেই স্বীকৃত হয়। তবে মাতাকে ম্রো নারী হতে হয় এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। নিজেকে ম্রো হিসেবে পরিচয় দান করে, এরূপ একজন ম্রোয়ের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী এবং দত্তক সূত্রে ম্রো পরিবারে লালিত সন্তানও ম্রো পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে।

ম্রোদের দল ও গোত্র: ম্রোদের মধ্যে কয়েকটি দল ও গোত্র রয়েছে। যেমন ম্রোদের ঙারুয়া নামক দলেরই ৪টি গোত্র রয়েছে যেমন- ১। খাটপো, ২। চিমলুং , ৩। জাং নাউ এবং ৪। চাউলা অন্যান্য গোত্রগুলি হলো- ৫। ঙারিং চাহ, ৬। তাং, ৭। দেং, ৮। খউ, ৯। তাম-তৃ-চাহ, ১০। কানবোক, ১১। প্রেনজু, ১২। নাইচাহ, ১৩। ইয়মরে ইত্যাদি।

জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহে সামাজিক বাধ্যবাধকতা: জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এ তিনটি অধ্যায়কে ম্রো জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও আচারঅনুষ্ঠানের দ্বারা সমাজসিদ্ধ করেছে। এসব রীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে ম্রো সমাজে অলক্ষনীয় করা হয়েছে।

শিশুর জন্মশুদ্ধি ও সামাজিক আচার: ম্রো সমাজৰ্ভুক্ত পরিবারে শিশু ভূমিষ্ট হবার পর বিশেষ কোনো আচার-অনুষ্ঠান হয় না। গ্রামের ধাত্রী এসে প্রতীকে সন্তান প্রসবের সময় সাহায্য করে। সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশুকে নয়দিন পর্যন্ত ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। প্রতীকে শুধুমাত্র লবণ দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়।

নয় দিন অতিবাহিত হবার পর প্রসূতীকে (বাড়ীর কাছে পাহাড়ী নদী, ছড়া বা ঝর্ণায়) স্নান করতে দেওয়া হয়। এরপর প্রসূতী সাংসারের স্বাভাবিক কাজ-কর্মে অংশ নিতে পারে।

সৎকার রীতি: ম্রো পরিবারে কারো মৃত্যু হলে সেই মৃতদেহকে বাড়ীর একটি বড় কামরায় রাখা হয়। মৃত ব্যক্তিকে দেখতে আসা লোকজনকে পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী শূকর-মুরগী বধ করে ভাত খাওয়ানো হয়।

সাতদিন পর মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়। শ্মশানকে ম্রোরা ‘চেংরং’ বলে। মৃতের মা গোত্রীয় একজনকে চুল পোড়ানোর মূল্য এবং সৎকারের অনুমতি দেয়া বাবদ মৃতের উত্তরাধিকারীর নিকট থেকে ৫টি রৌপ্য মুদ্রা অথবা তার সম পরিমাণ টাকা দিতে হয়।

চিতায় দাহ করার পর একটি কাপড়ে ছাই সংগ্রহ করে পুটলী বেঁধে একটি বাঁশের চোঙায় ঢুকিয়ে চিতায় পুঁতে রাখা হয় । চিতার উপর ৪ থেকে ৬ ফুট উঁচু একটি বাঁশের কাঠামো তৈরী করে সেখানে এক খন্ড সাদা নিশান উড়ানো হয়।

বর্ষাকালে ভেসে না যাওয়া পর্যন্ত এই কাঠামো থেকে যায়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে কেউ মারা গেলে তাকে গ্রাম থেকে দূরে কোথাও নিয়ে কবর দেয়া হয়।

ম্রো সমাজের রীতি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বাঁশের সাহায্যে মাচাং তৈরী করে সেখানে মৃতদেহ রেখে তার চারপাশে সারারাত বাণী, ঢোল বাজিয়ে গান বাজনা হয়।

সেই সাথে ১টি শূকর, ১টি মোরগ কাটা হয় এবং ১ বোতল মদ দিয়ে ভোজের আয়োজন করা হয়। যতদিন মৃতদেহের সৎকার না হয় ততদিন এ ধরণের আয়োজন চলতে থাকে।

মৃতদেহ শ্মশানে দাহ করার সময় মৃত ব্যক্তির আত্মার মুক্তির উদ্দেশ্যে একটা শূকরের ছানা বলি দেয়া হয়। শ্মশান থেকে বাড়ীতে ফিরে এসে ভবিষ্যত অমঙ্গলের হাত থেকে পরিবারের লোকজন পরিত্রাণ পাবার জন্য দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা এবং ১টি শূকর বলি দেয়া হয়।

