যৌতুক, দাভা, কর্ণওয়ালিশ ও আমরা

Jumjournal
Last updated Aug 31st, 2021

1594

featured image

শিরোনাম থেকে হয়তোবা ভাবছেন এখানে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কেন! আপনার মনে হতে পারে “যৌতুক” যখন দেখছি তখন হবে হয়ত বিয়ের দেনা পাওনার লেখাই। তবে কর্ণওয়ালিশ কেন?

আবার অনেকে বিশেষ করে যারা আমার বয়সী বা আমার চেয়ে বয়সে ছোট তারা হয়তোবা যৌতুককে চিনতে পারলেও দাভাকে চেনেন নি। তো জানবই বা কেমন করে আমরা তো এখনও বিয়ে করি নি।

এখনও ছোট! “দাভা” যেহেতু বিয়ে সংশ্লিষ্ট শব্দ, আগে বিয়ের অভিজ্ঞতা হোক তারপর দেখা যাবে “দাভা” কী? তো একটি কথা জেনে রাখুন আপনার এই “যৌতুক” শব্দটি চিনতে পারার জন্য কিন্তু লর্ড কর্ণওয়ালিশ সাহেবের একটু হাত রয়েছে।

সেজন্যই সাহেবকে এখানে আনা। ব্যাপারটা পরে খোলাশা করা যাবে। যা ধরেছেন তাই, মূলত বিয়ে সম্পর্কিত দেনা পাওনা নিয়েই একটু কথা বলব। তবে এই বিষয়টি লেখার পেছনে একটা কারণ আছে। এখন বিয়ের ধুম চলছে। পাক্কা বিয়ের মৌসুম।

তবে এর কারণগুলো কালজনিত নাকি ধর্মীয়, সেদিকে আমি যাচ্ছি না। তো এই বিয়ের মৌসুমে অনেককে বললাম ওমুক ওমুকের বিয়েতে কত বা কি কি পরিমাণ “দাভা” ধরা হয়েছে।

উত্তর খুব কমই যথাযথভাবে দিতে পেরেছে, অনেকেই তো জানেই না। বিয়ের দেনা  পাওনা সম্পর্কিত মনে করাতেই কর্ণওয়ালিশ এর সৌজন্যে সবাই “যৌতুক”-ই বলতে পেরেছে। আবার অনেকের কাছে দাভা মানেই যৌতুক।

আমিও খুব বেশি বলতে পারি নি কারণ আমি কিছুটা জানতাম বটে তবে পুরোপুরি নয়। তারপর আমি “দাভা” কে খুঁজতে বেরোলাম এবং কিছু তথ্য আমার মস্তিস্কে জমা করতে সমর্থ হলাম।

আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করতেই আমার এই লেখা। তো দেখি আমাদেরটা “যৌতুক” নাকি অন্য কিছু। সাহিত্যের ঢং এ একটু সমাজকে, যুক্তিকে দেখি, হয়ত ইতিহাসকেও।

প্রায়ই টিভিতে, পত্রিকায়, রিক্সায়, দেওয়ালে যৌতুকবিরোধী বিজ্ঞাপন দেখা যায়। আর পত্রিকায় তো যৌতুকের কারণে গৃহবধূদের নির্যাতন, মৃত্যুর খবর হরহামেশা দেখা যায়। এজন্যই মনে হয় বিয়ের দেনা-পাওনার ব্যাপারে কথা উঠতেই আমরা সবাই “যৌতুক”-ই উত্তর দিয়েছি কারন “যৌতুক” শব্দটি আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত।

আমাদের নিজস্ব মিডিয়া না থাকায় বা থাকলেও শক্তিশালী না হওয়ায় এবং পাঠ্যপুস্তকে এ ব্যাপারে যথাযথভাবে জানানো হয় না বলে আমরা কী বলি তা সঠিকভাবে জানি না।

এখন যৌতুক নামক প্রথাটি বাঙালি সমাজে “অপপ্রথা” বা “সামাজিক ব্যাধি”-তে রুপান্তরিত হয়েছে। তাই পত্রিকায় খবরাখবর দেখা যায়। এমনকি এই যৌতুককে রুখতে আইন ও বিদ্যমান রয়েছে।

আর এই যৌতুক বা বিয়েতে দেনা-পাওনার ব্যাপারটা থেকে নারীদের অধিকার বা সামাজিক অবস্থান কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা করা যায়। তাই আমি আসলে এই লেখায় দেখাতে চাইব বাঙালি বাদে বাংলাদেশে যে সকল জাতিসমূহ বসবাস করে তাদের মধ্যে চাকমাদের বিয়ের দেনা-পাওনা বা “দাভা” এর পরিস্থিতি। সেই সাথে নারীদের সামাজিক অবস্থান।

বর্তমানে যৌতুক সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হলেও আমরা সবাই জানি যে যৌতুক এর প্রকৃত ধারণাটি, নারীর সম্পত্তির অধিকারকে এবং সামাজিক সুরক্ষাকে নিশ্চিত করে।

আর লর্ড কর্নওয়ালিশ এর দায় এখানেই যিনি এটাকে ব্যাধিতে রুপান্তরিত করেছেন! এ প্রসঙ্গে পরে আসি।

তো প্রশ্ন হল “দাভা”-কে খোঁজাখুঁজির সংগ্রাম। যে সংগ্রামের হাতিয়ার তথ্য (বই)। তাই “দাভা”-কে খুঁজতে গিয়ে প্রথমে কিছু বই যোগাড় করি। যেসব বই পেয়েছি সেসব বইয়ে কোথাও খুঁব নিখুঁতভাবে এর উৎপত্তির ব্যাপারে তথ্য পাই নি।

দেখলাম শুধু প্রথাগুলো কীভাবে লালন-পালন করতে হয় তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তবে সেগুলো বাদে ও অন্যান্য বই থাকতে পারে যেগুলোর হদিস আমি পাই নি। তাই উইকিপিডিয়ায় ঢুঁ মারলাম। দেখেন, কী পেলাম।

(১) নৃবিজ্ঞানী গুডির মতে যৌতুক হচ্ছে উত্ত্বরাধিকার প্রদানের আরেক রুপ। এটা সাধারণত দেখা যায় সেইসব দেশে বা সমাজে যেখানে ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই উত্ত্বরাধিকার প্রাপ্ত হয়।

তিনি মূলত ইউরেশিয়ান (জাপান টু আয়াল্যান্ড) সমাজের উপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যেখানে বিয়ের সময় মেয়েকে তার “উত্তরাধিকার” হিসেবে সম্পত্তির প্রাপ্র্য অংশ বুঝিয়ে দেয়া হয়।

আবার তার মতে জুমকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থাতে বেশির ভাগ কাজ নারীরা সম্পাদন করে থাকেন। তাই এইসব সমাজ ব্যবস্থায় একজন বিবাহযোগ্য যুবতী মেয়ে একজন দক্ষ শ্রমিক ও বটে।

এমনকি সে দক্ষ শ্রমিক বিয়ের পর, বরের বাড়িতেও। তাই বরের পরিবার শ্রমিক কিনে নেওয়ার জন্য কনের পরিবারকে টাকা বা সেই পরিমাণ অন্য কিছু দিয়ে থাকে যেটাকে তিনি কনেমূল্য প্রথা নাম দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেছেন, যে সকল সমাজে সম্পত্তির মালিকানা বাবা থেকে ছেলে বা মা থেকে কন্যায় উত্তরাধিকার হিসেবে প্রদান করা হয় সেই সমাজে ও “কনেমূল্য” প্রথা দেখা যায়। এটা হতে পারে যে, বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যেখানে সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলেরা পায় এবং তাদেরকে “বংশের ধারক” বলে ধরা হয়।

এসব সমাজে মেয়েদেরকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। সেজন্যই মনে হয় তাদেরকে শুধু “শ্রমিক” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

(২) তবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশ হলেও ভুটানে কিন্তু যৌতুক প্রথা প্রচলিত নয়। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা জাতিগোষ্ঠীর সমাজে ও “যৌতুক” বা “কনেমূল্য” কোনটার অস্তিত্ব নেই।

তাছাড়াও সব জায়গায় “উত্তরাধিকার” সূত্রে “যৌতুক” দেয়া হয় না। অর্থাৎ জায়গা বা সময় ভেদে গুডি তত্ত্বের বিভিন্নতা থাকতে পারে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, আগে যৌতুক দেওয়া হয়েছিল মেয়ের প্রাপ্র্য সম্পত্তি হিসেবে যাতে করে সে বিয়ের পরও স্বাবলম্বী এবং আত্ননির্ভরশীল এককথায় তার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।

