পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ “লুরি”দের ইতিহাস বিচার ও বর্তমান অবস্থা

Jumjournal
Last updated Sep 29th, 2021

5129

featured image

  

১.

“নহি বেরেন বেরানি সম্মন্তি’ধ কুদাচসং,
অবেরেন চ সম্মন্তি এস ধম্মো সনন্তনো”

অতীতে-বর্তমানে সত্য এবং প্রাসঙ্গিক উপরিউক্ত বুদ্ধ ভাষিত পালি গাথাটির সঠিক বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- “শত্রুতার দ্বারা শত্রুতা কখনো প্রশমিত হয় না, শত্রুহীনতার দ্বারা শত্রুতা প্রশমিত হয়। জগতের ইহাই সনাতন ধর্ম (মূল নীতি)”।

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এরূপ অজশ্র উপদেশ বাণী নিয়ে সকল প্রাণীর আলোর পথের দিশারী হয়ে এসেছিলেন মহামানব গৌতম বুদ্ধ। যাঁর বাণী এবং ধর্ম-দর্শনের মধ্যে নিহিত ছিলো বৈশ্বিক কল্যাণ ও প্রাণীকূলের মুক্তি।

দীর্ঘ কঠোর সাধনার ফলে অর্জিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথা পুরো পৃথিবীব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বীয় প্রচেষ্ঠায় তিনি তাঁর বাণীসমূহ বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন সকল দিকে, যেটি শুরু হয়েছিলো পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের দীক্ষা এবং উপদেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে।

পরবর্তীতে বিভিন্ন সাংঘিক সম্প্রদায় এবং বৌদ্ধ রাজা-প্রজাদের দ্বারা সেই বিস্তৃতির ধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ বা প্রাচীন বাংলা বুদ্ধকালীন সময়ে ভারতবর্ষেরই একটি অংশ ছিল বলে বুদ্ধের সেই মৈত্রীময় বাণী মিশ্রিত ধর্মীয় জোয়ার প্রাচীন বাংলা বা বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল কিংবদন্তীতে সেরূপই সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বৌদ্ধ রাজবংশ ও বৌদ্ধ সভ্যতার অবদান অনেকটা স্থান জুড়ে আছে। সপ্তম শতাব্দী থেকে দীর্ঘ চারশত বছরের বৌদ্ধ রাজবংশের শাসনামল ছিল বাংলার গৌরবময় কাল।

সেকালের শালবন বিহার, পন্ডিত বিহার, সোমাপুর বিহারের মত উচ্চতর বিদ্যাপীঠ তৎকালীন সমাজমানসের গভীরতার প্রমান দেয়। সব মিলে কালটা ছিল সমৃদ্ধি ও সৃজনশীলতায় অত্যন্ত তাৎপর্যময়।

বিভিন্ন কাল পেরিয়ে বৌদ্ধধর্ম জোয়ারের সেই প্রদীপটা নিভু নিভু অবস্থায় জ্বালিয়ে রেখে বাংলাদেশে আজও কিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বৌদ্ধধর্মের ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি লালন-পালন করে আসছে। যারা বাংলাদেশে ‘বৌদ্ধ সম্প্রদায়’ হিসেবে অধিক পরিচিত।

বর্তমানে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বাংলদেশের মোট জনসংখ্যার ০.৬% শতাংশ যা বাংলাদেশের সমগ্র জনসংখ্যার অনুপাতে নেহায়েতই নগণ্য। বাংলাদেশের বৌদ্ধ সমাজের বেশির ভাগ মানুষ থেরবাদা বা হীনযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও খুব অল্প সংখ্যাক বৌদ্ধ রয়েছেন যারা নিজেদেরকে মহাযানী ধর্মমতের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন; যা দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানা।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত  গ্রামে সুদীর্ঘ কাল ধরে বসবাস এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে আসছে এক শ্রেণী সংঘ সমাজ, যারা নিজেদের মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী বলে দাবী করে থাকেন। এই মহাযানী অনুসারী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা স্থানীদের মাঝে ‘লুরি’ নামেই অধিক পরিচিত।

দেশী-বিদেশী ঐতিহাসিক এবং বৌদ্ধ গবেষকদের আগ্রহ বা লুরিদের বিষয়ে অজানা থাকায় আজ অবদি তেমন কোন গবেষণা কর্ম সম্পাদিত হয়নি। যার দরূণ তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং মহাযানী ধর্মমত গ্রহণ এবং ঐতিহাসিক সম্পর্কের সঠিক তথ্য উপাত্ত বা দালিলিক কোন প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হয়নি।

তবে সময়ের পরিবর্তনে স্থানীয় কিছু গবেষক লুরিদের বিষয়ে কাজ শুরু করেছেন। ছোট পরিসরে হলেও সেই সকল গবেষকদের বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে উঠে আসছে লুরিদের সমৃদ্ধ ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা যা এতদিন সাধারণ মানুষের কাছে অজানা ছিলো।

ফলে লুরিদের বিষয়ে সাধারণ বৌদ্ধদের মাঝে যে বিরূপ ধারণা ছিল সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।  

২.

ভৌগলিক অবস্থান এবং জাতিগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা

১.    সমতলীয় বাঙ্গালী বৌদ্ধ
২.    পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বৌদ্ধ
৩.    সমতলীয় রাখাইন বৌদ্ধ
৪.    উত্তরবঙ্গের ওরাঁও বৌদ্ধ

উপরিউক্ত বিভাজনগুলোর মধ্যে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্রের কারণে বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে সুদীর্ঘকাল বসবাস করে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বৌদ্ধ সমাজ।

এই উপজাতীয় বৌদ্ধ সমাজের মধ্যে চাকমা, মারমা, তনচংগ্যা, রাখাইন, চাক, ম্রো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো অন্যতম। যারা নৃতাত্ত্বিক বিচারেও সবাই মঙ্গোলয়েদ এবং কিছু নেগ্রোয়েট জাতি শ্রেণীভূক্ত।

উক্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আবার ‘চাকমা’ সম্প্রদায় সংখ্যায় গুরু। যারা সুদীর্ঘকাল ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাংগামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) বসবাস করে আসছে। যাদের রয়েছে নিজ জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ ইতহাস।

A luri Temple and a Buddha Statue
একটি লুরি কিয়ং এবং বুদ্ধ মূর্তি

বিখ্যাত ব্রিটিশ নৃকুলবিদ এবং ইংরেজ শাসনামলের প্রশাসক  Sir Risley Herbert Hope (1851-1911) চাকমা জাতির ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এভাবে –

Vestiges of primitive animism , which we may believe to have been the religion of the chakma’s befor their conversion to Buddhism, still survive in the festival called Shongbasa, when nats or the spirits of wood and stream are worshiped, either by the votary himself or by an axorcist(ojha or naichhura) who is called in to perform the necessary ceremonies. The demons of oholars, fever and others diseases are propitiated in a river-bed or in the thick jungle, where spirits delight to dwell, with offerings goats, fowls, ducks, pigeons and flowers. The regular priest nothing to do with this ritual, which has been condemned as unorthodox.”

তাঁর কথাটি আংশিক সত্য হলেও আদতে চাকমা জাতির একদম শুরুর দিকের  ইতিহাসেও বৌদ্ধ ধর্মের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তাইতো পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার T.H. Lewin লিখেছেন, “চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাস করে।”  

চাকমা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে “লুরি” নামক এক শ্রেণী কথিত মহাযানী বৌদ্ধ ভিক্ষুর সংঘের নাম জানা যায় অর্থাৎ সেই সকল লুরিগণই ছিলেন চাকমা বংশজাত ধর্মগুরু।

যারা একসময় চাকমা সমাজে বৌদ্ধ ধর্মের ধারক-বাহক ছিলেন। চাকমা সমাজের সেই পুরোহিতদের সম্পর্কে Dr. Francis Buchanan এর মত এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-

“They have two ranks of priests, the Samona and Moishang, the latter of whom are the superiors and by Bengalese are called Raulins8

যদিও এখন চাকমা সমাজে তাঁদের বিচরণ খুবই সামান্য। বর্তমানে চাকমা সমাজে  থেরবাদী  বনভিক্ষু ও পার্বত্যভিক্ষু নামক দু’টি সংঘের প্রভাব বেশি থাকলেও সমাজের বয়ষ্ক সকল নারী-পুরুষের মূখে মূখে সেই “লুরি”দের নিয়ে রচিত গীতি কবিতা, প্রবাদ ও ইতিকথা এখনও শুনা যায়। সেরূপ একটি গীতি কবিতা নিম্নে দেওয়া হলঃ  

“ছড়া আগারে লুরি হিয়ঙ,
বৌ ঝিও ন দেলং
বৌও নেই, ঝিও নেই
তোনে পাদে ভাত খেলং
ধুন্দো সুবোরী বেক খেলং
হাবর সুবোরে ঘুম গেলং
হন্না দিলগি ন দেলং
ধর্ম হদা শুনিলং
মন শান্দিয়্যে ঘরত ফিরিলং”

বঙ্গানুবাদ :

ছড়ার (ছোট নদী) উপরে লুরি ক্যাং(বিহার)
বৌ-ঝিও দেখলাম না
বৌও নেই, ঝিও নেই
সুস্বাদু খাবার দিয়ে ভাত খেলাম
তামাক, পান-সুপারি সব খেলাম
কাপড়-চোপড় দিয়ে ঘুম গেলাম
কে দিলো দেখলাম না
ধর্মের বাণী শুনলাম
মনের শান্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম।

৩.

লুরিদের অতীত ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা জানার পাশাপাশি তাঁদের নামের সঠিক ইতিহাস জানাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সেই ইতিহাস জানার জন্য বস্তুনিষ্ট এবং বিশ্বষ্ট কোন তথ্য আজ অবদি কেউ উপস্থাপন করতে  পারেনি।

লুরি বা লাউরি নামকরণটা কোথা থেকে আসছে? কেনই বা তাঁদের লুরি বা লাউরি নামে ডাকা হয়? এই সকল প্রশ্নের প্রত্ত্যুত্তরে যে উত্তর বা তথ্যগুলো উঠে আসছে সেগুলো বেশিরভাগ অনুমান নির্ভর, শ্রুত বা ব্যক্তিগত অভিমত মাত্র, গবেষণা নির্ভর বা সত্য কোন তথ্য নয়।

তাইতো এ বিষয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে এমনকি সাধারন জনগণের মধ্যে মতের বেশ অমিল পাওয়া যায়। যার কারণে কোন বক্তব্য বা কার ব্যাখ্যা সঠিক তা নির্ণয় করা আজও কষ্ট সাধ্যের ব্যাপার।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভৌগলিক ইতিহাস, গোষ্ঠীগুলোর নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাস নিয়ে রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যতটা গবেষণা হয়েছে সেরূপ ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা হয়নি।

তাইতো বিভিন্ন জনের কাছে অল্প যে তথ্য-উপাত্তগুলো ছিলো সেগুলো কালের বিবর্তনে অবহেলায়-অযত্নে হারিয়ে গেছে, যেগুলো পরে আর কোন গবেষকের পক্ষে উদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

লুরিদের নামের ইতিহাস বিষয়ে প্রচলিত অভিমতগুলোর একটি হলো-চট্টগ্রামের কিছু কিছু অঞ্চলে মুসলিম সম্প্রদায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাউরি নামে সম্বোধন করে থাকে।

কারণ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নির্বাণ দর্শন করার জন্য পরিবার, পরিজন, সহায়, সম্পদ, মাতা-পিতা, ভাই-বোন সহ পার্থিব জগতের সকল ভোগ সম্পদ ত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে সংসার পরিত্যাগ করে স্ব-ইচ্ছাই।

যেমনটা লক্ষ্য করা যায় ইসলামের সুফিবাদ বা আউলিয়াদের জীবনে। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মানজনক সম্বোধনের জন্য আউলিদের নামানুসারে রাউলি ডাকা হয়।

আরেকটি প্রচলিত অভিমত হলো-বর্মী সম্রাট আনোয়ারাথা (১০৪৪-৭৭ খ্রিঃ) সময়কালে মায়ানমার (বার্মায়) হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান ও প্রভাব বিস্তার শুরু করে।

তিনি মায়ানমার (বার্মা) থেকে ‘আরি’ নামক একশ্রেণী বৌদ্ধ পুরোহিতদের বিতারিত করেছিলেন। এই সম্পর্কে Prof. D.G.E. Hall লিখেছেন-

“Tradition asserts that he (Anawratha) took a monk Shin Arahan into his service and charged himself with the task od convertion the Burmese to Hinayana Buddhism. This entailed a struggle with a priesthood known as the Ari who dominated upper Burma. They were Mahayanist and practiced Tantric and other erotic rites. To obtain copies of the pali canon, the Tripitaka for the proper instruction of the people, he conquered Thaton, which composed thirty complete sets deported to Pagan”. ১০

উচ্চারণ এবং শাব্দিক বিবেচনায় আরি-লাউরি বা লুরি শব্দগুলোর তেমন বেশি পার্থক্য মনে হয় না। একদম একই না হলেও প্রায় কাছাকাছি। তাই বর্মী সম্রাট আনোয়ারাথা কর্তৃক বিতারিত মহাযানি বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘আরি’ থেকেই বাংলাদেশের মহাযানী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নাম লাউরি বা লুরি আসছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

কারণ চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সাথে আরাকান বা বার্মা অঞ্চলের মানুষের সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক পারস্পারিক সম্পর্ক বহু দিনের।

চট্টলতত্ত্ববিদ আবদুল হক চৌধুরীর মতে- “১৪৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দ অবদি হাজার অধিক বছর কাল চট্টগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে আরাকান, সমতট, হরিকেল, পাট্টিকারা, পূর্ববঙ্গের চন্দ্র ও ব্রহ্মদেশের পঁগার বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল।

আবার ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ অবদি চট্টগ্রাম একাক্রমে পঁচাশি বছরকাল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল।” ১১ এই সুদীর্ঘ সময়কালে আরাকানের ধর্মীয় প্রভাব চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের উপর চলে আসাটা অস্বাভাবিক নয়।

৪.

বিশিষ্ট চাকমা কবি ও ভাষা গবেষক মুকুন্দ চাঙমা ‘লুরিদের’ নিয়ে কবিতার সুরে লিখেছিলেন-

‘চাঙমা উনত্তুন লুরি বিলি পুরোহিত এলাক,
মরা মৃত্যু সাদ্দিন্যাত পূন্য কর্ম গরি দিদাগ।।
শিব (সীবলী) পূজা গরিদাক,
আগরতারা পড়িদাগ।।
ভাদদ্যা নাঙে জাতি(জ্ঞাতি) পূজা তারা গরিদাক,
আগরতারা মন্ত্র (সুত্র) পড়ি ইয়ানি সিরেদাগ।।’ ১২

বঙ্গানুবাদঃ

‘চাকমা জাতিতে লুরি নামক পুরোহিত (ভিক্ষু) ছিলো’
মৃতের দাহ, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে পূণ্য কর্ম করে দিতো।।
সীবলী পূজা করতো,
আগরতারা (চাকমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ) পড়তো।।
অতীত জ্ঞাতিদের উদ্দেশ্যে ভাত দেওয়া অর্থাৎ জ্ঞাতি পূজা করতো,
আগরতারা’র সুত্র/মন্ত্র পড়ে এগুলো সম্পাদন করতো।।’

উপরিউক্ত পঙতিগুলোতে লেখক চাকমা সমাজে লুরি নামক একশ্রেণী মহাযানী ভিক্ষু থাকার ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁদের সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেছেন। যেমন –

এক. চাকমা সমাজে লুরিদের কৃত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে প্রাসঙ্গিক সুত্র পাঠ করে মৃতদেহ সৎকার করা, পরবর্তীতে নির্দিষ্ট দিনে মৃত ব্যক্তির সৎগতির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পূণ্যকর্ম করে দেওয়া।

দুই. তখনকার সময়ে লুরিরা বিভিন্ন পূজার পাশাপাশি সীবলী পূজা করতেন।

তিন. চাকমারা জ্ঞাতিদের উদ্দেশ্যে যে পূণ্য কর্ম বা পূজা দিয়ে থাকে সেই কাজটিও সাধারনত লুরিদের মাধ্যমেই করা হত।

চার. সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলো লুরিরা আগরতারা নামক ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তো এবং এই গ্রন্থ থেকে সুত্র বা মন্ত্র পড়েই তাঁরা তাঁদের সকল ধর্মীয় কার্য-প্রণালী সম্পাদন করতো। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করলে লুরিদের সকল কার্যক্রম ছিলো মূলত “আগরতারা” ক্ষেন্দ্রিক।

লুরিদের প্রধান এবং প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রের নাম আগরতারা। তাঁরা বৌদ্ধ হলেও ত্রিপিটকের সাথে তেমন কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তবে আগরতারা গ্রন্থটি পবিত্র ত্রিপিটকের বিরুদ্ধে নহে, বরং সহযোগী ১৩

‘আগরতারা’ শব্দটি ‘আগর’ এবং ‘তারা’ দু’টি শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে সৃষ্ট। আগর শব্দটি চাকমা শব্দ যার অর্থ আগেকার বা পৌরাণিক আর তারা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ যার বাংলা অর্থ নক্ষত্র বা হিন্দুদের দশ মহাবিদ্যার দ্বিতীয়টিকে বুঝায় ১৪

বিশিষ্ট আগর শাস্ত্র গবেষক  ইন্দ্র লাল চাকমার মতে- তারা অর্থ হিন্দুদের তিন দশ মহাবিদ্যার ২য় মহাবিদ্যা। দেখা যায় যে, আগরতারা লেখা গুলোতে কোন দাঁড়ি, কমা ইত্যাদি নাই।

প্রত্যেকটি শব্দকে  ২ দাড়ি দ্বারা সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রাউলিরা পড়ার সময় প্রত্যেকটা শব্দ একটা সুর করে পড়ে থাকেন। তাতে মনে হয় তারা অর্থটি ঐ মন্ত্র বা মহাবিদ্যা হতে গ্রহণ করা হয়েছিল ১৫

তাহলে  আগরতারা শব্দের অর্থ হলো পৌরানিক মহাবিদ্যা বা শাস্ত্র। যদিও আগরতারা এই শব্দ যুগল এবং অর্থ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে অনেক মতবিরোধ রয়েছে।

তাঁরা এই আগরতারা শব্দদ্বয়ের বিষয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন অর্থ ও যুক্তি দিয়েছেন। ১৯০৯ সালে ভারতীয় বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও পন্ডিত  সতীষ চন্দ্র ঘোষ বলেন-চাকমাদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রের নাম “আগরতারা” অর্থাৎ পৌরাণিক শাস্ত্র।

‘আগর’ পূর্ব্বের ‘তারা’-শাস্ত্র; সুতরাং ‘আগরতারা’ শব্দের অর্থ -পৌরাণিক শাস্ত্র ১৬। ১৯৬২ সালে নোয়ারাম চাকমা কর্র্তৃক লিখিত ‘পার্বত্য রাজলাহরি’ গ্রন্থে তিনি আগর ও তারা শব্দের বিষয়ে শ্রী ঘোষকে সমর্থন করেন।

১৯৬৯ সালে বিরাজ মোহন দেওয়ান কর্তৃক লিখিত ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে চাকমাদের ধর্ম ও আগরতারা বিষয়ে বিশদভাবে আলোকপাত করলেও তিনি উক্ত শব্দদ্বয়ের সঠিক অর্থ বিষয়ে বিশ্লেষণাত্তক তেমন কোন তথ্য উপস্থাপন করেননি।

লেখক অশোক কুমার দেওয়ানের মতে- আগরতারা শব্দদ্বয়ের প্রকৃত অর্থ তর্কাতীতভাবে এখনও নির্ণিত হয়নি। সতীষ চন্দ্র ঘোষ এবং অপর কেউ কেউ এদের অর্থ করেছেন আগের শাস্ত্র বা প্রাচীন শাস্ত্র। আমার মনে হয়, সতীষ চন্দ্র ঘোষের অর্থ ব্যাখ্যা সঠিক নয়।

শব্দ দু’টির অর্থ করা যেতে পারে- আখর সুত্র বা অক্ষর সুত্র অর্থাৎ লিখিত সুত্র। চাকমা ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তনের সুত্রানুযায়ী আখর শব্দের উচ্চারণ যথার্থ হয় ‘আঘর’ (শ্রী ঘোষের ‘আগর’ শব্দটি ভুল)।

চাকমা সমাজের গীতি কবি গেংকুলীদের গীতেও -‘লেখা পড়ি আঘরে’ ইত্যাদি শব্দের আবৃত্তি শোনা যায়। ‘তারা’ নিঃসন্দেহে সুত্র বা শাস্ত্র। আগরতারার অন্তর্গত বিভিন্ন ‘তারা’ আসলেই বিভিন্ন ‘পালিসুত্র’ ১৭

এক্ষেত্রে আগরতারা এর মূল অর্থ শ্রী দেওয়ান কর্তৃক প্রদত্ত ‘অক্ষরবৃত্ত সুত্র’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপরদিকে বিশিষ্ট গবেষক S.P. Talukder চাকমাদের ধর্মীয় গ্রন্থের নামের শেষে “তারা”র সাথে তিব্বতী মহাযানী বৌদ্ধদের “তারা” এর সাথে মিল খুঁজতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন-

Their legendary remembrance of Agar Tara, Alim Tara etc and Gogen supreme truth Lama Corresponds to Tibetan faith. Tara or Arya Tara is a female Buddha typically associated eith Buddhist tantra practices as preserved in Tibetan Buddhism.”18

তিব্বতীদের তারা বা আর্য তারা হলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের একজন নারী বোধিসত্ব। যিনি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে একজন নারী বুদ্ধের মর্যাদা পেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি চাকমাদের আগরতারা আর তিব্বতীদের নারী বোধিসত্ব আর্যতারা নামকরণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংযোগ থাকতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

যদিও তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক কোন সম্পর্কের তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। উল্লেখিত দু’টি বিষয়ই মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের বিষয় তাই সম্পর্ক থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। তা অলোচনা বা গবেষণার বিষয়।

তার আগে তাঁর এই ধারণা সম্পুর্ণ সত্য বা অসত্য বলাটা অনুচিত হবে। ‘তারা’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এখানে আরেকটি বিষয় চলে আসে যা পূর্ববর্তী গবেষকগণ এড়িয়ে গেছেন। তা হলো- থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে ত্রিশরণ হিসেবে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের নাম নেওয়া হয় এবং সাধারণ বৌদ্ধরা মাঙ্গলিক উদ্দেশ্যে কোন কিছুর প্রারম্ভেও ত্রিশরণ হিসেবে বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের নাম লিখে থাকে।

ঠিক তেমনি মহাযানী বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও ত্রিশরণের নাম উচ্চারন এবং ব্যবহার করে থাকে। তাঁরা ত্রিশরণ হিসেবে ফারা, তারা, সাংঘা নামগুলো নিয়ে থাকে। অর্থাৎ লুরিরা বা তাঁদের ভক্তরা এখানে তারা বলতে ধর্মকেই বুঝে থাকেন। সেক্ষেত্রে আগরতারা বাংলা অর্থ পৌরানিক শাস্ত্রটাই বেশি গ্রহনযোগ্য এবং সঠিক বলে মনে হয়।

মূলত এই “আগরতারা” গ্রন্থটি বিভিন্ন কার্যে ব্যবহৃত মোট ২৮টি মন্ত্র বা সুত্রের সামষ্টিক নাম। যেগুলোর ব্যবহার করা হতো ভিন্ন ভিন্ন কাজে এবং সেই ব্যবহার বিধি অনুযায়ী নাম দেওয়া হয়েছিলো। সেই ২৮টি সুত্র বা মন্ত্রের নাম ও ব্যবহার নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ- ১৯

১. কর্মফুলু তারা- মৃত লোকের উদ্দেশ্যে দান-দক্ষিণা দেওয়ার সময় এ তারা ব্যবহৃত হয়। এই সুত্রটি দ্বারা  মূলত কাশ্যপ বুদ্ধের প্রশংসা করা হয়েছে।

২.    নতিক তারা বা বড় নিদিং তারা-  এই সুত্রে জ্যোতিষ শাস্ত্রের ব্যাখ্যাদেওয়া আছে। এই তারাই মেধাঙ্কর বুদ্ধের গুণাগান গাওয়া হয়েছে।

৩.    তনিক তারা- চাকমা ভেসজ ও তান্ত্রিক শাস্ত্রে এই তারা ব্যবহৃত হয়। এই তারাতে তৃষ্ণাঙ্খর বদ্ধের গুণ বর্ণনা করা হয়েছে ।

৪.    পুকিরি তারা- যুগ সিদ্ধি সাধনায় এই তারা ব্যবহৃত হয়। এটির মাধ্যমে শরণঙ্কর বুদ্ধের গুণগান গাওয়া হয়েছে।

৫.    রাকম ফুলু তারা- এই তারা দ্বারা ধার্মিক রাজার রাজ্য শাসন নীতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সুমেধ বুদ্ধের গুণ বর্ণনা করা হয়েছে এই সুত্রে। 

৬.    আরিষ্য নামা তারা- গৃহী ধর্ম পরিচালনা নীতি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে এই তারায়। দীপঙ্কর বুদ্ধেও গুণগান করা হয়েছে।

৭.    মালেন তারা- আরিয় মিডিঙা যুগে লোকজন কিভাবে ধর্ম পালন করবে এবং যুগধর্ম হিসেবে তখন কি কি লক্ষন পরিলক্ষিত হবে তার বর্ণনা আছে। মৃত্যুর পর কিভাবে সৎকার করে প্রেতাত্না উদ্ধার করা হয় তার ব্যাখ্যা আছে। তিস্য বুদ্ধেও গুন বর্ণনা আছে।

৮.    আনিজ তারা -মৃত্যুর পর কেউ অপায় বা নরকে গমন করলে তাকে উদ্ধার করা মন্ত্র। চাকমা রীতি ‘ভাদ্য পূজার’ সময় এই তারাটি ব্যবহৃত হয়। রেবত বুদ্ধেও গুণগান গাওয়া হয়েছে।

৯.    সাদেংগ্রী তারা- চাকমা জাতির আদি ধার্মিক রাজা প্রাতঃস্মরণীয় সাদেংগ্রী স্বশরীরে এই মন্ত্র দ্বারা স্বর্গে গমন করেন। তাই কোন রাজার মৃত্যু হলে তাঁর সৎকারের জন্য এই তারাটি ব্যবহৃত হয়। ফুস্স বুদ্ধের গুণগান গাওয়া হয়েছে এই তারায়।

১০.   বড় কুরুক তারা-  আদিকালে বাঘ, ভাল্লুক ও হিংস্র প্রাণী বশ করার জন্য এই মন্ত্র পরা হয়। কন্ডুণ্য বুদ্ধের নাম স্মরণ করা হয়েছে এই তারায় আছে।

১১.   ছোট কুরুক তারা- হিংস্র প্রাণী বশ করার কাজে এই তারাটি ব্যবহৃত হয়। সুমঙ্গল বুদ্ধের নাম এই তারায় আছে।

১২.   চান্দিমা তারা- শ্মশানে চাদোয়া টাঙানোর সময় এই তারাটি ব্যবহৃত হয়। শোভিত বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে এই তারাই।

১৩.   পুদুম ফুলু  তারা- মৃত লোকের উদ্দেশ্যে পিন্ড দান। মৃতাত্মা স্বর্গে গেলেও পিন্ড পেলে সুখী হয়। পুদুম বুদ্ধের গুণ গান গাওয়া হয়েছে।

১৪.   পুতুম ফুলু তারা- মানবের মনোবাসনা পূরণ করা হয় এই তারা মাধ্যমে । পুদুমুত্তর বুদ্ধের নাম স্মরণ করা হয়েছে এই সুত্রে।

১৫.   সাহস ফুলু তারা- ইহকালে কুকর্মের ফলে মৃত্যুর পর কেউ প্রেত হলে তাকে তাদের মুক্ত করা হয়। এই তারার শিখি বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে। 

১৬.   চাঙ্গি ফুলু তারা- পাপের ফলে যারা পশু-পাখি হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে তাদের উদ্ধার করার জন্য এই মন্ত্র পাঠ করা হয়। সুমঙ্গল বুদ্ধের গুণগান গাওয়া হয়েছে এই তারায়।

১৭.   সুভদিছা তারা- চাকমাদেও জ্ঞাতি উদ্ধার ভাদ্যা পূজা অনুষ্ঠানের সময় এই তারা পাঠ করা হয়। ছোট শিশুরা ছোটকালে বেশি কান্নাকাটি করলে তাদের শান্ত করার জন্য এদা ডাকার পূজাতেও এই মন্ত্রটি ব্যবহৃত হয়। সুমন বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে এই তারাতে।

১৮.  জিয়ন ধরণ তারা- ছোট শিশুরদের এদা ডাকা পূজায় এবং ভাদ্যা ধর্মাঅনুষ্ঠানে এটি পাঠ করা হয়। প্রিয়দর্শী বুদ্ধের নাম স্মরণ করা হয়েছে এই তারায়।

১৯.   সীগল মঙ্গল তারা- মানুষের গ্রহদশা এবং ফাঁড়া ইত্যাদি এই মন্ত্র দ্বারা কাটানো হয়। নিজের এবয় পরিবারের জন্য এই তারাটি খুবই উপকারী। সুজাত বুদ্ধের গুণগান গাওয়া হয়েছে এই সুত্রে।

২০.  চেরাগ ফুলু তারা- এই তারা মন্ত্র পড়ে মৃত লোকের উদ্দেশ্যে দান-দক্ষিণা দিলে দান সিদ্ধ হয়। ধর্মদর্শী বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে এই তারায়।

২১.   দাশা পারমি  তারা- জাদি পূজা এবং পূর্ব পুরুষদের উদ্ধেশ্যে পিন্ড দানের সময় এই তারা পাঠ করা হয়। গৌতম বুদ্ধের গুণ বর্ণনা করা হয়েছে এই তারায়। 

২২.  তৃপু  তারা- চাকমাদের ভাদ্যা পূজার সময় কেউ মূর্ষাহত হলে তাকে এই তারা পড়ে শুনানো হয়। ফলে তার পূনঃপূত্থান হয়। অনোমদর্শী বুদ্ধের জ্ঞান বর্ণনা করা হয়েছে এই তারায়।

২৩.  আঙারা  তারা- ইহাতে মোট ১৫টি সুত্র বা গাথা আছে। শীঘল মঙ্গল তারার সাথে এই তারাটি পড়া হলে অপদেবতা যেমন- ভুত, প্রেত, ঢেউ, দৈত্য ইত্যাদি গ্রাম ছেড়ে যায়। মানুষের ফাঁড়া দশা কাটানোর জন্য ও এই তারাটি ব্যবহৃত হয়। সিদ্ধার্থ বুদ্ধের জ্ঞান বর্ণনা করা হয়েছে এই তারাতে।

২৪.  বুজঙ্গ তারা- এই তারায় আটটি সুত্র বা গাথা আছে। এগুলো দ্বারা বাঘ বশ করা যায়। কুকুসন্ধ বুদ্ধের নাম নেওয়া হয়েছে এই তারাতে।

২৫.  জয় মঙ্গল তারা- জযমঙ্গল তারাতে ২০টি সুত্র বা গাথা আছে। এটি পাঠের মাধ্যমে রণে, বণে, জঙ্গলে এবং মোকদ্দমায় মঙ্গল হয়। নারদ বুদ্ধের জ্ঞান বর্ণনা আছে এই তারাতে।

২৬.  বোদ্যঙ্গ তারা- এই তারা পাঠের মাধ্যমে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। এই তারাতে তিনটি সুত্র বা গাথা আছে। বিপস্সী বুদ্ধের জ্ঞানের বর্ণনা দেওয়া আছে এই তারাতে।

২৭.  উদাং প্রামী তারা বা চাক প্রামী  তারা- এই তারাতে ৪৩ প্রকার কর্মফলের জাজ্জ্যল্যমান প্রমাণসহ অর্থদর্শী বুদ্ধ ও বুদ্ধদেবের অমীয় বানী বর্ণনা করা আছে।

(উল্লেখ্য, আগরতারা গ্রন্থে আটাশটি তারা থাকলেও কালের পরিবর্তনে একটি তারা হারিয়ে যায়। যেটি পরবর্তীতে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।)

বর্তমান দীঘিনালা উপজেলার ছোট মেরুং মৌজার চৌংরাছড়ি গ্রামের অধিবাসী শ্রীযুক্ত আঙুফুল চাঁন কার্বারী, যার জন্ম ১৮৯৮ সনের ৩০ শে চৈত্র। তিনি ১৯৬৪ সনে নিজ হাতে লেখায় চাকমাদের আদি ধর্মগ্রন্থ আগরতারার একটি পান্ডুলিপি রেখে গিয়েছেন।

পান্ডুলিপিখানা বর্তমানে রাংগামাটি উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিটের লাইব্রেরীতে সংগ্রহ আছে২০। উক্ত পান্ডুলিপিটিতে ২৮টি তারার মধ্যে চাকমা লেখায় ২৭টি এবং বাংলা কবিতার ছন্দে কর্মফুলু তারা লেখা আছে।

সেই পান্ডুলিপির কিছু অংশ নিম্নে দেওয়া হলঃ  

৫.

বাংলায় সুদীর্ঘ পাল শাসনের পরবর্তী ১২ শতক থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়কালকে বাংলাদেশের বৌদ্ধ তথা চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের জন্য কালো অধ্যায় হিসেবেই হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

কারণ বৌদ্ধ শাসক পাল রাজাদের পরাজয়ের পর বাংলায় শাসন ক্ষমতা চলে যায় পর্যায়ক্রমে হিন্দু ও মুসলমান শাসকদের হাতে। যারা বাংলার বৌদ্ধদের শুধু শোষণ ও বঞ্চিতই করেনি বাংলা থেকে চিরতরে নিঃচিহ্ন করার পায়তারা করেছিল।

তাইতো এত দ্রুত সময়ে  শত শত বছরের লালিত-পালিত বৌদ্ধদের ধর্মীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এই বাংলা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের সঠিক পন্থা ও রীতি-নীতি ভুলে বিভিন্ন শ্রেণী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়, যারাই মূলত বৌদ্ধধর্মকে বিকৃতভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করতে শুরু করে।

বলা যায় কয়েক শতাব্দির মধ্যেই গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত মৈত্রীমূলক সদ্ধর্ম যা অন্যতম বিশিষ্ট ধর্ম হিসেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বগৌরবে বিরাজিত ছিল তা স্বকীয়তা হারিয়ে বুদ্ধদেশিত মূল তত্ত্বগুলি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে এক অপমিশ্র বা নতুন ধর্মে পরিনত হয়েছিল ২১

তাইতো পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন- “বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হয়ে গেলো এবং অপর অর্ধেক ব্রাহ্মণের শরনাগত হলো। আর বৌদ্ধদের মধ্যে যারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করল মুসলমান-ব্রাহ্মণ উভয় পক্ষ হতে তখন তাদের উপর নির্যাতন উপস্থিত হল।” ২২

অর্থাৎ এসময় বৌদ্ধদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছিল। অত্যাচার আর নির্যাতনের ভয়ে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্ম পালন এবং আচরন থেকে বিরত থাকল।

তৎকালীন ক্ষমতাসীন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সাথে মিশে গিয়ে কিছু কিছু বৌদ্ধ হিন্দুদের বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা-অর্চনার পাশাপাশি নীরবে বৌদ্ধ ধর্মও চর্চা করতে লাগলো।

সেন আমলে বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিক সুনীল চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেন-

“সেন পর্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও দেবদেবীর প্রভাব বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছিলো। সেন রাজারা বৌদ্ধদের উৎপীড়ন করেনি তবে বৌদ্ধদের সম্পর্কে তাঁদের মনে অশ্রদ্ধা ছিল। বৌদ্ধদের পাষান্ড হিসেবে আখ্যা দেওয়া প্রায় রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।”

বল্লালসেন তাঁর ‘দানসাগর’ গ্রন্থে ঘোষণা করেন “নাস্তিকদের অর্থাৎ বৌদ্ধদের পদোচ্ছেদের জন্য তাঁর আবির্ভাব” এরূপ তথ্যও তিনি তুলে ধরেন। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে সেন রাজ্যের পরিমন্ডল বৌদ্ধধর্মের পক্ষে অনুকূল ছিলো না।

বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের অবনতির এটি একটি প্রধান কারন। ২৩ কোন উপায় না দেখে এবং পারপার্শ্বিক বাস্তবতার সাথে ঠিকতে না পেরে ধীরে ধীরে বেশিরভাগ বৌদ্ধ হিন্দুদের সাথে মিশে যেতে শুরু করে। বাংলাই এক সময় বৌদ্ধধর্ম আর হিন্দুধর্ম লালন-পালন এবং আচরণে একাকার হয়ে যাওয়ার ইতিহাস কারো অজানা নয়।

এই বিষয়ে ভারতীয় বিশিষ্ট লেখক মনিকুন্তলা হালদার বলেন- “বস্তুতঃ পাল রাজাদের সময়কালে বাংলাদেশে বিভিন্ন যান বা বিভিন্ন তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন দেখা যায়, যেগুলো মূল বৌদ্ধধর্মের অশেষ ক্ষতিসাধন করিয়া ধর্মের মধ্যে বিকৃতির আনয়ন করে এবং অবশেষে হিন্দু দিগের তন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্র মিলিয়া একাকার হইয়া যায়” ২৪

সেই মানুষরাই সময়-সুযোগ বুঝে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুরূপে আবির্ভূত হলো যাদেরকেই মূলত ‘লুরি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ততোদিনে যা হওয়ার তাই হয়ে গেলো, বৌদ্ধধর্ম বিকৃতির চরম অবস্থায় চলে আসলো। বিকৃত অবস্থায় তাঁরা বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী রূপ ধারন করে চট্টগ্রাম এবং তার পাশে পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় বিস্তার এবং বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করতে লাগলো।

বৌদ্ধ ধর্মের এই দুঃসময়ে বাংলাদেশের অন্যতম বৌদ্ধ সম্প্রদায় চাকমা সমাজে ধর্মীয় অবস্থা কেমন ছিলো তা জানার জন্য পাহাড়ী বৌদ্ধ সমাজের সাধকপুরুষ সাধনানন্দ মহাস্থবিরের (বনভান্তে) ২৫ একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য-

“কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী আমাদের গ্রাম মোরঘোনায় তখন প্রায়ই হিন্দু বৈরাগী আর ব্রাহ্মণের আগমন ঘটত। গ্রামের মানুষ তাঁদের গান-কীর্তন সুরে রামায়ন-মহাভারতের কথাগুলো এবং ব্রাহ্মণের গণা-পড়া ও আচার বিধির উপদেশকে পরম ধর্মজ্ঞানে বিশ্বাস করতেন আর মান্য করতেন।

‘মা-লক্ষী-মার’ পূজাদির সাথে বৌদ্ধ তান্ত্রিক লুরিদের(বড়ুয়া লাউরি) উপদিষ্ট গাং পূজা, শিব পূজা, থানমানা পূজা, ভাদ্যা পূজা, মরা-জেদা ফারক গরানা পূজাদিতে বহু শুকর আর মুরগির বলিদান প্রথা এবং ঝাড়-ফুক, তাবিজ-টোনা-চালান (আঙ) ছিল তৎকালীন চাকমা সমাজের ধর্ম-সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।

গ্রামের বা পাড়ায় কোথাও কোথাও ছোট আকারে ব্রোঞ্জ-পিতল অথবা শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি পূজার জন্য একটি চূড়া ও তিন কক্ষ বিশিষ্ট ছোট আকারের ক্যাং ঘর (বুদ্ধ মন্দির বা বিহার) ছিল।

চাকমা বিহারগুলোতে অনিয়মিতভাবে মারমা ভিক্ষুই বেশি থাকতেন, কদাচিৎ বড়ুয়া ভিক্ষু দু-একজনের আনাগোনা দেখা যেত। তবে সেই মারমা বা বড়ুয়া ভিক্ষুরা ধর্ম-বিনয় সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ এবং অনবিজ্ঞ।

লুরিগনই ছিলেন চাকমা বংশজাত ধর্মগুরু। তারা কখনো বৈদ্য, কখনো লুরি দীক্ষা নিতেন বিহারবাসী ভিক্ষুদের থেকেই। শ্রামণ্য দীক্ষা নেওয়ার পর বিহার থেকে সময়-সুযোগ বুঝে পলায়ন করে নিজেদের লুরি বলে পরিচয় দিতেন। তারা সাধারনত চীবরকে ধুতির মত করে কোমরে গোঁজ দিয়েই পরিধান করতেন।” ২৬

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামান্য কিছু এলাকা এদের বিচরণের ক্ষেত্র। তবে অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে হীনযান বা থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তৃতি লাভের আগে লুরিদের দ্বারাই বৌদ্ধ ধর্মীয় সকল আচার-অনুষ্ঠানাধি ( যেমন- জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, মাঙ্গলিক সুত্র পাঠ ইত্যাদি) সম্পন্ন হতো।

অর্থাৎ সেই সময়কালে বৌদ্ধ শাসনের হর্তাকর্তা ছিলেন তাঁরাই। বৌদ্ধদের যত আচার-অনুষ্টান, ধর্ম-কর্ম এই লুরিদের দ্বারাই পরিচালিত হতো। তখনকার সময়ে লুরিদের বিকল্প বলতে কিছুই ছিলো না।

চাকমা সমাজের বিশিষ্ট লেখক  বিরাজ মোহন দেওয়ান বলেন- “অতীতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর পরিবর্তে ঐ সুত্রগুলো রুলি (বরি) নামীয় এক ধর্মীয় সম্প্রদায় দ্বারা পাঠ করা হইত” ২৭

লেখক এখানে এই বৌদ্ধ সাধক সম্প্রদায়কে “রুলি” নামে গ্রন্থে উল্লেখ করলেও সঠিকটা আসলে রুলি হবে নাকি লুরি হবে প্রশ্ন থেকে যায়।

কারণ সাধারণত চাকমা সমাজ বা সম্প্রদায়ের সকলের মূখে মূখে রুলির পরিবর্তে লুরি নামটি বেশি শুনা যায় অপরদিকে স্বয়ং বর্তমানে চাকমা সমাজে যে সকল লুরি আছে তাঁরাও নিজেদেরকে লুরি হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকে।

তিনি আরো বলেছেন- বর্তমানে বিভিন্ন থেরবাদী সাংঘিক বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা ধর্মীয় কাজ সমূহ সমাধান হলেও প্রাচীন ঐ লুরি সম্প্রদায় চাকমা সমাজে এখনও রয়েছে।

৬.

বর্তমানে শুধুমাত্র চাকমা সমাজের মধ্যে লুরি নামক সাংঘিক সম্প্রদায়ের বসবাস হলেও অতীতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মীয় ইতিহাসে চাকমা সমাজের বাইরে অন্য কোন  বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও ছিলো কিনা এই নিয়ে ইতিহাস লেখক ও গবেষকদের মধ্যে মত পার্থক্ষ্য লক্ষ্য করা যায়।

তবে ধর্মরক্ষিত ভিক্ষুর মতে – অতীতে বড়ুয়া সমাজেও ঐরূপ লুরি বা রাউল সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের বড়ুয়া সমাজের মধ্যে এক সময় সুপরিচিত লাউরিদের মধ্যে যদরা রাউলি, খুদ্যা রাউলি, চান রাউলি, থান রাউলি প্রভৃতির বংশ এবং রাউলির রাস্তা-ঘাট, পুল-পুকুর, দীঘির পেছনেও তাঁদের নাম জড়িত রয়েছে। ২৮

A young Luri
তরুন লুরি, ছবি: ফেসবুক

বর্তমানে চন্দনাইশ থানার খানখানাবাদ গ্রামের “খুদে রাউলি মন্দির”, রাউজানের রাউলি রোড, অন্যান্য জায়গায় রাউলি পুকুর, রাউলি ঘাট, রাউলি পুল, রাউলি হাট ইত্যাদি নাম আজও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাউলিদের বিচরণের চিহ্ন বহন করে চলেছে।

আর অন্যদিকে বিশিষ্ট বৌদ্ধ লেখক জিতেন্দ্রলাল বড়ুয়াও স্বীকার করেছেন বড়ুয়া ২৯ সমাজের মধ্যে লাউরি নামক এক শ্রেণী মহাযানী বৌদ্ধ সাধকের বিচরণ ছিলো। যারা চাকমা সমাজে লুরি হিসেবে পরিচিত।

তিনি উল্লেখ করেছেন- “মুসলিম অধিকারের পর চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ঐতিহ্য নির্মমভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়, বিহার, ধর্মগ্রন্থ বিনষ্ট হয়। একসময় সকল প্রকার অধিকার থেকে দারুণভাবে উপেক্ষিত হয়ে ভিক্ষু-সংঘ ও সংঘারাম বিলুপ্তিতে তারা ভুলে যায় সকল প্রকার ধর্মীয় আচার-ঐতিহ্য ও সংস্কার।

শুধু রয়ে গিয়েছিলো এক টুকরো গেরুয়া বা পীত বসন। তা দিয়েই তারা ধর্মীয় পূজা পার্বণ ও অনুষ্ঠানাধি সম্পাদন করত। তখন তাদের রাউলি নামে ডাকা হতো। বর্তমানেও চট্টগ্রামের কিছু কিছু অঞ্চলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের লাউরি নামে সম্বোধন করা হয়ে থাকে।

সেই সময়কার লাউরিরা সাধারণত বিবাহিত ছিলো বলে তিনি উল্লেখ করেছেন ৩০। “মঘা খমুজা” নামক এক প্রকার ধর্মীয় গ্রন্থের সাহায্যে রাউলিগণ ধর্মীয় কাজ পরিচালনা করতেন ৩১। বর্তমানে বড়ুয়া সমাজে  লাউরি সাংঘিক সম্প্রদায়ভুক্ত কোন প্রকার বৌদ্ধ সাধক নেই বললেই চলে।

লেখক তাঁর গ্রন্থে বড়ুয়া সমাজে লাউরিদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করলেও বৌদ্ধ ধর্মের সেই সময়কালকে তিনি “বৌদ্ধ ধর্মীয় বিকৃতি ও মিথ্যা দৃষ্টির যুগ” হিসেবে অবহিত করেছেন। অর্থাৎ বৌদ্ধদের অন্যান্য সময়কালের মত উক্ত সময়ে গর্ব করার মত কিছুই ছিলো না কারণ লাউরিরা নিজেদেরকে বৌদ্ধ সাধক পরিচয় দিলেও তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকৃত বৌদ্ধিক আচরণ উপস্থিত ছিলো না।

বুদ্ধের প্রণীত বিধি-বিধানের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধাশীল ছিলো বলে জানা যায় না, তাঁরা নিজেদের মত করেই বিধি-বিধান মেনে চলাফেরা করতো।  চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মধ্যে বড়ুয়া এবং চাকমা সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাথে লুরি বা রাউলি সংশ্লিষ্ট ইতিাহাস পাওয়া যায় না।

উক্ত দুই সম্প্রদায়গুলোতে অতীতে বিদ্যমান লুরি বা লাউরিদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় বা সাংঘিক কোন সম্পর্ক, ঐতিহাসিক কোন সম্পর্ক ছিলো কিনা এরূপ কোন তথ্য- উপাত্ত কেউ হাজির করতে পারেনি। বিশিষ্ট লেখক বিরাজ মোহন দেওয়ানও তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন-

“চাকমা সমাজের রুলিদের সাথে বড়ুয়া সমাজের রুলিদের ধর্মীয় শাসনের একইরূপ সম্পর্ক ছিলো কিনা অবশ্য জানা নেই”৩২। এই দুই সম্প্রদায়ের লুরি বা লাউরিদের মধ্যে ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় কোন সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না গেলেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে তাদের মধ্যে মিল ছিলো।

প্রথমত, বড়ুয়া এবং চাকমা সম্প্রদায়ের লুরি বা লাউরিরা অতীতে বিবাহিত ছিলো, অর্থাৎ তারা ছিলো বিবাহিত বৌদ্ধ সাধক। হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫ খ্রিঃ) এর বল্তনের রাজতরিঙ্গিনী ও চাচনামা গ্রন্থেও বিবাহিত ভিক্ষুদিগের উল্লেখ পাওয়া যায়।

বস্তুতঃ মহাযানীরা বোধিসত্বের উচ্চ চিন্তাধারা গ্রহণের সহিতই মনে করিতেন যে, শাক্যমনি বুদ্ধ যেহেতু বিবাহিত ছিলেন সেহেতু বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও বিবাহ করিতে পারেন ৩৩। এই ধরনের বিবাহিত বৌদ্ধ সাধক বৌদ্ধ প্রতিরূপ দেশ নেপালের বেশির ভাগ বৌদ্ধ বিহারে দেখতে পাওয়া যায়।

একটা সময় মহাযানীদের মধ্যে হিন্দুধর্মের দেবদেবীদের ন্যায় সকল বুদ্ধ ও বোধিসত্বগণের পত্নীদের কল্পনা করা হয়েছে। ঐ সকল দেবীরা হলেন বজ্রদাত্রীশ্বরী, লোচনা, মামকী, পান্ডুরা ও তারা। দেবীরাই ছিলেন দেবগণের শক্তি বিশেষ এবং তাঁদের পূজা করা হতো। দেবীদের সাহায্য ছাড়া দেবগণের নাগাল পাওয়া সম্ভব ছিলো না।

উপরোন্তু যৌনমিলনের আদলে স্বর্গীয় সৃষ্টিকার্যকে কল্পনা করা হতো। এই সকল চিন্তা প্রসারের পাশাপাশি যৌন প্রতীক, ধর্মীয় আচার হিসেবে যৌন মিলনও হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধধর্মের কোন কোন শাখায় প্রবেশ করে৩৪

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে পন্ডিত  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন- “নেপালের বৌদ্ধদের মধ্যে তিনটি ভাগ আছে। প্রথম এবং সর্বোৎকৃষ্ট ভাগের নাম বানরা। বানরা নয় জাতি। তাঁরা বিহারে বসবাস করে। কোন বিহারে আর এখন অবিবাহিত বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখা যায় না। শুনেছি, শেষ অবিবাহিত ভিক্ষু প্রায় আশি বছর আগে মারা গিয়েছেন।” ৩৫

তাছাড়া অন্যসব বৌদ্ধ প্রতিরূপদেশ তিব্বত, কোরিয়া, জাপান, নেপাল ইত্যাদি দেশেও বর্তমানে বিবাহিত বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, তাঁরা উভয়েই বুদ্ধ প্রণীত পবিত্র ত্রিপিটকের উপর নির্ভশীল ছিলো না, তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় গ্রন্থ ছিলো।

তৃতীয়ত, তাঁরা উভয়েই নিজেদের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা সাধক হিসেবেই পরিচয় দিতো। বর্তমানে বড়ুয়া সমাজে লুরি বা লাউরি নামক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একদম বিলুপ্তি ঘটলেও চাকমা সমাজের কিছু কিছু এলাকায় এখনো তাঁদের দেখা পাওয়া যায়।

৭.   

 চাকমা সমাজের পূর্বালোচিত প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু লুরি সংঘ সম্প্রদায় নিজেদেরকে মহাযানি ধর্মমতের অনুসারি দাবি করলেও আদতে তাঁরা মহাযানি ধর্মমতের ধারক-বাহক কিনা এবং তথ্য-প্রমাণে কতটুকু সত্য তা প্রশ্ন থেকে যায়। বৌদ্ধ ধর্ম প্রধানত দু’টি শাখায় বিভক্ত যথা- ১. হীনযানী এবং ২. মহাযানী।

বৌদ্ধ ধর্মে এ দুইভাগে বিভাজনের মূল কারণ ছিল বুদ্ধের ভিক্ষু সংঘের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধ। বুদ্ধের সময়কালেও ভিক্ষুদের মাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মত পার্থক্য ছিলো বলে ইতিহাসে জানা যায় তবে নিজের প্রজ্ঞা বলে বুদ্ধ সমাধান করতে পারলেও পরবর্তীতে বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের পর ভিক্ষুদের মধ্যে আবার মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়।

এই মত পার্থক্যের প্রধান কারণগুলো ছিলো ভিক্ষুদের শাসন নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্মাদর্শ চর্চায় ভিন্নতা। সুভদ্র ৩৬ নামক বয়োজোষ্ঠ্য ভিক্ষুর বুদ্ধের পরিনির্বাণ উপলক্ষ্যে ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে দেওয়া “ক্ষান্ত হও, শোক করিও বিলাপ করিও না” ৩৭ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে মত পার্থক্যের শুরু।

যিনি বুদ্ধের পরিনির্বাণের সংবাদে সদ্ধর্মাচারের বিধিবদ্ধ নীতিমালা থেকে এখন মুক্ত এই ভেবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। আয়ুষ্মান মহাকশ্যাপ ৩৮ স্থবির বিষয়টি অবগত হয়ে খুবই আঘাতপ্রাপ্ত হলেন এবং “..মযা ধম্মো চ বিনযো চ দেসিতো পঞ্ঞত্তো সো বো মমচ্চযেন সত্থাতি ৩৯

অর্থাৎ “আমি যে ধর্ম বিনয় দেশনা করেছি, প্রজ্ঞাপন করেছি, সেই ধর্ম বিনয়ই আমার পরিনির্বাণের পরবর্তী তোমাদের গুরু হিসেবে পরিগণিত হবে” ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধের এই উপদেশবাণীর যেন ব্যর্থয় না ঘটে সেই উদ্দেশ্যে যত দ্রুত সম্ভব বুদ্ধবাণী গ্রন্থবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

রাজা অজাতশত্রুর সহায়তায় প্রথম সংগীতি আয়োজনের মাধ্যমে বিনয় পিটক ও সুত্ত পিটক সংগৃহীত করা হয়। অর্থাৎ দ্বি-পিটক সংগৃহীত হয়। ৪০ বয়োজোষ্ঠ্য ভিক্ষু সভদ্রের পরবর্তী আবার বজ্জী দেশীয় ভিক্ষুদের কারনে আবার ভিক্ষুদের মধ্যে সম্পর্ক ভাঙনের সুত্রপাত হয়।

দশবত্থুনি নামক দশটি নিয়মের শিথিলতাকে ক্ষেন্দ্র করে যে মত বিরোধের সৃষ্টি। উক্ত বিরোধ নিরোসনের জন্য আবার সংগীতির আয়োজন করা হয় যা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে দ্বিতীয় সংগীতি নামে অধিক পরিচিত। এই সংগীতির মধ্য দিয়ে নিন্দিত ভিক্ষুরা আবার নতুন সংঘ প্রতিষ্ঠা করে মহাসাংগিক আর বাকীরা স্থবিরবাদী হিসেবে দুই প্রধান নিকায়ে বিভক্ত হয়ে পরে।

পরে মহাসাংঘিক হতে গোকুলিক ও এক ব্যবহারিক এই দুই নিকায়ের উদ্ভব হয়। আবার গোকুলিক হতে প্রজ্ঞপ্তিবাদী ও বাহুলিক এবং বাহুলিক হতে চৈত্যবাদী নিকয়ের উৎপত্তি হয়। ৪১ উক্ত শাখা সমূহের মধ্যে কোনটির সাথে লুরিদের মতাদর্শের বাস্তবিক সম্পর্ক বা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

কারণ লুরিদের মধ্যে মহাযান ধর্মদর্শন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই বললেই চলে। অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কালটি ছিলো বৌদ্ধ ধর্মের তান্ত্রিক বিবর্তনের সময়। অর্থাৎ মহাযান ধর্ম দর্শনের ক্রমবিবর্তন সর্বশেষ অবস্থা ছিলো তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম।

তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে গৌতম বুদ্ধ প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্ম অনেকাংশে বিকৃত হয়ে হিন্দু দেবদেবীদের ন্যায় বৌদ্ধধর্মেও বৌদ্ধ দেবদেবীর আগমন ঘটিয়েছিল। যা একপ্রকার নতুন ধর্মে পরিনত হয়েছিল। যে ধর্মের প্রধান প্রধান দেবদেবী ছিলেন বুদ্ধ ও বোধিসত্ব এবং তাঁদের পত্নীগণ।

তা ছাড়াও পিশাচী, মাতঙ্গী, ডাকিনী ও যোগিনীর মত বিভিন্ন দেবী স্থান করে নিয়েছিল।  তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আবার কয়েকটি তান্ত্রিকশাখা ছিলো। যথা- মন্ত্রযান, বজ্রযান, সহজযান ও কালচক্রযান।

A group of Luri
শিষ্যসহ একজন লুরি

উক্ত বিভাজনগুলোর মধ্যে পাল শাসনামলেই মূলত বাংলাদেশে সহজযান এবং কালচক্রযান তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল বলে সেরূপ তথ্য জানা যায়। এ দুই তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে সহজযান তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির সাথে লুরিদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির কিছু মিল পাওয়া যায়।

সহজযানীরা মনে করে থাকে গুরুর উপদেশ ছাড়া সাধনার সুক্ষ্ম পদ্ধতি এবং সুক্ষ্মতত্ত্বের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব না। অর্থাৎ তাঁদের সাধনা এবং শিক্ষালাভ ছিলো সম্পূর্ণ গুরুমূখী। গুরুগণও দীক্ষিত শিষ্য ব্যতিত অন্য কাউকে ধর্মতত্ত্ব বুঝাতেন না।

তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের লুরিদের ক্ষেত্রেও গুরুদের আদেশ-উপদেশ এবং শিক্ষার প্রাধান্য বেশি। লুরিরাও সহজযানীদের মত দীক্ষিত কাউকে ছাড়া সাধনাপন্থা এবং  সুত্র বা পান্ডুলিপি দিতে চায় না।

বৌদ্ধধর্মের প্রতিচ্ছবিসম্মিলিত ‘চর্যাপদের’ রচয়িতা কবিগণ সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত, সাধারণত বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই এই নামে অভিহিত হতেন। সহজযানের আচার্যগণদের মধ্যে অন্যতম হলেন- লুইপা, সরপা, নারোপা, কান্থপা। সহজযানের আচার্যগণকে আবার সহজিয়া নামেও ডাকা হতো।

যারা বিবাহিত ছিলেন এবং স্বাভাবিক জীবন-যাপন করলেও তাঁদের জীবন-প্রকৃতি সাধারণ মানুষ থেকে একটু আলাদা ছিল। তেমনি লুরিরাও একসময় বিবাহিত জীবন-যাপন করতো এবং তাঁরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা ছিলো।

অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মত সব কিছু করার পাশাপাশি বৌদ্ধভিক্ষুর ভূমিকা পালন করতো। সহজযানী আচার্যদের রচিত চর্যাপদের পদগুলো ছিলো মূলত একাধিক চরণবিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত এবং গীতিধর্মী ৪২। অর্থাৎ চর্যাপদের পদগুলো আবৃত্তি করার সময় গানের সুরে বা গানের মত করেই আবৃত্তি করতো সহজিয়া কবিগণ।

চর্যাপদে পদগুলোতে সাধারণত কমা বা যতি চিহ্নের ব্যবহার খুব কম দেখা যায়। তেমনি লুরিদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ ‘আগরতারার’ তারাগুলোতে দাড়ি, কমা ইত্যাদির ব্যবহার নাই। আর লুরিরা আঘরতারা পড়ার সময় প্রত্যেকটি শব্দ একটা সুর করে পড়ে।

বাংলাদেশে অবস্থানরত বেশিরভাগ লুরিই নিজেদের মহাযানী দাবী করার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। কারণ বৌদ্ধধর্মের বিভাজন এবং হীনযান-মহাযান সম্পর্কে তাঁদের জানার পরিধি খুবই ছোট। তাই লুরিদের মহাযানী হিসেবে আখ্যা দেওয়াটা অনুমান নির্ভর অথবা ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে।

তবে মহাযানীদের অন্যতম যে বৈশিষ্ট্য ধর্মীয় বিনয় বা শীল পালনের ক্ষেত্রে শিথিলতা সেটির সাথে কিছু মিল পাওয়া যায় কারণ লুরিদের মাঝেও কঠোর পালনীয় সেরূপ ধর্মীয় বিনয় বা শীল নেই বললেই চলে।

এ প্রসঙ্গে ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো লিখেছিলেন- ‘চাকমাদিগের কেউ কেউ সংসার ধর্ম পরিত্যাগ পূর্বক শামেণী (লুরি) ব্রত গ্রহণ করেন। রড়ীদিগের (লুরি) আচার ব্যবহারে কঠোরতা নেই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই গৃহাশ্রম ত্যাগ করেন না ৪৩

তাছাড়া তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মহাযানীরা যেমন হিন্দু দেব-দেবীর পাশাপাশি নিজেদের মত করে বিভিন্ন দেবতার আবির্ভাব ঘটিয়েছিল তেমনি লুরিরাও বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর পাশাপাশি একটি সৃষ্টিকর্তা বা দেবতার কল্পনা করে যার নাম তাঁরা দিয়েছে ‘গোজেন’। চাকমাদের আদি কবি তাঁর ভক্তিমূলক গাথায় লিখেছিলেন-

“জল উবরে বচ্যে থল,
বানেল গোজেনে জীবসকল।।” ৪৪
অর্থাৎ, জলের উপর বসেছে সমান,
গোজেন সৃষ্টি করেছেন জীবসকলকে।।

কবি এখানে গোজেনকে সকল জীবের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাইতো চাকমা সমাজের লুরিরা সৃষ্টিকর্তা গোজেনকে সবার উপরে রেখেই সকল ধর্মীয় কার্যকলাপ পরিচালনা করে থাকে। অর্থাৎ লুরিরা নীতি বা শীল পালনের ক্ষেত্রে মহাযানী সম্প্রদায়ের মত কট্টর নয়।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের লুরিদের সাথে হীনযানী তথা থেরবাদীদের তুলনায় মহাযানী বিভিন্ন শাখার সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায়।  তবে তারা যে বাংলাদেশ তথা প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ অনুসারীদের একটি অংশ তা সত্য যা তাদের কার্যপ্রণালী, বিশ্বাস এবং পালনীয় রীতি-নীতি ও অনুষ্ঠানাদি মধ্যেই প্রকাশ পায়।

কারণ লুরিদের সকল কার্যক্রম বৌদ্ধ বিহার কেন্দ্রিক এবং বৌদ্ধ ধর্মের সকল আচার-অনুষ্ঠানাদি নিজেদের মত করে সামান্য বিকৃতাবস্থায় পালন করে থাকে।  

৮.   

 লুরিরা সাধারনত অন্যান্য থেরবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মত সারা বছর নির্দিষ্ট কোন বৌদ্ধ বিহারে অবস্থান করে থাকে। সেখানেই তাঁরা তাঁদের পত্যাহিক আহার গ্রহণ, প্রার্থনা এবং সকল প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানাধি সম্পন্ন করে থাকে।

লুরিদের বিহারে এক বা অধিক লুরি(থর) এবং শামেণী (শ্রামণ) থাকতে পারে। তাঁরা সাধারণত খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে, স্নান এবং পরিশুদ্ধ হয়ে পুষ্প সহিত বুদ্ধকে পূজা দান আর সকালের সমবেত প্রার্থনা সম্পন্ন করে।

লুরিরা বা তাঁদের অনুসারীরা সাধারণত সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। তাঁদের সৃষ্টিকর্তার নাম ‘গোজেন’। তাই তাঁরা প্রার্থণার ক্ষেত্রে বুদ্ধের আগে সৃষ্টিকর্তা অর্থাৎ গোজেনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। প্রথমে তাঁরা সৃষ্টিকর্তা গোজেনকে বন্দনা করে।

দ্বিতীয়ত তাঁরা বৌদ্ধধর্মে গত হওয়া আটাশ ৪৫ বুদ্ধকে বন্দনা করে। তৃতীয়ত ত্রিরত্নের বন্দনা। চতুর্থত বৌদ্ধধর্মের অনাগত বুদ্ধ ‘আর্যমিত্র’৪৬ বুদ্ধের বন্দনা। পঞ্চমত পৃথিবীর, স্বর্গলোক, দেবলোকের সকল দেবগণের বন্দনা। ষষ্ঠত জায়গায় স্থান পায় লুরিরা (ভিক্ষু)।

সর্বশেষ উপাসকরা লুরির (ভিক্ষু) কাছ থেকে ক্ষমা এবং আশির্বাদ প্রার্থণা করেই প্রার্থনা পর্ব শেষ হয়। বুদ্ধকে পানীয় (লুরিরা বুদ্ধকে আহার প্রদান করে না, তবে সৃষ্টিকর্তা বা ঘোজেনকে আহার্য্য প্রদান করে) প্রদানের পরবর্তী নিজেরা সমবেত হয়ে সকালের আহার গ্রহণ করে।

সারাদিনের মধ্যে কোন আমন্ত্রণ (ফাং) না থাকলে তাঁরা দিনটি বিহারেই কাটিয়ে দেয়। দুপুরেও তাঁরা সকলে মিলে দুপুরের আহার গ্রহণ করে থাকে। আহার গ্রহণের ক্ষেত্রে থেরবাদী বা হীনযানীদের দুপুর ১২টার পর আহার গ্রহণের নিষেধ থাকলেও মহাযানী লুরিদের ক্ষেত্রে তেমনটা নেই।

তবে ১২টার আগে গ্রহণ করলে সেটাকে বলে ‘সোয়্যাইং’ আর ১২টার পর গ্রহণ করলে সেটাকে বলে ‘দেবভোগ’। সন্ধ্যায় তাঁরা সকালের অনুরূপ পরিশুদ্ধ হয়ে বুদ্ধের পানীয় পরিবর্তন করে সমবেত প্রার্থণায় অংশগ্রহণ করে। কোন কোন দিন তাঁরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে ধর্মীয় আলোচনার আয়োজন করে। সারাদিনের সকল কার্যবিধি সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

লুরিদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য তা হলো, তাঁরা নিজেরা বৌদ্ধভিক্ষু পরিচয় দিলেও বুদ্ধ ভাষিত যে বাণী বা বুদ্ধ নির্দেশিত বানী সমূহের সংকলিত গ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’ এর দু’একটা শীল বাদে তাঁদের আর কোনটার সাথে সম্পর্ক নেই।

অর্থাৎ বুদ্ধ নির্দেশিত এবং নির্ধারিত শ্রামণদের জন্য যে দশশীল, ভিক্ষুদের জন্য যে দুই’শ সাতাশটি শীল এগুলোর কোন কিছুর সাথে তাঁদের সম্পর্ক নেই। তাঁদের দৈনন্দিন, মাসিক এবং বাৎসরিক সকল কার্যপ্রণালী লুরিদের ধর্মীয় গ্রন্থ ‘আগরতারা’ ক্ষেন্দ্রিক।

তবে তাঁরা নিজেদের মধ্যে শামেণী (শ্রামণ) দের জন্য দশশীল পালনের বিধান রেখে দিয়েছেন যে শীলগুলোকে ‘গণশীল’ বলে থাকে। এগুলো হলোঃ

১.    ওয়াদেক্কাং (পৃথিবী) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
২.    সেন্নাং (পানি) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৩.    কুরুক্কাং (আগুন) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৪.    ইঞায়যে (বাতাস) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৫.    পার্তাং (আকাশ) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৬.    ক্ষেমিয়াং শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৭.    লোভিয়াং শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৮.    অহিংসায়াং শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
৯.    ওয়াংটেংসাং (বয়স্ক থরদের উপাধি) শীলাং শিক্ষা করনিয়াং
১০.   গোজেন সৃজনং শীলং শিক্ষা করনিয়াং

শামেণী (শ্রামণ)দের পরবর্তী শীল পালনের বিধান চলে আসে লুরি (ভিক্ষু)দের উপর। থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে শ্রামণ থেকে ভিক্ষুত্ব লাভ করলে পালনীয় শীলের পরিমান বেড়ে গেলেও লুরিদের ক্ষেত্রে তা উল্টো অর্থাৎ তাঁদের আরো কমে যায়।

Luries rituals picture
শামেনী বা প্রব্রজ্যা গ্রহণের দৃশ্য

লুরিরা শামেণীদের পালনীয় দশটি শীলের মধ্যে প্রথম পাঁচটি শীলই মূলত থররা (ভিক্ষু) পালন করে। উপরিউক্ত শামেণী এবং লুরিদের পালনীয় মোট দশটি শীল বাদে আর কোন পালনীয় শীল নেই বলে জানা যায়।

তবে প্রথম দিকে একদম সরাসরি সনাতন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু লুরি দশটি শীলের বাইরেও কিছু শীল পালন করতো বলে জানা যায় যদিও এখন আর তেমন প্রচলন নেই। সেগুলো হলঃ-

১.    ব্রম্মা সৃজনং শীলং শিক্ষা করনিয়াং
২.    বিষ্ণু পালনং শীলং শিক্ষা করনিয়াং
৩.    শিবগুরু শরনত শীলং শিক্ষা করনিয়াং
৪.    ইন্দ্র শাসনং শীলং শিক্ষা করনিয়াং
৫.    দূর্গা পালনং শীলং শিক্ষা করনিয়াং

লুরিরা সাধারনত দু’একটি বাদে বাংলাদেশের থেরবাদী বৌদ্ধদের মত প্রায় সকল বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কীয় অনুষ্ঠানাদি- বৈশাখী পূর্ণিমা(বুদ্ধ পূর্ণিমা), মাঘী পূর্ণিমা,  পালন করে থাকে। তাঁরা শুধুমাত্র প্রবারণা পূর্ণিমা এবং তিন মাস বর্ষাবাস ব্রত পালন করে না। বাংলাদেশের অন্যান্য বৌদ্ধদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘কঠিন চীবর দান’  কে ‘ত্রি-চীবর দান’ হিসেবে পালন করে থাকে। 

বাংলাদেশের থেরবাদী বৌদ্ধদের মত লুরিদের মধ্যেও পুরুষেরা যে কেউ, যেকোন সময় শামেণী (প্রবজ্যা) নিতে পারে। পদ্ধতিগত এবং মন্ত্র বা সুত্র পাঠের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রবজ্যা লাভের ক্ষেত্রে উপাসককে কিছু দানীয় বস্তু বা পূজার উপাদান সামগ্রী সংগ্রহে রাখতে হয়।

এক্ষেত্রে থেরবাদী বৌদ্ধ এবং লুরিদের মধ্যে সম্পূর্ণ পার্থক্য দেখা যায়। লুরিদের নিয়মে শামেণী লাভের ক্ষেত্রে উপাসককে যে সকল দানীয় বস্তু বা উপাদানাদী সংগ্রহে রাখতে হয়, সেগুলো হলঃ- কলা এক আঁটি, আখ, নারিকেল, হরেক রকমের দোকানী সামগ্রী, পানীয়, ঘট, আমের ঝোপ, চাল, নজর (দানীয় অর্থ) তিন নলা সুতা, আগরবাতি, মোমবাতি এবং দিয়াশলাই।

আগেকার সময়গুলোতে লুরিদের মধ্যে সাংঘিক প্রথা লালন-পালনে কিছুটা শিথিলতা থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে যুগের চাহিদায় বর্তমানে তাঁরা বেশ সুশৃঙ্খল এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করে থাকে। সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য সংঘ কর্তৃক কিছু পালনীয় নীতি নির্দেশনা থাকে।

নীতি অমান্য করলেও কঠোর শাস্তির বিধান করে থাকে। যে থর (ভিক্ষু) নীতি বহিভর্’ত কর্মে লিপ্ত হবে তাকে চীবর পরিত্যাগ পর্যন্ত বাধ্য করা হয়। থেরবাদী বৌদ্ধ সংঘের মধ্যে কে ভিক্ষু আর কে শ্রামণ চেনার কিছু উপায় আছে ঠিক তেমনি মহাযানীদের মধ্যেও কে থর (ভিক্ষু) আর কে শামেণী (শ্রামণ) চেনার উপায় রয়েছে।

লুরিদের মধ্যে যারা থর (ভিক্ষু) হয় তাঁরা অন্তর্বাসটি গোঁজ (ধুরির মত) দিয়ে পরে আর যারা শামেণী (শ্রামণ) হয় তাঁরা অন্তর্বাসটি সাধারন লুঙ্গির মত করে পরে। এটি তাঁদের এতিহ্য এবং সংঘীয় রীতি।

৯.

চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মীয় সংস্কার বা আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিলো মূলত উনবিংশ শতাব্দির মধ্যবর্তী সময়ে। যে আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংঘরাজ সারমেধ থের।  তৎকালীন বৌদ্ধধর্মের দুরাবস্তা তুলে ধরতে গিয়ে Dr. Buchanan উল্লেখ করেছেন-

Their religion is that of Godama corrupted by their having adopted many Brahminical superstations and specialy bloody sacrifices to the Devtas…..At setaka Gaut (ghat) tha chakmas worship a sprit named Taung Mang or princes of the mountains.৪৭

এ যখন চাকমা সমাজের ধর্মীয় অবস্থা তখন উনবিংশ শতাব্দীতে চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর৪৮ প্রথম মহিয়সী রাণী কালিন্দির(১৮৪৪-৭৩ খ্রিঃ) রাজত্বকালে রাণীর আমন্ত্রণে ১৮৫৬ খ্রিঃ প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু সারমেধ মহাস্থবিরের চাকমা রাজ্যে আগমন এবং রাজানগরে মহামুনি বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠার ৪৯ মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য অঞ্চলে হীনযানপন্থী বৌদ্ধধর্ম প্রচার-প্রসারের চেষ্টা করেন।

স্বীয় চাকমা রাণী এবং ভিক্ষু-সংঘের প্রচেষ্টার ফলে চাকমা ও বড়ুয়া সমাজের মধ্যে হীনযান বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অধিকাংশ বৌদ্ধদের মধ্যে হীনযান বৌদ্ধধর্ম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চাকমারা হীনযানপন্থী বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে চলেছেন।

পরবর্তী সময়ে অগ্রজদের ধর্মীয় শিক্ষায় এবং অনুপ্রেরণায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ সমাজে শুদ্ধপুরুষ খ্যাত সাধক সাধনানন্দ মহাথের (বনভান্তে) এর মহাযান তথা সদ্ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধদের মাঝে সঠিক ধর্ম পালন করার ক্ষেত্রে এক প্রকার জাগরনের সৃষ্টি হয়।

সাধনানন্দ মহাথের এর শিষ্য-প্রশিষ্য বৃদ্ধির সাথে সাথে অঞ্চলভেদে সঠিক ধর্মীয় মত প্রচারও বাড়তে থাকে। যার কারণে এককালে বৌদ্ধ ধর্মের হর্তাকর্তা লুরিদের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে থাকে।

বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকায় সাধনানন্দ মহাথের এর ভিক্ষুদের শাখা বন বিহার থাকায় লুরিদের ঠিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে পার্বত্য অঞ্চলে পিছিয়ে পড়া বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষায়-দীক্ষায় বেশ অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতি ও ধর্মের সঠিক ইতিহাস তারা জানতে শুরু করে। সর্বোপরি বৌদ্ধ ধর্ম লালন-পালনে সঠিক পদ্ধতি তারা জানতে শুরু করে। ফলে লুরিদের পালনীয় বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতরূপগুলো বুঝতে পেরে লুরিদের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে থাকে।

শিক্ষিত হওয়ার ফলে কিছু মানুষ জ্ঞানচর্চা, লেখালেখি এবং বিভিন্ন ধর্মীয় পত্রিকা বা ম্যাগাজিন সম্পাদনায় মনোনিবেশ করে। যে অগ্রযাত্রা এখনো চলমান রয়েছে। ফলে শিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি অন্যরাও সংকীর্ণতা, কুসংস্কার এবং বিকৃত বিষয় সমূহকে পেছনে ফেলে সঠিক আর শুদ্ধতার পথে এগুতে থাকে।

তৎকালীন সময়ে দেখা যেত লুরিরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা, বিবাহ এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য হাস, মুরগি, পশু ইত্যাদি প্রাণী বলি দিত। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে লুরিদের কার্যক্রমগুলোর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। আগে যেরূপ নির্ভশীলতা ছিলো সেটি কমতে থাকে।

তাই একসময় চাকমা সমাজের প্রতিটা গ্রামে যে লুরিদের দেখা মিলত, বর্তমানে তাঁরা প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতরে চলে যেতে বসেছে। একসময় যেখানে সবখানে  তাদের জয়-জয়কার ছিলো  সেখানে আজ শিক্ষিত চাকমা সমাজের অনেকের কাছে একদমই অজানা।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধুমাত্র খাগড়াছড়ি জেলাতেই লুরিদের কার্যক্রম বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়াও ভারতের মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যে কিছু কিছু এলাকায় তাঁদের বিহার রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার মধ্যে লুরিদের বিহার সবচেয়ে বেশি রয়েছে দিঘিনালা উপজেলায়।

এই উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে আনুমানিক ৭-৮টি বিহার রয়েছে। আর পানছড়ি উপজেলায় রয়েছে ৪টি বিহার। লংঘদু উপজেলায় রয়েছে ১টি এবং আর ১টি  রয়েছে  বাঘাইছড়ি উপজেলায়। সময়ের প্রয়োজনে বর্তমানে লুরিরাও নিয়ম-নীতি পালনে এবং ধর্মীয় চর্চায় অনেক কিছু পবির্তন-পরিমার্জন সাধন করেছে।

মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেতন এবং শিক্ষিত লুরিরা পারস্পারিক আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাধারণ জনগনের কাছে পোছানোর লক্ষ্যে বাৎসরিক বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।

বছরে একবার বার্ষিক সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁরা দেশের সকল ভক্ত এবং অনুসরণকারীকে একত্রিত করার চেষ্টা করে থাকে। আগেকার সময়ে লুরিরা যেমন কিছু কিছু কাজ বাদে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতো কিন্তু বর্তমানে তারাঁ জনগনের সাথে মিলে মিশে কাজ করছে। 

১০.

পরিশেষে বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সমাজে প্রাচীন বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘লুরিদের’ সাথে মহাযনী বৌদ্ধ ভিক্ষু বা মহাযানী ধর্ম দর্শনের সাথে ঐতিহাসিক কোন যোগসুত্র পাওয়া না গেলেও এটি বলা যায় পাল বংশের পরবর্তী এবং

চাকমা রানী কালিন্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামে থেরবাদী বা হীনযানী ধর্মদর্শন প্রচার-প্রসারের মধ্যেবর্তী সময়ে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে যে অন্ধকার সময় নেমে এসেছিলো সে সময়ে বৌদ্ধধর্মকে কিছু কিছু মানুষ বিকৃতভাবে চর্চা করত,

সেই বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃত চর্চার ফসল এই লুরিরা। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের একটা সময় যে তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তন হয় সেই তন্ত্রযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের কয়েকটি শাখা (সহজযান ও কালচক্রযান) প্রাচীন বাংলায় প্রসার-প্রচারের ইতিহাস পাওয়া যায়।

বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য শাখাগুলোর তুলনায় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সেই শাখাগুলোর বেশ কিছু মিল পাওয়া যায় যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই ধারণা করা যায় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের সেই শাখাগুলোর দ্বারা প্রভাবিত কোন বিকৃত বৌদ্ধধর্মের একটি শাখা হবে এই লুরি সাংঘিক সম্প্রদায়। 

তবে তাঁদের ধর্মীয় ঐতিহ্য- সংস্কৃতি থেরবাদ  বা হীনযানী বৌদ্ধধর্মের সাথে কিছুটা অমিল থাকলেও তাঁরা চট্টগ্রাম বা পার্বত্য বৌদ্ধধর্মের যেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তেমনি ইতিহাসেরও অংশ। তাই তাঁরা বৌদ্ধ ধর্ম লালন-পালনে অন্তরায় নয় বরঞ্চ সহযোগী। 

চট্টগ্রাম বা পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস জানার জন্য এবং চাকমা সম্প্রদায়ের জাতিগত এবং ধর্মীয় অতীত ইতিহাস জানার জন্য লুরিদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় কদাচিৎ তাঁদের দেখা পাওয়া গেলেও, তাঁদের এই অবস্থাটা বিলুপ্তির অন্তিম মুহূর্ত বলা চলে।

এই যে প্রাচীন মহাযানী ভিক্ষু লুরিদের দিন দিন হারিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা এই চিত্র দেখে, বৌদ্ধ ধর্মীয় সংস্কারবাদীরা খুশি হলেও ইতিহাস সচেতন এবং অনুসন্ধিৎসু কোন মানুষের পক্ষে খুশি হওয়া সম্ভব না। এই সাংঘিক সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি মানে তাঁদের সকল তথ্য-উপাত্তের বিনাস।

এভাবে যদি চলতে থাকে খুব শীঘ্রই লুরিদের জীবনাচরণ, ধর্মীয় চেতনা, আচার-বিধি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য হারিয়ে যাবে যা বাংলার বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে যারা অনুসন্দিৎসু, যারা বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক এমনকি যারা চাকমা জাতি ও ধর্ম নিয়ে গবেষণা করতে ইচ্ছুক তাঁদেরই ক্ষতি।

তাই বৌদ্ধ ধর্মের অতীত ইতিহাসে সাক্ষী হিসেবে লুরিদের সকল ইতিহাস এবং তথ্য-উপাত্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হউক আর ব্যক্তিগতভাবে হউক সঠিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে রাখা অতীব জরুরি।

তথ্যনির্দেশ ও টীকাঃ

১.    যমক বর্গ, ধম্মপদ।

২.    হীনযানঃ বৌদ্ধধর্ম প্রধানত দু’টি শাখায় বিভক্ত, একটি হীনযান আরেকটি মহাযান। হীনযানীদের পালিতে থেরবাদীও বলা হয়ে থাকে। হীনযানীদের মধ্যে আবার এগারটি উপশাখা রয়েছে।

৩.    মহাযানঃ বৌদ্ধধর্মের প্রধান দু’টি শাখার একটি হল মহাযান। মহাযানীদের মধ্যে আবার সাতটি উপশাখা রয়েছে।

৪.    বাংলার বৌদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, শিমুল বড়ুয়া, অনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, চট্টগ্রাম, ২০১২, পৃঃ ৮২।

৫.    উপজাতিঃ বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি গুলোকে সংবিধানে উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

৬.    R.H. Resly, 1892, Trives and Casts of Bengal, Vol.1,  Calcuta, , pp.173.

৭.    বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের আদিম জনগোষ্ঠী, টি. এইচ, লুইন, অনুবাদ জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, রাংগামাটি, ১৯৯৮, পৃঃ ৯৭।

৮.    Williem Van Schendel, 1992, Dr. Francis Buchanan in South East Bengal (1798), UPL, Dhaka, pp.108.

৯.    বন ভিক্ষু ও পার্বত্য ভিক্ষুঃ  পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধান দু’টি বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের নাম বন ভিক্ষু সংঘ ও পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ। বন ভিক্ষু সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে) আর পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের ।

১০.   D.G.E Hall, 1966, History of South Est Asia, , 1sted, 4rth ed. Reprint in Hongkong in 1985, pp.158-159.

১১.   চট্টগ্রামের সমাজ ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা, আব্দুল হক চোধুরী, চট্টগ্রাম, বাংলা একাডেমি, মে, ১৯৮৮ পৃঃ ৩৫।

১২.   হিলট্রেকসর দুগ সুগ, মুকুন্দ চাঙমা, রাংগামটি, পৃঃ ১৭।

১৩.   মালেম তারা অর্থসার, ইন্দ্র লাল চাকমা, ১৪১০ বাংলা, রাংগামাটি, পৃঃ ১১।

১৪.   আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমী, ২০১৬, ঢাকা. পৃঃ ৫৯৯।

১৫.   মালেম তারা অর্থসার, ইন্দ্র লাল চাকমা, ১৪১০ বাংলা, রাংগামাটি, পৃঃ ৫।

১৬.   চাকমা জাতি(জাতীয় চিত্র ও ইতিবৃত্ত), শ্রী সতীষ চন্দ্র ঘোষ, বড় বাজার, কলকাতা-১৯০৯, পৃঃ ১৮৭।

১৭.   চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার, ২য় খন্ড, অশোক কুমার দেওয়ান, রাংগামাটি, ১৯৯৩, পৃঃ ৯৯।

১৮.  S.P. Talukder, Chakma Buddhist and Their Pulverization Worldwide, pp.67.

১৯.   মালেম তারা অর্থসার, ইন্দ্র লাল চাকমা, ১৪১০ বাংলা, রাংগামাটি, পৃঃ ১৪-১৫।

২০.  মালেম তারা অর্থসার, ইন্দ্র লাল চাকমা, ১৪১০ বাংলা, রাংগামাটি, পৃঃ ৫।

২১.   বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মনিকুন্তলা হালদার, মহাবোধি বুক এজেন্সি, ১৯৯৬ পৃঃ ২৩৬।

২২.  বৌদ্ধ বিদ্যা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা, ১৯৮৪ পৃঃ ২৭২-২৭৩।

২৩.  প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড, সুনীল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৮৫,পৃঃ ৪২১।

২৪.  বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মনিকুন্তলা হালদার, মহাবোধি বুক এজেন্সি, ১৯৯৬ পৃঃ ৩৪৪।

২৫.  সাধনানন্দ মহাস্থবির(বনভান্তে) : পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মধ্যে সাধনানন্দ মহাস্থবিরকে সাধকপুরুষ ভাবা হয়। যিনি স্থানীয়দের কাছে বনভান্তে নামেই অধিক পরিচিত। জন্মঃ ৮ই জানুয়ারি, ১৯২০ এবং মৃত্যুঃ ৩০ জানুয়ারি, ২০১২।

২৬.  মহতো মহান, রাজবন বিহার, রাংগামাটি, ২০১৩, পৃঃ ১।

২৭.  চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, শ্রী বিরাজ মোহন দেওয়ান, রাংগামাটি, ১৯৬৯, পৃঃ ২১৫।

২৮.  ময়নামতির ইতিহাস, ধর্মরক্ষিত ভিক্ষু, চট্টগ্রাম, পৃঃ ৬৯।

২৯.  বড়ুয়াঃ বাংলাদেশের সমতলে বসবাসরত বৌদ্ধরা হচ্ছেন বড়ুয়া। যারা বাংগালী বৌদ্ধ হিসেবে অধিক পরিচিত।

৩০.  আত্নঅন্বেষণঃ বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়, জীতেন্দ্রলাল বড়ুয়া, বাংলা একাডেমি, পৃঃ ১০৮।

৩১.   চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম, ভিক্ষু শীলাচার শাস্ত্রী, চট্টগ্রাম, পৃঃ ২০।

৩২.  চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, শ্রী বিরাজ মোহন দেওয়ান, রাংগামাটি, পৃঃ ২১৫।

৩৩.  বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মনিকুন্তলা হালদার, মহাবোধি বুক এজেন্সি, ১৯৯৬ পৃঃ ৩৬৬।

৩৪.  বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মনিকুন্তলা হালদার, মহাবোধি বুক এজেন্সি, ১৯৯৬ পৃঃ ২২০।

৩৫.  বৌদ্ধ বিদ্যা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা-১৯৮৪ পৃঃ ৩১

৩৬.  সুভদ্র ভিক্ষুঃ তিনিই ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সর্বশেষ সাক্ষাত-শ্রাবক।

৩৭.  মহাপরিনির্বাণ সুত্র, দীর্ঘনিকায়, সুত্ত পিটক।

৩৮.  আয়ুষ্মান মহাকশ্যাপ স্থবিরঃ বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তী আয়ুষ্মান মহাকশ্যাপ স্থবির ছিলেন সবচেয়ে বয়োজোষ্ঠ্য ভিক্ষু।

৩৯.  মহাপরিনির্বাণ সুত্র, দীর্ঘনিকায়, সুত্ত পিটক।

৪০.  ত্রিপিটক পরিচিতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, ড. সুকোমল বড়ুয়া ও সুমন কান্তি বড়ুয়া, বাংলা একাডেমী ঢাকা, ডিসেম্বর, ২০০০, পৃঃ ১৯।

৪১.   মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের ইতিহাস, ড. জিতেন্দ্রলাল বড়ুয়া, ঢাকা-১২০৫, ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, পৃঃ ১৭।

৪২.  উইকিপিডিয়া

৪৩.  পার্বত্য চট্টগ্রামঃ ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি, অধ্যাপক ড. সুনীতি ভ’ষণ কানুনগো, ২০১৮, রাংগামাটি, পৃঃ ১১৪।

৪৪.  গোজেন লামা, রচনায়- শিবচরণ, সম্পাদনায়- সুগত চাকমা, ২০০৪, রাংগামাটি, পৃঃ ৮(এক লামা)।

৪৫.  আটাশ বুদ্ধঃ বৌদ্ধধর্মে গত হওয়া আটাশ বুদ্ধের নাম- তৃঞ্চাঙ্কর বুদ্ধ, মেধাঙ্কর বুদ্ধ, দীপঙ্কর বুদ্ধ, শরণঙ্কর বুদ্ধ, কৌন্ডন্য বুদ্ধ, সুমঙ্গল বুদ্ধ, সুমন বুদ্ধ, রেবত বুদ্ধ, কপিল বুদ্ধ, অনোমদর্শী বুদ্ধ, নারদ বুদ্ধ, পদুম বুদ্ধ. পদুমত্তর বুদ্ধ, সুমেধ বুদ্ধ, প্রিয়দর্শী বুদ্ধ, অর্থদর্শী বুদ্ধ, ধর্মদর্শী বুদ্ধ, সিদ্ধার্থ বুদ্ধ, তিষ্য বুদ্ধ, ফুস্য বুদ্ধ, বিপর্শী বুদ্ধ, শিখি বুদ্ধ, শোভিত বুদ্ধ. কুকুসন্ধ বুদ্ধ, কনাগমন বুদ্ধ, কশ্যাপ বুদ্ধ, গৌতম বুদ্ধ।

৪৬.  আর্যমিত্র বুদ্ধঃ বর্তমান গৌতম বুদ্ধের কল্পায়ু শেষ হলে তাঁর পরবর্তী যিনি বুদ্ধ হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভুত হবেন তিনি হলেন আর্যমিত্র বুদ্ধ।

৪৭.  Williem Van Schendel, 1992, Dr. Francis Buchanan in South East Bengal (1798), UPL, Dhaka, pp.105.

৪৮.  ধরম বক্স খাঁঃ চাকমা রাজ বংশের ইতিহাসে ৬১তম চাকমা রাজার নাম ধরম বক্স খাঁ। যিনি ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যভার গ্রহণ করেন (১৮১২-৩২ খ্রিঃ।

৪৯.  চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবৃত্ত), শ্রী সতীষ চন্দ্র ঘোষ, বড় বাজার, কলকাতা-১৯০৯, পৃঃ ১১২।

লেখক : প্রকট চাকমা, এম.ফিল. গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা