রাখাইন রূপকথা: পইংঞাসি ক্ষঙবো

Jumjournal
Last updated Apr 30th, 2020

911

featured image

বিশ্ব আয়নাতে যে কোন একটি জন সম্প্রদায়কে উপস্থাপন করতে চাইলে তাদের ইতিহাসের পাতা থেকে সন্ধান করে নিতে হয় জাতির উৎস সংস্কৃতিকে।

যে কোন একটি জন সম্প্রদায়কে ইতিহাসের পাতা থেকে ক্ষয় অথবা বিলুপ্ত করতে চাইলে সর্বাগ্রে তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে।

সংস্কৃতি যত দিন সেই জন সম্প্রদায়ে জেগে থাকবে, ততদিন সেই জন সমাজ সগৌরবে বেঁচে থাকবে। রাখ+আইন সন্ধি করণের ফলে রাখাইন।

রাখাইন একটি রক্ষণশীল জন সম্প্রদায়। রাখাইনরাও তাদের জাতির প্রাণ সংস্কৃতির উৎসসমূহ যেমন : ভাষা, বর্ণ, ব্যাকরণ, সভ্যতা, রীতি, রেওয়াজ যুগ-যুগান্তর থেকে লালন-পালন করে আসছে একান্ত আন্তরিকভাবে।

এ সাংস্কৃতিক অঙ্গসমূহকে রাখাইনরা আগামীতেও লালন-পালন করে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

রাখাইনদের আছে রূপকথা, লোককাহিনী, উপকথা, কিংবদন্তি, প্রবাদ বচন, বাগধারা প্রভৃতি।

আজ আমি একটি রাখাইন রূপকথা/ লোককাহিনী উপস্থাপন করতে চেষ্টা করছি। পাঠক কিংবা পাঠিকা মাত্রই এ রাখাইন লোককাহিনী সম্পূর্ণভাবে অধ্যয়ন করে বোধগম্য হলে আমার শ্রম স্বার্থক বলে বিবেচনা করবো।

পইংঞা একটি রাখাইন শব্দ, যার বাংলা অর্থ জ্ঞান। সি অর্থ আছে।

আর ক্ষঙবো রাখাইন শব্দ, যার বাংলা অর্থ পেঁচা। বিশেষ অর্থে পইংঞাসি ক্ষঙবো অর্থ বুদ্ধিমতি পেঁচা।

পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর যেন সাজানো বাগান। চির সবুজ এ বন বীথির পাশ দিয়ে প্রবাহমান ছোট নদী।

নদীর পানি যেন কাক চোখের মত টলমল করছে। সেই অরণ্যে মনোরম পরিবেশে বসবাস করত পাখির সম্ভার।

পাখিরা মুক্ত আকাশে মনের সুখে বিচরণ করত। একদিন পাখিদের মনে অভিলাষ হলো, আমাদের একতা প্রয়োজন।

পাখিরা একতাবদ্ধভাবে বাস করতে লাগল। পাখিরা উপস্থিত সবার সম্মতিক্রমে পাখিরাজের আসনে অলংকৃত করল ময়ূরকে।

প্রথম পর্যায়ে পাখিরাজ ময়ূর পাখিদেরকে সুখ-সমৃদ্ধির সাথে শাসন করতে লাগল।

একদিন ময়ূরীর একটা সাধ জাগল। মনের বাসনা বার্তা তার স্বামী পাখিরাজ ময়ূরের নিকট ব্যক্ত করল, পাখিরাজ, আমার খুবই বাসনা জাগ্রত হতে চলেছে।

ময়ূরাণী, কি বাসনা তোমার ? প্রশ্ন করলেন পাখিরাজ ময়ূর। ময়ূরী বলল, আমরা পাখিদের রাজা।

অন্যান্য পাখিদের মত তরুলতার বাসায় থাকতে চাইনা। নোংরা আবর্জনাময় পরিবেশে বাস করলে নানা রকম রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে হবে।

কষ্ট হবে আমাদের, আমাদের সন্তানদের। আর প্রাসাদে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করবে।

 এ প্রশ্ন করলেন পাখিরাজ ময়ূর, ময়ূরী, কি দিয়ে আমরা বাসা তৈরি করবো ? বলল ময়ূরী, আমার কথা শুনুন, আমার কথা মনযোগ সহকারে শুনুনগো পাখিরাজ।

আমাদের সুন্দর ও সুরম্য প্রাসাদ প্রয়োজন, যে প্রাসাদ আমাদের মানানসই হবে। ঐ নোংরা পাখিদের মত তরুলতার বাসায় আমাদের মানাচ্ছে না।

তাহলে আমাদের প্রয়োজন একটি সুন্দর ও ঝলমলে প্রাসাদ, যা দেখে অন্যরা বাহ্ বাহ্ করে প্রশংসা করবে।

পাখিরাজ, প্রাসাদ তৈরির জন্য প্রচুর পালক প্রয়োজন হবে আমাদের। পাখিরাজ সরল চিত্তে প্রশ্ন করলেন, ময়ূরী, এত পালক আমরা কোথায় পাবো ?

রাগে ময়ূরী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো, কেন আপনি পাখির রাজা। পাখি সব আপনার কথার অবাধ্য হবে না।

প্রতিটি পাখি থেকে এক একটা পালক সংগ্রহ করলে। আমাদের সুন্দর ও সুরম্য প্রাসাদ তৈরী হবে। অন্যদিকে তাদেরও শ্রী হারাবে না।

ময়ুরী পাখিদের ব্যথা-বেদনার কথা একটুও ভাবল না। পাখিরাজ ময়ুর স্ত্রীর ব্যক্ত কথা প্রসঙ্গে না-বোধক উচ্চারণ করতে পারল না।

স্ত্রীর কথা মত পাখিরাজ ময়ূর পাখিদের থেকে তাদের মাংসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সৌন্দর্যবাহী পালক এক একটা উপড়িয়ে নেবার জন্য সভা আহ্বান করলো ।

পাখিরাজের সভা আহ্বানের সংবাদ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হলো বজ্রকণ্ঠে সেই সংবাদ বিশ্বের আনাচে কানাচে প্রচার হতে লাগলো ।

রাখাইন এক কিংবদন্তিতে উল্লেখ আছে, নারীর মায়া থেকে শতকরা নিরানব্বই জন রেহাই পায়না।

তেমনি পাখিরাও নারীর মায়াজালে, স্ত্রীর মমতায় অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করতে চেষ্টা করলো কারণ স্ত্রীর কথা না ধরলে, স্ত্রীর কথা মত কার্য সম্পাদন না করলে, স্ত্রীর চাওয়া ইচ্ছাকে পূর্ণ না করলে সংসারে কোন্দল সৃষ্টি হবে।

পাখিরা গগনে বিচরণ করে চিন্তায় মগ্ন হলো। রাজা ময়ূর আমাদের কি একটা কর্মসূচী প্রণয়ন করলেন।

পাখিদের পক্ষ থেকে জনমত সৃষ্টি করতে লাগল কাক। কা-কা-কা করে কালো কাক পেঁচার নিকট গেল। পেঁচার সাথে কাকের বিস্তারিত আলোচনা হলো।

পেঁচা মতলব এঁটে বলল, আগামীকাল সভার দিন। তোমার যথাসময়ে রাজপ্রাসাদের সভায় উপস্থিত থাকবে।

আর আমি (পেঁচা) একটু বিলম্বে পৌঁছাতে চেষ্টা করবো। রাজা যদি কারও অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, তাহলে আমার (পেঁচা) কথা বলবে। আমাকে যেন একটু অপেক্ষা করেন।

কাক যথা সময়ে চলে গেল সভায়। অন্যান্য পাখিরাও দলে দলে সভার উদ্দেশ্যে গমন করল।

পেঁচা তাতো পাখিকে দেখে বলল, তাতো ভাই, তুমি সভায় যাচ্ছ বুঝি ? তাতো বলল, হা।

তাহলে যাবার আগে শুনে যাও, আমার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করার জন্য সভাকে বলবে। বিশ্বের সকল পাখি উপস্থিত হল প্রাসাদে।

সভার প্রারম্ভে পাখিরাজ চারিদিকে অবলোকন করে বললেন, সবাই হাজির হয়েছে?

সভায় পাখিরাজের প্রশ্নের জবাবে তাতো পাখি বলল, মহারাজ, পথে এক পেঁচা আসতে দেখলাম।

আমার সাথে সংবাদও পাঠাল। সে শীঘ্রই সভায় উপস্থিত হবে। প্রসঙ্গের সমাপ্তি হতে না হতে পেঁচা সভায় উপস্থিত হল।

পাখিরাজ ময়ূর পেঁচার সভায় উপস্থিত হতে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলেন।

পেঁচা উত্তরে বলল, মহারাজ মহারাজ, পথে আসতে আসতে দেখলাম, দুই মানব সন্তান উ নু মং ও ড মা টিং তাদের মধ্যে তুমুল বিবাদ হচ্ছিল।

স্বামী উ নু মং-কে স্ত্রী ড মা টিং বলল, দনিয়ায় মুখ বেশি নাকি মলযন্ত্র বেশি।

মুখ বেশি আর মলযন্ত্র বেশি এ বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থেকে হল বিবাদ । আমাকে সেই বিবাদ সমাধান করতে হয়েছিল।

এটাই সভায় উপস্থিত হতে বিলম্বের একমাত্র কারণ।

কিভাবে তুমি এ বিবাদ সমাধান করে মীমাংসা করে দিয়েছ ? প্রশ্নটা ছিল পাখিরাজ ময়রের।

পেঁচা জবাবে বলল, মহারাজ, আমি দুনিয়ায় মুখের চেয়ে মলযন্ত্র বেশি বলে সমাধান করে দিয়ে এসেছি।

আমি জানি, এ উভয়ই সমান সংখ্যক। মহারাজ, যে জন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে, কথা মত কাজ করে না, সিদ্ধান্তের অপব্যয় করে থাকে, সে জনের বাকযন্ত্র থাকলেও সেই বাকযন্ত্রের কোন মূল্য নেই।

রাখাইন প্রবাদ মতে, মানুষের প্রতিজ্ঞা আর রাজার আশ্বাস রক্ষা করে চলতে হয়।

তাই আমি বিশ্বে মুখের চেয়ে মলযন্ত্রের সংখ্যা অধিক বলে সমাধান দিয়েছি।

পাখিরাজ পেঁচার ব্যক্ত বার্তা শুনে লজ্জায় পড়লেন। মনে মনে ভাবনায় ব্রত হলেন, পেঁচার কথা মত আমার মুখ থাকতেও আমার মুখের মর্যাদা নেই।

বরং মলযন্ত্রের তালিকায় আমার মুখকে স্থান দেওয়া হয়েছে। কেননা, আত্ম- দায়িত্ববোথ তার অভাব।

পাখিরাজ পেঁচার কথা আর্যাআলোচনা সভা স্থগিত করলেন। পাখিরা ডানা মেলে মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে লাগল।

এভাবে কাটতে লাগল অনেক দিন। | মহারাণী ময়ুরী তার স্বামী ময়ুরকে জ্বালাতন করতে লাগল একটি প্রাসাদের জন্য ও পাখির পালকের জন্য।

রাজা ময়ুর স্ত্রীর কথা মত প্রথমবারে কাজ করতে গিয়ে লজ্জায় পড়লেও স্ত্রীর যন্ত্রণায় অসহ্য হয়ে আবার সভার প্রচার করতে লাগলেন। এতে সমস্ত পাখিকে সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান করা হলো।

পূর্বের ন্যায় পেঁচা আবার তোতার সাথে সংবাদ পাঠাল। যাতে পেঁচার জন্য একটু অপেক্ষা করে সভা শুরু করা হয়।

সমারোহে পাখিরা নির্দিষ্ট দিনে সভায় আগমন করতে লাগল । ময়ুররাজ সবার উপস্থিতির কথা শুনতে চাইলে তোতা পাখি বলল, পেঁচা এখনও অনুপস্থিত।

তার জন্য একটু অপেক্ষা করে সভা আরম্ভ করুন মহারাজ। সেইক্ষণে সভা কক্ষে প্রবেশ করল পেঁচা।

পেঁচার আগমনের সাথে সাথে ময়ুররাজ প্রশ্ন করলেন, কেন তোমার এত বিলম্ব ? সভ্যগণ তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে অধিকক্ষণ ধরে।

পেঁচা বিনয়ী সুরে ব্যক্ত করতে লাগল তার বিলম্বের কারণ, মহারাজ, আপনার আহ্বানের সংবাদ শুনে আসতে আসতে পথে দেখি, এক রমণী ও এক পুরুষ তর্ক করছে, বিশ্বে নর সংখ্যা বেশি, না নারী সংখ্যা বেশি।

এ বিষয় নিয়ে বাযুদ্ধের প্রবল আকার ধারণ করতে লাগল। তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, বুদ্ধিমান পেঁচা, তুমি বল, নর না নারী সংখ্যা বেশি।

আমি তাদের বিবাদ মীমাংসা করে দিলাম। পাখিরাজ, পেঁচা বলল, বিশ্বে নর সংখ্যার চেয়ে নারী সংখ্যা অধিক বলে সমাধান দিয়েছি।

ময়ুররাজ নর-নারী সংখ্যা সমতা জ্ঞাত হয়ে পেঁচাকে প্রশ্ন করলেন, কেন নর চেয়ে নারী সংখ্যা অধিক পেঁচা?

পেঁচা প্রশ্নোত্তরে বলল, মহাশয়, যে জন স্ত্রীর কথা মত উঠে বসে, সাহসে দুর্বল ও নারীর মত জ্ঞান সংকীর্ণ, তারা পুরুষ নামের কলঙ্ক।

তাদের হৃদয়ে সর্বদা মেয়েলী মন বিরাজ করে। তেমন মনোভাবাপন্ন জন নর মনে হলেও প্রকৃত নর নয়, সে নারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এ কারণে বিশ্বে নর সংখ্যার চেয়ে নারী সংখ্যা অধিক বলে সামাধান দিয়েছি, মহারাজ।

পাখিরাজ মনে ভাবনার জাল বুনতে লাগলেন। ময়ুররাজ লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মত নুয়ে পড়লেন।

পেঁচার নিশ্চয় আমার রহস্য জানতে বাকি নেই। তাহলে আমিও নারী তালিকায়, এখন নারীর সমতুল্য। পেঁচার কথায় ময়ুররাজ সভা মুলতবি করলেন।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে পাখিরা মুক্ত আকাশে বিচরণ করতে লাগল। ময়ূরীর ভাগ্যেও পালকের সুরম্য প্রাসাদ আসলনা।

পাখিরাও মুক্ত মনে, বিনা ব্যথায় ও পালক সৌন্দর্য নিয়ে জীবন যাপন করতে লাগল।

পাখিরা ময়ূর-রাজের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা থেকে বিরতি গ্রহণ করল। | কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে ভাবনা করা উচিত।

নারী বা স্ত্রীর কথা মত কাজ করার পূর্বে নিজ বিবেকের প্রতি প্রশ্ন করে কার্য সম্পাদন করা শ্রেয়।

কোন আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দান করে থাকলে, সেই আশ্বাস কার্যকরী করতে হবে।

উভয় কার্য সম্পাদন না হলে নারীর মানসিকতার সমতুল্য বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

| পাঠকদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ, গল্পের মত না করে নগর, রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠানের গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে সচেষ্ট থাকুন। ধন্যবাদ।

লেখক: উ খ্যাই রাখাইন

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা