রাখাইন বা মারমা জাতির সংক্ষিপ্ত ইতি কথা
6506
রাখাইন বা মারমাদের ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সর্বদাই লক্ষ্য করা যাই যে এরা জাতি হিসেবে এক নাকি অভিন্ন। রাখাইন, মগ, মারমা, আরাকানী এদের নামের ভিন্নতা থাকলেও আসলে এদের শিকড় একই জায়গায় গাঁথা। অনেকের জন্য বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে হয়তো কিন্তু আশা করি লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়লে সব শঙ্কা দূর হবে।
আসলে কালের বিবর্তন, ভৌগলিক অবস্থান গত ভিন্নতা, এই ভূখণ্ড আগমনের সময় ভিন্নতা এই সম্প্রদায়ের লোকদের পরিচয় গত এই নাম গত ভিন্নতার কারণ।
এই সম্প্রদায়ের কক্সবাজার, বরিশাল এবং পটুয়াখালীতে যারা থাকে তারা নিজেদের রাখাইন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা থাকে তারা মারমা এবং ভারতে যারা থাকে তারা মগ নামে পরিচয় দিয়ে থাকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদিবাসীদের কাছে এই সম্প্রদায় বিভিন্ন নামে পরিচিত। চাকমা ও তঞ্চগ্যা সম্প্রদায়ের কাছে মগ, ম্রোদের কাছে ম্রান, পাংখোয়াদের কাছে ম্রং, চাকদের কাছে ম্রাইঙ, ত্রিপুরাদের কাছে মুখু, খুমিদের কাছে ত্রামো খিয়াংদের কাছে ওঅঃ নামে পরিচিত।
আসলে শব্দটি ছিল “মং(maung)”, যা এখনও বাংলাদেশে কিছু সংখ্যক রাখাইন পরিবার ব্যবহার করে থাকেন। ধারণা করা যেতে পারে উক্ত “মং” শব্দটি জাতি ভেদে উচ্চারণের ভিন্নতার কারণে বিকৃত হয়ে পরবর্তিতে “মগ” আকার ধারণ করেছে।
জাতির পরিচয়গত এই সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বোমাং রাজা মং শৈ প্রু ১৯৫১ সালে আদামশুমারির সময়ে তৎকালীন সরকারের কাছে এই সম্প্রদায়কে মারমা নামে উল্লেখ্য করার আবেদন করেন।
এই নাম গ্রহণের আরেকটি কারণ হয়ত হতে পারে, তারা নিজেদের মগ নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন না।
অষ্টাদশ শতকে বর্মি এবং ইংরেজি দলিলপত্রসমুহে মারমা বাস্তুহারাদের উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজার শাসন আমলে এই ভূখণ্ডে এই সম্প্রদায়ের লোকদের আগমন ঘটেছে। ১৫০০ ও ১৭৮৪ সাল দুটি এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
১৫০০ সালে বার্মা ও আরাকানের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পেগুর (অনেকে একে পেগুর বদলে হংসবতি বলেও মনে করে থাকেন এ নিয়ে দি মত রয়েছে) রাজকুমার মঙ চ পিঁয়ো এবং রাজকুমারী সাইন্ড হ্না ঙ আরাকানরাজ দাংয়া ওয়াদির(Danya Wadi) সমীপে নীত হন।
পরবর্তী সময়ে যুবরাজ মঙ চ পিয়ো আপন যোগ্যতায় আরাকানরাজ মিং খা মুং এর দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন এবং আরাকানরাজ তাঁকে ১৬১৪ সালে চট্টগ্রামের প্রশাসন নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে আরাকানরাজ মঙ চ পিঁয়োকে বো মং উপাধিতে ভূষিত করেন। যুবরাজের বংশধরেরা কয়েক পুরুষ ধরে চট্টগ্রামে শাসন করেন।
দক্ষিণে মারমাদের দাবি তারা সেই রাজাদের বংশধর। ধারণা করা হয় এভাবেই মারমাদের এই ভূখণ্ড আগমন। কিন্তু দক্ষিণের মারমাদের এই দাবি সন্দেহমুক্ত নয়।
কারন অনেকে মারমাদের তেলেঙ্গ রাজাদের বংশধর হিসেবেও মনে করে থাকেন। কিন্তু এই দাবির পক্ষে তেমন কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না।
বরং রাখাইনদের সাথেই তাদের বেশি মিল রয়েছে (যেমন – ভাষাগত, খাদ্যভাস, সংস্কৃতি, পোশাক ইত্যাদি)। তেলেঙ্গ রাজার বংশধর দাবি করলেও তেলেঙ্গ ভাষা তাদের কাছে অপরিচিত।
অন্যদিকে আরাকানী ভাষা অর্থাৎ রাখাইন সম্প্রদায় কর্তৃক ব্যবহৃত ভাষা মারমাদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত এবং এই ভাষার বর্ণমালাই মারমা বর্ণমালা হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে রাখাইন নামে পরিচিত এই সম্প্রদায়ের আরেক অংশের এই ভূখণ্ড আগমন ঘটে অন্যভাবে। ১৭৮৪ সালে সামন্তবাদী বর্মীরাজের বাহিনীর হাতে রাখাইন সাম্রাজ্যের স্বাধীনতার শেষ সূর্য রোহিত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ সাল পর্যন্ত বিসতৃত এক গৌরবময় ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধের লক্ষ্য শুধু রাখাইনদের হারানোই ছিল না বরং লক্ষ ছিল এই জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত করা এবং সকল অস্তিত্ব নির্মূল করা।
এবং তাদের এই লক্ষে তারা সফল হয়েছিল বলেই বলা চলে। কারণ তারা রাজ্য দখলের পাশাপাশি প্রায় সিংহভাগ পুস্তক, বুদ্ধমুর্তিসহ আরো এমন অনেক জিনিস যা রাখাইন জাতির পরিচয় বহন করে, তা তারা হয় জালিয়ে দেয় নয় লুট করে।
এসব নিদর্শনের মধ্যে উল্ল্যেখ করার মত নিদর্শন ছিল মূল্যবান ও আলৌকিক “মাহামূনিং (রাখাইন ভাষায়)” বুদ্ধেরমুর্তি।
“A Brief History of Arakan: From Kingdom to a Colony” লেখাটিতে লেখক আবিদ বাহার (Abid Bahar) বার্ণনা করেন-
“in 1784 Burmese king Budapaya sent a large army led by his son who mercilessly razed the city to ground and took away the Arakanese symbol of pride – the Mohamini to the Burmese heartland” [3]
এরপর, (১৭৮৪ – ১৮২৬) সাল পর্যন্ত বর্মীরা এবং (১৮২৬ – ১৯৪৮) ইংরেজরা আরাকান শাসন করে। ১৯৪৮ সালের পরে এই ভুখণ্ডটি স্বাধীন বার্মার (যা বর্তমানে মায়ানমার) অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
এই সময় বর্মি আক্রমণকারীদের দ্বারা আরাকান থেকে এই সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন বিতারিত হয়ে মাতামুহুরি উপত্যকায় মধ্যে দিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া এবং অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। আবার অনেকেই পটুয়াখালী বা বরিশালের দিকে চলে যায়।
এমন নয় যে এই ঘটনা গুলোর আগে এই ভূ-খন্ডে এই সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করত না। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮০ সালে রাখাইন রাজা চেন্দাসুরিয়া আরাকান অঞ্চলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেন।
সেই সময়ে বহু আরাকানী রামু অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে আগমন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। এই কিংবদন্তি মেনে নেয়া হলে সেই সময়কেই রাখাইনদের এই ভূ-খন্ডে আগমনের সময় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
এছাড়াও আমরা জানি যে চট্টগ্রাম ফেনী সহ এদেশের কয়েকটি অঞ্চল প্রাচীন আরাকান রাজ্যের অন্তরভুক্ত ছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সকল ঘটনা উপরে উল্লেখিত লাইন,(রাখাইন, মগ, মারমা, আরাকানী এদের নামের ভিন্নতা থাকলেও আসলে এদের শিকড় একই জায়গায় গাঁথা)- এর পক্ষে অবস্থান করছে।
অতএব উক্ত তথ্যগুলোকে ভিত্তি করে বলতেই পারি ভিন্ন নামে পরিচিত এই জাতি সমূহের শিকড় একি সুঁতোই গাঁথা।
(তথ্যে ঘাটতি বা অন্য কারণে হয়ত ভুল থাকতে পারে। যদি পাঠকের মতে লেখাটিতে কোনো ভুল থেকে থাকে তাহলে সঠিক তথ্যটি জানিয়ে আমাকে এবং সবাইকে আরো জানার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ রইল)
লেখক : জওয়াং রাখাইন
তথ্যসূত্র :
[1] অং, ক. লুন্ঠিত সভ্যতা.
[2] বুলবুল, স. বাংলাদেশের রাখাইন জনগোষ্ঠী.
[3] Bahar, A. (2016). A Brief History of Arakan: From Kingdom to a Colony [Blog]. Retrieved from http://southasiajournal.net/a-brief-history-of-arakan-from-kingdom-to-a-colony/
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।