ম্রো রূপকথা: এক ডাইনীর গল্প
1131
অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে বাস করত দুই ভাই-বোন। তাদের ছোটকালেই তাদের মা-বাবা মারা যায়। তারা একে অপরকে খুবই ভালবাসত। তারা জুম চাষ করত।
একদিন তারা একটা পাহাড়ে জুম কেটে আগুনে পুড়ানোর পর ধান লাগাল। এভাবে দিন যায়, মাস যায়। জুমে ধান পাকতে শুরু হল। আর জুমে ধান পাকার সাথে সাথে টিয়ে পাখিরা ধান খেতে আরম্ভ করল।
তখন ভাই বোনকে বলল, “আমার লক্ষ্মী বোন, তুমি জুম পাহারা দিবে এবং টিয়ে পাখি তাড়াবে। আর আমি বাড়ীতে গৃহস্থালীর কাজ করব।” ভাইয়ের কথা মত বোনটি পরদিন জুমে গেল এবং জুমে গিয়ে টিয়ে পাখিদের বলল “ওরে টিয়ে পাখি, তোমরা আমাদের পরিশ্রমে করা পাকা ধান খেয়োনা”।
এই কথা বলার সাথে সাথে জুমের অপর প্রান্ত থেকে ডাইনীর গলার আওয়াজ ভেসে আসল, অবিকল কিশোরীর কথার মত। এভাবে সে দুতিন বার লক্ষ্য করে চতুর্থ দিনে তার ভাইকে জানাল, “ভাইয়া, আমি আর জুমে যাবনা।
জুমে যেতে আমার ভয় হয়। আমি যখন টিয়ে পাখি তাড়াই তখন জুমের অপর প্রান্তে কে যেন আমার কথা অনুসরণ করে।” তখন ভাই বলল, “ঠিক আছে, কাল থেকে তাহলে আমিই যাব—-কে আসে দেখি।”
পরদিন ভাই জুমে গিয়ে ঠিক বোনের গলার আওয়াজের মত ডাকলো। সত্যি সত্যি জুমের অপর প্রান্ত থেকে সেই অবিকল শব্দ ভেসে আসল। তখন ভাই বুঝতে পারলো, বোন সত্যি কথা বলেছে। তাহলে সত্যি কি সেখানে কেউ আছে? মনে মনে প্রশ্ন জাগল তার এবং তাকে খুঁজার জন্য সেদিকে গেল।
খুঁজতে খুঁজতে একটা গাছের তলায় বসে থাকা ডাইনীকে দেখতে পেল এবং সাথে ছিল তার ছোট বাচ্চা। সেখানে তাদের দেখা হলে ডাইনী বলল, “তুমি আমাকে বিয়ে কর, না করলে তুমি আমার খাবারের ১নং তালিকা হবে।” তখন ভাই কোন উপায় না দেখে ডাইনীর বিয়ের প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হল।
সন্ধ্যায় সে নিয়ে আসলো ডাইনী-বৌকে বাড়ীতে। এসে ডাইনী স্বামীকে বলল, “যখন বাপের বাড়ীতে ছিলাম তখন কত রকম শাক-সবজি খেতাম। তাই সবজি খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি আমাকে শাক দাও না।” তখন স্বামী তাকে অনেক শাক-সবজি এনে দিল।
এনে দেয়ার পর ডাইনী বলল, “আমার বাবা-মা পর্যন্ত কোন দিন এ সমস্ত খাবার খায়না।” বলেই সব তরকারি ফেলে দিল। আবার পরদিন কলার মোচা (কলার ফুল) এনে দেয়ার জন্য স্বামীকে বলে দিল। যখন তার স্বামী কলার মোচা এনে দিল।
পুনরায় তাও ফেলে দিল। পরদিন আবার ডাইনী বলল, “আমাদের বাড়ীতে যে ছোট মুরগির বাচ্চা সব সময় ধান খেতে আসে তাকে মেরে ফেল। আমার মুরগীর মাংস খেতে খুব ইচ্ছে করছে।” ডাইনী তার স্বামীর ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে মুরগীর কথা বলেছে।
কিন্তু ভাইয়ের কোন উপায় নেই যদি বোনকে না দেয় তাহলে তাকেও খেয়ে ফেলবে। তখন ভাই বোনকে ডেকে বলল, “আচ্ছা বোন, বলতো কোন ফুল তুমি এখনও খোঁপায় গুজে দাওনি”।
বোন বলল, “ভাইয়া, আমার লসা’ ফুল বাকি আছে।” তাহলে কাল সকালে আমরা লসা ফুল আনতে যাব। রাতে ভাই সাতটা চালুন’ তৈরী করল।
পরদিন সকালে তারা দুই ভাই-বোন মিলে লসা-ফুল আনতে গেল। বোনকে গাছের নিচে চালুন মাথায় ঢেকে রেখে বসতে বলল। তারপর ভাই লসার গাছের উপর উঠে গেল। গাছের ডাল দিয়ে বোনকে মারবার জন্য প্রস্তুতি নিল।
যখন ভাই ছোট বোনকে লসার ফুল গাছের প্রশাখা উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে তখন যাতে বোন দেখতে না পায় সে জন্য চালুন দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা হয়েছে। গাছের তলায় চালুন দিয়ে মাথা ঢেকে বসে রইল ছোট বোন।