ম্রো সামাজিক রীতিনীতি

রুইপারম: প্রাচীন রীতি অনুসারে প্রত্যেক ম্রো’কে কানে ছিদ্র করতে হয়। ম্রো-ভাষায় এই কান ছিদ্ৰ করাকে বলা হয়- ‘রুইপাম’। সাধারণতঃ তিন বৎসর বয়সে কানে ছিদ্র করতে হয়। কানে ছিদ্র করার নির্দিষ্ট দিনে পাড়ার লোকদের নিমন্ত্রণ করা হয় এবং ১টি শূকর ও ১টি মোরগ কেটে ১ বোতল মদ সহ নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো হয়। নিমন্ত্রিতদের সামনে বসে গ্রামের একজন বৈদ্য কানে ছিদ্র করে দেয়।

জুম চাষ ও পূজার প্রচলন: ম্রো সমাজে জুম চাষের পূর্বে মাছ, মাংস, মশল্লা ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাদ্য খাওয়া সামাজিক ভাবে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই রীতি ম্রো সমাজে এখনও প্রচলিত। আবার জুম থেকে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার পর দেবতার সন্তুষ্টির জন্য প্রত্যেক পরিবারকে ১ বোতল মদ, ১টি শূকর এবং ১টি মোরগ বলি দিয়ে পুজা দিতে হয়। তাদের ধারণা দেবতাকে সস্তুষ্ট করা না হলে পরবর্তী বছরে ফসল ভাল হয় না।

ম্রোরা সাধারণতঃ বছরে দু’বার বিশেষ পূজা করে থাকে। ম্রো ভাষায় এই পূজাকে ”খ্যাং” বলা হয়। এসময় তিনদিন পাড়া বন্ধ (পাড়ার বাইরে আসা-যাওয়া বন্ধ) থাকে এবং বাড়িতে বাড়িতে পিঠা তৈরী করা হয়। এসময় ছাড়া অন্য কোনো সময় পিঠা তৈরী করা যায় না। ”খ্যাং” এর সময় বিভিন্ন জীব, যেমনঃ- মোরগ, শূকর, ছাগল, গরু ইত্যাদি বলি দিয়ে পূজা করা হয়।

ব্যভিচারের দণ্ড: অবিবাহিত কোনো যুবক-যুবতী অবৈধ দৈহিকসঙ্গমে ধরা পড়লে উভয়কে একটি শুকর জরিমানা করা হয় এবং পাড়ার নির্দিষ্ট যে স্থানে নাচ-গান হয় সেখানে শুকরটি বধ করে দন্ডিত যুবক যুবতীকে সেই শূকরের রক্ত প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে ভাগ করে দিতে হয়।

পারলৌকিক বিশ্বাস: ম্রো পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যু হলে সাথে সালে একটি শূকর, একটি কুকুর ও একটি মুরগী বধ করা হয়। এর কারণ হলো, ম্রোরা মনে করে মৃত্যুর পর আত্মা স্বর্গে যায়। স্বর্গের পথে বড় বড় পোকা থাকে। সে পথে আত্মা যাবার আগে পোকাগুলোকে মুরগী খেয়ে ফেলে।

আর কুকুর হচ্ছে আত্মার পথ প্রদর্শক। মৃতদেহকে ২/৩ দিন পর্যন্ত বাড়িতে রাখা হয়, কারণ মৃতের সাথে আর কোনো দিন দেখা হয় না। শ্মশানে নেবার সময় মৃতের মাথার দিকটা আগে নেওয়া বারণ, পায়ের দিকটা আগে নিতে হয়। তা না হলে আত্মা কষ্ট পায় বলে তারা মনে করে।

মৃত ব্যক্তি যদি পুরুষ হয় তাহলে চিতায় মৃতের মুখ পূর্বদিকে রাখা হয় আর যদি মহিলা হয় তাহলে পশ্চিমমুখী রাখা হয়। এর কারণ হলো ছেলেরা পূর্বদিকে সূর্যের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে, জুমে যাবার জন্য তাকে প্রস্তুত থাকতে হয় বলে।

আর নারীরা বিকেলে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে থাকে তার পারিবারিক কাজের জন্য। কখন জুম থেকে বাড়ি ফিরতে হয় তা পশ্চিম দিকের সূর্য দেখে সময় নির্ণয় করা হয়।

শবদাহে মামার কর্তৃত্ব: ম্রো সমাজে কারো মৃত্যু হলে তার সৎকারের জন্য মামার গোত্র থেকে কোনো একজনকে মরদেহ সনাক্ত করতে হয়। যতক্ষণ না মামা বা মামার গোত্রের লোক এসে অনুমতি না দেয় ততক্ষণ পর্যন্ত মরদেহ রেখে দিতে হয়। মামার গোত্র থেকে মৃতের স্বাভাবিক মৃত্যু অথবা কোনো অঘটনে মারা গেছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মরদেহ দাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়।

মৃতদেহ দাহ করার পূর্বদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রত্যেক পরিবার থেকে ম্রো মেয়েরা এক বোঝা লাকড়ি মৃতের সৎকারের জন্য নিয়ে আসে। পরদিন সকালে এ লাকড়ী দিয়ে মৃতের দাহ হয়।

বিদেহী আত্মার কষ্ট লাঘব: ম্রোরা নদীর ধারে, পাহাড়ি ছড়া বা খালের পারে চিতা তৈরী করে। এর কারণ হচ্ছে তাদের বিশ্বাস শবদাহ করার সময় মৃতের আত্মা আগুনের উত্তাপে খুবই কষ্ট পায়। নদী বা খালের পারে দাহ করা হলে পানি কাছে থাকায় আত্মা তেমন কষ্ট পায় না। আগুনের উত্তাপ থেকে কিছুটা রেহাই পায়।

তাই শবদাহ পরে পরেই শ্মশানের আগুন নেভানো হয়, যাতে আত্ম তাড়াতাড়ি শান্তি পায়। এরপর শ্মশানে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। শবদাহ করার পর সাতদিন পর্যন্ত সেই ঘরে আত্মা বাস করে বলে ম্রোদের লোকবিশ্বাস রয়েছে।

শ্মশান থেকে ফিরে আসা লোকজন বাড়ির উঠানে পৌঁছলে বাড়ির যে কোনো একজন সেই শ্মশান ফেরত ব্যক্তির দিকে এক মুঠে ছাই নিক্ষেপ করে থাকে যাতে ভূত-প্রেতের চোখে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তারা সরে পড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় মৃত ব্যক্তির পরিবারে শূকর কিংবা গরু বধ করে গ্রামবাসীকে নিমন্ত্রণ খাওয়ানো হয়। এ সময় মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যেও এক থালা ভাত ও এক থালা তরকারী বাড়ির দরজা থেকে উঠানে নিক্ষেপ করা হয়।

অপমৃত্যু নিবারণ: ম্রো পরিবারের কেউ দূর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গেলে, যতক্ষণ লাশের দাহ না হয় ততক্ষণ তরিতরকারী দিয়ে আহার করা মৃতের পরিবারের জন্য নিষেধ থাকে। তখন তাদেরকে লবণ দিয়ে ভাত খেতে হয়। তরিতরকারী দিয়ে আহার করলে সেই গোত্রের আরও লোকজন দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা থাকে। ম্রো সমাজে সন্তান প্রসবকালীন প্রসূতি মায়ের মৃত্যুকেও দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হিসেবে ধরা হয়। তখনও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়।

ধর্মীয় বিশ্বাস ও ম্রো সামাজিক প্রথা: আসলে একজন ম্রো সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী ও প্রকৃতি পূজারী। পরবর্তীতে ম্রো সমাজে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ক্রামা ধর্ম প্রচারিত হবার পর এ তিনটি ধর্মের অনুশাসন ম্রো জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করলেও তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথার পরিবর্তন তেমন ঘটেনি।

ম্রো সমাজে ক্রামা ধর্মের উদ্ভব হয়েছে ১৯৮৫-৮৬ সনে। ম্যানলে ম্রো হলেন ‘ক্রামা’ ধর্মের মূল প্রবক্তা। তিনি নিজেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি/স্বর্গদূত হিসেবে দাবী করে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের সমন্বয়ে রিয়াংক্ষীতি (সুনীতি) নামের একখানা ধর্মীয় পুস্তক রচনা করেন।

বর্তমানে ক্রামা ধর্ম অনুসারীদের জন্য পৃথক ধর্মীয় মন্দির রয়েছে। “ম্রো” বর্ণমালার উদ্ভাবক হলেন ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক “ম্যানলে ম্রো”। তারপরেও ম্রোদের গ্রামীণ সমাজে এখনো প্রকৃতি পূজা সহ পশুবলি প্রথা বিদ্যমান।

ম্রো সমাজের রীতিনীতি ও প্রথাগত আইন তাদের সামাজিক আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা, লোকবিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি সমাজের আনুগত্য ও সমর্থন এখনও অটুট রয়েছে।

দেব-দেবীর পূজার মন্ত্র ও পদ্ধতি, তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ/মাদুলি প্রস্তুত বা লিন, ভেষজ চিকিৎসা এসব বিষয়ের প্রতি ম্রো সমাজের বিশ্বাস সুপ্রাচীনকালের। ম্রো গ্রামীণ সমাজে এখনো বছরের বিভিন্ন সময়ে গ্রাম বা সমাজের সুখ, শান্তি ও মঙ্গল কামনায় এবং দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধি হতে মুক্তির জন্য গো-হত্যা এবং জুমচাষের সফলতার জন্য পশুবলি দিয়ে প্রকৃতি পূজা করা হয়।

ম্রো গ্রামীণ সমাজে দেবতা, অপদেবতা ও প্রকৃতি পূজার প্রবণতা তাদের সামাজিক বিশ্বাস হিসেবে গণ্য হয়। সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী ও প্রকৃতি পূজারী ম্রো জনগোষ্ঠী পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও একজন ম্রো যতক্ষণ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ঘোষণার মাধ্যমে কিংবা আচার-আচরণ দ্বারা ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নিজস্ব কৃষ্টি, রীতিনীতি ও প্রথা পরিত্যাগ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ম্রো হিসেবে গণ্য হয়।

 

তথ্যসূত্র:

১। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮।

২। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ (২০০১ সনের ৫৩নং আইন)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা