ম্রো রূপকথা: পাক হন প্রি (শূকর ও বাঘ)
1159
অনেক দিন আগের কথা। এক বনে বাস করতো এক বাঘ ও এক শূকর।
তবে একের সাথে অন্যের কোনদিন দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। বাঘ বাসা বাঁধত গাছের ডালে আর শূকর বাসা বাঁধত গাছের নীচে।
একদিন প্রচন্ড ঝড় এলো। ঝড়ে গাছের ডালে বাঁধা বাঘের বাসাটি ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলো। বাঘ গাছের নীচে পড়ে গেলো ।
ঝড়ের মধ্যে এখন সে কোথায় আশ্রয় নেবে তা বুঝতে পারলো না। তাই সে এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগেলা।
গাছের নীচে হঠাৎ একটা সুন্দর বাসা দেখতে পেলো। বাসা দেখতে পেয়ে বাঘ সেখানে ছুটে গেলো।
বাঘ কড়া নেড়ে হাঁক দিলো, “এই যে ভাই, ঘরের ভেতর কেউ আছেন? দরজা খুলুন। আমি বিপদে আছি।” ভিতর থেকে শূকর জবাব দেয়, “তুমি কে ভাই?” “আমি বাঘ” জবাব দেয় বাঘ।
শূকর কাতর সুরে বলল, “না, না, আমি দরজা খুলতে পারবো না। তুমি আমাকে খাওয়ার জন্য এখানে এসেছো।” “না, না, আমি তোমাকে খেতে আসিনি।
বিপদের দিনে আশ্রয়দাতাকে কেউ কি কোনদিন খায় ?” জবাবে বাঘ বলল। শূকর দরজা খুলে দিলো।
কিছুক্ষণ পরে উভয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। বাঘের ভয়ে এবং নাক ডাকার শব্দে শূকর ভালো করে ঘুমাতে পারলো না।
পরদিন সকালে উভয়ের ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠে বাঘ বললোঃ “শূকর ভাই, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, যদি কিছু মনে না করো।
শুনবে ?” শূকর জবাব দিলো, “হ্যাঁ, শুনবো। শীঘ্রই বলো।” বাঘ ঃ “তাহলে শুনো। আজ রাত্রে স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে হত্যা করে খেয়ে ফেলেছি।
তাই আজ বাস্তবেও তোমাকে খেয়ে ফেলবো।” অবাক হয়ে শূকর জবাব দিলো ঃ “অসম্ভব।
তা হতেই পারে না। স্বপ্ন কি কখনো বাস্তবরূপ নেয় ?” বাঘ বললোঃ “অবশ্যই বাস্তবরূপ নেয়। তা যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে রাজদরবারে বিচারকের নিকট চলল।”
শূকর তা মেনে নিলো। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করবার জন্য শূকর বাঘের কাছ থেকে সাতদিন সময় নিলো।
তার ফাঁকে বাঘ চালাকী করে বিচারক মহোদয়ের কাছে গিয়ে চুক্তি করলো শূকরকে মেরে মাংস ভাগাভাগি করবে বলে।
শূকরের মাংসের ভাগ পাবে বলে বাঘের কূটবুদ্ধির প্রস্তাবে বিচারক মহাশয় ভারী খুশী হলো।
এ দিন যায় । রাত যায়। বিচারের দিনও ঘনিয়ে আসলো। আর এ দিকে শূকরের চিন্তাও বাড়তে লাগলো।
চার-পাঁচ দিন চিন্তায় চিন্তায় না খেয়ে শূকরের শরীর কাঠ হয়ে গেলো। বাকি আর মাত্র দুইদিন। চিন্তিত মনে অশ্রুভরা নয়নে শূকর বনের ভেতর ঘুরতে লাগলো।
এমন সময় পেঁচার সাথে তার দেখা হলো। শূকরের অবস্থা দেখে পেঁচা জিজ্ঞাসা করলো ঃ “তোমার কি হয়েছে ? তোমাকে এতো গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন?”
শূকর চোখের জল মুছতে মুছতে জবাব দিলো, “আমি বিপদে আছি পেচা ভাই। গত সপ্তাহে ঝড়ের রাতে বাঘকে আশ্রয় দিতে গিয়েই আমার এ দশা।”
“পরিষ্কার করে আমাকে খুলে বলো। আমি স্পষ্টভাবে বিষয়টি বুঝতে পারছি না”, বললো পেঁচা। শূকর সমস্ত ঘটনা পেঁচার কাছে খুলে বললো।
শূকরের কথা শুনে পেঁচা বললোঃ “শূকর ভাই, তুমি চিন্তা করো । আমি আছি। এটা কি কোন ব্যাপার হলো?
যাও, চিন্তা মুক্ত করো। আর ভাল ভাল খাওয়া খাব এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাবে।
আমি তোমাকে প্রাণপণে সাহায্য করবো। এ বিপদ থেকে আমি তোমাকে মুক্ত করে ছাড়বো। কথা দিলাম।”
শূকর পেঁচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো আর ভাবতে লাগলো, পেঁচা তো সামান্য ক্ষুদ্র জীব। কিভাবে আমাকে সাহায্য করবে।
পরদিন শূকর পেঁচাকে নিয়ে বিচারকের কাছে গেলো। শূকর আর পেঁচা যেতে যেতে অনেক বেলা হয়ে গেলো।
গিয়ে দেখে সেখানে সকলেই উপস্থিত। শূকর ও পেঁচাকে দেখে বিচারক রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো ঃ “তোরা এতো দেরি করলি কেন ?”
কম্পিত স্বরে শূকর জবাব দিলো,”আমাদের আসার রাস্তা খুব দুর্গম। তাই দেরি হয়ে গেলো। ক্ষমা করবেন মহাশয়।” |
বিচার শুরু হলেঅ। তখন পেঁচা ঘুমাবার জন্য বিচারকের নিকট অনুমতি চেয়ে বললো ঃ “মহামান্য বিচারক, গত রাত্রে বাচ্চার অসুস্থতার দরুন আমার ঘুম হয়নি।
বিচারের ফাঁকে কিছুক্ষণ ঘুমাবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি। বিচার শেষে হলে আমাকে জাগিয়ে তুলবেন।
আমি শুধু ফলাফল শুনবো।” পেঁচার প্রার্থনায় বিচারক অনুমোদন দিলো। পেঁচা বিচারকের সভার খাটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকলে বাঘের প্রস্তাবকে সমর্থন দিতে লাগলো যে, স্বপ্নে যদি বধ করে তাহলে বাস্তবেও শূকরকে বধ করতে হবে।
আর সবাই শূকরকে পরিহাস। করলো, “তোমার পেঁচা উকিল তো এখনো ঘুমাচ্ছে।
সভা তো প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সে কেমন বিচার করবে ? আর সামান্য পেঁচাই বা কি করতে পারবে?”
শূকর তখন একা। তার পক্ষে কেউই সমর্থন দিলো না।
শূকর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চুপচাপ বসে রইলো। আর মনে মনে পেঁচার প্রতি তার ঘৃণাও হলো।
সেও মনে মনে ভাবলো, পেঁচাই বা কি করতে পারবে ?
বিচার প্রায় শেষ। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হলো যে, আজ শূকরকে বধ করা হবে।
বাঘের প্রস্তাব সত্যি গ্রহণযোগ্য। তখন পেঁচাকে ঘুম থেকে জাগানো হলো। পেঁচা হাই তুলতে তুলতে কিছু বলার জন্য বিচারকের নিকট অনুমতি চাইলো।
বিচারকও বলার জন্য অনুমতি দিলো। অনুমতি পেয়ে পেঁচা বলতে শুরু করলো, “মহামান্য বিচারক, বেআদবি মাফ করবেন।
কিছুক্ষণ আগে ঘুমে একটা সুস্বপ্ন দেখলাম যে, আপনার ছোট মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।
যাক খুব ভালই হলো, শূকরকে হত্যা করা হবে; সে অনুষ্ঠানে আপনার মেয়ের সাথে আমারও বিয়ে হবে।
শূকরের হত্যার অনুষ্ঠানে আমার বিয়ে হবে এ সৌভাগ্য আর কার হয়?” পেঁচার কথা শুনে বিচারক রেগে জ্বলে উঠলো এবং বললোঃ “তোমার এ স্বপ্ন কি সুস্বপ্ন হলো ?
সামান্য পেঁচা হয়ে আমার সামনে এতো বড় কথা বলার সাহস তোমাকে কে দিয়েছে ? তোমার লজ্জা নেই?”
পেঁচা হেসে হেসে জবাব দিলো ? “মহাশয়, তা-ই যদি হয় তাহলে শূকরকে কেন হত্যা করা হবে ?
বাঘও তো শূকরকে স্বপ্নে হত্যা করেছে। শূকরকে যদি বাস্তবে হত্যা করা হয় তাহলে আমারও আপনার মেয়েকে প্রাপ্য নয় কি?”
পেঁচার যুক্তি কেউই খন্ডন করতে পারলো না। পেঁচার যৌক্তিকতা দেখে বিচারক তার ভুল বিচার স্বীকার করলো এবং মাথায় করে পেঁচার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
পেঁচার যৌক্তিকতা দেখে সভা ভেঙ্গে গেলো। শূকরকে আর হত্যা করা হলো না।
বিচারের সময় পেঁচা ঘুমাচ্ছিলো না। একটি ফন্দি বের করবার জন্য সে ঘুমের ভান করেছিলো।
বাঘ নিরাশ হয়ে ক্ষুধার জ্বালায় গজরাতে গজরাতে ফিরে গেলো। শূকর পেঁচাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে ফিরে গেলো।
মুরুং ভাষায় প্রবাদ আছে, যেখানে বন্যশূকর থাকবে সেখানে অবশ্যই পেঁচাকেও দেখা যাবে।
লেখক: সিং ইয়ং মুরুং
চিত্রায়নঃ তনময় চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।