অপরদিকে “কনেমূল্য” প্রথায় একজন মেয়েকে শুধুমাত্র একজন সবল ও দক্ষ শ্রমিক হিসেবে একপক্ষ থেকে আরেক পক্ষে স্থানান্তরিত হতে হয় বলে একজন মানুষ হিসেবে সে তার পর্যাপ্ত অধিকার পায় না।

কিন্তু কী থেকে কি হয়ে গেল! তবে আমার এই তত্ত্বের বিশ্লেষণ ভুল ও হতে পারে কারণ আমি একজন ছাত্র মাত্র, সমাজবিজ্ঞানী বা নৃবিজ্ঞানী নয়। ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী।

(৩) চাকমা সমাজে মূলত কনেমূল্য প্রথাই প্রচলিত যেটাকে “দাভা” বা “ধরাবানা” বলা হয়। আমি অবশ্য আমাদের দাভাকে গুডির তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা না করে কিছুটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।

সাধারণত আমাদের সমাজের বিয়েতে বর-কনের বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন মিলে, কনের পরিবারের সাথে পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে, বর এবং কনের পরিবারের আথির্ক দিক বিবেচনা করে “দাভা” নির্ধারণ করে থাকে।

“দাভা”-র সাথে অবশ্য মেয়েকে দুধ খাইয়ে বড় করার সম্মান স্বরুপ মেয়ের মাকে দুধের মূল্য দিতে হয়। দাদিকে দিতে হয় ছোটকালে দোলনায় দোল খাইয়ে লালন-পালনের টাকা এবং ভাই-বোনদের দিতে হয় ছোটকালে লালন-পালনের সম্মানিক মূল্য।

উৎপত্তিটা গুডি অনুসারে হলেও হতে পারে তবে বর্তমানে যা দেখি তাতে আমার মনে হয়, মূলত বিয়ের আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর জন্যই কনের পরিবার বরের পরিবারের কাছ থেকে দাভা নিয়ে থাকে।

প্রথাগতভাবে সাধারণত বিয়েতে আমাদের সমাজে কনে পক্ষ থেকে কনের জন্য কাপড় চোপড় (পিনন-হাদি), গলার, কানের, নাকের, হাতের, পায়ের অলঙ্কারসহ টাকা, মদ, চাল, শুকর ইত্যাদি দাবি করা হয় এবং বরের পক্ষ  থেকে সাধ্যানুযায়ী দাবি পূরণের অঙ্গীকার করে একটি মৌখিক চুক্তি হয়।

চুক্তি মোতাবেক দাভা ও অন্যান্য জিনিসপত্র অবশ্যই বিয়ের আগে কনের পরিবারকে সম্প্রদান করতে হয়। আর সাধারণত কণে সম্ভ্রান্ত বা ধনী পরিবারের হলে তাকে কোন “দাভা” দিতে হয় না।

তাই এটাকে সহযোগিতা চুক্তি ও বলা যেতে পারে। তবে মেয়ের অলঙ্কার এখানে দাভা বলে গন্য হয় না যদি না দামি ধাতু (সোনা) দাবি করা না হয়।

(৪) শ্রী সতীশচন্দ্র ঘোষ এর তথ্য অনুযায়ী “দাভা”-র পরিমাণ ৫০/৬০ তোলা রম্নপার গহনা এবং ১০০/১২০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

(৫) আবার বঙ্কিম চন্দ্র চাকমার তথ্য অনুযায়ী “দাভা”-র টাকার পরিমাণ ৫ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে এবং বিয়ের খাওয়া-দাওয়ায় কত মণ চাল লাগতে পারে সেই হিসেব করে চাল ধার্য করা হয়ে থাকে। যদি কনে পক্ষ অবস্থাসম্পন্ন হয় তাহলে নামমাত্র পরিমাণ টাকা “দাভা” নির্ধারণ করা হয়।

বর্তমানে তো শুধুমাত্র প্রথা পালনের জন্য নামমাত্র “দাভা” ধরা হয়ে থাকে। আর শহরে তো শুধু কনেকে সাজিয়ে দেওয়ার অলঙ্কারগুলো দিলেই হয়। এজন্যই “দাভা”-কে পুরোপুরি কনেমূল্য প্রথা না বলে “সহযোগিতা চুক্তি”-ও বলা যেতে পারে।

তবে অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা বিভিন্ন কারণে মেয়েকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ার মত অবস্থা হলে তখন কনে পক্ষ থেকে এমনভাবে “দাভা” ধরা হয় যাতে বরপক্ষ দিতে অপারগ হয় বা দিতে অসমর্থ হয়।

এইখানে ও সামাজিক বাস্তবতার কারণসমূহ আছে যদিও আমি সে ব্যাপারে বিশ্লেষণে যাচ্ছি না। সাধারণত এটা করার পেছনে প্রকৃত উদ্দশ্য থাকে যাতে বিয়েটা না হয়।

প্রকৃতপক্ষে এধরনের ঘটনা ঘটার হার খুবই কম। এবার দেখা যাক, আমাদের সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, উপাখ্যানে কীভাবে “দাভা”-কে উপস্থাপন করা হয়েছে।

(৬) “রাধামন-ধনপুদি” পালাতে আমরা দেখতে পাই ধনপুদির মা কপুদি (হপুদি) ও তার বাবা নীলগিরি আদিচরণ নামক এক যুবকের সাথে ধনপুদির বিয়ে ঠিক করে। যদিও এই বিয়ে শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন হয় নি।

বিয়েতে ধনপুদির বাবা-মা, আদিচরণের বাবা ধনীরামের কাছে দুই কুড়ি (১২০) টাকা, সাত কলসি মদ, একটা নয় মুত্ত্যা শুকর “দাভা” হিসেবে দাবি করে। এছাড়া ধনপুদির জন্য অলঙ্কার দাবি করা হয়।

ধনীরাম সব দিতে রাজি হওয়ায় বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করা হয়। কিন্তু বিয়েতে ইচ্ছা না থাকায় ধনপুদি বিয়ের দিন “চুঙুলাং” পূজার জন্য কলসী নিয়ে পানি আনতে গেলে জলপূর্ণ করে তাদের বাড়ীতে না ফিরে কলসিসহ রাধামনের বাড়ীতে গিয়ে উঠলো।

ফলে বিয়েটা পন্ড হয়ে যায়। পরে রাধামনের বাবা জয়মঙ্গল ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিয়েতে “দাভা” সহ আদিচরণের বাবার যত টাকা খরচ হয়েছে সব দিতে বাধ্য হয়।

(৭) “দাভা” জিনিসটা যে কী, তা আসলে সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে “তান্যাবী” বারমাসী অবলম্বণে নির্মীত চলচ্চিত্র “তান্যাবী ফিত্তি” এবং “দাভা” তে। এ এক গরীব গ্রামীণ সমাজের ছবি। তান্যাবীর পরিবার ছিল সমাজের আর দশটা পরিবারের মত সাধারণ গৃহ।

তারা চেয়েছিল তাদের মেয়েকে ভালো কোনো স্বচ্ছল গৃহস্তের বাড়ীতে বিয়ে দিতে। তাই বিয়ের প্রস্ত্মাব নিয়ে তান্যাবীর প্রেমিক পুনংচান যখন তান্যাবীর বাবা-মার কাছে যায় তখন তারা হাজার টাকা “দাভা” দাবি করে।

তারা জানত যে পুনংচানের পক্ষে এত টাকা দেয়া সম্ভব না। তারা অবশ্য বিয়ে দিতেও অপারগ ছিল। ফলে পুনংচান “দাভা”-র টাকা দিতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

আর তারা দুই হাজার টাকা, চার বস্তা চাল, দুইটা শুকর এবং সাজ-গোজের সকল অলঙ্কার “দাভা”-র বিনিময়ে হরিশচন্দ্র কার্বারির সাথে তান্যাবীর বিয়ে ঠিক করে। এখানে দাবার পরিমাণ বেশি হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণ ছিল।

“সুন্দরী” বলে তান্যাবীর বেশ নামডাক ছিল। তাই সুন্দরী বউ পাওয়ার জন্য হরিশচন্দ্র দাবিকৃত সব “দাভা” দিতে রাজি হয়। তান্ন্যাবীর বাবা-মা এখানে তান্যাবীর মতামতের তেমন একটা গুরত্ব না দিয়ে ধনীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং দাভা কে প্রাধান্য দেয়।

এটা একটা বাস্তবতা। সব মেয়ের বাবা-মাই মনে হয় চায় যে তাদের মেয়েকে পারতপক্ষে তাদের নিজেদের চাইতে স্বচ্ছল পরিবারে বিয়ে দিতে, কমপক্ষে তাদের সমপরিমাণ। আর এখানে দুটি স্বার্থ কাজ করতে পারে, এক.মেয়ের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, দুই. “দাভা”-র মাধ্যমে কিছু টাকা আদায় করা। আর তান্যাবী ফিত্তিতে তাই ঘটেছে।

এবার দৃষ্টি দেয়া যাক “দাভা” সংশিস্নষ্ট গানের দিকে। “ও গাবুরি যেই বেরেয়োই, ম গরান সেবাত্তেই – মুই এক্কান গর বানেয়োং তরে লোবাত্তেই – শ হুড়ি টেড়া দাবা দি, আদত-হানত সোনা দি – .. .. .. .. .. .. .. .. ..।”

এই চাকমা গানে একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদনের সময় “দাভা” প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করেছে। এই গানের মাধ্যমে এক যুবক মূলত এক যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং আহ্বান জানায় তার বাড়িটি দেখতে যাওয়ার জন্য এবং বলতে ভুলে না যে, সে তাকে হাতে-কানে সোনার অলঙ্কার এবং একশ কুড়ি টাকা “দাভা” দিয়ে নিয়ে যাবে। তাই “দাভা” প্রদান একজন যুবকের কাছে তার সামর্থ্যের প্রকাশও বটে।

এবার ফিরে আসি যৌতুক এর কাছে। ধরা যাক, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হল পুরোপুরিভাবে দুই দেশের বুদ্ধিজীবিদের, রাজনীতিবিদদের কথা মত। তাহলে বাংলাদেশের মানুষ হত সবাই বাঙালি মুসলিম।

(আমাদেরকে আপাতত উহ্য রাখুন কারণ দেশ বিভাগের সময় আমাদেরকে সেভাবে আমলে নেয়া হয়নি) আর পশ্চিমবঙ্গেও (ভারত) সবাই হতো বাঙালি হিন্দু। তখন বলা যেত হিন্দু বাঙালিরা একটা জিনিস ফেলে গেছে যেটা মুসলিম বাঙালিদের “ব্যাধি”-তে পরিণত হয়েছে।

(৮) কারণ বাঙালি সমাজে যৌতুক এর উৎপত্তি হিন্দু সমাজের মাধ্যমে। বাংলাপিডিয়া এবং আরও অনেক তথ্যকোষের কাছ থেকে সেটাই জানতে পারলাম।

তবে ইতিহাস ঘাটলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে তাদের সবাই একই ঘাটের লোক ছিল। তা যদি হয়ও তারপরও বাঙালি হিন্দুদের দোষারোপ করা যাবে না।

(৯) কারণ তারা যৌতুক হিসেবে দিত “জমি” বা “সম্পত্তি” যাতে করে তাদের মেয়েটি বিয়ের পরও আত্ননিয়ন্ত্রন করতে পারে। আবার প্রাচীন ভারতে মেয়েদের অবস্থান কখনো খারাপ তো ছিলই না উল্টো পুরুষদের চেয়ে ভাল ছিল।

“স্বয়ংবর” নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মেয়েরা বিভিন্ন প্রতিযোতিায় উর্ত্তীর্ণ হওয়া ছেলেদের মধ্যে থেকে একজনকে বর হিসেবে বেছে নিতে পারত। কিন্তু ছেলেদের “স্বয়ংবধূ” করার অধিকার ছিল না।

আবার হিন্দুদের ধর্মে ও পুরুষ দেবতাদের চেয়ে নারী দেবতারা বেশি শক্তিশালী। স্বরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী, ব্রহ্মা নন তেমনি লক্ষ্মী হলেন সম্পদের দেবী বিষ্ণু নন, আবার দুর্গা হলেন শক্তির দেবী, শিব নন।

অর্থাৎ এর পেছনে ধর্মের দায় থাকার কথা না। তাহলে দায়ী কে বা যৌতুক আদায় করা শুরু হল কি কারণে? যৌতুককে ব্যাধিতে পরিণত করল কারা, কীভাবে? আর এখানেই দোষ লর্ড সাহেবের।

১৭৯৩ সালে তার চালু করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতি এখানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এ নীতির মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির স্থায়ী মালিকানা নিশ্চিত করা হল।

কিন্তু ব্রিটিশদের অধীনে নারীদের সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার সুযোগ না থাকায় এ নীতি সমাজে বিরুপ প্রভাব ফেলল। এ নীতি চালু হওয়ার আগে মেয়ের সুখের (অধিকারের) কথা চিন্তা করে মেয়ের পরিবার মেয়েকে মৌখিকভাবে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিত কারন তখন পর্যন্ত কারো হাতে সম্পত্তির চিরস্থায়ী মালিকানা ছিল না।

কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে বিয়ের সময় জমির মালিকানা লিখে দিতে হল এবং মেয়েদের মালিকানাপ্রাপ্তির সুযোগ না থাকায় তা জামাইয়ের নামে লিখে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।

এভাবেই জামাইদের ক্রমে ক্রমে যৌতুক হিসেবে জমি বা দামী জিনিস পাওয়ার প্রত্যাশা বেড়ে গেল যেটা পরবর্তীতে স্থায়ী রীতিতে পরিণত হয়। তারপর আস্তে করে যখন নারীদের সামাজিক অবস্থান নড়েবড়ে হতে শুরু করল তখন একে একে মেয়েদের হাঁটা-চলা, চুল দেখা প্রভৃতি রীতিও চালু হল এবং যৌতুক প্রথারুপে প্রতিষ্ঠা পেল যা এখন একটা ব্যাধি এবং এর দায় পরোক্ষভাবে হলেও কর্ণওয়ালিশ বা ব্রিটিশ পলিসির ওপর বর্তায়।

তো এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এখানে কেন কর্ণওয়ালিশ সাহেবকে টেনে আনা হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জাতিসমূহের ব্যাপারে লিখতে পারলাম না। সময় এবং জ্ঞান দুটোরই পর্যাপ্ত অভাব আছে।

তবুও যদি জানতে চান তাহলে সুগত চাকমার সম্পাদনায় “পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় উৎসব ও বিবাহ” বইটি দেখতে পারেন। কিছু তথ্য পেয়ে ও যেতে পারেন। এই যৌতুক, দাভা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে একটা মজার তথ্য পেলাম যা আমি আগে জানতাম না।

(১০) তা হল ১৬৬১ সালে পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথেরিন ডি ব্র্যাগানজার সাথে ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস ২ এর বিয়েতে মুম্বাই শহরকে যৌতুক হিসেবে উপহার দেয়া হয়েছিল।

এটা জানার পর আমার মনে হল যে, ইশ! আমিও যদি এরকম তথ্য দিতে পারতাম, আমাদের রাজপরিবারের রাজারা বিয়ের “দাভা” হিসেবে ওমুক ওমুক “মৌজা” উপহার দিয়েছিলেন তাহলে আমার খুব ভাল লাগত।

জানার একটা সুযোগ হয়েছিল বটে কিন্তু কাজ হয় নি। কয়েকদিন আগে আমাদের রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় এর কাছে একটা ডকুমেন্টারির কাজে অর্ণব দার সাথে কাজ করতে গিয়েছিলাম।

উনার কাছে খুব জিজ্ঞেস করতে মন চাচ্ছিল উনি কি পরিমাণ বা কি কি দাভা দিয়েছিলেন। নিশ্চয় দাভাটা ও রাজকীয় হবে?! কিন্তু কিছুই জানতে পারিনি কাজের চাপে উনার সাথে কথা বলার সুযোগ না পাওয়ায়।

অবশ্য আমার ও সাহস হত কিনা সন্দেহ! জানতে পারলে বুঝতে পারতাম রাজ পরিবারের “দাভা”-র রুপ। যাক, দুঃখ করে লাভ নেই। দুঃখটা আমার যে আমি আপনাদেরকে সে তথ্য দিতে পারলাম না বলে। কোনদিন রাজ পরিবারের কাউকে পেলে জেনে নিয়েন।


লেখক: এডিট দেওয়ান, ঢাবি।

তথ্যসূত্র :

১। Bride price.

২। The bride’s dowry!

৩। সুগত চাকমা সম্পাদিত “পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় উৎসব ও বিবাহ” এবং অন্যান্য বই।

৪। শ্রী সতীশচন্দ্র ঘোষ, চাকমা জাতি।

৫। বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা, চাকমা সমাজ ও সংস্কৃতি।

৬। সুগত চাকমা সম্পাদিত “রাধামন-ধনপুদি”।

৭। “তান্ন্যাবী ফিত্তি” এবং “দাভা” (ফিল্ম)।

৮। Dowry.

৯। The Origin of Dowry System – British Policies convert Gifts to Bride into an instrument of oppression against women.

১০। History of Bombay under Portuguese rule (1534–1661).

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা