ম্রো রূপকথা: মিন হন কুই (বিড়াল ও কুকুর)
849
অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক ধনী রাজা। রাজার বহু ধন-সম্পদ ছিল। তার রাজ্যে কোন অভাব ও দুঃখ ছিল না। রাজ্যে সব সময় সুখ-সমৃদ্ধি ছিল। রাজা প্রায় সময় দিগ্বিজয়ের জন্য বেড়িয়ে যেতো।
এ সুযোগে এক ভন্ড সন্ন্যাসী রাজ্যে ভিক্ষা করতে আসত। এক সময় রাণীর সাথে তার গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠল। রাজা অনুপস্থিত থাকলেই সন্ন্যাসী রাজ দরবারে আসত এবং রাণীর নিকট হতে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান দ্রব্যাদি খুঁজত আর রাণীও নির্দ্বিধায় দিয়ে দিতো সুযোগ পেয়ে সন্ন্যাসীর দিনের পর দিন লোভ বেড়ে গেলো।
একদিন সন্ন্যাসী রাজার সুরক্ষিত হীরের টুকরো রাণীর নিকট হতে চাইলো। না ভেবে-চিন্তে রাণীও হীরের টুকরো ভন্ড সন্ন্যাসীর হস্তে সঁপে দিলো।
সন্ন্যাসী হীরের টুকরো পেয়ে মহানন্দে চলে গেলো। তখন থেকে তার আর কোন হদিস পাওয়া গেলো না। হীরের টুকরো পাওয়ার পর থেকে সন্ন্যাসী উধাও হয়ে গেলো।
রাণী সন্ন্যাসীকে হীরের টুকরো সঁপে দেওয়ার পর থেকে রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টি হতে শুরু করল। দিনে দিনে রাজ্যে খুন-রাহাজানি, মহামারী, ডাকাতি ইত্যাদি নানা ধরনের কু-কর্ম শুরু হল।
রাজ্যের ভান্ডারে সম্পত্তিও দিনে দিনে শেষ হতে লাগলা। রাজা কিছু বুঝতে পারল না। নিরূপায় হয়ে পড়ল। কোন উপায় না দেখে রাজ্যের এক পাল হাতি বিক্রি করল।
এক মাস কোন রকম সংসার সামলাতে পারল। অতঃপর আবার এক পাল ঘোড়া বিক্রি করল। মাস শেষ হতে না হতেই টাকা ফুরিয়ে গেল। রাজা আবারও এক পাল মেশ বিক্রি করল।
এভাবে তার যত পোষা প্রাণী আছে, একের পর এক বিক্রি করতে লাগল। তবুও তাদের তিনবার আহারের ব্যবস্থা হল না। শুধু রয়ে গেল একটা বিড়াল ও একটা কুকুর।
গৃহকর্তার এহেন অবস্থা দেখে বিড়াল খুবই দুঃখ ও কষ্ট পেলো। সে কুকুরকে ডেকে বললো, “কুকুর ভাই, বর্তমানে গৃহ কর্তার (রাজা) অবস্থা খুব শোচনীয়।
আমি দিনে দিনে সব উপলব্ধি করে দেখেছি। যত পোষা প্রাণী আছে, হাতি থেকে শুরু করে সব বিক্রি করে ফেলেছে। বর্তমানে শুধু বাকী আছি তুমি আর আমি। হয়তো আজ না হয় কাল আমাদেরকেও বিক্রি করে ফেলবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই।
দুই-তিন টাকা পেলেও বা মন্দ কি। আমিতো এ প্রাসাদ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাই না। তুমি কি তা চাও?” কুকুর উত্তর দিল, “আমিও এ প্রাসাদ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাই না, বিড়াল ভাই।”
বিড়াল বললো, “তাহলে চলো না রাজার কেন এ অবস্থা হলো তা আমরা পরখ করে দেখি।” “কিভাবে পরখ করবো”? প্রশ্ন করলো কুকুর।
বিড়াল বললো, “তাহলে চল হিমালয় চূড়ায়। আমরা সেখানে একরাত ঘুমাবো। তাহলে মহারাজের দুর্দশা সম্পর্কে আমরা স্বপ্নে দেখতে পাবো।” বিড়ালের কথা মত তারা সেখানে ঘুমাতে গেল।
পরদিন সকালে বিড়াল কুকুরকে জিজ্ঞাস করল, “কুকুর ভাই, স্বপ্নে তুমি কি দেখেছো?” কুকুর এতক্ষণে হাই তুলতে তুলতে জবাব দিলো, “স্বপ্নে আমি প্রচুর খাবার দেখেছি। মহারাজা আমাদেরকে অন্যত্র বিক্রি করলেও আমার মনে হয় আমাদের খাবার অভাব হবে না।” আসলে কুকুর স্বপ্নে কিছুই দেখেনি।
এমনি বিড়ালকে সে মিথ্যা বলেছে। বিড়াল বিরক্ত হয়ে তার স্বপ্ন বলে দিল, “স্বপ্নে আমি মহারাজের দুরবস্থাগুলো সব দেখে ফেলেছি। তুমি ভাল করে শোন। এককালে রাণীর সন্ন্যাসীর সাথে গোপন সম্পর্ক ছিলো।
তখন তিনি রাজ্যের ভান্ডার থেকে হীরের টুকরোটা সন্ন্যাসীকে বিশ্বাস করে দিয়ে ফেলেছেন। তখন থেকে রাজার গরীব হওয়া ও রাজ্যে নানা ধরনের অশান্তির সূত্রপাত ঘটে।” বিড়ালের কথা শেষ হতে না হতেই কুকুর প্রশ্ন করলো, “তাহলে কি করা যায়, বিড়াল ভাই ?”
ধীরে-সুস্থে বিড়াল উত্তর দিল, “আমি আরও স্বপ্নে দেখেছি যে, সন্ন্যাসী ঘুমাবার সময় হীরের টুকরো মুখের গহ্বরে পুরে ঘুমায়। এই ঘুমের অবস্থায় জ্যান্ত সাদা ইদুরের লেজ যদি তার নাকে ঢুকাতে পারি তাহলে সে যখন হেঁচকি ছাড়বে তখন মুখ থেকে হীরের টুকরো পড়ে যাবে।
এভাবে আবার আমরা মহারাজকে হীরের টুকরো ফিরিয়ে দিতে পারবো। তাহলে আবার রাজ্যে পূর্বেকার অবস্থা ফিরে আসবে।” “তাহলে আমরা কোথায় সাদা ইঁদুর পাব?” পুনরায় কুকুর প্রশ্ন করে।
বিড়াল আবার উত্তর দিল, “আমি স্বপ্নে সাদা ইঁদুরের গর্তও দেখতে পেয়েছি। গর্তটা নীল সাগরের পাড়ে আছে। গর্তে শুধু তিনটা সাদা ইদুর বাস করে।”
তারা নীল সাগরের পাড়ে গিয়ে সত্যি সাদা ইঁদুরের গর্ত দেখতে পেলো। বিড়াল ইঁদুর তাড়াবার জন্য কুকুরকে গর্তে ঢুকতে বলল। কিন্তু ইঁদুরের ভয়ে কুকুর গর্তে ঢুকতে নারাজ।
মনে মনে বিড়ালের কুকুরের প্রতি রাগ হলো এবং জ্যান্ত ইঁদুর ধরবার পরামর্শ দিয়ে সে গর্তে ঢুকলো এবং সে দেখতে পেলো তার স্বপ্নের মত সত্যিই তিনটি ইদুর। খুশীতে তার মন ভরে গেল।
বিড়ালের ভয়ে ইঁদুর গর্ত হতে বেরিয়ে আসলো। অমনি কুকুর এক কামড় বসিয়ে দিল ইঁদুরের গায়ে। সঙ্গে সঙ্গেই ইদুর মারা গেলো। ইঁদুরকে জীবন্ত অবস্থায় ধরতে পেরেছে কি-না তা’বিড়াল গর্তের ভিতর থেকে কুকুরকে জিজ্ঞাস করল।
উত্তরে কুকুর বললো, “আমি সত্যি ধরতে পেরেছিলাম। তবে আমার কামড়ে ইঁদুর মারা গেছে।” বিড়াল আবার ইদুর তাড়াতে শুরু করলো। আবারও গর্ত থেকে ইদুর বের হওয়ার সাথে সাথেই কুকুর মেরে ফেললো।
বিড়াল ইঁদুরের গর্ত হতে বেরিয়ে এলো এবং কুকুরের অপারগতা দেখে খুব রাগ হল। কুকুরকে গর্তে ইঁদুর তাড়াবার জন্য ঢুকতে বলল।
কুকুর কোন উপায় না দেখে ভয় হওয়া সত্ত্বেও গর্তে ঢুকলো এবং ভয়ে হৈ চৈ করতে করতে ইঁদুর তাড়াতে লাগলো। ইঁদুর বাহির হওয়ার সাথে সাথে বিড়াল ধরে ফেললো।
জীবন্ত ইদুর নিয়ে তারা ভন্ড সন্ন্যাসীর গৃহে গেলো এবং দেখতে পেলো সন্ন্যাসীর মুখ হতে হীরের টুকরো জ্বল জ্বল করছে। সমস্ত ঘর আলোকিত হয়ে গেলো। তখন সন্ন্যাসী অঘোর ঘুমে অচেতন।
বিড়াল জীবন্ত সাদা ইঁদুর নিয়ে আস্তে আস্তে সন্ন্যাসীর নাকের কাছে গেলো এবং কুকুরও সন্ন্যাসীর সামনে গেলো। বিড়াল নিকটে যেয়ে ইদুরের লেজ দিয়ে সন্ন্যাসীর নাকের ভেতর রগড়াতেই সন্ন্যাসী চমকে উঠে এক হাঁচি দিলো।
তাতে মুখ থেকে হীরের টুকরো বেরিয়ে মেঝে পড়ে গেলো। কুকুর বিলম্ব না করে মুখে তুলে নিয়ে দুজনে তাড়াতাড়ি দৌড় দিলো। কিছুদূর তাদের পেছন পেছন সন্ন্যাসীও লাঠি নিয়ে ছুটে আসলো। কিন্তু তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে অবশেষে সন্ন্যাসী হেরে গেলো।
তারপর তারা হাঁটতে হাঁটতে একটা খাল পাড়ি দিল। তখনও হীরের টুকরো কুকুরের মুখে ছিলো। খাল পাড়ি দেওয়ার সময় বিড়াল কুকুরকে একটু তো ষামোদ করে বললো, “ওহ্ কুকুর ভাই, তোমাকে তো আজ মহারাজ সোনার প্লেটে ভাত খাওয়াবে আর আমাকে তো ভাঙ্গা ময়লা প্লেট দিয়ে খাওয়াবে,” এ বলে বিড়াল হি-হি-হি করে মৃদু হাসলো।
কুকুর বিড়ালের কথায় খুশী হয়ে হা-হা-হা করে হাসতে লাগলো। অমনি তার মুখ থেকে হীরের টুকরো পানিতে পড়ে গেলো।
আবার তারা সুসপ্লের আশায় হিমালয়ের চূড়ায় গেলো। পরদিন সকালে বিড়াল আবার তার দেখা স্বপ্ন কুকুরকে বলে দিলো, “হীরের টুকরো কাতাল মাছ গিলে ফেলেছে। বর্তমানে কাতাল মাছের পেটে আছে। তবে আগামী কাল জেলেরা মাছ ধরতে আসবে।
যখন তারা বাজারে মাছ বিক্রি করবে তখন কাতাল মাছের পেট থেকে হীরের টুকরো পাবে এবং তারা একের অন্যের হাতে দেবে পরখ করবার জন্য। তখন আমি জেলের হাতে থাবা মারব আর তুমি তখন তা ধরে ফেলবে।
এ পথ যদি আমরা অবলম্বন করতে পারি তাহলে আবার আমরা হীরের টুকরো পেয়ে যেতে পারি।” কুকুর তা ভাল করে মন দিয়ে শ্রবণ করলো।
পরদিন তারা বাজারে গেলো এবং সত্যিই বিড়ালের স্বপ্নের মতো হীরের টুকরো জেলেরা একের পর এক অবাক হয়ে পরীক্ষা করছে। বিড়াল এমন সময় জেলের হাতে এক থাবা বসিয়ে দিলো।
বিড়ালের থাবার যন্ত্রণায় জেলের হাত থেকে হীরের টুকরো মাটিতে পড়ে গেলো। কুকুর তাড়াতাড়ি মুখে পুরে দিয়ে দৌড় দিল। বাজারে হৈ চৈ রোল পড়ে গেল। ততক্ষণে দুই বন্ধু উধাও হয়ে গেলো।
কিছুদূর যেতে বিড়াল কুকুরের নিকট হতে হীরের টুকরো নিয়ে ফেললো। যেতে যেতে আবারও আগের খাল পাড়ি দিতে হল। এবার কুকুর বিড়ালকে তোষামোদ করতে শুরু করলো। কিন্তু বিড়াল একটুও হাসলো না। রাজদরবারে তাদের পৌছাতে রাত হয়ে গেলো।
অপর দিকে রাজ্যের অশান্তি হওয়ার রহস্য পরীক্ষা করবার জন্য রাজা একজন জ্যোতিষী আনল। জ্যোতিষী গণনা করে দেখলো যে, রাণীর সাথে সন্ন্যাসীর গোপন সম্পর্ক ছিল।
তখন তিনি হীরের টুকরো সন্ন্যাসীকে দিয়ে ফেলেছে। যার ফলে বর্তমান রাজার এ’অবস্থা। রাজা রাগান্বিত হয়ে রাণীকে দ্বীপান্তর করার জন্য প্রস্তুতি নিল। এক বছর চলার মত খাবার ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নৌকায় সজ্জিত করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিল।
রাণীর বিদায় সমাপ্ত হওয়ার পর পরই বিড়াল ও কুকুর রাজদরবারে এসে উপস্থিত হলো এবং হীরের টুকরো রাজার হাতে তুলে দিল। রাজা খুব খুশী হলো। সত্যি বিড়ালকে সোনার প্লেটে আর কুকুরকে রূপোর প্লেটে ভাত খাওয়ালো।
কুকুর খুশী হয়ে বিড়ালের দিকে একটু একটু চোখ ফিরিয়ে হাসলো। রাজা আবার হারানো সম্পদ ফিরে পেল এবং আবার আগের মত সুখে শান্তিতে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগল।
লেখকঃ সিং ইয়ং মুরুং
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।