প্রসঙ্গ: রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ
1435
রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ ও আমাদের করণীয়:
আমাদের শিক্ষা দরকার। উচ্চ শিক্ষা আরো বেশী দরকার। এদিক থেকে চিন্তা করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা দরকার।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে, বিশেষ করে বর্তমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তা পাহাড়ী জনগণের জন্য কতটুকু উপকারে আসবে- তা পর্যালোচনার দাবী রাখে।
কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা হলো- সরকারের অতীতের উন্নয়ন প্রকল্প বা বিভিন্ন ভাল ভাল উদ্যোগ পাহাড়ীদের উপকারে আসেনি।
সরকারের অতীতের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয় না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল রাঙ্গামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে, সে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার যোগ্যতাসম্পন্ন পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী খুব বেশী পাওয়া যাবে না।
বাস্তবে দেখা যায় যে, বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়ে যে পাহাড়ী কোটা রয়েছে সে পাহাড়ী কোটার আসন এখনো খালি থেকে যায়।
যোগ্যতার অভাবে / প্রয়োজনীয় নম্বর (মার্কস) না পাওয়ার কারণে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীরা পাহাড়ী কোটার আসনসমূহ পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
এর অন্যতম কারণ হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মানসম্মত শিক্ষার অভাব। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না।
সেকারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠা না করে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুফল পাহাড়ীরা পাবে না; বরঞ্চ তা পাহাড়ীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রাসঙ্গিক বিধায় সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে গৃহীত অতীতের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বা বিভিন্ন উদ্যোগের ব্যাপারে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল-
দৃষ্টান্ত- ১ পাকিস্তান আমলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল এ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে, ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া হবে ইত্যাদি।
কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা কি? আমাদের অভিজ্ঞতা হলো- কাপ্তাই বাঁধের কারণে লক্ষাধিক পাহাড়ী উদ্বাস্তু হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে উর্বর ভূমি যার পরিমাণ ৫৪ হাজার একর এবং জুমচাষীদের জুম ভূমি পানির নীচে তলিয়ে গেল এবং একারণে পাহাড়ীদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়লো; সর্বোপরি, পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বাস্তবতা সম্পর্কেও আমরা অবগত আছি।
আজও বরকল, থানচি উপজেলাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু জায়গায় বিদ্যুত পৌঁছেনি। বেশীরভাগ পাহাড়ী এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
দৃষ্টান্ত- ২ পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই- এ বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হল। পাহাড়ীদের শিক্ষা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হল।
কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও আমাদের অভিজ্ঞতা কি বলে? পূর্বে এ ইনষ্টিটিউটে বহু পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হতো।
কিন্তু বর্তমানে এখানে মাত্র ৪%-৫% পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয় যদিওবা এ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার যোগ্যতাসম্পন্ন ভর্তিচ্ছু বহু পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে।
দৃষ্টান্ত- ৩ চন্দ্রঘোনা পেপার মিল, ঘাঘড়া রেয়ন মিল ইত্যাদি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একইরূপ চিত্র আমরা দেখতে পাই। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে প্রথমদিকে শ্রমিকসহ বিভিন্ন পদে পাহাড়ীদের অবস্থান ছিল। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পাহাড়ী শ্রমিকদের সংখ্যা হাতেগুণা কয়েকজন মাত্র।
দৃষ্টান্ত- ৪ ১৯৯৭ খ্রীষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হল। সরকারের প্রতি বিশ্বাস রেখে এ চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পাহাড়ীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
কিন্তু সরকার এ প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে। সরকার এ অঞ্চলকে পাহাড়ী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের অঙ্গীকার করলেও সরকার তার বিপরীতে এই অঞ্চলকে একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার সকল প্রকার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
আমি মনে করি সেই মহা-পরিকল্পনার অংশ হল পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার এই অপচেষ্টা।
সরকার যদি সত্যি সত্যিই এ অঞ্চলের শিক্ষা উন্নয়নের আন্তরিক হতো তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে শিক্ষা সংক্রান্ত যেসব বিষয়ে সরকারের অঙ্গীকার ছিল সেসব বিষয় বাস্তবায়নে এবং এ অঞ্চলের পাহাড়ীদের শিক্ষা উন্নয়নের এগিয়ে আসতো, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও এর আলোকে প্রণীত আইন অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শ গ্রহণ করতো।
সরকার যদি আন্তরিক হতো তাহলে অঙ্গীকার অনুসারে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতো, পাহাড়ীদের সকল গ্রামে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতো এবং এসব মহৎ দায়িত্ব পালনের জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদকে শক্তিশালী করতো।
কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখতে পাই যে, সরকার পার্বত্য জেলা পরিষদে দুর্ণীতিবাজ ও অদক্ষ লোকদের বসিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ঘুষ নিয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে এবং এর কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে এবং এতে সমাজের যে ক্ষতি হবে তা পূরণ হবার নয়।
এর জন্য সরকার দায়ী এবং এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। এধরণের প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণার চিত্র আমরা অতীতে দেখেছি এবং বর্তমানেও দেখতে পাচ্ছি এবং এক্ষেত্রে পাহাড়ীরা বার বার প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তাহলে কিসের ভিত্তিতে, কোন যুক্তিতে পাহাড়ীরা সরকারের উদ্যোগের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারবে?
প্রথম দিকে উল্লেখ করেছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মানসম্মত শিক্ষা না থাকার কারণে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না।
এ পর্যায়ে সে সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হল- (১) রাঙ্গামাটি কলেজের শিক্ষার অবস্থা: রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজে শিক্ষক পদের সংখ্যা রয়েছে-৬৭ জন। তৎমধ্যে কর্মরত শিক্ষক আছেন মাত্র ৪৭ জন।
২০ জন শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। কর্মরত এই ৪৭ জন শিক্ষক ৬৭ জন শিক্ষকের দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে পারবে? এছাড়াও কলেজে শিক্ষক আবাসন, প্রয়োজনীয় ক্লাশ রুম ইত্যাদির অভাব রয়েছে যা কলেজে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য জরুরী।
(২) খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজের শিক্ষার অবস্থা: এই কলেজে শিক্ষক পদের সংখ্যা ৪৮। তৎমধ্যে মাত্র ২৮ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন, বাকী ২০ জন শিক্ষকের পদ শূন্য।
একটি কলেজে ৪৮ জন শিক্ষকের মধ্যে যদি ২০ জন শিক্ষকের পদ শুন্য থাকে তাহলে সে কলেজে কিভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
(৩) বান্দরবান কলেজ- এই কলেজে শিক্ষক পদের সংখ্যা- ৩৯। তৎমধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ২৯ জন। বাকী ১০ জন শিক্ষকের পড় শূন্য।
মন্তব্য: আমি এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদরে অবস্থিত তিনটি সরকারী কলেজের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা অনুধাবনের জন্য।
জেলা সদরে তিনটি সরকারী কলেজের শিক্ষার অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে বাকী সরকারী ও বেসরকারী কলেজ ও স্কুলের অবস্থা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কলেজের এ অবস্থার কারণে হাতেগুণা কয়েকজন মাত্র এসব কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারছে ও ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে।
যার কারণে দেখা যায় যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যেসব কোটা রয়েছে, সেসব কোটাও পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠে না যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রী না পাওয়ার কারণে।
বিশেষত: বিজ্ঞান বিষয়গুলিতে প্রতি বছর ‘পাহাড়ী কোটা’ খালি থেকে যায়। এই দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাহাড়ীরা উপকার পেতে গেলে এ দু’টি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার আগে সরকারকে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার, সে সম্পর্কিত প্রস্তাবনা নিম্নে উপস্থাপন করা হল-
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে:
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব কলেজ রয়েছে সেসব কলেজে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে যাতে এসব কলেজ থেকে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহন করার মধ্য দিয়ে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে;
(২) কলেজের শুন্য শিক্ষক পদসমূহে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। ভাল শিক্ষকরা যাতে এসব কলেজে বদলী হয়ে এসে চাকরি করার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কলেজে সেধরণের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
(৩) শিক্ষকদের জন্য আবাসন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
(৪) কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন- ক্লাশ রুম, শিক্ষক রুম, মিলনায়তন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে;
(৫) কলেজে খেলার মাঠ, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে;
(৬) কলেজে একটি ভাল লাইব্রেরী ও গবেষণা কার্যক্রম- এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
(৭) পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব বেসরকারী কলেজ রয়েছে সেসব কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে;
(৮) প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
(৯) অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে:
(১) সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শূন্য পদসমূহ পূরণ করা ও শিক্ষকের আবাসন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা;
(২) বেসরকারী উচ্চ বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক ও অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে;
(৩) প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
(৪) অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে;
মন্তব্য: মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এসব সুবিধা প্রদান করতে না পারলে ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারবে না।
মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় পয়েন্ট না পেলে ভাল কলেজে ভর্তি হওয়া যাবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয় পয়েন্ট সংগ্রহ করা যাবে না।
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯০% প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া মানসম্মত নয়। বহু আদিবাসী গ্রাম আছে যেখানে সরকারী/ রেজি: প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।
বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে বর্গা শিক্ষক দিয়ে চলে। শিক্ষক নিয়োগ করা হয় অর্থের বিনিময়ে, যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়।
এর জন্য দায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ তথা সরকার। প্রাইমারী, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধান না করে সরকার কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়- এ চিন্তা বাস্তবসম্মত নয়।
প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয়-
(১) যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করা;
(২) বর্গাশিক্ষক ও ডেপুটেশন নিয়োগ বাতিল করা;
(৩) স্কুলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা;
(৪) শিক্ষক আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা;
(৫) স্কুলের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করা;
(৬) অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও গরীব পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা;
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
(১) পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাতে তারা নির্বিঘ্নে স্কুল-কলেজে যাতায়াত করতে পারে;
(২) পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা;
(৩) গরীব পাহাড়ী পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা, যাতে তারা তাদের সন্তানদের পড়ালেখার খরচ যোগান দিতে অসুবিধা না হয়;
(৪) পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা;
সরকার কর্তৃক উপরে উল্লেখিত বিষয়াদি নিশ্চিত করা হলে তবে পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন স্তরে মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে এবং এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সুফল পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে পৌঁছবে।
নচেৎ এ দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাহাড়ীদের জন্য কোন উপকারে আসবে না; বরং তা পাহাড়ীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এই দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা পাহাড়ীদের কি কি লাভ বা ক্ষতি হতে পারে সেবিষয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হল- পার্বত্যবাসীর কি কি লাভ হতে পারে?
(১) পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ পাবে;
(২) অনেক পাহাড়ী স্টুডেন্ট ঘরে বসে / আত্মীয় স্বজনের বাসায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় / মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করতে পারবে;
(৩) অর্থনৈতিক সাশ্রয় হবে;
(৪) চিকিৎসা সুবিধা পাবে; আমি এখানে যেসব সুবিধার কথা উল্লেখ করলাম তা আপেক্ষিক মাত্র।
পার্বত্যবাসীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ পাবে এ কথা সত্যি, কিন্তু এ দু’টি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কারণে পাহাড়ীদের উপকার হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
এ দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার সুযোগ গ্রহন করে অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের বিষয়টিও অনিশ্চিত। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ভর্তির সাথে ভর্তির ন্যুনতম যোগ্যতার বিষয়টি জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার ন্যুনতম যোগ্যতা পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রীদের আছে কি না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। তেমনিভাবে চিকিৎসা সুবিধার বিষয়টিও একটি আপেক্ষিক বিষয় বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।
পাহাড়ীদের কি কি ক্ষতি হতে পারে?
(১) এ প্রসঙ্গে প্রথমে প্রশ্ন হলো- এ মূহুর্তে বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে তাতে ক’জন পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হতে পারবে? বাস্তবতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় ভর্তির যোগ্যতা না থাকার কারণে খুব বেশী পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী এ দু’টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না।
ফলত: এ দু’টি প্রতিষ্ঠান পাহাড়ীদের উপকারে আসবে না; ররং পাহাড়ীরা নানামূখী ক্ষতির শিকার হবে;
(২) সারা দেশের ছাত্র-ছাত্রী এই দু’টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে। তারা এখানে পড়াশুনা করবে পাশাপাশি তারা এখানে জমির মালিক হবে, পরিবারের মালিক হবে; যেমনি হয়েছিল সমতল এলাকা থেকে যারা স্রেফ চাকরি করতে এসেছিল তারা;
(৩) এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দু’টি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আখড়া হবে। সেখানে পাহাড়ীরা হবে প্রান্তিক। এটি বাঙালীদের রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্ররূপে আবির্ভূত হবে। তাই এটি পাহাড়ীদের জন্য খাল কেটে কুমির আনার মত হবে;
(৪) এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও স্টাফ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
(৫) পাহাড়ীদেরকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রে এ দুটি প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে;
(৬) পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থায় এই দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা হবে;
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তা গভীর পর্যালোচনার দাবী রাখে, তা হলো- উন্নয়ন আগে না অস্তিত্ব আগে? অর্থাৎ আমাদের কোনটি জরুরী-উন্নয়ন না অস্তিত্ব? চিকিৎসা বা শিক্ষার সুবিধা না অস্তিত্ব রক্ষা? কোনটিকে আমরা প্রাধান্য দেবো? অবশ্যই আমরা এক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া উচিত ও প্রাধান্য পাওয়া উচিত।
শিক্ষা বা অন্য কোন উন্নয়ন করতে যেয়ে যদি আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যায় বা অস্তিত্ব ধ্বংস হবার ভিত্তিভূমি আমরা নিজেরাই তৈরী করি তাহলে সেটি অবশ্যই আমাদের আত্মঘাতি হবে।
নিশ্চয়ই আমরা এমন উন্নয়ন প্রকল্পে সায় দেব না, যার কারণে আমাদের অস্তিত্ব ধ্বংস হবার ভিত্তিভূমি তৈরী হবে, সেটি শিক্ষা উন্নয়ন কিংবা অন্য কোন উন্নয়ন হোক।
আমি শুরুতেই বলেছি- আমাদের শিক্ষা দরকার। উচ্চ শিক্ষা আরো বেশী দরকার। সেকারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ দরকার। কিন্তু এ মূহুর্তে নয়।
‘স্থান-কাল-পাত্র’ বলে একটি কথা আছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার সময় এখনো হয়নি। আমার সামর্থ্য হলো ১ মণ ওজণের একটি বস্তা বহন করার।
কিন্তু আমি যদি ৩ মণ ওজনের একটি বস্তা নিই বা আমাকে দেওয়া হয় তাহলে আমার অবস্থা কি হবে? ঠিক তেমনি যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ স্থাপন শাকান্ন ভোজী গরীব মানুষকে পোলাও-বিরানী খাওয়ায়ে অসুস্থ করার সামিল হবে।
এ বিষয়গুলি আমাদের গভীরভাবে ভাবার দাবী রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ না হলে পাহাড়ীদের উচ্চ শিক্ষা থেমে থাকবে না; কিন্তু এ দু’টি প্রতিষ্ঠান হলে পাহাড়ীদের জীবন থেমে যাবে।
এ জনগোষ্ঠীর জীবন থেমে যাবার ভিত্তিভূমি রচিত হবে। বর্তমানেও পাহাড়ীদের উচ্চ শিক্ষার সম্প্রসারণ থেমে নেই। দিন দিন এর সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এটিকে আরো গতিশীল করার নানান উপায় আছে। বর্তমানে সেদিকে বেশী নজর দিতে হবে। ভবিষ্যতের পানে তাকিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাব্যবস্থায় মানসম্মত শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে যাতে যোগ্যতা অর্জন করতে সেদিকে অধিক পরিমানে মনোনিবেশ করতে হবে।
এটি করা যদি সম্ভব হয় তাহলে নিকট ভবিষ্যতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ হয় তখন পাহাড়ীরাই উপকৃত হবে এবং এর সুফল পাবে।
আমি এ বিষয়ে সকলের সুচিন্তিত মতামত ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কামনা করছি। সর্বশেষ আমাদের প্রস্তাবনা:
(১) বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ স্থাপনসহ সকল উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাগত নেতৃত্বের সাথে আলোচনা ও পরামর্শ গ্রহণ করা;
(২) পাহাড়ী ছাত্র-ছাত্রী তথা পাহাড়ী জনগণ যাতে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সুফল পেতে পারে সেজন্যে এই দু’টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা;
(৩) আপাতত: রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সকল প্রকার কার্যক্রম স্থগিত রাখা;
(৪) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা করা; এ সরকার জনগণের নির্বাচিত সরকার।
তাই এ সরকার জনগণের স্বার্থ ও মতামত গ্রাহ্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর সরকার যদি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ভুলুন্ঠিত করে জোর করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেক্ষেত্রে জুম্ম জনগণের পক্ষ থেকে যেকোন মূল্যে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই বাঞ্চনীয়।
লেখক: শক্তিপদ ত্রিপুরা (সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি)
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।