ভাই গাছে উঠে একটা গাছের ডাল কেটে ছুঁড়ে মারল বোনকে। তখন ভাইয়ের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল বোনের চালুনের উপর। বোন জিজ্ঞাসা করল, “উপর থেকে পানি পড়ল কেন, ভাইয়া ?” ভাই বলল, “পানি না তো, এটাতো কুয়াসার পানি।
তুমি ভালভাবে থাকবে, কেমন।” আবার একটি গাছের ডাল কেটে ছুঁড়ে মারল। তখন ভাই আরও ভাল করে বোনকে থাকতে বলল এবং একটা চালুন ফেলে দিতে বলল। এভাবে ছয়বার গাছের ডাল ছুঁড়ে মারল।
তবু বোনের গায়ে পড়ল না। যখন সাতবার হল তখন বোনের মাথায় একটা গাছের ডাল পড়ল। সাথে সাথে বোনটি মারা গেল। তখন কাঠবিড়ালী এক টুকরো মাংস নিয়ে চলে গেল। তারপর বোনের লাশ এনে দিল ডাইনী বৌ-এর কাছে। ডাইনী খুশীতে নাচতে নাচতে বোনের মাংস সব খেয়ে ফেলল।
তার পরদিন সে জুমে গেল। জুমে যতসব চালকুমড়া আছে তাও খেয়ে ফেলল। আর যেগুলি খেতে পারে না ছোট টুকরো করে তাও সব খেয়ে নিল। বাড়ীতে এসে পেটের ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কাঠবিড়ালী মাংস টুকরাটি নিয়ে তুলায় মুড়ে রেখে দিল। সাতদিন পর সুন্দর ফুটফুটে এক মেয়ে শিশু তুলার মোড়া থেকে জন্ম নিল। দিন যায় মাস যায়। মেয়েটি বড় হতে লাগল এবং কৈশোরে পদার্পণ করল।
কাঠবিড়ালী একটা জায়গায় তাকে আটকে রাখল যাতে কেউ দেখতে না পায়। আর কিশোরী সব সময় আপন মনে বাঁশী বাজাতে লাগল।
এদিকে ভাইটি বাঁশীর সুর শুনে কাঠবিড়ালীর কাছে গেল এবং বলল, “কে এখানে এত সুন্দর বাঁশী বাজাচ্ছে ?” তখন কাঠবিড়ালী বলল, “আমিই বাঁশী বাজিয়েছি।”
কাঠবিড়ালী তাকে সত্য তথ্য দিল না। একদিন কাঠবিড়ালী জুমের কাজে চলে গেলে সেই ফাঁকে আবার ভাই গেল কাঠবিড়ালীর বাড়িতে এবং দেখতে পেল এক ফুটফুটে কিশোরী মেয়ে। কথা বলতে বলতে এক সময় সে জানতে পারলো কিশোরীটি তার ছোট বোন এবং বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বোনকে পরামর্শ দিল।
তখন বোন বলল, “ভাইয়া, আমি বাড়ী যাবো না। আমি গেলে ডাইনী আবার আমাকে মেরে ফেলবে।” তখন ভাই বলল, “দেখ, আমি ডাইনীকে মেরে ফেলেছি”। এই বলে শূকরের রক্ত বোনকে দেখাল। বোনটি বলল, “না ভাইয়া এইটা ত শূকরের রক্ত।” পরদিনও সে মুরগি কেটে বোনকে দেখাল তবু বোন বিশ্বাস করল না।
সত্যি সত্যিই একদিন ডাইনী জুম থেকে ফেরার পথে তাকে মেরে ফেলা হল। বোনের নিকট গিয়ে দেখাল সেই ডাইনীর রক্ত। তারপর বোনকে নিয়ে গেল বাড়ীতে। ভাই বোনটাকে বলল, “বোন, আমি জুমে যাচ্ছি সাত দিনের জন্য।
কেউ যদি তোমাকে ডাকে তাহলে বলে দেবে যে, ভাইয়া আমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। আমি বাইরে যেতে পারবনা।”
সকালে ভাই চলে গেল জুমের কাজ করতে। আর ওদিকে কাঠবিড়ালী এসে দেখল যে, তার ঘরে সেই কিশোরী নেই। কাঠবিড়ালী রেগে গেল এবং কিশোরীকে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পেল তার আসল ভাইয়ের বাড়ীতে।
ঘরের বারান্দা থেকে কাঠবিড়ালী কিশোরীকে ডাকল। তখন কিশোরী বলল,“ভাইয়া, আমাকে সাতদিন পর্যন্ত বের হতে নিষেধ করেছে। তাই আমি বাইরে আসতে পারব না।” কিশোরী দরজা খুলছে না দেখে কাঠবিড়ালী দা নিয়ে সব ভেঙ্গে ফেলল এবং তাকে খাল থেকে পানি আনতে বলল।
তখন কিশোরী বলল, “না আমি যাব না। ভাইয়া সাত দিনের জন্য পানি তুলে রেখে দিয়ে গেছে। আর সাত দিন পর্যন্ত ভাইয়া আমাকে পানি তুলতেও নিষেধ করেছে। পানি গায়ে লাগলে না-কি আমি মাটি হয়ে যাব।”
তখন চালাক কাঠবিড়ালী পানি রাখার লাউ-এর খোলসগুলো সব ছিদ্র করে ফেলল এবং বলল, “দেখ, কোনটাতেই পানি নেই।” তখন কিশোরী পানি আনতে রাজী হল। দু’জনে পানি আনতে গেল।
খালে গিয়ে যখন কিশোরী পানি স্পর্শ করলো সঙ্গে সঙ্গে মাটি হয়ে গেল। সে জায়গায় ফুটে উঠল একটা দোলন চাঁপা। আর কাঠবিড়ালীও লেজ উঁচিয়ে পালিয়ে গেল।
লেখক: তুমপিয় ম্রো
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।