রাধামন ধনপুদি পালা ও ইতিহাসের কিছু কথা

Jumjournal
Last updated Jul 2nd, 2020

2671

featured image

এই নিবন্ধের শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ইতিহাসের কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনছি বিধায়। চাকমাদের ঐতিহাসিক তথ্য মতে, কলাপনগরের রাজা লাঙল ধনের রাজত্বকাল ৫৬৪ – ৫৩০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ। লাঙল ধনের পুত্র ক্ষুত্রজিতের রাজত্বকাল ৫২৯ – ৫১০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ।

ক্ষুত্রজিতের পূত্র সমুদ্রজিত পিতার ন্যায় প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তাঁর একমাত্র প্রাণসম পুত্রের মৃত্যু হলে অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে সংসার ও রাজ্যশাসনের প্রতি উদাসীন হন। তাঁর এই উদাসীন বৈরাগ্যের কারণে মন্ত্রী শ্যামলকে রাজ্যভার অর্পণ করে বুদ্ধের সন্যাস ব্রত গ্রহণ করে তপোবনবাসী হন।

মন্ত্রী শ্যামল কলাপনগরের রাজ্যভার গ্রহণের পর বহু বছর দক্ষতার সহিত রাজ্য পরিচালনা করার পর পরলোক গমন করেন। রাজা পরলোক গমন করার পর তাঁর পুত্র চম্পাকলি সগৌরবে পিতৃসিংহাসনে উত্তরাধিকারী মনোনীত হন।

Chakma traditional dress up
চাকমাদের জাতীয় পোশাকে দুজন শিশু, ছবিঃ chakmapeoples.blogspot

চম্পাকলি সিংহাসনে বসার পর অপর বহু রাজ্য জয় করে নিজের করায়ত্বে নিয়ে আসেন। পরে কলাপনগর ত্যাগ করে হিমালয় পর্বতের পার্শ্বে গঙ্গানদীর তীরবর্তী সমতল এলাকায় এক সুন্দর নগর স্থাপন করেন। স্বীয় নামানুসারে নগরের নাম রাখেন ‘চম্পকনগর’।

মূলত চাকমা ইতিহাসে ঐতিহ্যসহ নানা তথ্যমতে এটিই প্রথম চম্পকনগর এবং ভারতের মগধ রাজ্যে এই চম্পকনগর অবস্থিত বলে ঐতিহাসিকদের মত।

এবার নিবন্ধের মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক; চাকমা জাতির আদি নিবাস চম্পকনগর। সেই চম্পকনগর রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি জনবসতি গ্রামের নাম ছিল ধনপাতা।

গ্রামটি ছিল ধনে জনে পরিপূর্ণ এবং ঐ গ্রামের ছয় কুড়ি মানে একশ বিশটি চাকমা পরিবার বাস করতো। তখন চাকমারা মাচাং ঘরের উপর বাস করতো। ধনপাতা গ্রামের সব বাড়ীই ছিল মাচাং ঘর।

চম্পকনগরের সেই ধনপাতা গ্রামে মেনকা ও কপুদি নামে দুই বোন বাস করতো। একসময় তাদের বিয়ে হয় ঐ গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরে।

মেনকার স্বামীর নাম জয়মঙ্গল আর কপুদির স্বামীর নাম নিলগিরি। মেনকার স্বামী জয়মঙ্গল শুধু অবস্থাপন্নই নয়, সেই ধনপাতা গ্রামে বিশাল প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল।

এক সময় তাদের দু’বোনের মধ্যে মেনকার ঘরে জন্ম হয় রাধামন আর কপুদির ঘরে জন্ম হয় ধনপুদি। রাধামন ধনপুদি থেকে এক বছরের বড়। তারা দু’জন বেড়ে উঠে মা-বাবা আর নানা-নানী, দাদা-দাদির কোল বেয়ে।

শিশুকালে তাদের নানা-নানীরা দোলনায় রেখে নানা রকম ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতো, যেমন-

নাদিন দ্বিবে এধঝেবর
দাঙর দাদা এক বঝর
গলা মরিজে তান্যাগোই
পারবো দগা আন্যাগোই
নাক্স গাজর রিবেং জু
বুন্যা ধুলোন কেরেং জু
কেরেং জু ধুলোনর কেরেদ’ চাক
ওঝে বুনিল চলাবাপ
ধুলোন বুনোনা থুম অল’
নাদিন দুওবো তুলিল’
বোত্যা দোরি ঘন’ পাক
অলি দাগি দের চলাবাপ
সনার ধুলোনত রূবোর দোরি
দাদালোই বেবেই ঘুম যাদন
সমারে ধুলোনত পরি
অলিরে অলি অলি অলি।
আহ্ধত লোইয়্যা বাদোল বাজ
কুচ্যাত লোইয়্যা গুলি
আমা দাদা মারি আনিব’
বনের’ পক্খী।
ধুল্ল বুয়ারে ধুলনান
আহঝি উধিল’ জনমান।

[মেইয়্যা ছিদিল’ মেইয়্যা জালে
মাত্তল অল’ মহাকাল
দিনর গাঙে দিন উযাদন
গুরো দুওবো বারদন
এ্যাহ্ধে ফরেল’ কাদাবন
চিগোন ছরার পাদাবন
মেনকা পুও রাধামন
সাবে বানল্য রঙকুদি
বিদ্যাসুন্দর গমপুদি
কপুদি ঝিব’ ধনপুদি
চগদায় কামাল্য থুর’কুন
মেনকা কপুদি সদর ভোন
পুগ’ বেল পজিমে গেল’
সাগর দিন বিদি গেল
ফুদিলেক খলাত জেদেনা খৈ
গাভুর সুন্দর অহলাখকোই
শুল’ সদরত পলাখকোই
সাগর দিন গেলগোই
বেবেই ধনপুদি বার’ বঝরত পলগোই
ঘিলে খারাত তাক চেলাক
সয় সমাজ্যা লাক পেলাক।]

এভাবে দোলনায় দুলতে দুলতে কবে যে তারা কৈশোর পেরিয়ে যৌবনকালে পদার্পন করলো তাদের কারোর হুঁশ নেই। একদিন মাটিতে নেমে খেলতে শুরু করে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে-

ঘিলে খেলা
নাদেং খেলা
পোর খেলা
পোত্তি খেলা
গুদু খেলা
যেমন-
ফুলে লাম্যা ফুল বিজু
তার পর দিন মূল বিজু
সমারে বেরাদন গুর’ঝাক
ঘিলে ভাগ গোল্য চলাবাপ
ধল্য ঘিলে এক থাগত
মিলে মদ্দে এক ফাগত
লামি এলাক গরত্তুন
অহ্লাক এক ফাগত মরত্তুন
পেংগুল রাঙা ঘিলেগুন
কমর দর’ মিলেগুন
নালি ঘোস্য কুরেলাক
আদাম্যা পাড়াল্যা থুবেলাক
বোত্যা দুরি ঘনপাক
খবর দিল চলাবাপ।

কখনো মুখে খেংগরং, বাঁশি, ধুধুক, শিঙা, মেমত বাজাতো শিখলো।

এভাবে তারা একদিন হেসে খেলে তাদের পৃথিবী বড় হয়ে উঠলো এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে সঙ্গী-সাথীও অনেক জুটে গেল। মূলত চাকমাদের লোক কাহিনী ‘রাধামন-ধনপুদি’ পালাটি চাকমা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গীতিকা।

এর সময়কাল আনুমানিক ৫৭০ – ৬০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ। গেংখুলী বা চারণ কবিদের রচনাকাল ৬০০ – ১০০০ খ্রিস্টাব্দ (?) এর মধ্যে।

চম্পকনগরের সুন্দরী কন্যা কপুদি নন্দিনী ধনপুদি এবং মেনকা তনয় রাধামনের প্রেম-মিলন-বিরহ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘রাধামন ধনপুদি’ অমর প্রেম কাহিনী।

এ কাহিনীর মধ্যে দেখা যায় চাকমাদের প্রাচীন সামাজিক প্রথা এবং সামাজিক ঐতিহ্য। যেমন তাদের দু’জনের দীর্ঘদিনের প্রেম-ভালোবাসা থাকার পরও ধনপুদির মা বাবা তাদের একমাত্র কন্যার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে প্রতিবেশী গ্রামের এক ধনী ছেলে আদিচরণের সাথে বিয়ের বন্দোবস্ত করে।

এতে ধনপুদির মতকে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে জোরপূর্বক আদিচরণের সাথে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় ধনপুদির। ধনপুদিকে দেখতে এসে-

খল্যা মেলি পান খাদন
ধনপুদিরে বো চাদন
বগরা মুঝি কপুদি
কয়দ্যা ঝিবরে বো-দি
বিদুর শুনি রাগ বাড়ে
উহ্রুজ-আহ্রাজ কাম গরে
তাগল লাগেই সামেই ব’
দেঘা আনলাক জামেইব’
আদাম্যা গুরয় খাপ্পেই চান
আদিচরণরে রিনি চান
সাঝিত তলে ঝামপাদি
নোনেয়্যা ভোন্ন ধনপুদি
পিজুম বাচ্ছ্য ধোয্যাগোই
সাঙু পাগেই পোজ্যাগোই
সিত্তুন ঘরত উথ্যাগি
সাজিত তলে বোচ্চ্যেগি
মরিচ বাদে ধনপুদি
কামত বাচ্ছ্যে কপুদি
পানে খেইয়্যা সিবুদি
গত্তন আদিচরণরে বিগিদি
মেলাঘরত জামেই ব’
কু-ব’ ক’ধেই ত’ বো-ব’
আহ্ধ ভরেইনে দৈ খেইয়্যা
থিক দি আদিচরণে চেই রইয়্যা
ফুলর কাবর বিঝেই দি
বোচ্ছ্যে ধনপুদি মা পুদি পিঝেদি
বিজি খেল’ খাজুরে
দেঘেই দিল’ আদিচরণ
এ্যাই-এ ম’ বৌ-ব’
মুজুঙে কপুদি মুঝিরে
গানে ধুলে নাঝদন
জাগায় জাগায় আহঝদন
মুঝি ক’পুদি কাঝিল’
দাদা আদিচরণে লাজেল’
সালাঙ গোরি পোয্যাগোই
পান’লঘে সিবুদি
উল্লেই পল’ পিঝেদি
ফেল্যা আহ্ত্থান বিজিদি
দৈয়্য মাধাত ঘি অভ’
কল’ কপুদি কি অভ’
বুগত ফুদিল শক্তি শেল
ঘরত্তুন চিত্তি লামি গেল
আজু ঘরত বোচ্ছ্যেগোই
গুজুরি গুজুরি কানেল্লোই
বোত্যা দরি ঘনপাক
কল’ আজু চলাবাপ
ভাদে কাবরে খেই পেবে
দিলে মা বাবে যেই পেবে।

নিরুপায় ধনপুদি মা-বাবার মন রক্ষা করতে গিয়ে রাধামনের দীর্ঘ দিনের মন দেওয়া-নেওয়ার ঘটনা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। তারপরও আদিচরণের সাথে ধনপুদির বিয়ের পিড়ি বা চুমুলং অনুষ্ঠানে বসতে হয়।

বাদ্য বাজেই সারঙ্গ
গোরিবেক চুমুলং আরাম্ভ
ফুল খাদি থং বদি
চুমুলঙ’ পানি খুম্ম
গাঙত ভরা গেল
নোনেইয়্যা ভোন্ন ধনপুদি
চোরোন্দি ঘরা চোয্যাগোই
চালাগি বুদ্ধি ধোয্যাগোই
চুমুলঙ’ পানি খুম্মলোই
রাধামন দাঘী ঘরত উথ্যাগোই..

তখন কনের সঙ্গে অবশ্যই ৪/৫ জন সঙ্গী যেতে দেওয়া হয়। যাতে কনে পথ ভুলে বা অন্য কোন কারণে অপর কেহ ঘরে না উঠে পড়ে।

চাকমা জাতির সমাজ ও সংস্কৃতির স্মারকরূপে চিহ্নিত এই অমর প্রেম কাহিনীটি স্মরণাতীত কাল থেকে সাহিত্য ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রেখে চলেছে। চাকমা সাহিত্যে এটি একটি মহাকাব্য বলা যেতে পারে।


ঋণ স্বীকারঃ
১। রাধামন-ধনপুদিঃ সম্পাদক – সুগত চাকমা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি;
২। সুহৃদ চাকমা স্মারকগ্রন্থ- সম্পাদক – মৃত্তিকা চাকমা, জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক), রাঙ্গামাটি;
৩। সূর্যবংশ ও চাকমা রাজ বিজক – শ্রীমৎ জীবনসার ভিক্ষু, সাধনাপ্রেম বনবিহার, বানছড়া, রাঙ্গামাটি।


লেখকঃ মৃত্তিকা চাকমা। কবি, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা