মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার(এম এন লারমা ) স্মৃতি
1844
তখন ১৯৫৩ সাল। গ্রামের পাঠশালা সমাপ্ত করে মহাপুরুষ জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হলাম প্রাইমারি সেকশনে। একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর বিদ্যালয়টি অবস্থিত।
বিদ্যালয়টির পশ্চিম পার্শ্ব দিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে খাগড়াছড়ি পর্যন্ত একটি সরকারি রাস্তা চলে গেছে। বিদ্যালয়ের উত্তর-পূর্ব দিকে দিগন্ত প্রসারী ধানের ক্ষেত, দক্ষিণে খেলার মাঠ ও তিন দিকে নানা রকম ফুলের বাগান।
বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত মহাপুরম গ্রাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে ছোট্ট নদী মহাপুরুম প্রবাহিত। নদীর নামানুসারে গ্রামটির নাম হয়েছে মহাপুরম।
বিদ্যালয়ের প্রশাসন ছিল আদর্শস্থানীয়। শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেকটি ছাত্রই বিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন কড়াকড়ি ভাবে মেনে চলতো। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী চিত্ত কিশোর চাকমা।
এই রকম হৃদয়বান আদর্শ শিক্ষক হাজারেও একজন মিলে না। তিনি একজন সমাজ সেবক ও শিক্ষাবিদ। এই প্রধান শিক্ষকের তৃতীয় সন্তান হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু)।
শ্রদ্ধেয় এম এন লারমা আমার থেকে বয়সে ও ক্লাসে ছিলেন বড়। তিনি স্বল্পভাষী ছিলেন, অপ্রয়োজনীয় কথা সহজে বলতেন বলে আমার জানা নেই। পড়াশুনার প্রতি তাঁর বেশ একাগ্রতা ছিল।
অন্যান্য ছাত্রদের মতন তিনি তেমন ঘুরাফিরা করতেন না। এই স্বল্পভাষী লোকটির অন্তরের ভিতর এত দেশপ্রেম, এত জাতীয়তাবোধ যে লুকায়িত ছিল এবং কে জানতো যে শেষ পর্যন্ত তিনিই পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তির আন্দোলনের প্রধান ও প্রথম জীবন্ত মূর্তি হয়ে উঠবেন।
তিনি সৎ ও ন্যায়ের প্রতীক ছিলেন। শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে গোটা ছাত্র সমাজে তিনি ছিলেন প্রিয়পাত্র। কারণ তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও সহমর্মী ছিলেন।
১৯৫৬ সালে তিনি মহাপুরম জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় একটি মাত্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
এই বিদ্যালয়ে অনেকের পড়াশুনা করার ইচ্ছা থাকলেও ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হতে হয়। তাও কিন্তু খুব কড়াকড়ির মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) তখনকার সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটাই ছিল সবচাইতে বড়।
আমিও ঠিক তাঁর চলে যাওয়ার এক বছর বাদে মহাপুরম স্কুল থেকে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমি থাকতাম দুই নম্বর হোস্টেলে আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা থাকতেন এক নম্বর হোস্টেলে। সেখানে দেখেছি পড়াশুনায় দিনে একদম ধ্যানস্থ হয়ে থাকতেন; কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদও করতে দেখিনি। কিন্তু কেউ যদি স্বজাতির নামে অসম্মানজনক ও অবজ্ঞাসূচক কথা বলতো তখন কিন্তু তিনি তাঁর জোড়ালো প্রতিবাদ না করে থাকতেন না।
এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনাই তাঁর ছাত্রজীবনে ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু তিনি যে ভিতরে ভিতরে রাজনীতি আর দর্শন তত্ত্বের বই পড়তেন খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রই তা জানতে পারে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও এখানে আর একজন ছাত্রের কথা উল্লেখ করছি।
তাঁর নাম ছিল সুধাকর খীসা। তিনিও থাকতেন দুই নম্বর হোস্টেলে। তাঁকেও দেখেছি নানা ধরনের রাজনীতির বই পড়তে।
একদিন তো থানা থেকে পুলিশ এসে দস্তুর মতন তাঁর সব বইপত্র এবং ট্রাঙ্ক তল্লাসী করেছিল এবং তাঁকে শেষ পর্যন্ত থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। অবশ্য পরে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।
আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়তাম তখন একদিন আমাকে বিকেল বেলায় বিদ্যালয়ের কম্পাউন্ডে ডেকে নিলেন প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। বললেন, ‘দেখো মনোজ, চলবে না!
এই ডিগ্রির সার্টিফিকেট দিয়ে আমাদের কোন লাভ হবে না। সরকারি চাকরি করি আর বেসরকারি চাকরি করি, আমাদের জুম্ম জাতির ভাগ্য কিছুতেই পরিবর্তন হবে না।
কাজেই আমাদের অন্য পথ ধরতে হবে। যেই পথের কথা বলছি, সেই পথ কিন্তু খুবই কঠিন আর বিপদসঙ্কুল।
যেমন দেখো – মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বোস, সূর্যসেন-এর মত অনেক মহাপুরুষ ও বিপ্লবীদের ঘটনাবলী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।’ আমি প্রয়াত নেতার এ ধরণের কথা যতই শুনছি ততই আমার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতে থাকে।
তিনি আরও বলেন – ‘মহাপুরুষের জীবনী সুযোগ পেলে পড়ে নিও। পত্রপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনও পড়তে হবে। তিনিই প্রথম আমার পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন পড়ার প্রেরণা এনে দিয়েছিলেন।
প্রয়াত নেতা ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েও কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে তিনি ঐ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। আবার তিনি একই কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। থাকতেন পাথরঘাটার পাহাড়ী ছাত্রাবাসে।
তখন আমি পড়তাম স্যার আশুতোষ কলেজে আইএ ক্লাসে। তখনও তিনি আমাকে মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য খবরাখবর দিতেন।
স্যার আশুতোষ কলেজে পড়লেও আমি থাকতাম শ্রীপুর পাহাড়ী ছাত্রাবাসে। গ্রাম্য এলাকা হলেও শ্রীপুর বেশ সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও বর্ধিঞ্চু ছিল।
তখন ১৯৬২ সাল। প্রয়াত নেতা তখন বিএ ক্লাসের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমাকে একখানা জরুরি চিঠি দিলেন তাঁর সাথে দেখা করার জন্য।
তখনতো সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলছে। ভয়ে ভয়ে চলতে হয়। তখনতো কলেজে জুম্ম ছাত্রসংখ্যা একদম নগণ্য। প্রত্যেকটি জুম্ম ছাত্রের পিছনে টিকটিকি (ডিআইবি) লাগানো থাকতো। গেলাম চট্টগ্রামে।
দেখা যখন হয় তখন আমাকে বললেন, ‘ভাই আমাদের একটা কাজ করতে হবে। দেখছ না কাপ্তাই বাঁধের ফলে আমাদের জুম্ম জনগণের ৫৪,০০০ একর জমি জলের তলায় ডুবে গেল, আর লক্ষাধিক লোক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন না পেয়ে নানাদিক ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।
পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উপর ভণ্ডামী আর জোচ্চুরী রাজনীতি শুরু করেছে। কাপ্তাই বাঁধের জল ৬০ ফুটের নিচে রাখা; উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে একটা লিফলেট জুম্ম জনগণের কাছে বিতরণ করি।’
অবশ্য এ ব্যাপারে বুদ্ধিজীবী এবং চাকরিওয়ালা ছেলেদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবো না বলে মন্তব্য করলেন। তুমি আজ শ্রীপুর ছাত্রাবাসে গিয়ে এ সম্পর্কে অবস্থা বুঝে আলোচনা করো।
পরের দিন সতীর্থদের প্রয়াত নেতার কথাগুলো বললাম। তখন গ্রামের ছেলেরা প্রত্যেকেই প্রয়াত নেতার কথা সমর্থন করলো। শুধু চুপ করে রইলো ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের ছেলেরা।
শুধু চুপ করে থাকলো না, তারপর দিন থেকে কলেজের পড়াশুনা বাদ দিয়ে গোপনে স্ব স্ব বাড়িতে চলে যেতে শুরু করলো।
পাশে রাজনীতি করার অজুহাতে গ্রেপ্তার এবং নিজ নিজ অভিভাবকদের স্বার্থহানি হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা গাঁয়ের চাষাভূষা ছেলেরাই শ্রীপুর পাহাড়ী ছাত্রাবাসে রয়ে গেলাম।
সম্ভবত ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস হবে। আমি ও পূর্ণ মোহন চাকমা দু’জনে চট্টগ্রাম গেলাম নির্দিষ্ট তারিখে লিফলেট গুলি নিয়ে আসার জন্য।
এম এন লারমার সাথে দেখা হলো এবং গোপনে প্রেস থেকে ছাপা কাগজগুলি নিয়ে আসলাম। আমরা সেই লিফলেটগুলি নিয়ে সোজা চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে গেলাম।
গোমদণ্ডী রেল স্টেশন হয়ে চলে আসলাম সেদিন রাত্রে শ্রীপুর ছাত্রাবাসে। কিন্তু পরের দিন যোগাযোগ ছাড়াই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ও প্রদ্যুৎ দেওয়ানসহ চট্টগ্রাম থেকে শ্রীপুর ছাত্রাবাসে হঠাৎ উপস্থিত হলেন।
আমরা তো একদম অবাক। শেষ পর্যন্ত আসল ব্যাপারটা জানতে পারলাম। জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ও প্রদ্যুৎ দেওয়ান লিফলেটগুলো বিতরণ করার সম্পূর্ণ বিরোধী।
কারণ যুক্তি হলো ভাষাটা অত্যন্ত কড়া হয়েছে। এই লিফলেটগুলি বিলি হবার সাথে সাথে আমরা সবাই গ্রেপ্তার হয়ে যাবো।
শেষ পর্যন্ত কিছু শব্দের রদ-বদল করে আবার ঠিক হলো ছাপানো হবে। এই মর্মে সিদ্ধান্ত হলেও আমরা তেমন পরিবর্তন না করেই পুনরায় ছাপালাম।
এবারের লিফলেটগুলো বিতরণ করার পালা। কিভাবে বিতরণ করা হবে প্রয়াত নেতা সবই আগেভাগে আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
একদিন সকালে আমি ও কালী মাধব চাকমা (মিহির) শ্রীপুর থেকে সে কাগজগুলো নিয়ে দু’টো সাইকেল দিয়ে রওনা দিলাম। প্রথমে চন্দ্রঘোনার দিকে।
তখন চারু বিকাশ চাকমা ও ধর্মদর্শী চাকমা চন্দ্রঘোনা কাগজের মিলে চাকরি করতেন দু’জনকে দু’টো আলাদা খামের ভিতর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ব্যক্তিগত চিঠিসহ একটি করে লিফলেট বিতরণ করলাম।
এরপরে গেলাম কাপ্তাই। সেখানকার সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) ছিলেন প্রভাত কুমার চাকমা। তাঁর নামের খামটি দিলাম। লিফলেট কপি পড়লেন এবং কয়েকটি স্থানে দাগ দিলেন। বললেন, ‘পুতলক্’ (ছেলেরা), তোমরা এসমস্ত কি কাজ করেছ? মঞ্জু (এম এন লারমা) তোমাদেরকে শেষ করবে। তোমরা এগুলি আর বিলি করো না।
কলেজে ফিরে যাও। এটা পাকিস্তান সরকারের কানেও গেছে। সরকার তোমাদের ছাড়বে না, আমাদেরও চাকরি থাকবে না। অবশ্য তাঁর সাথে এ ব্যাপারে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়ে যায়।
অনেক কষ্টে রাঙ্গামাটি পৌঁছলাম। সেখানে পৌঁছে কারো বাড়িতে না উঠে আনন্দ বিহারে (বৌদ্ধ মন্দির) উঠলাম। পথে যারা আমাদেরকে দেখেছে অনেক বাঁকা চোখে দেখলো এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি।
তারপর আমরা রাঙ্গামাটি পৌঁছার আগেই বাড়ি বাড়ি প্রচার হয়ে গেছে যে, লিফলেট যারা বিলি করতে আসবে তাদেরকে অন্তত কেউই জায়গা দেবে না।
এই সূত্রে আমরা কারো বাড়িতে না উঠে সেজন্য সোজা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে উঠলাম। আমাদের একটাই সংকল্প যে কোনভাবেই হোক আমাদের এই লিফলেটের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকারের ভন্ডামী আর অন্যায়ের কথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছে পৌঁছে দেবো।
এরপর বন্ধুবর গৌতমমুণি চাকমা (অঙ্কন) এর সাথে দেখা হয় এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বললাম। বলার পরই তিনি সোজাসুজি তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন।
তাদের বাসায় আমাদের সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গেলাম। তারপরের দিন থেকে লিফলেট বিলি করতে শুরু করি।
এক সপ্তাহের মধ্যে পাহাড়ী ছাত্র সমিতির সহযোগিতায় এই কাজটি আমরা নিরাপদে সমাপ্ত করে শ্রীপুর ছাত্রাবাসে ফিরে গেলাম। শ্রীপুরে একদিন বিশ্রাম নেয়ার পরে এম এন লারমার সাথে দেখা করতে গেলাম চট্টগ্রামে।
তাঁর বিছানায় বসলাম। আমরা কিভাবে বিলি করেছি, সুবিধা-অসুবিধার কথা অবগত করতে শুরু করলাম। এমন সময় একজন দাঁড়িওয়ালা বাঙালি লোক ছাত্রাবাসে ঢুকে পড়লো।
এম এন লারমা আমাকে বললেন ‘এই লোকটি টিকটিকি। আমার মনে হয় সরকার আমাকে ছাড়বে না। আমার পিছনে ওরা অনেকদিন ধরে লেগেছে। আমার মন বলছে পুলিশ যে কোন সময়ে আমাকে গ্রেপ্তার করবে।
পাহাড়ী ছাত্র সমিতির কোন কাগজপত্রে যদি আপত্তিমূলক লেখা থাকে সেগুলি আজকে শ্রীপুর ছাত্রাবাসে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে।
সেখানেও তল্লাসী চলতে পারে (কারণ পাহাড়ী ছাত্র সমিতির প্রধান কার্যালয় ছিল তখন শ্রীপুর ছাত্রাবাসে)। তবে এ কথা মনে রেখো আমাদের দেশে একদিন আন্দোলনের জোয়ার আসবে।
আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তোমরা ঘাবড়িয়ে যেও না। যেকোনভাবে হোক না কেন পাহাড়ী ছাত্র সমিতিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাইও।’
বিকাল প্রায় পাঁচটা বাজে। প্রয়াত নেতা লারমার নিকট থেকে বিষণ্ন আর ক্ষুণ্ণ মনে বিদায় নিয়ে বের হলাম। ৬:৩০ মিনিটের ট্রেনে করে ফিরলাম শ্রীপুর ছাত্রাবাসে।
এর কিছুদিন যেতে না যেতেই শুনতে পেলাম তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তখন আমরা মর্মাহত হয়ে পড়লাম। কিন্তু তথাকথিত আদর্শবান ছাত্ররা তাঁর গ্রেপ্তারের খবর শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
আর ঘুণেধরা সামন্ত সমাজে তথাকথিত নেতা, বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী যারা ড্রইংরুমের রাজনীতি, সমাজনীতিতেই পারদর্শী, যারা রাজনীতির নামে ‘র’ও উচ্চারণ করতে সাহস করতো না, যারা কাপ্তাই বাঁধের মতো ধ্বংসাত্নক কার্যক্রমে কোনদিন প্রতিবাদ করেনি বরঞ্চ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে নিজের আখের গুছিয়েছে তারা সবাই তরুণ ছাত্রনেতা মানবেন্দ্র লারমাকে পরমানন্দে নানাভাবে বিদ্রুপ করতে থাকে।
যেমন – এবার নিশ্চিন্তে ঘুমানো যাবে, যেমনি কর্ম তেমনি ফল, এত বড় সাহস যে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু কালের গতিতে যারা একদিন তাঁকে বিদ্রুপ ও কটুবাক্য বর্ষণ করেছিল, সেসব তথাকথিত স্বনামধন্য ব্যক্তিরা একবাক্যে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, হ্যাঁ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সত্যিই মানবের ইন্দ্র (শ্রেষ্ঠ), অন্তত এত অনুন্নত পশ্চাদপদ জনগণের মধ্যে সে একমাত্র নেতা।
ইহা বাস্তব সত্য একমাত্র মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাই প্রথম ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম সত্যিকারভাবে জীবনের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে জুম্ম জনগণের স্বার্থে কারাবরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তান সরকারের স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন নির্ভয়ে।
তিনিই ছিলেন জুম্ম জাতির সংগ্রামী ইতিহাসে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
জেলে থাকাকালীন তাঁর সাথে আমার মাত্র তিনবার দেখা হয়েছিল। তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সাদা রঙের কাপড়-চোপড় খুবই পছন্দ করতেন। স্কুল এবং কলেজ জীবনে এমনকি চাকরি জীবনেও সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট বেশি পরতে দেখেছি।
সেই জেলে থাকার সময়েও একই পোষাক পরিহিত অবস্থায় বার বার দেখেছি। তাঁর সাথে কথা বলার সাহস করতে পারিনি কোনদিন।
মনে ভয় ছিলো তাঁর সাথে কথা বললে হয়তো পুলিশের লোকেরা আমাকে এবং তাঁকে অপদস্ত করবে। তখন অবশ্য পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বন্দীদের সাথে যে কথা বলা যায় সেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল।
একবার কোর্ট থেকে যখন তাঁকে অন্যান্য বন্দীদের সাথে লাইন করে জেলে নিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ রাস্তার মধ্যে চোখাচোখি হয়। আমাকে দেখে একটু করে হাসলেন তিনি। সেই দিনও সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরিধান করেছিলেন।
দেখলাম কাপড়-চোপড় একদম ময়লা হয়ে গেছে। শরীর শুকিয়ে গেছে। হাতে হাতকড়া ছিল। সেদিন উনাকে যে দেখতে পাবো আমি কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি।
ধীরে ধীরে রক্ষীরা চলে গেলে এক বুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস অজান্তেই বের হয়ে গেল। বুকে এক যন্ত্রণা নিয়ে আমি আমার আবাসে গেলাম সেদিন। ভাবলাম রাজনীতি জীবনে একমাত্র বন্ধু ও পথ প্রদর্শক আজ আমাদের থেকে অনেক দূরে।
এদিকে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে। প্রয়াত নেতার মুক্তির কোন খবর নাই। সমাজে যারা নিজেদেরকে নামীদামী পন্ডিত, রাজনীতিবিদ আর সমাজসেবী ও জাতীয় নেতা বলে নিজেদের বাহাদুরির ঢং দেখায়, তারাতো ভুলেও কোনদিন লারমার মুক্তির ব্যাপারে মুখ খুলেননি। রতনে রতন চিনে আর ভণ্ড ভণ্ডকে চিনে।
তাই বাঙালি সমাজের মধ্যে অনেকেই জুম্ম জনগণের দুঃখ দুর্দশা উপলব্ধি করতেন আর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম তথা মানব প্রেমের দিকটা যারা জানতেন তারাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন মুক্তির জন্য।
আর সেইসব বাঙালি হিতাকাঙ্ক্ষী, দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী বন্ধুদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ মুক্তি লাভ করেন। যেদিন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা মুক্তি লাভ করেন সেদিন স্বজাতির মধ্যে ক’জনেই বা উপস্থিত থেকে তাঁকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন দিয়েছিলেন। ভাবতেও অবাক লাগে।
জুম্ম জনগণ সে সময়ে কতই না ভয়ে ভয়ে থকতো। অথচ অকুতোভয়ে যেসব বাঙালি বিপ্লবী বন্ধুরা চট্টগ্রামের জেএম সেন হলে এক বিরাট সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে তরুণ ছাত্রনেতা নারায়ণ লারমাকে মাল্যভূষিত করে। সম্বর্ধনা সভায় শত শত লোক উপস্থিত ছিল। সেদিন সেই সম্বর্ধনা সভার পক্ষ থেকে জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন – ‘আমাদের মানবদা (মানবেন্দ্র লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মুক্তি আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী, যিনি আগামী দিনে একজন বড় রাজনীতিবিদ এবং জুম্ম জনগণের মুক্তির দিশারী হবেন।
আমরা বাঙালি হলেও একদিন আমাদেরকে তাঁর থেকে রাজনীতির পরামর্শ নিতে হবে।’ বস্তুত পরবর্তী জীবনে আমরা তাই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হতে দেখেছি।
কিন্তু তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ, আর বিপ্লবী চেতনা এবং নির্যাতিত নিপীড়িত জুম্ম জনগণের মুক্তির দিশা, মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দেশী-বিদেশী গুপ্তচরের খপ্পড়ে পড়ে জুম্ম জাতির মুক্তির অগ্রনায়ক মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি।
যারা তাঁকে শত্রু ভেবেছিলেন, তাদেরকে তিনি ভেবেছিলেন নিতান্তই আপনজন। তিনি ছিলেন একাধারে ক্ষমাশীল এবং অন্যধারে দয়াশীল।
এই দু’য়ের সুযোগে ক্ষমতালোভী জাতীয় বেঈমান গিরি, প্রকাশ, দেবেন, পলাশ চক্র তাদের কয়েকজন বাছা বাছা অনুগামী চাটুকার এলিন, এ্যামং-এর নেতৃত্বে পাঠিয়ে দিয়ে প্রিয় নেতাকে হত্যা করতে সাহস পেয়েছিল ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সনে।
এরা জাতীয় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। জুম্ম জাতির ইতিহাসে জাতীয় শত্রু হিসেবে এদের নাম চিরদিন থাকবে। এই কুলাঙ্গারেরা জীবিত থেকেও মৃত।
কিন্তু হে মৃত্যুঞ্জয়ী মানবেন্দ্র তোমার তো হয়নি মৃত্যু! তুমি অমর। তুমি বিশ্বের বিস্ময়! তুমি শহীদ। তোমার স্মৃতি চিরদিন আমাদের প্রেরণা যোগাবে। তোমাকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি।
লেখকঃ মনোজ
তথ্যসূত্রঃ স্মারক গ্রন্থ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবন ও সংগ্রাম; এপ্রিল ২০১৬
আরও পড়ুন – আমার চোখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।