লুঙ্সা গ্রামের রূপকথা : কোহিটোর কুয়ো
1346
নাগাভূমির বড় শহর কোহিমা। তার থেকে আশি-একাশি মাইল দূরে জুনহেববাটোও মোটামুটি শহর।
সেই শহরের আশেপাশে ছিল অনেকগুলি নাগা বসতি। তারই একটিতে কোহিটো নামে এক শিশুর জন্ম হয়। অল্প বয়সে সে বাপ-মাকে হারিয়ে অনাথ হয়েছিল।
তাকে প্রতিপালনের কেউ ছিল না। তবু কেমন। করে যে একটু একটু বড় হয়ে উঠল, তা কেউ বলতে পারে না। অথচ সে বড় হয়ে উঠল।
আর ছেলেবেলা থেকেই সে মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকল সে বড় হবে, সে হবে সমাজের একজন গণ্যমান্য মানুষ। সবাই তাকে সম্মান করবে, ভালবাসবে।
কিন্তু কি করলে সমাজে গণ্যমান্য হওয়া যায় তার উপায় সে জানত না।
তার খেলার সাথী ছিল সিখোসা। তাকেই বলল, আমি সমাজে গণ্যমান্য হতে চাই। কি করলে তা হওয়া যায় বলত !
সিখোসা মোটামুটি ধনী পরিবারের মেয়ে। তাদের বাড়িতে নানা ধরনের লোক আসে, নানা ধরনের আলোচনা হয়। সে সব শোনে সিখোসা।
তার ফলে কোহিটোর চেয়ে জানে সে বেশি। তাই সে বলল, দেখ, এমন একটা কিছু যাদ করতে পার, যাতে সমাজের সকলের মঙ্গল হয়। তবে সহজেই তুমি গণ্যমান্য হতে পারবে।
কিন্তু, সেটা কি ? তাইত বুঝছি না। কোহিটো বলল।
সিখোসা বলল, সেটা আমিও বুঝছি না। ভেবে দেখা যাবে।
সেদিন বিকেলে জল আনতে সকলের সঙ্গে যাচ্ছিল সিখোসা। এখানে জলের বড় অভাব।
পাহাড় থেকে নেমে অনেক দূর পথ গিয়ে জল আনতে হয়। সে দৌড়াতে দৌড়াতে কোহিটোর কাছে এসে বলল, কোহিটো আমি উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি। কোহিটো ব্যর্থ হয়ে বলল, কি ?
সিগোসা বলল, আমাদের এখানে জলের বড় অভাব। যদি একটা কুয়ো খুঁড়তে পার তবে সমাজের সকলের উপকার হবে। তাহলে তুমি সঙ্গে সঙ্গে গণ্যমান্য হয়ে যাবে।
কোহিটো বলল, ঠিক বলেছ সিখোসা। আমি নিশ্চয় একটা কুয়ো খুঁড়ব।
ক’দিন মনে মনে নানা হিসেব করে কুয়োর জন্য স্থান নির্বাচন করল কোহিটো। স্থানটা গ্রাম থেকে দুরে হলেও হবে না, আবার উঁচুতে হলেও হবে না।
উচুতে জল না পাওয়াও যেতে পারে। আবার কুয়ো খুঁড়তে অনেক সময় লাগবে। ততদিন সে অন্যকে জানতে দিতে চায় না কুয়োর কথা।
অতএব স্থানটা হবে একটু আড়ালে। এমন জায়গা মেলা সহজ নয়। অনেক খুঁজে সে ঠিক জায়গাটি বের করল।
পাহাড় নেমে যেখানে সমতলে মিশেছে, যেখান থেকে নদী পর্যন্ত চলে গেছে মেয়েদের জল আনতে যাবার পথ, ঠিক তার পাশের গুটিকয় বড় গাছ আর একটা মক্ত পাথরের আড়ালে একটা সুন্দর ঘাসে ঢাকা জমি পছন্দ হল তার।
সে সেখানে রোজ একটু একটু করে কুয়ো খুড়তে থাকল।
বছর বারো-তেরো বয়সে কুয়ো খুঁড়তে শুরু করেছিল কোহিটো পুরো যুবক হয়ে উঠেও জল পেল না সে। এক একবার হতাশ হয় সে। আবার আশায় বুক বাঁধে।
আর একটু খুঁড়লেই হয়ত জল উঠবে। কিন্তু কোথায় জল। বছর পাঁচেকের চেষ্টাতেও জল না ওঠায় সে স্থির করল আজ যদি জল না ওঠে, তবে সে আর খুড়বে না।
তার আর সমাজের উপকার করা হ’ল না। সত্যি সত্যিই সেদিনও জল পেল না কোহিটো। সে ছুঁড়ে ফেলে দিল কোদাল আর ঝুড়ি।
আর সে খুড়বে না সেই কুয়ো।
কাড়ি গিয়ে শুয়ে রইল সে। রাত্রে স্বপ্ন দেখল গায়ের সব রোক তাকে আঙুল তুলে দেখিয়ে হাসছে। ঘুম ভেঙে গেল। সে প্রতিজ্ঞা করল, পাতাল পর্যন্ত খুঁড়তে খুড়তে যাবে সে। জল না পেয়ে ছাড়বে না।
পরদিন অন্য কাজে গেল না কোহিটো। যেই প্রতিজ্ঞা নিয়ে কাজে নামল, অমনি, একি, দু কোদাল মাটি না তুলতেই জল এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল। কল-কল করে আসতে থাকল জল।
সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল ঝুড়ি কোদাল নিয়ে। সে ওপরে উঠতে না উঠতে কুয়ো ভরে গেল জলে। টলটল করতে থাকল।
আঁজলাভরে জল নিল কোহিটো। ছিটিয়েদিল। লাফিয়ে পড়ল জলে। হাতে তুলে খেয়ে দেখল। কি মিষ্টি, কি মিষ্টি। আনন্দে আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
সে চিৎকার করতে করতে ছুটল গ্রামের দিকে, জল এনেছি, গ্রামের কাছে জল এনেছি।
লোকেরা, যে যেখানে ছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। কি বলে ছেলেটা! জল এনেছে? মানেটা কি? সকলে ঘিরে ধরল কোহিটোকে।
সে তখন হাঁফাচ্ছে। ঐ অবস্থাতেই সে বলল, গত পাঁচ-ছ বছর ধরে আমি একটু একটু করে একটা কুয়ো খুঁড়ছিলাম। আজ তাতে জল বেরিয়েছে।
লোকজন হৈ হৈ করে ছুটল কুয়ো দেখতে, তার জল দেখতে।
জল! এত জল। এত কাছে এত জল! সকলে কোহিটোর জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল। একদিনে সে সমাজের বিখ্যাত মানুষ হয়ে গেল।
কোহিটোর কুয়ো খোঁড়ার কাহিনী আর জলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশান্তরে। পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে মেঘরাজার দেশে বাস করে অপ্সরীকিন্নরী-পরীর দল।
সেখানেও এ সংবাদ পৌছাল। সাত পরীর একটি দল সংবাদ সত্যি কিনা দেখতে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ডানা মেলে সাত খণ্ড সাদা মেঘের মত ভেসে এসে ডানা গুটিয়ে নামল সেই কুযোর পাশে। মেজো পরী বলল, কুয়ো কোথায়, এত ছোটখাট একটা পুকুর।
বড় পরী বলল, এতে জল কোথায় এত’ স্ফটিকের তরঙ্গ।
আর এক পরী একটু জল তুলে বলল, ওমা, এযে গরম!
পরীরা আনন্দে এত উৎফুল্ল হয়ে উঠল যে ডানা খসিয়ে তারা জলে নেমে পড়ল। সারা রাত ধরে তারা জলে এত উথাল-পাথাল করল যে জল হয়ে গেল। ঘোলা, নোংরা। সূর্য উঠবার আগেই তারা সেখান থেকে চলে গেল মেঘলোকে।
গ্রামের মেয়েরা তার পরেই জল নিতে এল। কিন্তু একি জলের দশা ! কে করল এমন কাজ ? তারা বাধ্য হয়ে আবার নদী থেকে জল আনল।
কিন্তু এতদিনের অনভ্যাসে খুবই কষ্টকর মনে হল অতদূর থেকে জল আনাটাকে। যারা জল ঘোলা করেছে, তাদের নামে নানা কটু কথা বলতে থাকল তারা।
পরপর কয়েকদিন জল ঘোলা হওয়ায় তারা কাজটা কোহিটোর বলেই স্থির করল। কাছাকাছি ত’ গ্রাম নেই যে তার লোক এসে শত্রুতা করে জল ঘোলা করে রেখে যাবে।
মনে হয় কোহিটো আর সকলকে এ জল ব্যবহার করতে দিতে চায় না। তাই জল ঘোলা করে রেখে বাধ্য করছে সকলকে দূরে যাবার জন্য।
কদিন আগেও যে ছিল গ্রামের সবচেয়ে সম্মানের পাত্র, ক’দিনে সেই হয়ে উঠল গ্রামের শত্রু।
গ্রামের বুড়োরা, যাদের ওপর সমাজ শাসনের ভার, তারা তাকে ডেকে বলল, দেখো বাপু! কুয়ো তোমার হতে পারে কিন্তু তাই বলে জল ঘোলা করে তুমি সকলকে কষ্ট দিতে পার না। তোমাকে এ কাজ বন্ধ করতে হবে।
কোহিটো বলল, দেখুন, পাঁচ বছর ধরে খুঁড়ে কুয়ো কেটেছিলাম নিজে জল খাওয়ার জন্য নয়। গ্রামের সকলের জন্য।
তবে আজ আমি সকলকে তাড়াতে যাব কেন ? তাতে আমার কি লাভ? আমি এ কাজ করিনি।
গ্রামের বুড়োরা বলল, তবে কে এ কাজ করছে সেটা খুঁজে বের কর। আর যদি জল ঘোলা করা বন্ধ না করতে পার তবে হাত-পা বেঁধে তোমাকে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হবে। আমরা জানি তা হলেই সব বন্ধ হয়ে যাবে।
কোহিটো দুশ্চিন্তায় ঘেমে উঠল। এ কাজ যে সে করছে না তা কেউ বিশ্বাস করছে না। সিখোসা বড় হয়েছে।
সে মোরাঙ্গে থাকে। তাকেও পাওয়া যায় না যে কোহিটো পরামর্শ করবে। কিযে করবে কোহিটো।
ভাবতে ভাবতেই পথ চলছিল সে। হঠাৎ এক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সিখোসা।
বলল, কোহিটো রাত জেগে পাহারা দাও। নিশ্চয় দুষ্টলোক ধরা পড়বে।
ঠিক ঠিক! এই সহজ বুদ্ধিটা মাথায় আসছিল না। তুমি আমাকে বাঁচালে সিখোসা। বলল কোহিটো।
রাত জেগে পাহারা দিতে বসল কোহিটো। তখন কৃষ্ণপক্ষের রাত চলছে। রাত গভীর হলে জ্যোৎস্না ওঠে।
জলের কাছে এক গাছের ছায়ায় অন্ধকারে বসে আছে সে। হঠাৎ সে জ্যোৎস্নার মধ্যে সাত খণ্ড সাদা মেঘ ভেসে আসতে দেখল।
কিন্তু ঠিক মেঘ বলেও মনে হ’ল না। বড় আকারের কোন পাখি। পাখিগুলো এসে ডানা গুটিয়ে নামল তার কুয়োর পাশে।
কিন্তু ও কি ? ও ত’ পাখি নয়। পরী! চোখের সামনে পরী দেখে কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল কোহিটো। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সে দেখল পরীরা একে একে ডানা খুলে দূরে রেখে নেমে গেল জলে। জলের মধ্যে হুল্লোড় করতে থাকল তারা। সেই শব্দ শুনতে শুনতে হঠাৎ সে দৌড়াতে থাকল গ্রামের দিকে।
সে সকলকে ডেকে তুলে নিয়ে এলো কুয়োর দিকে।
কিন্তু ততক্ষণে সুর্যের লাল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। পরীরা তার আগেই চলে গেছে। কুয়োর ধার শুন্য। সকলে আর এক দফা গালাগাল করল তাকে।
বলল, ওসব পরী-টরীর কথা ছেড়ে ভাল চাওত জল গোলা করা বন্ধ কর। নচেৎ বিপদে পড়বে। এই বলে গ্রামের লোকেরা চলে গেল।
একা একা বসে ভাবছে সে কি করবে। এমন সময় সিখোসা এলো। কোহিটো বলল, সখি, বিশ্বাস করো আমি মিথ্যে বলিনি। পরীরা এসেছিল।
সিকোসা বলল, ধর পরীদের।
কিভাবে ধরব? জিজ্ঞাসা করল কোহিটো।
কেমন করে কি কি দেখেছে সব জানতে চাইল সিখোসা। কোহিটো সব বর্ণনা করল।
তা শুনে সিখোসা বলল, কোহিটো তা হলে ত’ পরী ধরা খুব সোজা। তুমি অন্ততঃ একজনের ডানা লুকিয়ে রাখবে।
কোহিটো প্রায় লাফিয়ে উঠল। ঠিক, ঠিক। এত’ খুব সহজ ব্যাপার।
পরপর ক রাত জেগে থেকেও কাউকে পেল না কোহিটো। জলও ঘোলা হ’ল না। তবে কি পরীরা আসবে না ? কোহিটো সে রাতেও বসে রইল। কিন্তু সেদিন যেন তার দুচোখ ঘুমে ভেঙে আসছে। সে যেন আর জেগে থাকতে পারছে
সে জোর করে চোখ খুলে রাখতে চাইল। কিন্তু ঘুমে ঢুলে পড়ল।
হঠাৎ কি শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। পরীরা এসে গেছে। ডানা খুলে তারা নেমে পড়েছে জলে। এবার অন্ততঃ একজোড়া ডানা সরাতে হবে তাকে।
সে সবে পা সড়াতে যাচ্ছে এমন সময় সে আকাশে আর এক পরীর আভাস পেল। নীল ডানা মেলে নেমে আসছে পরীটি।
উৎসুক চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সে। পরীটি নেমে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল অন্যদের।
সকলকে জলে দেখতে পেয়ে সেও ডানা খুলে নেমে পড়ল জলে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঐ নীল ডানা জোড়া নিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়াল সে।
কোথায় লুকিয়ে রেখে গ্রামের সকলকে জাগিয়ে ডেকে নিয়ে এলো।
আজ সকলে সূর্য উঠবার আগেই উপস্থিত হ’ল। পরীরা তখন জল থেকে উঠে মেঘলোকে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
গ্রামের লোকের সাড়া পেয়ে তারা দ্রুত ডানাগুলো পরে উড়ে গেল। নীল পরীটি আর ডানা খুঁজে পেল না।
সে উড়তেও পারল না। অন্য পরীরা তাকে সাহায্যও করতে পারল না। দু হাতে মুখ ঢেকে পরীর মেয়েটি কাদতে থাকল।
তাকে পেয়ে গাঁয়ের লোকেরা বুঝল বটে যে কোহিটো মিথ্যে কথা বলেনি, পরীরাই জল ঘোলা করেছে—তবু সমস্যা দাঁড়াল পরীর মেয়েকে নিয়ে।
মেয়েটি বলল, আমার ডানা দিয়ে দাও। আমি চলে যাই। আমি কথা দিচ্ছি, আর আমরা আসব না।
কোহিটো বলল, ডানা কোথায় ! ডানা আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।
কোহিটো যে মিথ্যা বলছে, তা পরীর মেয়ে বুঝল। কারণ ও ডানা পোড়ান যায় না। ও ডানা আগুনে পোড়ে না। বুঝেও করার কিছু ছিল না পরীর মেয়ের।
গাঁয়ের বুড়োরা বলল, ওর ডানা পুড়িয়ে ওর ফিরে যাওয়ার পথ যখন তুমি বন্ধ করেছ, তখন মেয়েটির দায় তোমাকেই নিতে হবে।
গাঁয়ের বুড়োরা কোহিটোর সঙ্গে পরীর মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। মেঘের দেশের মেয়ে নাগা বৌ হয়ে বাস করতে থাকল।
অনেক দিন পার হয়ে গেছে। কোহিটো সুখে বাস করছে পরী বৌ নিয়ে। দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তার বেশ ভর ভরন্ত সংসার।
খেতের ফসল, বাড়ির গরুর দুধ আর অনেক মুরগীর মাংস ও ডিম খাওয়া-পরার কোন অভাব নেই।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় না যে পরীর মেয়ের মেঘের দেশের জন্য মনের ভেতরে কোন দুঃখ আছে।
সে যে বাধ্য হয়ে মানুষের বৌ হয়ে আছে, কে বুঝবে তাকে দেখে। কোহিটোর সঙ্গে তার সব কথা হয়, কেবল সেই ডানা জোড়ার কথা। কেউ মুখে আনে না।
পরীর মেয়ে জানে যে ডানা দুটো কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু কোথায় ? কোহিটো নিশ্চয় সেগুলো বাড়ির বাইরে কোথাও রাখেনি—বাড়ির মধ্যেই রেখেছে।
বাড়ির সবই ত’ সে জানে। এ বাড়ির সবই ত’ তার নখদর্পণে।
সে শুধু যায় না গরুর গোহালে বা মুরগীর খোঁয়াড়ে। ঐ গন্ধ তার সহ্য হয় না। তা না গেলেও গোহাল বা মুরগীর খোঁয়াড়ের সবটাই ত’ দূর থেকে দেখা যায়।
গরুর জন্য যে খড়ের গাদা রাখা আছে, তাও বারবার খুঁজে দেখেছে পরীর মেয়ে। সে শুধু চিন্তা করে, কোথায় আছে সেই ডানা দুটো।
সে দুটোর জন্যই সে কোহিটোকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আশ্চর্য লোকটা। কোন অসতর্ক মুহূর্তেও বলে ফেলেনি ডানা দুটোর কথা।
একদিন পরীর মেয়ে ছেলেটাকে বলল, তোর বাবা রোজ কি কি করে, তা ভাল করে দেখিস ত’।
ছেলে বলল, তাত’ আমি দেখিই মা। আমাকে বড় হয়ে ওসব কাজ করতে হবে না।
মা বললেন, করতে হবেই ত’। বাবার কাজ দেখে দেখেই ত’ কাজ শিখতে হয়। তা, বাবার সব কাজ দেখিস?
ছেলে বলল, না মা! মুরগীর খোঁয়াড়ের ওপর তলায় যেখানে মুরগী তায়ে বসান হয়, ওখানটায় যখন কাজ করেন, তখন বাবা আমাকে থাকতে দেন না।
বলেন, মুরগীগুলো যখন তায়ে বসে তখন খুব রাগী হয়। ওদের সরালেনড়ালে ঠুকরে দেয়। তোমাকেও ঠোকরাতে পারে।
বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত ঝলসে উঠল পরীর মেয়ের মন।
ওখানে ত’ থাকতে পারে! তায়ে বসা মুরগী রেগে থাকে সত্যি, কিন্তু ছেলে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলে তাকেও কি মুরগী ঠোকরাতে আসবে? আসতেও পারে। আবার ওখানেও লুকোন থাকতে পারে ডানা দুটো।
যতই ভাবতে থাকল পরীর মেয়ে ততই তার মনে হতে থাকল ওখানেই আছে ডানা দুটো। তার মনে হ’ল গুটি পাঁচেকের বেশি মুরগীকে কখনই একত্রে তায়ে বসান হয় না।
তার জন্য অতবড় জায়গাটার কোন প্রয়োজনই নেই। আবার জায়গাটা গরম রাখবার নাম করে চারদিক ঢেকে এমন অন্ধকার করে রাখা হয়েছে যে সেখানে চোখ চলে না।
কোন জিনিস গোপনে লুকিয়ে রাখবার সবচেয়ে ভাল জায়গা ওটা। তার খুব আপশোষ হতে থাকল যে এতদিন জায়গাটার কথা মনে পড়েনি কেন!
ছেলেমেয়ে খেলতে বেরিয়ে যেতেই পরীর মেয়ে সেই অন্ধকারে হাত ঢুকিয়ে দিল। তেড়ে এলো দু’টি মুরগী। একটা ঠকরেও দিল। দিক কিছুতেই গ্রাহ্য করল না পরীর মেয়ে।
যদি ডানাগুলো পাওয়া যায় তবে দুটো মুরগীর ঠোকোর কিছু নয়। কিন্তু হতাশ হ’ল সে। নেই, কোন অন্ধকারেই নেই। সে হাত বের করে নিতে গেল।
একটা মুরগী আবার ঠকরে দিতে গেল। সে হাত ওপরে তুলে ঠোকর এড়াতে গেল। কিন্তু ও কি। কিসে ঠেকল হাত? একটা আলো নিয়ে এলো পরীর মেয়ে।
দেখল, ছাদের সঙ্গে কৌশলে বেঁধে রাখা আছে ডানা দুটো। একেবারে সামনে, চোখের সামনে। অন্ধকার বলেই এতদিন নজর পড়েনি।
পরীর মেয়ে বাঁধন কাটিয়ে ডানাগুলো বের করে আনল।
নোংরা হয়ে আছে ডানা দুটো। না হলে ঠিকই আছে। সে ঝেড়েঝুড়ে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলল ডানাগুলো। তার মন মেঘলোকের জন্য আনচানিয়ে উঠল।
এমন সময় সিখোসার গলা পাওয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি ডানা দুটো লুকিয়ে ফেলল খাটের তলায়। তারপর বেরিয়ে এসে বলল, কি গো সই! অনেকদিন দেখা নেই কেন?
সিখোসা বলল, বোঝ না! নিজের সংসার সামলে কি আগের মত বের হওয়া যায়!
: তবে আজ বের হলে কি করে ?
: প্রাণের দায়ে বেরিয়েছি বৌ। কাল আই-বুড়ি এসেছিল। জান ত’! সে ভাগ্য গুণতে পারে।
সে বলে গেছে কোহিটোর দুর্দিন আসছে। সংবাদটা দিতে এলাম। ওকে খুব সাবধানে থাকতে বলো।
পরীর মেয়ে বলল, সই তুমি ত’ ওকে ছেলেবেলা থেকে জান! ওকে কি কিছু বলে করান যায়! গোঁয়ার। একেবারেই গোঁয়ার।
হাসল সিখোসা। তার মনে পড়ল কোহিটোর অনেক গোঁয়ার্তুমির কথা। কিন্তু সিখোসার কথা অমান্য করত’ না সে।
সে মনে মনে স্থির করল, সে নিজেই কোহিটোকে জানাবে বিষয়টা। পরী বৌকে বলল, ছেলেমেয়েরা কোথায় ?
পরী বৌ হাসল। বলল, যেখানে যাবার। ওরা কি এ সময়ে বাড়িতে থাকে। খেলতে গেছে। এ ভারী সুন্দর ছেলেমেয়ে দুটি। সিখোসার চোখ জুড়িয়ে যায় ওদের দিকে
তাকিয়ে, মন ভরে যায়। ওদিকে কাজ পড়ে আছে। তাই সিখোসা বলল, যাই বৌ। তুই ওকে বলিস।
পরী বৌ বলল, বলব ত’ বটেই। কিন্তু তুমি যাওয়ার পথে ছেলেমেয়ে দুটোকে পাঠিয়ে দিয়ে যেও ত’!
চলে গেল সিখোসা। পরী মেয়ে খাটের তলা থেকে বের করল ডানা দুটো। পিঠে এঁটে নিল। এ সময়েই দৌড়ে ঘরে ঢুকলো ছেলেমেয়ে দুটো।
তারা মায়ের পিঠে ডানা দেখে চমকে গেল। ছেলেটা বোনকে বলল, মা পরী হয়েছে।
বোন চেঁচিয়ে চিৎকার করে লাফাতে থাকল, পরী, পরী। মা ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, চুপ করে শোন। আমি আসলে পরী।
তোমাদের বাবা আমার ডানা দুটো লুকিয়ে রেখেছিল। আজ আমি ওগুলো খুঁজে পেয়েছি। আমি আজ মেঘের দেশে চলে যাব।
মেয়েটি কেঁদে ফেলল। বলল, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না মা।
ছেলে চেপে ধরল মার কাপড়। বলল, আমি তোমাকে আমাদের ফেলে যেতে দেব না।
পরীর মেয়ে হাসল। বলল, তোমাদের ছেড়ে আমিও কি থাকতে পারব। আমি গিয়ে রামধনুর দড়ি ছুঁড়ে দেব।
তোমরা সেই দড়ি আচ্ছা করে কোমরে জড়িয়ে নেবে। আমি ওপর থেকে তোমাদের তুলে নেব। তুমি ভাল করে বঁধতে পারবে না থোকা?
ছেলে উজ্জ্বল চোখে বলল, পারব।
মেয়ে বলল, রামধনুর দড়ি পাঠাবে তো? ভুলে যাবে না?
মা বলল, দুর পাগলি। মা কি ছেলেমেয়ের কথা ভোলে,
এরপর পরীর মেয়ে ডানা মেলে উড়ে গেল আকাশে। ছেলেমেয়ে দুটো দেখল তাদের পরী মা একটু একটু করে হারিয়ে গেল মেঘের মধ্যে।
ওরা ভাবতে থাকল এখুনি নামবে রামধনুর দড়ি। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল দড়ি নামল না।
মেয়েটি বলল, দাদা দড়ি নামল কৈ?
ছেলেটা বলল, অনেকদিন পর মা দেশে ফিরেছে ত। মায়ের বাবা-মা, ভাইবোনরা মাকে ঘিরে রেখেছে। দেখিস, একটু পরেই দড়িড নামবে।
মেয়েটি বলল, সবাইকে পেয়ে মা যদি আমাদের ভুলে যায়!
ছেলেটা বলল, দুর পাগলি। মা কি কখনও ছেলেমেয়েকে ভোলে।
কিন্তু রামধনুর দড়ি নামল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হ’ল। তবু দড়ি নেই। কোহিটোর বাড়ি ফেরার সময় হ’ল।
সে আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরছে। সিখোসা এসে গনক বুড়ির কথা জানিয়ে গেছে। কি খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে, সে কথাই ভাবছিলো কোহিটো।
এমন সময় বুঝুঁপিয়ে নামল বৃষ্টি। কোহিটো একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিল।
রামধনুর দড়ির বদলে বৃষ্টি নামায় ছেলেমেয়ে দুটোও অঝোরে কাঁদতে থাকল।
মেয়েটা দাদার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকল আর বলতে থাকল, আমাদের কথা মা ভুলে গেছেরে দাদা। তুই কেন মাকে ছেড়ে দিলি?
ছেলেটি বলল, মা মিথ্যে কথা বলে না রে। মা ত’ ছেলেমেয়েদের ভোলে না।
মেয়ে বলল, সে ত’ মানুষ মা। পরী মা ভোলে।
ছেলেটা মনে মনে হতাশ হলেও বোনকে সাহস দিতে বলল, নারে, তাই কি হয়! পরী মা-ও ত’ মা!
এইসব কথা হতে হতেই ওরা দেখল বৃষ্টি থেমে গেছে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে আকাশে। কিন্তু ওকি? মেয়েটি চমকে উঠে চেঁচিয়ে বলল, দাদা! রামধনু!
ছেলেটিও দেখল। বৃষ্টিঝরা আকাশে দেখা দিয়েছে রামধনু। ক্রমে রামধনুর একটা প্রান্ত দড়ির মত নেমে এল তাদের উঠোনে।
ওরা দৌড়ে গিয়ে ধরল সেটা। ছেলেটা ঐ দড়ির প্রান্তটায় দোলনার মত করে একটা শক্ত লাঠি বাঁধল। তারপর দুজনে উঠে পাশাপাশি বসল।
ওদের কাজ শেষ হতে দড়িটা ওদের নিয়ে উঠতে থাকল আকাশে। কে যেন দড়ি টেনে তাদের তুলে নিচ্ছে। এক সময়ে তারাও মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে কাউকেই দেখতে পেল না কোহিটো। এমন ত’ হয় না। তার আসবার আগে পরী বৌ তার আসার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ছেলেমেয়েরা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। কিন্তু আজ তারা কেউ নেই কেন ? তবে কি গণক বুড়ি যা বলেছিল…..
কোহিটো ছুটে গেল ঘরে। এঘর ওঘর খুঁজল। কেউ নেই। বুকের ভেতর কেমন করে উঠল তার। সে দৌড়ে গেল মুরগীর ঘরে। হাত ঢোকাল ওপরে।
নেই, ডানা নেই। তার আর বুঝতে বাকী রইল না যে মাটির মায়া কাটিয়ে পরীর মেয়ে চলে গেছে মেঘের দেশে। সঙ্গে নিয়ে গেছে তার ছেলে ও মেয়ে।
ডানা চরি করে সে পরীর মেয়েকে বাধ্য করেছিল তাকে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে। আজ সে তার পাপের সাজা দিয়েছে।
পৃথিবীটা কোহিটোর কাছে শূন্য হয়ে গেল। সে তার কুয়োর পাশে গিয়ে বসে রইল—এখানেই সে একদিন পেয়েছিল পুরীর মেয়ে নীলপরীকে।
নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। কোহিটো বসেই আছে কুয়োর ধারে গাছের তলায়। ক’ দিন কেটেছে তারও, হিসেব নেই তার।
উন্মনা, উদাসীন। কয়েকবার সিখোসা এসে ডেকে গেছে তাতেও সম্বিত আসেনি তার। অবশেষে তার সম্বিত এলো এক কাকের ডাকে।
সে সেই মুহূর্তে যেন কাকেদের ডাকের অর্থ বুঝতে পারল। বলল, এমনি করে বসে থাকলে কি আর বৌ-ছেলেমেয়েদের ফিরে পাবে?
কোহিটো তাকাল তার দিকে। দেখল, কাকটি বিশিষ্ট। সে সাদা। কোহিটো তাকে বলল, তারা কোথায় তা কি তুমি জান ?
কাক বলল, আমি এখানে বসে সব দেখেছি। তারা আছে ঐ পাহাড়গুলো ছাড়িয়ে মেঘরাজ্যে। যদি তাদের সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে মেঘরাজ্যে যাও।
এত দুঃখেও হাসল কোহিটো। বলল, কি করে যাব কাক? আমার ত’ পরীদের মত ডানা নেই! তোমার ত’ ডানা আছে, তুমি কি পার আমাকে ওখানে পৌঁছে দিতে?
কাক বলল, পারি। আমার ক্ষমতা অসীম। তুমি আমাকে ছুঁয়ে থাকলে
আমি ঐ পাহাড়গুলো পার হয়ে তোমাকে ঐ মেঘরাজ্যে পৌঁছে দিতে পারি। তোমাকে শুধু একটি কাজ করতে হবে।
কোহিটো জিজ্ঞাসা করল, কি ?
কাক বলল, আমাকে ছুঁয়ে তোমাকে আমার মত কা-কা করে ডাকতে হবে। ডাক বন্ধ করলেই তুমি পড়ে যাবে।
তা হলেই তোমাকে পৌঁছে দেব মেঘরাজ্যে। কাক একটু থামল। তারপর বলল, তবে এমনি তোমাকে পৌঁছে দেব না। তার বদলে আমিও কিছু চাই।
কি? কোহিটো জানতে চাইল।।
কাক বলল, জান! আমিও তোমার মতই একা। কালো কাকেরা আমাকে দলে নেয় না। তুমি যদি আমাকেও কালো করে দিতে পার, তবেই তোমাকে সেখানে পৌঁছে দেব।
কোহিটো বলল, এ আর কঠিন কি? পরীরা অনেক কাজ পারে।
আমি ওখানে পৌঁছে আমার বৌকে বলে তোমাকে কালো করে দেব। আর সে যদি না দেয় তবে আমি তোমাকে কালো রঙ দিয়ে কালো করে দেব।
কাক বলল, বেশ তবে চল।
কোহিটো ছুঁয়ে থাকল কাককে। সে যেই কা-কা করে ডাকতে থাকল অমনি কাক ওড়া শুরু করল। সাত-সাতটা পাহাড়ের চূড়া পার হয়ে তারা এলো মেঘের রাজ্যে।
যেখানেই মেঘের ছায়া নেই, সেখানেই রোদের তীব্র তেজ, আগুনের মত জ্বলছে। সে তেজ সহ্য করা সহজ নয়। কোহিটো চোখ বন্ধ করে থাকল। কিন্তু কা-কা রব থামাল না।
এক সময় কাক থামল। বলল, মেঘের দেশে পৌঁছে গেছি। তুমি এবার ডাকা বন্ধ করতে পার।
কোহিটো ডাকা বন্ধ করে চোখ খুলল। চোখ খুলেই সে অবাক হ’ল। সাদা কাক সূর্যের তেজে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।
সে চিৎকার করে বলতে গেল, কিন্তু তার আগেই কাক উড়ে চলে গেল।
এবার মেঘের রাজ্যের দিকে তাকাল কোহিটো। ছবির মত সুন্দর দেশটা। ফুল-ফলে ভরা গাছপালা, নদী, পাহাড় দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে।
সেই গাছের তলায় ঘুরছে হরিণ, গাছে গাছে নানা রঙ-বেরঙ-এর পাখি। কি সুন্দর তাদের গান। কোহিটোর খুব দুঃখ হ’ল।
আহারে! এই সুন্দর দেশ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পরীর মেয়েটিকে তাদের ধুলো ময়লার রাজ্যে বৌ করে রেখে কত কষ্টই দিয়েছে। সে স্থির করল পরী বৌ-এর সঙ্গে দেখা হলে সে এজন্য ক্ষমা চাইবে।
কোহিটো চলছে আর দেখছে সে দেশের সৌন্দর্য। কিন্তু কিভাবে সন্ধান পাবে তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার? কে তাকে দেখিয়ে দেবে পথ? ঠিকানা দেবে তাদের? পৌঁছে দেবে তাদের কাছে?
এ কথা ভাবতেই তার সামনে হাজির হ’ল এক যক্ষ। সে বলল, আরে কোহিটো! এসো, এসো। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।
চল, আমিই তোমাকে তোমার পরী বৌ আর তোমার ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দেব।
বলে যক্ষটি তাকে হাত ধরে মুহূর্তে হাজির করে দিল তার পুত্র, কন্যা এবং পত্নীর সামনে। আনন্দে কোহিটো চিৎকার করে কি বলতে গেল।
কিন্তু তার কণ্ঠ দিয়ে শুধুই কা-কা রব বের হ’ল। সে আবার চেষ্টা করল, আবারও কাকা রব। রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হ’ল তার।
তারপর পিছন ফিরে ছুটতে থাকল। সকলে, থাম, থাম বলে চিৎকার করে তাকে থামাতে ছুটতে থাকল তার পিছনে। ক্রমেই কোলাহল বেড়ে যেতে থাকুল। কোলাহল বেড়েই চলল, বেড়েই চলল……..
সেই কোলাহলেই ঘুম ভেঙে গেল তার। কিন্তু কৈস ছুটছে না, আর যক্ষরাও ত’ ছুটছে না তার পিছনে।
কোলাহল করছে তার গ্রামের লোকেরাই। তারা ধরেছে ক’টি গ্রামের লোককেই—যারা ঈর্ষায় জল্বে কোহিটোকে হেয় করতে রাতে এসে জল ঘোলা করত।
ওদের ধরতে পারায় গ্রামের লোক কোহিটোকে যে তারা সন্দেহ করেছিল এজন্য ক্ষমা চাই ওরা কোহিটোর জয়ধ্বনি দিচ্ছে। এ কোলাহল তারই।
কোহিটোর মাথা আরো ভার হয়ে উঠল। তবে সবটাই সে কি স্বপ্ন দেখছিল ? কোনটক স্বপ্ন? পরী-ধরা, পরী বৌ, ছেলেমেয়ে, কাম যক্ষ……কতটুকু সত্য, কতখানি স্বপ্ন বা কল্পনা?
সে কি কুয়োও কাটেনি? জল কি পরীরা ঘোলা করত না? সে কি পরী ধরেনি ? তার কি ছেলেমেয়ে হয়নি ?…..প্রশ্ন আর প্রশ্ন! চিন্তা আর চিন্তা।
কোহিটোর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকল, তার হাত-পা অবশ হয়ে এল। বাইরের আর কিছুই তার মাথায় এলো না।
তাকে পাথরের মত বসে থাকতে দেখে গাঁয়ের লোকেরা তাকে নিয়ে গেল বাড়িতে। কিন্তু রাখা গেল না তাকে।
সে ছুটে এসে বসে রইল সেই গাছের তলায়। আর মাঝে মাঝে ডাকছে কাকের মত কা, কা।
ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেল তার দেহ। রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেল। একদিন দেখা গেল তার দেহ স্থির হয়ে আছে।
সকলে বলল, কোহিটো মারা গেছে। তা শুনে সিখোসা ছুটে এলো। কিন্তু তাকে যেতে দিল না গণক বুড়ি।
বলল, ওখানে যাসনে, যাসনে। কোহিটো মরেনি। ওখানে ওর দেহটাই পড়ে আছে। আমি দেখেছি ওর আত্মা একটা কাক হয়ে উড়ে গেছে।
সেই থেকে সিখোসা রোজ ভোরে উঠে খাবার ছড়িয়ে দেয়। অনেক কাক আসে খাবারের লোভে। কিন্তু তাদের মধ্যে কোনটা যে কোহিটো তা কিছুতেই বুঝতে পারে না।
তথ্যসূত্র : লুঙ্সা গ্রামের লোককথা ও অন্যান্য
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।