লুঙ্সা গ্রামের রূপকথা

Jumjournal
Last updated Mar 25th, 2020

632

featured image

নাগাভূমির একটি ছোট্ট গ্রাম। তার নাম লুঙসা। লুঙসায় লোথাদের বসতি। সেই গ্রামেই লিমো আর টোমো নামে দুই যুবক বাস করত।

দিন-রাত একত্রে ঘুরত। একত্রে শিকার করত। একত্রে বনে ঘুরত, একত্রে বাড়ি ফিরত।

 লোথাদের বিশ্বাস, কোন বাঘ যদি কারো পিছু নেয়, তবে হয় সে বাঘকে মেরে ফেলতে হবে, নতুবা সে বাঘ একদিন তাকে খেয়ে ফেলবেই।

এ কথা জেনে টুনলার বাবা বলেছেন, যে ছেলে ঐ কেঁদো বিশাল বাঘকে মারতে পারবে, তার সঙ্গেই বিয়ে দেবেন টনলার।

ঐ বাঘ মারা সহজ নয়। এ জন্যই নলার মত সুন্দরী মেয়ের আজও বিয়ে হয়নি। একে তার বাবা সমাজের সর্দার তায়।

এ বাঘ মারার দায়- এ জন্যই লোথা যুবকেরা টুনলাকে বিয়ে করার কথা ভাবে না। লিমোর মনে গেঁথে গেছে কিন্তু টুনলার ছবি।

ঐ বনদেবীর মত মেয়ে। যদি ঘরে না আনা গেল, তবে কিসের পৌরুষ? কিন্তু কিভাবে মারা যাবে ঐ বাঘ?

লিমো তার মনের কথা কাউকে বলতে পারে না। বলতে পারে না তার বাবা-মাকে। বলতে পারে না প্রাণের বন্ধু টোমোকে।

বুকের ব্যথা বুকে চেপে রেখে দুঃখে দিন কাটায়। মনের দুঃখে লিমো দিনকে দিন রোগা হয়ে যেতে থাকে। তার আহারে রুচি থাকে না।

টোমোর সঙ্গে শিকারে বেরিয়ে ঠিকমত তীর চালাতে পারে না। টোমো বলে, ভাই লিমো, কি হয়েছে তোর।

 লিমো ম্লান হাসল, বলল, যা হয়েছে তা সকলকে বলবার নয়।

টোমো বলল, লিমো ! আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, সমস্ত সুখে, দুঃখে আমি থাকব তোর পাশে—সে কথা কি ভুলে গেছিস? আমি তোর বন্ধু ! আমাকে বলতে পারিস না, এমন কথা কি থাকতে পারে ?

লিমা বলল, এ সব আমি জানি। তুই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু । তবু তোকে আমি বলতে পারছি না, এও যে কতবড় দুঃখ তা তোকে কি বলব!

 টোমোও হাল্কা হাসল। বলল, তুই না বললেও আমি বুঝেছি তুই টুনলাকে বিয়ে করতে চাস।

কিন্তু ঐ বাঘ না মারলে তো টুনাকে বিয়ে করতে পারবি না। ও বাঘ মারা কি সহজ!

 লিমো ঢোমের হাত চেপে ধরল। অবেগে বলল, আমাকে ও বাঘ মারতেই হবে।

টোমো বলল, পূবের সুর্য পশ্চিমে ওঠা যায় না। তুই ও সংকল্প ছেড়ে দে। ওটা অসম্ভব ব্যাপার।

লিমো বলল, আমি অসম্ভবকে সম্ভব করব।

লিমোকে চোখে চোখে রাখে টোমো। ওর ভাবভঙ্গি দেখে ভয় পায় সে।

কিন্তু বাঘ মারবার কোন উপায়ও বের করতে পারে না। হঠাৎ যদি লিমো গিয়ে

হাজির হয় বনে! টোমো বন্ধুর হাত ধরে বলে, আমাকে না বলে কিছু করবি লিমো।

লিমো বলে, বন্ধু ! বাঘ আমাকে মারতেই হবে।

টোমো বলে, ভাবা যাক। ভাবতে ভাবতে একটা পথ পাওয়া যাবেই।

কিন্তু কোন পথের জন্য অপেক্ষা করল না লিমো। একদিন হঠাৎ টোমো দেখল বর্শা আর দা নিয়ে লিমো চলেছে বনের দিকে।

পশ্চিম আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য এখুনি অস্ত যাবে। এখন ত’ বনে যাবার সময় নয়—এখন ফেরার সময়।

এ সময়ে কাউকে না জানিয়ে গোপনে লিমো কোথায় চলেছে? সঙ্গে বর্শা আর দা! তবে কি লিমো বাঘ শিকারে চলেছে? এ যে মৃত্যুর জন্য যাওয়া।

 টোমো আর চিন্তা করল না। সেও বর্শা আর দা নিয়ে লিমোর পিছন পিছন চলল। লিমোকেও কিছু জানাল না।

গভীর বন। পাশে ঝরনার জল বয়ে চলেছে ঝির ঝির করে। এখানেই বাঘ জল খেতে আসে।

লিমো কাছেই একটা ন্যাড়া গাছে উঠে বসল। টোমো গাছে উঠল না। বাঘকে তার সামনে দিয়েই যেতে হবে।

গভীর রাত। দেখা গেল অন্য পথে বাঘ এসে দাঁড়িয়েছে লিমোর গাছের নিচে। সে লিমোকে দেখেছে।

সামনের দু-পা তুলে সে গাছ আঁচড়াচ্ছে আর গাঁক গাক চিৎকার করছে।

 খুবই চমৎকার সুযোগ। লিমো ওপর থেকে বর্শা একেবারে বাঘের দুই চোখের মাঝখান দিয়ে গোটা মাথা ভেদ করে দিতে পারে।

কিন্তু সে মারছে না। কেন ? টোমো দেখল, লিমো ভয়ে কাঁপছে। হয়ত পড়ে যাবে।

আর ভাববার সময় নেই। চিৎকার করে উঠে টোমো লাফিয়ে বেরিয়ে এলো। উল্টো দিকের চিৎকারে বাঘ মাথা ঘুরিয়ে দেখল টোমোকে।

তারপর চকিতে ঘুরে দিল লাফ। টোমো তার আগেই সবশক্তি একত্র করে ছুঁড়েছিল তার বর্শা। বাঘের মাথা ভেদ করে গেছে সে বর্শা।

টোমো আর পাশে সরবার অবকাশও পেল না। ঐ বিশাল বাঘ এসে পড়ল টোমোর বুকের ওপর। সেই আঘাতে তার পাঁজর গেল ভেঙে।

টোমো মাটিতে পড়ে গেল। তার হাতের দা শুধু ছিটকে গেল দূরে। মৃত্যু যন্ত্রণায় বাঘ নিজেই টোমোর বুক থেকে গড়িয়ে পড়ল।

তার পায়ের দাপানিতে তার মুখ, গাল, ঘাড় চিরে গেল। টোমোর মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বের হতে থাকল।

কোথা থেকে কি হ’ল, কিছুই বুঝল না লিমো। হঠাৎ কি করে গোটা পরিস্থিতি এমনভাবে বদলে গেল তার কিছুই বুঝল না লিমো।

যেখানে তার মরবার কথা সেখানে বাঘ মরল কি করে ? গোঙানির শব্দে ছুটে এসে টোর্মেকে দেখে তার কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।

সে টোমোর মাথা উঁচু করে ধরে বলল, এ তুই কি করলি টোমো ? টোমো হাসল। বলল, ভাই তোর জন্য আর কি করতে পারলাম আমি?

আমি না মরলে, বাঘ তোকেই মারত। একটু থামল টোমো। বলল, আর বেশিক্ষণ আমি বাঁচব না। তাই আমাকে আমার কথা বলে যেতে দাও।

একটু পরেই আমি মারা যাব। তুই এখানেই আমাকে সমাধি দিবি। তারপর বাঘের মাথা কেটে নিয়ে যাবি টুনলার বাবার কাছে। বলবি, তুই বাঘ মেরেছিস।

 লিমো বলল, টোমো! তোর এ ঋণ ……

 টোমো থামিয়ে দিল। বলল, ভাই, আমার কথা শেষ করতে দে। তোর আর টুনলার বিয়েতে আনন্দ করা হ’ল না।

যাকগে। যা বলি শোন। বিয়ের পর আমার সমাধির ওপর লাগাবি একটা পাইন গাছ। গাছটা বড় হলে তোরা এসে বসবি সেই গাছের তলায়।

সামনে ছায়ায় খেলা করবে তোদের ছেলে। এতেই আমার আত্মা তৃপ্ত হবে, এতেই তুই ক্ষমা পাবি। আর আমার নামে তোর ছেলের নাম রাখবি।

রাখব। নিশ্চয় রাখব। বলল লিমো। কিন্তু সে কথা বোধ হয় শুনল না টোমো।

সে তো লিমোর কথা শুনতে চায়নি। নিজের কর্তব্য পালন করে, নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে, নিজের সব কথা শেষ করে চলে গেল টোমো।

লুঙ সা গ্রামে গেলে আজও যে কেউ দেখতে পাবে, পাইন বনের শান্ত পরিবেশে এক সমাধির স্মৃতি।

লিমোর লাগান একটি গাছ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এক পাইন অরণ্য। গাঁয়ের কোন বুড়োর সঙ্গে দেখা হলে, সে সমাধি দেখিয়ে এই গল্প বলবে।

আর বলবে, হ্যা বাবুজী হ্যা। লিমো তার বন্ধুর সব কথা রেখেছিল।

শুধু পাইন গাছই পোঁতেনি, তার আর টুনলার যে দুই ছেলে হয়েছিল, তাদের নিয়ে এসে তারা বসত এই গাছের তলায়। তাদের দুজনেরই তারা নাম রেখেছিল টোমো। বড় টোমো আর ছোট টোমো।

এই নাম শুনে টুনলার বাবা বাঘ মারবার রহস্য যেন বুঝতেন। কিন্তু তখন তার আর করবার কিছু ছিল না।

আর জামাই ! জামাইকে শুধু মেয়ের নয় তারও যে খুব পছন্দ হয়েছে। থাক, ওরা সুখে থাক আর বেঁচে থাক বড় টোমো আর ছোট টোমো।

  কাছাকাছি দুটি গ্রাম। ওপরে আর নিচে। ওপরে মাওগ্রাম আর নিচে দিহোমার। দিহোমার গ্রামটা কোহিমার দক্ষিণে।

সেখানে বাস করে আঙ্গামী উপজাতির লোকেরা। উঁচুনিচু দুটো গ্রামকে যোগ করেছে দিখু নদী।

মাও গ্রামের পাহাড়ের উৎস থেকে নেমে আসে দিখু। অল্প জলের সরু দেহ নিয়ে একটা রুপোলী সুতোর মতো দুটো গ্রামকেই স্পর্শ করে বয়ে যায়।

এ নদী নিয়ে মাও গ্রামের গর্বের অন্ত নেই। কারণ নদীটার উৎস তাদের গ্রামে।

তারা ভাবে নদীটা তাদেরই। দিহোমার গ্রামের লোকেরাও দিখুকে কম ভালবাসে না। দিধূর তীরে অযত্নে বেড়ে ওঠে ঘাস—তৃণভূমি। তাদের গরুমোষ চরে তাতেই।

দিখুর জলে তাদের তৃষ্ণা মেটে। দিখুর জলেই হয় তাদের চাষ। ঐ জলেই মেটে তাদের গৃহস্থালী, তাদের স্নান ও অন্যান্য সব কাজ।

আসলে দিখুই তাদের একমাত্র জলের উৎস। দিখু আছে দেখেই দিহোমার গ্রামটা গড়ে উঠেছে।

কিন্তু এই দিই বর্ষায় হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। পাহাড়ের ওপরে বৃষ্টি হলেই দির ছোট্ট খাত আর জল ধরে রাখতে পারে না। উপর থেকে নামে জলের ঢল।

#দিখুর দু-কূল যায় ছাপিয়ে। তৃণভূমি তলিয়ে যায়, তলিয়ে যায় চাষের জমি।

সতর্ক দিহোমারবাসীরা আগেই তাদের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়ে যায় উঁচুতে। তবু ক্ষতি কম হয় না।

কিন্তু যে বার আচমকা জল নামে, সে বছর দুর্দশার অন্ত থাকে না। তৃণভূমি বা চাষের ক্ষতি ত’ হয়ই, জলের তোড়ে ভেসে যায় গৃহপালিত গরু-মোষ-ছাগল।

ভেসে যায় ঘরবাড়ি আর গৃহস্থালীর জিনিসপত্তর। কিছু লোকও যে কখনই না মারা যায় এমন নয়। এ তাদের বাৎসরিক রীতি।

এ তারা মেনে নিয়েই দিহোমারে বাস করে। এ সব জেনেও তারা দিখুকে ভালবাসে। কারণ দিখু তাদের ক্ষতি করে বটে আবার সারা বছর পালনও করে যে।

জলের অন্য নাম যে জীবন। দিখুও তেমনি তাদের জীবন-দাতা। যে দেয় সে ত’ কখনও নিতেও পারে।

দেওয়া-নেওয়ার ভেতর দিয়ে দিখু দিহোমারবাসীদের কাছে জীবন্ত। সেও এক সজীব সত্ত্বা।

দির সূত্রে মাও ও দিহোমার গ্রামের মধ্যে একটা সহজ সম্পর্ক আছে।

দুই গ্রামের সাধারণ-সমস্যা মেটাতে দুই গ্রামের গ্রাম-বুড়োদের নিয়ে একটা বিচারসভাও আছে।

দুই গ্রামের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত কোন সমস্যা দেখা দিলে এই বিচারসভা তার বিচার করে। এই বিচারসভার একটা মস্ত গর্ব আছে , তারা কখনই অন্যায্য বিচার করে না। তারা নিরপেক্ষ। দই গ্রামের শান্তিরক্ষার দায় তাদের, আর তা তারা করেও।

সে বার একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই যৌথ সভা চঞ্চল হয়ে উঠল। এক গভীর রাতে কিভাবে দিতোমার গ্রামে আগুন লাগল।

পুড়ে গেল সারা গ্রাম। যখন হৈ হৈ চিৎকারে সকলের ঘুম ভাঙল, তখন তারা কোনক্রমে ছেলে-মেয়ে ও অক্ষমদের টেনে বার করল, বাচাল পোষা জীবজন্তুগুলোকে।

দিখুর বন্যা আসার অভিজ্ঞতা তাদের খুব কাজে লাগল সকলকে বাঁচাতে। মনে মনে তারা দিখুকে ধন্যবাদ দিল।

দিখুর জলেও আগুন নিভল না। গোটা গ্রামকে পুড়িয়ে যখন গ্রামে আর কিছু পেল না, তখন আপনা থেকেই নিভে গেল আগুন।

কিন্তু পুরোপুরি নিভল কি? যদি নেভে, তবে এত লাল আলো কিসের ?

তারা আগুনের দিকে তাকিয়ে দেখল, মাও গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছে। কিভাবে লাগল ওখানে আগুন ? একই সময়ে দুগ্রামে কিভাবে জ্বলল ?

একই সময়ে নয় গো—আগে ও পরে। আগে তোমাদের গ্রামে, পরে মাও গ্রামে। তোমাদের আগুনের কোন ফুলকি বা বাঁশের গিঁট ফাটার ছিটকে ওঠা আগুনের গোলা উঁচুর গ্রাম মাওকেও জ্বালিয়ে দিয়েছে।

গোটা মাও গ্রামও পুড়ে ছাই হ’ল। শুধু তাই নয়।

ওদের ত’ বন্যা এলে কেমন করে তাড়াতাড়ি প্রাণ বাঁচিয়ে দূরে সরতে হয়, সে অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই ওরা আগে গেল গৃহস্থালীর জিনিস সরাতে।

কিন্তু ততক্ষণে অক্ষম, শিশু-বৃদ্ধদের সরাবার সুযোগ পার হয়ে গেছে। পার হয়ে গেল পোষা জীবজন্তুকে সরাবার সময়।

ফলে দিহোমারের চেয়ে মাও-এর ক্ষতি হ’ল বেশি।

ওদের ঘরবাড়ি গৃহস্থালীর জিনিসপত্র ত’ পুড়লই, পুড়ে গেল বহু মানুষ এবং পোষা জীবজন্তু। প্রকৃতপক্ষে মাও গ্রামে হাহাকার পড়ে গেল।

 বিপদে পড়লে মানুষের বুদ্ধি হয় বিপরীত। সব হারিয়ে মাওদের অবস্থাও তাই হ’ল।

তারা তাদের এই সব বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দিহোমারদেরই দায়ী করল।

তারা যৌথসভায় দিহোমারদের বিরুদ্ধে নালিশ করল ও তাদের অসতর্কতাতেই আগুন লেগেছে তাদের গ্রামে এবং তাদের অসর্তকতাতেই যে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে তাদের গ্রামে। হয়েছে অনেক ক্ষতি।

এ জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যার অসর্তকতায় আগুন লেগেছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে দেবে ক্ষতিপূরণ, আর তা না হলে গোটা গ্রামকে দিতে হবে।

 দু গ্রামের অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক গাঁও বুড়োরা বসলেন বিচার করতে। দু দু গ্রামের লোক হলেও তারা সত্য খুঁজে পেতে চান। তারা গম্ভীর মুখে শুনলেন।

মাওগ্রামের অভিযোগ। অভিযোগ করবার মতো বিষয়ই বটে। তারা যে দাবি করেছেন তাও অন্যায্য নয়।

বিচার যাই হোক, কার অসতর্কতায় আগুন লাগল, তা খুঁজে বের করা দরকার। বিচারসভা দিহোমারদের অপরাধী খুঁজে বের করতে বললেন।

 দিহোমার গ্রামের লোকেরাও বুঝল যে মাওদের দাবির মধ্যে যুক্তি আছে। অপরাধীকে খুঁজে বের করাও উচিত।

কিন্তু তারা কোনক্রমেই অপরাধীকে পেল না। সকলেই উঠে দেখেছে প্রায় গোটা গ্রাম জ্বলছে।

ফলে কোথা থেকে আগুন শুরু হয়েছে তা কে বলবে? ওরা বুঝল যে বিচারসভা ওদের ক্ষতিপূরণ করতে বলবে।

কিন্তু কোথা থেকে ক্ষতিপূরণ করবে তারা? তারাও যে সর্বস্বান্ত।

শুধু বন্যার অভিজ্ঞতায় তারা তৎপরতার সঙ্গে লোকজন ও পোষা জীবগুলো বাঁচাতে পেরেছে, এড়াতে পেরেছে মৃত্যুকে।

প্রাচীনকালে যখন টাকাকড়ির প্রচলন ছিল না তখন লোকে লেনদেন চালাত গুরু-ছাগল দিয়ে।

একটা গরুর বদলে পাঁচটা ছাগল বা এক বস্তা ধানের বদলে একটা ভেড়া দিয়ে বিনিময় হত। তোমরা জান না, ইংরাজী ফি কথাটার আদিম অর্থ ছিল গরু বা ভেড়ার পাল।

কোন কাজের বদলে তাকে দেওয়া হত গরু-ভেড়া। তা থেকে আজও আমরা কোন কাজের বদলে যা দেওয়া হয় তাকে বলি ফি।

ডাক্তারবাবু বা উকিলবাবুর কাজের বদলে তাকে টাকা দিই, কিন্তু বলি ফি অর্থাৎ জন্তুর পাল।

নাগাদের মধ্যে তখনও গরু-ভেড়ার পাল দিয়েই বিনিময় হ’ত।

গোটা মাও গ্রামকে যদি ক্ষতিপূরণ দিতেই হয় তবে তারা যে জন্তুর পাল আগুন থেকে বাঁচাতে পেরেছে সেগুলো সব দিয়েও কুলোবে না। তবে!

দিহোমারের নাগারা মাথায় হাত দিয়ে বসল। 

দিহোমার গ্রামবাসীদের আশঙ্কা সত্যে পরিণত হ’ল। বিচারসভা তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করলেন।

এ বিষয়ে তাদের কোন বক্তব্য থাকলে তাও জানাতে বললেন, আর তারা কত ক্ষতিপূরণ হওয়া উচিত সে বিষয়ে চিন্তা করতে থাকলেন।

 দিহাহোমারেরা তাদের অস্থায়ী বাসস্থানে এবার সত্যিই মাথায় হাত দিয়ে বসল।

বংশ বংশ ধরে মাওদের দাস হয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোন পথ রইল না।

 দিহোমারবাসীদের মধ্যে এক আশি বছরের বুড়ো বেঁচে ছিল। লাঠি ঠুক টুক করে হাসি হাসি মুখে বুড়ো এলো।

বলল, অত চিন্তা কিসের রে ! আমি সব শুনেছি। জানবি যেখানে মুস্কিল, সেখানেই আসান।

মাওরা মুস্কিল বাধিয়েছে, মাওরাই মুস্কিল তুলবে। শুধু জোঁকের মুখে নুন দিতে হবে।

 দিহোমাররা খুশি হওয়ার বদলে বুড়োর ওপর চটে উঠল। একজন তেড়ে বলল, জোঁকের মুখে নুন দিতে তুমি যাবে নাকি?

 বুড়ো গায়ে মাখল না ও-কথা। বলল, আমিই যেতাম যদি তোর মতো বয়স থাকত। বলে একটু থামল বুড়ো।

পরে গম্ভীর গলায় বলল, দুশ্চিন্তা থামা। একটা তুখড়, চটপটে আর গুছিয়ে কথা বলতে পারে এমন ছেলে কেউ খুঁজে বের কর।

তাকে যা শেখাবার আমি শিখিয়ে দেব। সে যাবে বিচারসভায়। আমাদের যা বলবার তা সে বলবে।

ফেকুয়া নামে একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল।

বলল, আমাকে আপনার পছন্দ হবে কিনা, জানি না। তবে আমার মনে হয়, আপনি যে তিনটি গুণের কথা বললেন, তা আমার আছে।

ওর ওপরেও আমার গুণ হল, আমি কখনোই রেগে উঠি না, ধীর মাথায় বিচার করে কথা বলতে পারি।’

বুড়ো বলল, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে ফেকুয়া। তুমি এসো আমার সঙ্গে। আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দিচ্ছি।

মনে রেখো, দিহোমার গ্রামের ভবিষ্যৎ তুমি নিজের হাতে তুলে নিলে।

ফেকুয়া বলল, আমি সব বুঝেই এগিয়েছি।

সকলকে দুশ্চিন্তার দায় থেকে মুক্ত করতে, গ্রামের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে আমি আমার সাধ্য মতো সব করবো।

বুড়ো পিছন ফিরে চলল তার কুঁড়ের দিকে। ফেকুয়াও চলল।

বিচারসভা বসেছে। সভার বৃদ্ধ বয়স্ক সভ্যেরা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কিছুতেই স্থির করতে পারছেন না। নানাভাবে হিসেব কষা হচ্ছে।

তারা অযথা চাপও চান না, আবার মাওরা কম পাক তাও চান না। এ কারণেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চলছে তাদের মধ্যে।

এমন সময় অত্যন্ত সাদামাঠা পোষাক পরা ফেকুয়া এসে হাজির হ’ল সবার সামনে।

সকলকে প্রণাম জানিয়ে বলল, দিহোমার-বাসীরা আমাকেই তাদের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছে তাদের বক্তব্য রাখতে।

বিচারসভা বলল, হ্যা! তা তারা পারে। এটা আইনসম্মত। তুমি তাদের বক্তব্য বল।

 মাথা নত করে ফেকুয়া সকলকে সম্মান দেখাল।

তারপর বলতে শুরু করল, মান্যবর বিচারকেরা আর উপস্থিত মাও গ্রামবাসীরা, আমি দিহোমার গ্রামের তরফ থেকে তাদের বক্তব্য রাখার প্রথমেই আপনাদের অভিযোগের সত্যতা মেনে নিচ্ছি।

এ কথা সত্য যে আগুন প্রথম আমাদের গ্রামে লাগে, পরে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে মাও গ্রামে।

স্বভাবত এ ক্ষতির মূলে আমরা। আমাদের গ্রামে আগুন না লাগলে মাও গ্রামেও আগুন লাগত না।

তাই মাও গ্রামের সব ক্ষতির মূল যে দিহোমার গ্রাম এ বিষয়ে না মানবার কিছু নেই।

আর আমরা’ কোন সময়েই এ দায় ত’ অস্বীকার করিনি।

বরং বন্যার অভিজ্ঞতায় বিপদের সময় কত দ্রুত এবং কিভাবে সরে যাওয়া যায়, তা আমরা জানতাম।

কিন্তু ওদের দেশ থেকে বন্যা নামলেও ওদের দেশে কখনও বন্যা না হওয়ায় ওরা জানতেন না, বিপদের সময় কেমন করে আত্মরক্ষা করতে হয়। তাই ওদের ক্ষতি হয়েছে বেশি।

এই বেশি ক্ষতির দায় ওদেরই অজ্ঞতা, ওদের অনভিজ্ঞতা।

তবু একটা আদর্শ তৈরির জন্য সমবেত দিহোমারবাসীর তরফ থেকে আমি জানাচ্ছি বিচারসভা থেকে ক্ষতিপূরণ স্থির করে দেবেন আমরা প্রয়োজনে বংশ বংশ ধরে মাওবাসাদের দাসত্ব করেও সেটা পূরণ করব।

ফেকুয়া থামল। বিচারসভা দিহোমারবাসীদের এ বক্তব্য তারিফ করল। সকলে বাঃ বাঃ করে উঠল।

ফেকুয়া আবার সম্মান জানাল সকলকে। বলল, বিচারসভার কাছে আমি আর্জি রাখছি যে, তারা পরিস্কার করে আজকের বিচারের নীতিটা ঘোষণা করুন।

তাহলে এ জাতীয় অন্য ঘটনা ঘটলে বিচারের সুবিধা হবে।

সকলে বলল, ঠিক, ঠিক।

বিচারসভার প্রধান বললেন, এ তো খুব সহজ কথা বাপু! কোন বিপদ বা ক্ষতির সূচনা যে গ্রামে হবে, তা সেই গ্রামে না থেকে যদি অন্য গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে, তবে দ্বিতীয় গ্রামের সব ক্ষতির দায় প্রথম গ্রামকে নিতেই হবে।’

সকলে আবার বলল, ঠিক, ঠিক! |

ফেকুয়া আবার মাথা নত করে সম্মান জানাল সকলকে।

তারপর মাওবাসীদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি স্পষ্ট করে জানতে চাই এই বিচারনীতিতে মাওবাসীরা বিশ্বাস করেন কিনা?

যদি কখনও তাদের গ্রাম থেকে কোন সর্বনাশের সূচনা হয়, তবে সেই ক্ষতির দায়িত্ব তারা গ্রহণ করবেন কিনা?

মাওবাসীরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল—বিচারের এ নীতি আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের গ্রাম থেকে কোন সর্বনাশের সূত্রপাত হলে সে সর্বনাশের ক্ষতিপূরণ আমরা করব।

 ফেকুয়া আবার সকলকে সম্মান দেখিয়ে বলল, সম্মানীয় বিচারসভা! মাওবাসীদের কথায় আপনাদের কাজ একটু কঠিন হয়ে গেল।

কারণ, একবার আমাদের আগুন ওদের গ্রাম পুড়িয়ে ক্ষতি করেছে।

আর বছরের পর বছর ওদের গ্রাম থেকে জলের ঢল নেমে নষ্ট করেছে আমাদের ক্ষেত, আমাদের ঘরবাড়ি, আমাদের সুখ-শান্তি।

বিচারসভা, ওদের গ্রামে আগুন লাগার দায় যদি আমাদের তবে আমাদের বছর বছর বন্যায় ভাসার দায় মাওবাসীদের।

আপনারা হিসেব করুন, একবার আগুনের জন্য আমরা কত ক্ষতিপূরণ দেব আর তার বদলে বছর বছর বন্যায় ভাসার জন্য ওদের কাছ থেকে কত ক্ষতিপরণ পাব।

আপনারা সহজ হিসেবেই বুঝবেন যে ওদের কাছে আমাদের যা পাওনা তা ওরা জন্ম জন্ম ধরে দাসত্ব করলেও শোধ করতে পারবে না।

মাও গ্রামবাসীরা পাওয়ার আশায় উৎফুল্ল হয়েছিল। ফেকুয়ার কথায় তাদের হতাশায় মন ভরে গেল। মুখ আতঙ্কে কারো হয়ে গেল।

বিচারকেরাও হতভম্ব হয়ে গেলেন।

শুধু বিচারকদের প্রধান বললেন, ফেকুয়ার কথায় মনে হচ্ছে আমাদের নীতিটার মধ্যে কোথাও একটা ভুল আছে।

আমাদের চিন্তাতেও ভুল ছিল। কিন্তু কি করে সত্যে পৌঁছানো যায়?

 কে জানত যে দিহোমার গ্রামের লোকেরা বাঁশের ডুলি করে সেই আশি বছরের বুড়োকে সঙ্গে এনেছিল।

এবার সে সকলের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভুলটা খুঁজতে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগাও। দেখবে সত্য খুঁজে পাবে।

আসলে তোমাদের নীতিতে ভুল নেই। নীতিটা ঠিকই। মানুষ নিজে যে সর্বনাশ করে তার দায় মানুষকেই নিতে হবে।

কিন্তু প্রকৃতি যে সর্বনাশ করে তার দায় কার ? বন্যা, আগুন সবই প্রকৃতির দান। কোন মানুষের দায় নেই তাতে।

তাই মাওবাসীদের অভিযোগের গোড়াতেই ছিল ভুল। ফেকুয়া ঐ ভুলের বর্শাতেই ভুলকে বিঁধেছে।

তাই বিচারসভাকে বলব, এ মামলা খারিজ করে দিতে।

আর সকলকে বলব, কি করে প্রকৃতির দেওয়া এ অভিশাপের বেদনা দ্রুত দূর করা যায়, তার জন্য সবাই মিলে একত্রে কাজ করতে।

মুহূর্তে মাওবাসীরা বুড়োকে কাঁধে তুলে নাচতে থাকল।

গোটা ব্যাপারটা মাওরাই শুরু করেছিল বলে সঙ্গে সঙ্গে এই মিলন উৎসবে সমস্ত মধু (নাগাদের সবচেয়ে প্রিয় মদের নাম।

এ মধু না হলে তাদের উৎসবই জমে না।) যোগানের দায় নিল তারা। তিন দিন, তিন রাত ধরে মাও আর দিহোমার গ্রামে মিলনোৎসব চলল।

তারপর শুরু হ’ল দুটো গ্রামই নতুন করে গড়ার পালা।

গ্রাম দুটি আজও পাশাপাশি, অর্থাৎ ওপরে-নিচে বন্ধুভাবে বাস করছে। এ গল্পটা আজও তাদের মুখে মুখে ঘোরে।

তথ্যসূত্র : লুঙ্সা গ্রামের লোককথা ও অন্যান্য

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা