প্রথাগত আইনে আদিবাসী লুসাই নারীর অবস্থান

Jumjournal
Last updated Aug 20th, 2020

1118

featured image

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি আদিবাসী জাতির মধ্যে লুসাইরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। মূলত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদর ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যকা এবং বান্দরবান জেলা ও রুমার লুসাইরা বসবাস করে।

লুসাই পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সামাজিক পরিচিতি প্রদানে পিতাকে অবশ্যই লুসাই হতে হয় কিন্তু মাতার লুসাই হওয়ার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

পিতৃকুলের পিতামহ-পিতামহী লুসাই দম্পতির প্রথম সন্তানের নামকরণ করে থাকেন। এখানেও শিশুর মাতার কোনো অধিকার থাকে না। লুসাই জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন মূলত তাদের সামাজিক ও গোত্রগত রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।

লুসাই সমাজে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি খেতখামারে উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। জুমচাষের বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, ধান কাটা ও উত্তোলন, ফসলাদি সংগ্রহসহ সকল কাজে নারীরা সমভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে।

নারীর প্রতি অবহেলা ও অসম্মান লুসাই সমাজে ভালো চোখে দেখা হয় না। উৎপাদন কাজের পাশাপাশি লুসাই নারীরা ঘরকন্না ও সন্তান লালন পালনের কাজও করে থাকে। সে বিচারে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ অধিক।

তবে সাধারণভাবে সকল শোষণমূলক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ন্যায় লুসাই সমাজেও নারীর অবস্থান পুরুষের সমকক্ষ নয়। পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের প্রাধান্য নারীর চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বা সুযোগের পরিমাণ পুরুষের চেয়ে কম।

সচরাচর লুসাই সমাজে নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা কম এবং নারীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। যৌতুক নিয়ে নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, স্ত্রীকে খুন করা, ধর্ষণ ইত্যাদি লুসাই সমাজে খুব কমই দেখা যায়। যদিও নানাভাবে, নানামাত্রায় নারীর ওপর সহিংসতা বিদ্যমান।

বিয়ে

লুসাই সমাজে বাল্যবিয়ের কোনো রীতি প্রচলিত নেই। এ সমাজে পাত্র ও পাত্রী সাবালক হলেই বিবাহযোগ্য হয়। তাদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের সাবালকত্ব প্রমাণেরও কিছু মাপকাঠি রয়েছে।

পুরুষেরা বাইরের কাজ ও অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ করতে পারলে ভাবা হয় যে তারা সাবালক হয়েছে; যেমন বাঁশ দিয়ে হারুং তৈরি, জুমচাষ, ঘরবাড়ি তৈরি ও ভারবহনে পারদর্শিতা। নারীদের ক্ষেত্রে দেখা হয় যে, তারা কাপড় বোনা ও গৃহস্থালি কাজে পারদর্শী কি না।

লুসাই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিয়ের পর স্ত্রী তার স্বামীর ভরণপোষণ ও সামাজিক মর্যাদা পান এবং স্বামীর পারিবারিক পদবির অধিকারী হন। চিহ্নিত বৈবাহিক কর্তব্যসমূহ নিম্নরূপ :

  •  স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করবেন এবং স্বামীর ন্যায়সংগত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলবেন;
  • স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন;
  •  উভয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকবেন।

বিয়ের পর লুসাই স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী স্থানে স্বামীর সাথে থাকতে হয় এবং সকল প্রকার ন্যায় সংগত নির্দেশ মানতে হয়।

অনুরূপভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরণপোষণ দিতে হয়। এখানে যদিও ন্যায়সংগত বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীকে সব নির্দেশই মানতে হয়। এখানে স্বামী অনেকটাই স্ত্রীর অভিভাবক রূপে গণ্য।

স্ত্রীর অধিকার (নু নিহুনা): লুসাই সমাজে ‘ইননেহুয়না’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ নিয়মে অথবা চার্চ বা গীর্জায় বিয়ের পর একজন স্ত্রীর নিবর্ণিত অধিকারসমূহ স্বামীর পরিবার ও সমাজের কাছে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পদবি ও মর্যাদা : বিয়ের পূর্বে একজন লুসাই নারী পারিবারিক যে পদবি ও মর্যাদারঅধিকারীই হোন না কেন, বিয়ের পর তিনি স্বামীর পরিবারের পদবি ও মর্যাদার অধিকারী হবেন।

স্বামীর থেকে পৃথকানে বসবাস: লুসাই সমাজে স্বামীর কাছ থেকে পৃথকান্নে বসবাসের  প্রকার সুযোগ নেই।

বিবাহবিচ্ছেদ (ইনঠেন): স্বামী পুরুষত্বহীন বা নপুংশক হলে অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, মানসিক ভারসাম্যহীন হলে, অনেক বছর বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে স্ত্রী সমাজপতি বা লাল/কার্বারি/হেডম্যান/সামাজিক আদালত বা প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (ইনঠেন) সম্পাদনের অধিকারী হন। চার্চের শপথ অনুসারে স্বামী স্বেচ্ছায় ত্যাগ করলে বা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান নিজ ঔরসজাত স্বীকার না-করলে বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

স্বামীর মৃত্যুজনিত কারণে বা বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে করার অধিকার স্বামীর মৃত্যু হলে অথবা স্বামী কর্তৃক ইনঠেন প্রাপ্ত হলে অথবা সমাজপতি বা লালকার্বারি/হেডম্যান বা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে স্বামীকে ইনঠেন প্রদান প্রলে স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করার অধিকারী হন। নাবালক সন্তানের বয়স তিন বছর পূর্ণ-হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী দ্বিতীয় স্বামীর সম্মতিতে পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত নাবালক সন্তানকে নিজ হেফাজত রাখার অধিকারী হন।

বিধবার অধিকার লোপ: লুসাই সমাজে একজন বিধবা নারীর প্রাপ্য অধিকার নিমোক্ত কারণে সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে লোপ পায় ।

ক. যদি উক্ত বিধবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, তবে মৃত স্বামীর সংসারের প্রাপ্য সকল অধিকার তার জন্য বিলুপ্ত হয়;

খ. এ স্বামীর মৃত্যুর দিন থেকে ২৮০ দিন পর বা ধাত্রীবিদ্যা মতে যদি বিধবা অবৈধভাবে গর্ভবতী হন এবং সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে স্ত্রী মৃত স্বামীর সংসারের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন;

 গ. কোনো নারী সামাজিক ও অর্পনৈতিকভাবে বেপরোয়া জীবনযাপনে লিপ্ত হলে এবং সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে উক্ত বিধবা তার স্বামীর সংসারের প্রাপ্য সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হন;

স্ত্রীর অধিকার (নু নিহুনা): লুসাই সমাজে পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচলিত সামাজিক প্রথায় উননেহয়না অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীরূপে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। পিতত দ্বারা সন্তানের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উভয়ের মধ্যে উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ, ইত্যাদি গুরু দায়দায়িত্ব সৃষ্টি হয়। পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভূমিষ্ট সন্তান অবৈধ বলে গণ্য হয়।

সমাজসিদ্ধ বিয়ে ব্যতিরেকে প্রেম-ভালোবাসা জনিত বা অন্য কারণে যৌনমিলনের মাধ্যমে কোনো যুবতী গর্ভবতী হলে তাকে সমাজপতি বা লাল/কার্বারি/হেডম্যান/সালে চিফ আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়।

বিচারকালে উক্ত যুবতী তার গর্ভজাত সন্তানের জন্য যে পুরুষকে দায়ী করবে, সেই পুরুষ স্বেচ্ছায় যদি যুবতীর গর্ভধারণের দায় স্বীকার করে নেয়, তাহলে প্রচলিত নিয়মে জরিমানা ধার্য করা হবে এবং যুবক-যুবতী পরস্পর বিবাহ নিষিদ্ধ-সম্পৰ্কীয় আত্মীয় না-হলে সামাজিক প্রথা অনুসারে ‘ইননেহুয়না’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উভয়ের বিয়ে হবে। এক্ষেত্রে গর্ভবতী যুবতীর ভূমিষ্ট সন্তান বৈধ হবে এবং পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হবে।

নাবালকের অভিভাবকত্ব: লুসাই সমাজে ভিন্ন কোনো কিছু প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত পিতাই সন্তানের আইনগত অভিভাবক। পিতার অবর্তমানে সমাজপতি বা লালকার্বারি/হেডম্যান। সার্কেল চিফের মতামত সাপেক্ষে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ ধারায় বণিত ক্ষমতাবলে জেলা প্রশাসকের আদালত কর্তৃক উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদানের সময় মাতাকেই সচরাচর নাবালকের অভিভাবক ধরা হয়।

মা নাবালকের শরীর এবং সম্পত্তি উভয়ের হেফাজত বা দেখানা করেন। সাবালকত্ব আইনের ৩ ধারা অনুসারে ১৮ বছর পূর্ণ হলে তার নাবালকত্বের অবসান ঘটে।

তবে সম্পত্তির ক্ষেত্রে এবং আদালত কর্তৃক কোনো অভিভাবক নিযুক্ত হয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী সন্তান ২১ বছরে সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়।

অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ (১৮৯০ সালের ৮ নম্বর আইন)-এর ৭(১) রায় আরো বলা হয়েছে, যেক্ষেত্রে আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, নাবালকের কল্যাণার্থে তার শরীর অথবা সম্পত্তি উভয়ের স্বার্থে একজন অভিভাবক ঘোষণা করা প্রয়োজন রয়েছে, সেক্ষেত্রে আদালত তদনুসারে অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন।

তবে পথ সমাজে পিতা-মাতার মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে নাবালক সন্তানের অভিভাবকত্বের মন মাতার দাবি অগ্রগণ্য হবে। মাতার অবর্তমানে সহোদর বড় ভাই, তার অবর্তমানে সহোদর বড় বোন অথবা উভয়ের অবর্তমানে রক্ত-সম্পৰ্কীয় জেঠা বা কাকার দাবি অগ্রগণ্য হবে।

মিশ্র বিয়ে: লুসাই সমাজ লুসাই ব্যতীত অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাথে বিয়েকে স্বীকৃতি দেয়। তবে লুসাই নারী যদি অন্য জাতিগোষ্ঠীর পুরুষকে বিয়ে করেন, তবে তিনি নিশ্চিত ভাবে তার উত্তরাধিকার সহ পদ ও পদবি হারান।

অন্যদিকে কোনো লুসাই পুরু ভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কোনো নারীকে বিয়ে করলে স্ত্রীকে তার নিজস্ব পরিচিতি বিলোপ করে স্বামীর লুসাই পরিচয় ও পদবি ধারণ করতে হয়।

বিবাহবিচ্ছেদ: স্বামী-স্ত্রী যে কারো কারণে ইনঠেন বা বিবাহবিচ্ছেদ সম্পাদিত হলে তাদের সন্তান অবশ্যই পিতার উত্তরাধিকারী হবে। পরিবারের স্ত্রী ও কন্যা বিবাহবিচ্ছেদজনিত কারণে প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়। পুত্রের অবর্তমানে সহোদর ভাই, ভাইপো উত্তরাধিকারী হয়।

লুসাই সমাজে উত্তরাধিকারের সাধারণ রীতিনীতি হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া স্থাবরঅস্থাবর সম্পত্তি অর্জন করতে হয় মৃত ব্যক্তির সকার ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে বা সামাজিক বিধি বিধানের মাধ্যমে।

১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ধারামতে জেলা দেওয়ানি আদালত কর্তৃক উত্তরাধিকার সনদ প্রদান করা হয়। বিধিতে উইলমূলে উত্তরাধিকার প্রাপ্তির রীতি প্রচলিত আছে। সাধারণভাবে লুসাই সমাজে পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে কনিষ্ঠ পুত্রসন্তান।

তবে পিতা-মাতা ইচ্ছা করলে অন্য ছেলেদেরও সম্পত্তির ভাগ দিতে পারেন। সাধারণভাবে কন্যাসন্তান সম্পত্তির ভাগ পায় না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতা-মাতা মেয়েসন্তানদেরও সম্পত্তির ভাগ দেন, যদিও এ ধরনের ঘটনার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য।

লুসাই সমাজে ‘ইননেহুয়া’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ প্রাপ্তির অধিকারী হন। একজন লুসাই নারী বিয়ের পূর্বে রে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান পহার হিসেবে কিংবা উপার্জিত অর্থে সম্পত্তি করা অথবা লাভ করতে পারেন।

বিয়ের অতি যেকোনো সম্পত্তির ওপর আইনত নিরঙ্কশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, সতিনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হলে, প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে আত স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হন অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গ্রহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামী কাছ থেকে খোরপোষ লাভের অধিকারী হন।

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ ও পদবি: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর ৪৮ বিধিমতে সার্কেল চিফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে যে,

  • এ বিধি অনুসারে এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চিফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। হেডম্যান বা কার্বারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র যদি যোগ্য হন, তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
  • লুসাই সমাজের সমাজপতি বা পাড়াপ্রধান পদে বংশানুক্রমিক হিসেবে পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্রাধিকার পান।
  •  

লুসাই সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস: পরিবারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে লাল বা সমাজপতি বা হেডম্যান বা কার্বারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

  •  লুসাই পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র/পুত্রগণ পিতার আইনগত উত্তরাধিকারী। তবে অবিবাহিত বিধবারা ভরণপোষণ পাবেন;
  • লুসাই পরিবারে পুত্রসন্তান না-থাকলে ভাই, ভাইবােন বা গোত্রের রক্ত-সম্পৰ্কীয় পুরুষ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন;
  • স্বামী-স্ত্রী : লুসাই পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে না হলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে আমৃত্যু ভণপোষণ লাভের অধিকারী হবেন;
  • পিতা-মাতা : মৃত ব্যক্তির যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনি না থাকে বা জীবিত না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তানরূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছেন, সেই পিতা-মাতা, মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, তার পুত্র তার আইনগত উত্তরাধিকারী হবে;
  • রক্ত-সম্পর্ক : লুসাই সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি, পিতা কেউ যদি জীবিত না-থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না-করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, তার পুত্র তার আইনগত উত্তরাধিকারী হবে;
  • লুসাই পরিবারে মৃতের পিতা, ভাই ও এ সকলের রক্ত-সম্পৰ্কীয় নাতিদের কেউই যদি জীবিত না থাকে অথবা গহণ না করে, সেক্ষেত্রে জেঠা/কাকা, তাদের সন্তান আইনগত উত্তরাধিকারী হবে;
  • লুসাই সমাজে মৃত ব্যক্তির রক্ত-সম্পকীয় কেউ না-থাকা অবস্থায় লাল বা সমাপতি বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সম্পত্তির পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্ধারিত হবে।

দেখা যায়, পরিবারের ভেতর থাকলে, বসবাস করলে তাকে পরিবারে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হবে, বা মা সম্পত্তিও ভোগ করতে পারবেন কিন্তু মালিকানা পাবেন না।

কন্যারা স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন না। তবে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে প্রাপ্ত স্বামীর সম্পত্তি অথবা পিতৃ পরিবারের দান করা সম্পত্তি বা দ্রব্য তাদের অধিকারে থাকবে।

দান: চাকমা, বোমাং ও মং সার্কেলে বসবাসরত লুসাই পরিবারের স্ত্রী এবং কন্যাসন্তান স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী না-হলেও স্বামী/পিতার সম্পত্তি দানমূলে গ্রহণ করতে পারেন। লুসাই প্রথামতে স্বাভাবিক উত্তরাধিকারীদের এতে আপত্তি করার কোনো সুযোগ নেই।

উইল বৌলুয়াহু মান): প্রথামতে অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী থাকলে তাকে বা তাদের বঞ্চিত করে উইল করা যায় না। তেমনি কোনো ব্যক্তির পুত্রসন্তান থাকলে এদের বঞ্চিত করে তার সব সম্পত্তি উইল করা যায় না।

দত্তক (কাচ) সন্তানের উত্তরাধিকার: লুসাই সমাজে সন্তান দত্তক গ্রহণ করা সমাজসিদ্ধ। দত্তক পুত্র বা কন্যা নিজের নামের শেষে পালিত পরিবারের পদবি ধারণ এবং পিতা-মাতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে অন্য সন্তানদের ন্যায় অংশলাভের অধিকারী হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর ৪৮ বিধিমতে নিয়োগ যোগ্য হেডম্যান, কার্বারির মতো পদে দত্তক পুত্র যোগ্য হলে এবং সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হলে মৃত পিতার সেই পদে নিয়োজিত হবার আইন গত অধিকারী হয়।

সন্তান দত্তক দেবার ক্ষেত্রে অবশ্যই দাতা কর্তৃক তার সন্তানকে সমাজস্বীকৃত রীতি অনুযায়ী চার্চ বা গির্জায় গিয়ে ধর্মীয় নিয়মে বা সমাজপতি বা লালকার্বারি/হেডম্যান সামাজিক আদালতের সম্মতিতে গ্রহীতার প্রতি হস্তান্তর করতে হয়।

প্রেম সম্পর্কজনিত যৌনমিলনের কারণে অবৈধ সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর জন্মদাতা পুরুষ যদি উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেন এবং মা যদি সন্তানের পিতৃত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হন, তাহলে মা তার সন্তানকে দত্তক গ্রহণে আগ্রহী ও সক্ষম কোনো ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে পারেন।

দত্তক সন্তান গ্রহণের পর নিঃসন্তান পালক পিতা-মাতার সংসারে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তা নিরসনের জন্য লুসাই সমাজে নিম্নোক্ত দিকনির্দেশনা রয়েছে:

  • কে সন্তান কন্যা হলে আর নিঙ ঔরসজাত সন্তান পুত্র হলে : লুসাই সমাজের বা রীতি অনুযায়ী কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। দত্তক কন্যা ঔরসজাত কন্যাসন্তানের ন্যায় সব অধিকার ভোগ করবে;  
  • দত্তক সন্তান পুত্র আর নিত্ত ঔরসজাত সন্তান কন্যা হলে : দত্তক পুত্রসন্তান আসল সমানের মর্যাদা নিয়ে ঘরে আসে বলে সে পালক পিতার উত্তরাধিকারী হবে। আর নিজ ঔরসজাত বা গর্ভজাত কন্যাসন্তান কন্যার মতোই পারিবারিক মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে;
  • দত্তক ও ভুমিষ্ট সন্তান উভয়ে কন্যা হলে : উডয়ে পিতার উত্তরাধিকারী হবে এবং পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তির সমান অংশীদার হবে।

তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা