বরিশাল অঞ্চলের রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর ভূমি এবং সম্পদে অধিকারঃ বর্তমান প্রেক্ষিত ও করণীয়
3403
পূর্ণাঙ্গ জাতিসত্তার সমস্ত সত্তা ও শরীর নিয়ে রাখাইনরা এ দেশে বিন্যস্ত।
আপন জাতিগত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রেখে তারা বাংলার মাটিতে নতুন ভূমি চেতনায় ভাগ্যকূল মেনে সাজিয়ে তোলে জীবন-সংসার-সমাজ ১৭৮৪ সাল থেকে।
বাংলাদেশ একটি বহুজাতির বহু ভাষার বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র পূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙ্গালী জনগোষ্ঠি ছাড়া ও প্রায় ৩০ লক্ষ জনসংখ্যার ৪৫টির ও অধিক আদিবাসী স্মরনাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে।
মোট জনসংখ্যা কোথাও বলা হয় ১২ লাখ, কোথাও ১৮ লাখ, কোথাও বা বলা হয় ৩০ লাখ, কোথাও দেখানো হয় জাতিসংখ্যা ২৪, ২৫, ২৭ আবার কোথাও দেখানো হয় ৪৫ বা তার ও কম বেশী। রাষ্ট্র এখনও সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারে নি।
ভৌগলিক ভিন্নতায় দেশের সবগুলো অঞ্চলই বৈচিত্র্য ও বৈভবে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। এক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও আদিবাসীদের জীবনের মূল অবলম্বন ভূমি হারানোর বেদনা সব অঞ্চলেই এক।
আদিবাসীরা প্রকৃতিকে অনুভব করতে পারে, তারা বন ও সম্পদকে কোনোদিন বেচাকেনার বিষয় হিসেবে দেখে না, জীবনের অংশ হিসেবে দেখে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা বন, সম্পদ, প্রকৃতি সবকিছু ভোগ ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখে।
সমতল-পাহাড় এবং উপকূলে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত আদিবাসীদের জীবন সংগ্রামের কথা বিস্তারিত আলোচনায় আমরা না গিয়ে আজকে আমরা দেশের সর্বদক্ষিণ উপকূল অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইন জনগোষ্ঠীর নানা সমস্যার মাঝে ভূমি সমস্যার কথাই তুলে ধরব।
বাংলাদেশের “বরিশাল অঞ্চলের রাখাইনদের ভূমি এবং সম্পদে অধিকার: বর্তমান প্রেক্ষিত ও করণীয়” বিষয় নিয়ে আজকের আলাপ।
বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে সর্ব দক্ষিণে রয়েছে রাখাইনদের বসতি । ‘‘রাখাইন” শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘‘রক্ষা” শব্দ থেকে যার অর্থ হলো যে জনগোষ্ঠী নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। তবে রাখাইনদের প্রশ্ন এ রক্ষা কে করবে?
আজকের ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য হলো আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক প্রতিনিধি দল ও আদিবাসী ফোরাম কে বিষয়গুলো আবারো যৌক্তিকভাবে মনে করিয়ে দেয়া।
যাতে রাখাইনদের ভূমি সমস্যার ইতিবাচক সুরাহার উদ্যোগ তৈরী হয়।
ইতিহাসঃ
১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দে রাখাইনরা বরিশালের সর্ব দক্ষিণাঞ্চল উপকূলীয় এলাকায় পদার্পণের পূর্বে এলাকাটি জনমানবহীন হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল গভীর বনভূমি ছিল।
তদানিন্তন বৃটিশ সরকারের আনুকূল্যে এই অঞ্চলকে তারা চাষযোগ্য আবাদিভূমিতে রূপান্তর করে। যার দ্বারা যতটুকু ভূমি দখলে আসে সরকারীভাবে তা দখলীয় স্বত্বে মালিকানা সৃষ্টি করে দেয়া হয়।
ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার ও জি ই হার্ভের সমসাময়িক তথ্যেও পরিদৃষ্ট হয় ১৮ শতকের শেষপ্রান্তে ব্রিটিশ সরকার জঙ্গল পরিস্কার ও ভূমি পুনরুদ্ধারকল্পে রাখাইনদের সুন্দরবন অঞ্চলে পুনর্বাসিত করে।
বর্তমান পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী ও বরগুনায় এভাবে ধীরে ধীরে জঙ্গলাকীর্ণ উপকূলীয় পলিসঞ্চিত ভূমিতে রাখাইনরা বসতি বিস্তার করে।
রাখাইনদের দিয়ে বন-জঙ্গল পরিস্কার ও পতিত জমি আবাদে উৎসাহিত করার জন্যে ব্রিটিশ সরকার ভূমি আবাদকারীর প্রথাগত অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।
১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে বৃটিশ সরকার সর্বপ্রথম খেপুপাড়ায় একজন কলোনিজেশন অফিসার নিযুক্ত করেন। তখন সমগ্র কলোনিজেশন এলাকার নাম ছিল “দি বাখরগঞ্জ-সুন্দরবন কলোনিজেশন।” ঐ কলোনিজেশন এলাকায় প্রায় ২৩৭টি রাখাইন গ্রাম গড়ে উঠেছিল।
সেগুলোর প্রত্যেকটি ছিল নিজ হাতে জঙ্গল কেটে আবাদ করা জমির উপর। প্রথম জঙ্গল আবাদ করার পর বিনা খাজনায় পাঁচ থেকে দশ বছর চাষ করে ফসল ফলাতে পারত।
পরবর্তীকালে সি এস সেটেলমেন্ট নামে “সার্কেল সেটেলমেন্ট”-এর মাধ্যমে প্রথম দশ বছরের জন্য খাজনা ধার্য করা হয়।
ঐ সময় কালের মধ্যে অর্থাৎ ১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত সময়টা কলোনিজেশন এর স্বর্ণযুগ বলা যায়।
কারণ ঐ সময়ে রাখাইন জনগোষ্ঠীর প্রধানগণ এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার ও অবকাঠমোগত উন্নয়নের জন্য অনেক ঐতিহ্যময় বৌদ্ধ স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে এ অঞ্চলকে একটি সমৃদ্ধি সম্পন্ন রাখাইন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৪৫-১৯৫০ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সার্ভে ও সেন্টেলমেন্ট অপারেশনে এ অঞ্চলে ৮৫% রায়তদের (Tenure holder) অধীন এবং জেলার দক্ষিণ অঞ্চলে আবাদকারীরা (Tenure holder) অধিক বিদ্যমান ছিল।
১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে পটুয়াখালীর রাখাইনদের বাখেরগঞ্জের “মগ” অভিধায় আদিবাসীরূপে স্বীকার করে ভূমির হস্তান্তর বিষয়ে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে উক্ত আইনের ৯৭ ধারা সন্নিবেশ করা হয়।
বিভিন্ন নথি অনুযায়ী দেশের উপকূলে বসবাসরত ৯৯ ভাগ রাখাইন পরিবারই আজ ভূমিহীন। এই ভূমিহীনতার কাহিনী করুন এবং প্রশ্নহীন।
অথচ একটু পিছনে তাকালে দেখি, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে আদিবাসীদের মধ্যে ভূমিহীনের সংখ্যা ছিল শতকরা ২০-২৫ ভাগ, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯০ ভাগে।
রাখাইন জনগোষ্ঠী ভূমি জনিত নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিজের জমির রেকর্ড থাকা সত্তেও প্রভাবশালী শক্তিমান ভূমিগ্রাসী চক্র ক্রমাগতভাবে আদিবাসীদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছে জোঢ় করে।
জাল দলিল দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে, নানারকম মামলা দিয়ে সর্বশান্ত করা হচ্ছে।
এমনকি রাখাইনদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও করা হয়। এভাবে জমির মালিকানা থেকে দিন দিন রাখাইনদের নাম মুছে যাচ্ছে। বিকৃত হয়ে যাচ্ছে পাড়া/ গ্রামের নামকরণ ।
রাখাইনদের জমি শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি হয়ে গেছে। রাখাইনরা কখনও কখনও আইনের আশ্রয় নিয়েছে, মামলা করেছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালাতে গিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
সময়ের পরিবর্তন, কিছু বাঙ্গালী কর্তৃক জমি দখল, আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকা, ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতিক কাজে বাঁধাগ্রস্থ হওয়ার কারনে আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বরগুনা- পটুয়াখালীর রাখাইন জাতিসত্তা।
যদি অতীতের পরিসংখ্যান আমরা দেখি; ১৭৮৪-১৯০০ সালের দিকে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫০,০০০ এর উর্দ্ধে রাখাইনরা বসবাস করত। ১৯০০-১৯৪৮ সালে এই সংখ্যা হয় ৩৫,০০০। ১৯৯০সালে ৪০০০ জন।
২০১৪ কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (আইসিডিপি-রাখাইন) জরিপ অনুযায়ী অত্র উপকূলীয় অঞ্চলের রাখাইন জনসংখ্যা প্রায় ২৫৬১ ।
মোট ২৩৭ রাখাইন অধ্যুষিত পাড়া যার মধ্যে পটুয়াখালীর ১৪৪ টি(১৭৮৪-১৯৮৪) রাখাইন অধ্যুষিত পাড়া বা গ্রামের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৩২টি ( কলাপাড়া ২৮ + গলাচিপা ৪, ২০১৫ খ্রীঃ) গ্রাম এবং বরগুনার ৯৩ টি(১৭৮৪-১৯৮৪ খ্রীঃ) রাখাইন পাড়া বা গ্রামের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ১৩টি গ্রাম রয়েছে। প্রশ্ন আসে বিলিন/বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ১৯২ টি পাড়া বা গ্রামের ভিটা ও ঐ গ্রাম গুলোতে নাল জমি এখন কাদের দখলে?
যে ভূমিকে রাখাইনরা মনে করতো তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন, এখন সেই ভূমির অধিকার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে।
ভূমি না থাকলে কোথায় তারা উৎসব করবে, সামাজিক জীবন যাপন করবে? আদিবাসীদের নাচ-গান-উৎসব সব তো ভূমিকে কেন্দ্র করে।
তাদের উৎসবগুলো ঋতু ও ভূমিকে নিয়েই। ফসল ফলানোর জন্য জমি তৈরি করা, বীজ বোনা, ফসল তোলা, ফসলের ব্যবহার, বিয়ে, জন্ম-মৃত্যু-আনন্দ, এর বাইরে কোনো নৃত্য, কোনো গান নেই তাদের জীবনে।
ভূমিবিহীন আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণ অসম্ভব। আদিবাসীরা বলে, আমাদের নিকট থেকে ভূমি কেড়ে নেয়ার অর্থ হলো একটি বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে নেয়ার মত।
ভূমি নেই তো আনন্দ নেই, উৎসব নেই, সংস্কৃতি নেই। ভূমিহীন আদিবাসী সংস্কৃতিচর্চা করবে কোথায়, তার নৃত্য করার, কথা বলার, গান করার, মনের কথা বলার জায়গা কোথায়?
ভূমির এ এক করুন কথা
একটি জতি সত্তার এ এক ভিন্ন রকম সংকট ও বিপর্যায় –মানুষজাতির-শেষ ঠিকানা “শ্মশান” এর ভূমিটুকুও কেড়ে নিতে কুন্ঠাবোধ করছেনা ভূমিগ্রাসীরা! এ যেন মানবতার এক চরম বিপর্যয়।
উদাহরন স্বরূপ কলাপাড়া উপজেলার থনজুপাড়া ও মিশ্রীপাড়া, দিয়োর আমখোলা পাড়া, কালাচাঁন পাড়া, তুলাতলী, নয়াপাড়া-বাবলাতলা, সোনাপাড়া, চৈয়পাড়া, হাড়িপাড়া এবং এক কথায় একইভাবে উভয় উপজেলার (তালতলী ও কলাপাড়া) সবক’টি পাড়ার শ্মশান ভূমি দখল হচ্ছে।
দখল হয়ে যাচ্ছে কুয়াকাটার পর্যটন ও হোটেল মোটেলের নামে প্রত্মতাত্বিক নিদর্শন। কুয়াকাটা পর্যটন থেকে ১কিঃমিঃ উত্তরে বঙ্গবন্ধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত ১৯২৫ সালে নির্মিত বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ শয়নকৃত বুদ্ধ প্রতিকৃতি ও বিহার। রয়েছে ২৫০০ (দুই হাজার পাঁচশত বছর) বুদ্ধাব্দ পূর্র্তিস্তম্ভ।
এ সকল বর্তামনে রয়েছে মালিকানা কাটাতারের বেড়াজালে এবং বিহারের ৯৯ শতাংশের অধিক স্থানীয় পৌরভবনের প্রস্তাবিত ভবন নির্মানের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ।
উল্লেখ্য, সিএস, আর এস, এস এ রেকর্ডে উক্ত জায়গাটি দেবালয় হিসাবে উল্লেখ আছে।
ভূমি সংক্রান্ত মামলায় দীর্ঘ জটিলতার করুন উদাহরন।
কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের এই আইসিডিপি প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, মিসেস মাতেন (৪৮), পিতাঃ মৃতুঃ চোচিংলা, গ্রামঃ বর্তমান কেরানীপাড়া। যার মামলা নম্বর ডিসিআর ৭২৯(এম) ৫৯-৬০।
উক্ত মামলায় প্রজন্ম ক্রমে দীর্ঘ ৬০ বছর পর ২০১০ সালে এসে তা নিস্পত্তি হয়।
গ্রামঃ আগাঠাকুর পাড়া (বর্তমানে মিঃ খেনমংলা চালাচ্ছেন) ১ম মামলা নং ৭৬/৪৬। প্রাথমিক রায় ডিক্রি পাওয়ার পরও ভুয়া/জাল চুক্তিপত্র/ নিলাম দেখিয়ে দখল নেয়। পুনরায় মামলা; এভাবে এই জমির মামলা এখনও চলমান।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬২ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কলাপাড়া ও আমতলী ভূমি অফিসের নথিপত্র ভাসিয়ে নিয়ে যায়/নষ্ট হয়।
রাখাইন কর্তৃক নিয়মিত জমির খাজনা প্রদান করা সত্ত্বেও এ ১৯৬২ সালকে ভিত্তি করে কতিপয় অসাধু ভূমিগ্রাসীরা ভূয়া নিলাম সৃষ্টি করে ভূ-সম্পত্তিগুলো প্রভাবশালীদের নামে বন্দোবস্ত করে নেয়।
সুইচি মং, পিঃ সুইলা অং, গ্রাম: সওদাগরপাড়া, উপঃ বর্তমান তালতলী, (পূর্বে আমতলী), জেলা : বরগুনা যার মিস কেইস নং ৪৭৬/৮১, উক্ত মামলায় প্রজন্ম ক্রমে দীর্ঘ ৬৯, ৩৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও তা আজও নিস্পত্তি হয়নি।
দখলকারী ব্যক্তি দখলকৃত জমির ধান বিক্রি করে উক্ত জমির মামলা চালান। অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্থ ও দখলচ্যুত রাখাইন ব্যক্তি তার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া নিষ্কটক (যেখানে এখনও কোন ব্যক্তি/মহল কর্তক দখল হয়নি) জমি খন্ড খন্ড বিক্রি করে মামলার খরচ চালান।
জানা যায়, উপজেলা শহরে এসে মামলার হাজিরা দিতে মামলা প্রতি উকিল খরচ, ক্লার্ক খরচ, হাজিরা কোর্ট ফিঃ, সেরেস্তা, এজলাস সহ যাতায়াত ভাড়া, খাবার ও অন্যান্য সহ কমপক্ষে ৫,০০০ টাকা খরচ হয় ।
মাসে একবার অথবা ১৫ দিন পর পর আসতে হয়। আবার কখনও স্বাক্ষী প্রদানের জন্য একটানা ৭ দিন উপজেল/জেলা শহরে অবস্থান করতে হয়। সেক্ষেত্রে খরচ দ্বিগুনেরও বেশি করতে হয়।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা ও বরগুনার তালতলী/আমতলী উপজেলায় মোট ৬৫৫ (কলাপাড়া ৩৪০ ও তালতলী ৩১৫) রাখাইন পরিবার রয়েছে।
উক্ত পরিবারের মধ্য প্রত্যেক পরিবারই জমি জমা সংক্রান্ত বিষয় ভোগদখলের জটিলতায় গড়ে ২টি করে মামলা মোকদ্দমায় দীর্ঘকাল যাবত জড়িত হয়ে আছে।
এভাবে অজস্র উদাহরণ আছে, যা লিখতে গেলে তা রূপকথাও কে হার মানাবে ।
কারিতাস বরিশাল অঞ্চলের আইসিডিপি-রাখাইন প্রকল্প থেকে ভূমি আইনী সহায়তা প্রদান ২০০৭ সাল থেকে আইসিডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে ২টি উপজেলা যথাঃ কলাপাড়া ও আমতলী, বর্তমান তালতলী উপজেলার রাখাইনদের অস্তিত্ব রক্ষায় @ ৭০০০ টাকা হারে পর্যায়ক্রমে এ পর্যন্ত মোট ২৩৮টি ভূমিবেদখল সংক্রান্ত ২৩৮ টি পরিবারকে আইনি সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান পূর্বক মোট ১৬,৬৬,০০০ টাকা (ষোল লক্ষ ছিষট্টি হাজার টাকা মাত্র) প্রদান করা হয়েছে।
তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। ইতিমধ্যে ৫৯টি মামলা নিস্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। মোট ৬২,৬৬৫ শতাংশ ভূমি তাদের নিজের দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে।
মামলার জটিলতা ছাড়াও রাখাইনদের নিষ্ককণ্টক বাকি যে ভূমিটুকু রয়েছে তাও বেমেয়াদী ও মেয়াদী পাট্টা বন্ধক হিসাবে বাঙ্গালীদের কাছে রয়েছে।
এমন ১৫৭টি পরিবার প্রকল্প থেকে ৩১,৪০,০০০ টাকা ভূমি বন্ধকী ঋণ (এলআরডি) গ্রহণ করে বন্ধকী জমি উদ্ধার করেছেন। উদ্ধারকৃত জমির পরিমান ২৩,০৪৭ শতাংশ।
এ ছাড়াও প্রকল্প থেকে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মৌলিক আইন ও সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও আইনী পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
বর্তমান প্রধান সমস্যা মোটা দাগেঃ
১) প্রতিটি রাখাইন পাড়ার/গ্রামের বৌদ্ধ বিহারের আশে-পাশের জায়গা কতিপয় প্রভাবশালী ও ভূমিগ্রাসী কর্তৃক দখল হচ্ছে। কুয়াকাটায় অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ৯৯ শতাংশের অধিক জায়গা স্থানীয় পৌরভবনের প্রস্তাবিত ভবন নির্মানের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । যেখানে রয়েছে বাংলাদেশের প্রাচীন বৃহৎ গৌতম বুদ্ধের শায়িত মূর্তি;
২) প্রতিটি পাড়ার শ্মশান ভূমির চারপাশ বেদখল হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত অবৈধ দখলের সীমানা বাড়ছে। (কলাপাড়া উপজেলার কাঁলাচানপাড়া, হাড়িপাড়া সহ তালতলী উপজেলার তালতলী সদর, অংকুজানপাড়া উল্লেখযোগ্য) ;
৩) শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত রাখাইন পাড়ার রির্জাভ পুকুর বেদখল হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভূমি অফিস কর্তৃক লিজ/বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। (দিয়ার আমখোলা পাড়া, কালাচাঁন পাড়া, হাড়িপাড়া, থঞ্জু পাড়া, লক্ষিপাড়া, নায়রী পাড়া)
৪) অবিরত ভূমি বেদখল এবং মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা, অবিরাম/ মামলার দীর্ঘসূত্রীতা, জমি সংক্রান্ত সহিংসতা হচ্ছে;
৫) গভীর রাতে রাখাইন বাড়ী ও গ্রামে প্রায়-ই হামলার ঘটনা ঘটছে; (কুয়াকাটার নয়াপাড়া, কালাচানপাড়া, নায়োরীপাড়ায় সম্প্রতি এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বিষয়টি নিষ্পত্তি হলেও পরিবারগুলো আতঙ্কে, নিরাপত্তাহীনতায় আছে বলে তারা জানিয়েছে);
৬) চরম অর্থনৈতিক নাজুকতা ও সামাজিক পরিবেশ এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে;
৭) বৌদ্ধবিহার থেকে ভগবান বুদ্ধমূর্তি, পিতলের ঘন্টা সহ আরো পূজার সামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, এমন কোন রাখাইন গ্রাম/পাড়া পাওয়া যাবে না যেখান থেকে বুদ্ধমূর্তি চুরি হয়নি ।
৮) রাখাইন সংস্কৃতি রক্ষা, বিকাশ ও চর্চার ব্যবস্থা না থাকা;
৯) বানিজ্যিক পর্যটন এলাকার নামে রাখাইনদের জমি দখল ও মার্কেট স্থাপনা সহ একশ্রেনীর স্থানীয় ভূমিদস্যু; কতিপয় অসাধু সাবেক ও বর্তমান ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ও অবৈধ হাউজিং ব্যবসা ও হয়রানি দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছে;
১০) রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯৭ অনুচ্ছেদ যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া;
১১) সরকারীভাবে মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ না থাকা বিদ্যালয় সমূহে রাখাইন শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার সুযোগ না থাকা;
১২) প্রয়োজনীয় অর্থ, প্রশিক্ষণ, বাজারজাত করণ ব্যবস্থা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রাখাইন তাঁত শিল্প;
১৩) রাখাইন নারীরা নিরাপত্তা হীনতার স্বীকার;
আদিবাসী ভূমি অধিকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি প্রসঙ্গ :
জাতীয় ভূমি, পরিবেশ, পানি, প্রানবৈচিত্র বিষয়ক বেশ কিছু জাতীয় আইন ও খসড়া আইনে আদিবাসী অধিকারের প্রসঙ্গসমূহ ইতিবাচক ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্ত বিদ্যমান আইনসমূহের যথাযথ প্রয়োগ স্থানীয় এলাকায় দেখা যায় না। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারী কর্তৃপক্ষ এবং আইনী কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা-অবহেলা এবং সকল আইন সম্পর্কে উপযোগী ও সর্বোপরি ধারণা না থাকাকেই অধিকাংশ দায়ী মনে করেন।
রাষ্ট্রীয় ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন ১৯৫০ (ইস্ট বেঙ্গল এ্যাক্ট নং ২৮/১৯৫১) এর নিয়মানুযায়ী আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তরের উপধারাঃ
উপধারা : ২ : কোন উপজাতি বা আদিবাসী তার ভূমি অনুরূপ আদিবাসী ছাড়া অন্য কারো নিকট হস্তান্তর করলে তা বৈধ হবে না।
উপধারা : ৩ : আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তর ক্রয়-বিক্রয়, দান এবং উইল প্রক্রিয়ায় হতে পারে। তবে বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তর আদিবাসীদের ভেতরই হতে হবে। কোন আদিবাসী তার ভূমি অন্য কোন আদিবাসীকে বিক্রয়, দান এবং উইল হস্তান্তর করতে পারে। অন্য কোন সম্প্রদায়ের লোকের নিকট আদিবাসী তার ভূমি বিক্রয় করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে রেভিনিউ অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে এ ধরনের হস্তান্তর হতে পারে।
উপধারা : ৪: প্রত্যেক হস্তান্তর রেজিষ্ট্রিকৃত দলিল মূলে হতে হবেএবং দলিল রেজিষ্ট্রি হওয়ার পূর্বে এবং হোল্ডিং অথবা এর যে কোন খন্ডে হস্তান্তরিত হলে দলিল মতে এবং হস্তান্তরের শর্ত অনুযায়ী রাজস্ব অফিসারের লিখিত সম্মতি নিতে হবে।
উপধারা : ৫: একজন আদিবাসী অন্য কোন বাংলাদেশী বা বাংলাদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাসকারী অন্য আদিবাসীর নিকট স্বীয় জমি খাইখালাশী বন্ধকদিতে পারবে।এরূপ বন্ধকের মেয়াদ ৭ বছরের অধিক হবে হবে না বরং বন্ধকটি অবশ্যই ১৯০৮ সনের রেজিষ্ট্রেশন আইন অনুযায়ী হতে হবে।
উপধারা : ৭ : আদিবাসী হস্তান্তর এই ধারার বিধান লংঘন করা হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
উপধারা : ৮ : যদি কোন আদিবাসী রায়ত এই ধারার বিধানসমূহ লংঘন করে কোন হোল্ডিং বা এর অংশ হস্তান্তর করা হলে রাজস্ব অফিসার রাজস্ব রেভিনিউ অফিসারের অনুমতি ব্যাতিরেকে কোন আদিবাসীর ভূমি অন্য কোন সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর হলে সেই হস্তান্তর বলবৎ হবে না।
ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪ঃ
ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনযায়ী জোরপূর্বক আদিবাসীদের গ্রাম ও নিজস্ব বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা বেআইনী। পল্লী এলাকায় বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত কোন ভূমি হতে বাড়ির মালিককে উচ্ছেদ করা যাবে না (সূত্র : ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪, ধারা)
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২০০১:
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২a০০১ এ স্পষ্ট আদিবাসীদের ভূমি অধিকার বিষয়টি “উপজাতীয় সম্প্রদায়” হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে প্রচলিত আইন মোতাবেক ভূমির অধিকার প্রদান সহ তাদেও সমাজগত অধিকার সংরক্ষণ করা হবে ( সূত্র : জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২০০১, ধারা ১৬.২৮)।
এমনকি এই নীতিমালা অনুযায়ী আদিবাসীদের ভূমির প্রথাগগত অধিকারের প্রতিও সমর্থন রেখেছে রাষ্ট্র, নীতিমালাতে আদিবাসীদের “সমাজগত অধিকার” সংরক্ষণের উল্লেখ রাখা হয়েছে।
জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২০০১ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে একটি বিশোর্ধ আন্ত: মন্ত্রণালয় ভিত্তিক জাতীয় কমিটি গঠন এবং জাতীয় ভূমি ব্যবহার কমিটিকে সাচিবিক সহযোগিতা করার জন্য ভূমিমন্ত্রীকে আহ্বায়ক করে আর একটি আন্ত: মন্ত্রণালয় ভিত্তিক ভূমি ব্যবহার বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (সূত্র : জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা ২০০১, ধারা ১৮ ও ১৯)।
আদিবাসী অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষনা পত্রের ভূমি অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ২৮- আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত ভাবে মালিকানাধীন কিংবা অন্যথায় ভোগ দখলকৃত বা ব্যবহারকৃত এবং তাদের স্বধীন পূর্বাহিত সম্মতি ছাড়া বাজেয়াপ্ত হরন দখল ব্যবহার বা ক্ষতি সাধন করা ভূমি, ভুখন্ড ও সম্পদ যাতে তারা ফিরে পায় কিংবা তা সম্ভব না হলে ন্যায্য যথাযথ ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরন পায় সেরূপ প্রতিকার পাওয়ার অধিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রয়েছে।
আইএলও কনভেনশন নং-১০৭
Indigenous and Tribal Populetions convention, 1957 (ILO 107)
অনুচ্ছেদ ১১, দ্বিতীয় অংশ : বলা হয়েছে, “সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে।” বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলও কনভেনশন অনুস্বাক্ষর করেছে।
আইএলও কনভেনশন নং – ১৬৯
Indigenous and Tribal Populetions convention, 1989 (ILO 169)
অনুচ্ছেদ ১৪.১ : আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে আয়ত্তকৃত জমির মালিকানার অধিকার ও ঐতিহ্যগতভাবে দখলীসত্ত্বেও স্বীকৃতি দিতে হবে। অধিকন্তু ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহারকৃত জমি যা তাদেও জীবনযাপন এবং ঐতিহ্যবাহী কার্যক্রমে ব্যবহার করতো সেগুলো রক্ষার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এই মর্মে যাযাবর ও স্থান পরিবর্তনকারী চাষীদেও অবস্থাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে।
অনুচ্ছেদ ১৪.২ : সরকার এসব জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগতভাবে আয়ত্তকৃত ভূমি চিহ্নিতকরণ এবং তাদেও মালিকানার অধিকার ও দখলীসত্ত্বে কার্যকরী নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করবে।
রাখাইনদের ভূমি সমস্যার সমাধানে সমন্বিত প্রস্তাব
রাখাইনদের ভূমি সমস্যার সমাধানে আমাদের কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া অত্যন্ত জরুরী। প্রকল্পের সীমিত সহায়তার মধ্যে দিয়ে আদিবাসীদের দীর্ঘসময় ব্যাপী চলমান জটিলতা নিরসন সম্ভব নয়।
সকল সমস্যা, দাবী-প্রস্তাব-সুপারিশ এসবের বাস্তবায়ন রাষ্ট্রীয় সীদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমেই করা জরুরী। সেইসাথে স্থানীয় প্রশাসনকেও সহায়তার হাত বাড়াতে হবে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে দ্রুত/ অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজনঃ
১. বেদখলকৃত বৌদ্ধ বিহারের জমি মুক্ত করে রাখাইন কর্তৃপক্ষের নিকট ফিরিয়ে দেয়া। রাখাইনদের বেদখলকৃত শ্মশান ভূমি দখলীমুক্ত করে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া এবং অবৈধদখলদারীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করা।
২. রাখাইন ভাষা রক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অবিলম্বে রাখাইন ভাষায় শিশু শিক্ষা কার্যক্রম শুরু এবং বিদ্যালয় সমূহে রাখাইন শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষার সুয়োগ দেয়া।
৩. রির্জাভ পুকুর দখলমুক্ত করে স্ব স্ব রাখাইনপাড়া কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দেয়া।
৪. রাখাইন সংস্কৃতি রক্ষা, বিকাশ ও চর্চার লক্ষে রাখাইন কালচারাল একাডেমিকে সক্রিয় করা।
৫. বিকৃত করা রাখাইন পাড়ার নাম স্ব স্ব ঐতিহ্যগত নামে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। (হুইসেন পাড়াকে করা হয় হোসেন পাড়া, দোকাশি পাড়াকে করা হয় দোভাষী পাড়া, থঞ্জু পাড়াকে করা অঞ্চু পাড়া, ফ্যাথিপাড়াকে করা হয় ফাঁসিপাড়া ইত্যাদি)
৬. যে সকল রাখাইন অধ্যুষিত গ্রামে শ্মশান ভূমি নাই সেখানে অতি শিঘ্রই মৃতদেহ সৎকারের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে জায়গা বরাদ্দ দেয়া (কলাপাড়া সদর, কালাচাঁন পাড়া, কুয়াকাটা পাড়া, নয়াপাড়া, নায়রীপাড়া)।
৭. ভূমিদস্যু, স্থানীয় প্রভাবশালী ও সাবেক ভূমি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে অবৈধ হাউজিং ব্যবসা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৮. রাখাইন তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, প্রশিক্ষণ ও বাজারজাতকরনের ব্যবস্থা করা।
৯. স্থানীয় প্রশাসনের কমিটিতে রাখাইন সম্পদ্রায় থেকে কমপক্ষে ৩ জন অর্ন্তভুক্ত করা।
১০. পটুয়াখালী ও বরগুনার সর্বশেষ যে ২৫৬১ জন রাখাইন বাস করছেন রাষ্ট্র ও সরকারকে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া এবং এই অঞ্চল থেকে যেন রাখাইন মানুষেরা চিরতরে হারিয়ে না যান তার নিশ্চয়তা প্রদান করার ব্যবস্থা করা।
১১. ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাসত্ব আইনের ৯৭ ধারা পরিপূর্ণ ভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করা।
১২. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা। ভূমি কমিশনের মাধ্যমেই স্থানীয় ভূমি বিষয়ক/মামলা,তথ্য-নথি,দলিল-পত্র সংরক্ষণ ও কর্ম প্রক্রিয়া সম্পাদন করা ।
১৩. রাখাইনদের সংরক্ষিত পবিত্র-প্রথাগত ভূমি-বনভূমি, জলাভূমি, বৃক্ষ, দেবস্থান, মন্দির, বিহার, উৎসব ও মেলা এলাকা-প্রার্থনা এলাকা, সামাজিক রীতি ও আইনের মাধ্যমে পরিচালনা, রক্ষা-বিকাশের জন্য আইনগত ভাবে স্বীকৃতি,মর্যাদা ও দখলীমুক্ত করে রাখাইনদের হাতে তুলে দেয়া।
১৪. রাখাইনদের ঐতিহাসিক স্থান সমুহ সহ নিজস্ব সংরক্ষিত এলাকা কোন ভাবেই অধিগ্রহণ না করা।
১৫. বেদখলকৃত, অর্পিত শত্রু সম্পত্তির নামে দখলকৃত জমি-জবরদখল হওয়া সকল জমি ও ভূমি আইনগত স্বীকৃতিসহ রাখাইনদের মাঝে ফিরিয়ে দেয়া।
১৬. রাখাইন অধ্যুষিত স্থানীয় ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদে রাখাইনদের জন্য কমপক্ষে দু’টি সংরক্ষিত আসন রাখা। (একজন নারী ও একজন পুরুষ) এবং স্থানীয় ভাবে রাখাইনদের জন্য ভূমি আদালত ও ভূমি পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করা।
১৭. ভূমি বিষয়ক স্থানীয় সরকার কাঠামোতে স্থানীয় নিজস্ব শাসন কাঠামোর প্রতিনিধি নেতৃত্বকে মর্যাদার সাথে অর্ন্তভুক্ত করা।
১৮. স্থানীয় খাস জমিতে রাখাইনদের পূর্ন অধিকার নিশ্চিত করা।
১৯. রাখাইনদের নিয়ে কোন প্রকল্প গ্রহণ করার পূর্বে তাদের পূর্বঅনুমতি সহ রাখাইন বান্ধব প্রকল্প হাতে নেয়া।
আমরা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাশা করি উপকূল-সমতল-পাহাড় তথা সকল আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানে সরকারী -বেসরকারী পাশাপাশি গনমাধ্যমসহ এক বিশাল নাগরিক সমাজও এই বিরাজমান সমস্যা সমাধানে আরও অধিকতর গতিশীল হয়ে উঠবে। সম্মান দিবে আদিবাসীদের ভূমি দর্শন ও প্রকৃতি কে।
লেখকঃ মেইনথিন প্রমীলা। সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম
ইমেইল: promilapromi@yahoo.com
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।