লুসাই জনগোষ্ঠী প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথা
1653
লুসাই পরিচিতি
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ট হলো লুসাই জনগোষ্ঠী।
মূলতঃ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা সদর ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যকায় এবং বান্দরবান জেলা সদর ও রুমায় স্বল্প সংখ্যক লুসাইরা বসবাস করে।
উনবিংশ শতাব্দীতে লুসাই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক অভিযান পরিচালিত হয়।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে এবং ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্ববৃহৎ লুসাই অভিযানের পরবর্তী সময়ে নানা প্রতিকুলতার মুখে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যাযাবর জীবনযাপনকারী লুসাই জনগোষ্ঠীর অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরাম রাজ্যের একাংশ নিয়ে গঠিত লুসাই হিলস ডিষ্ট্রিক্ট- এ স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে।
অবশিষ্ট সামান্য অংশ বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করছে, যা জনসংখ্যার দিক থেকে আনুমানিক এক হাজার। জাতিগতভাবে তারা মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভূক্ত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী লুসাই জনগোষ্ঠী টিবোটো-বাৰ্মেন শাখার কুকি-চিন দলের মধ্যে কুকি-চিন উপদলের অন্তর্গত ভাষাভাষী মানুষ।
লুসাই প্রথাগত আইনের উৎস
লুসাই জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন প্রধানতঃ তাদের সামাজিক ও গোত্রগত রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
লুসাই জনগোষ্ঠীর সামাজিক প্রধান বা সর্দারকে ‘লাল’ বলা হয়। তিনি সমাজপতি বা নেতা হিসেবে লুসাই সমাজের যে কোনো বিরোধের মীমাংসা বা সুবিচার করেন এবং সমাজকে সকল বৈরিতা বা প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করেন।
লুসাই জনগোষ্ঠীর যে কোনো বিরোধ বা সামাজিক কিংবা পারিবারিক সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে প্রচলিত ”মিজৌ হ্লাম দান” ১৯৫৬ (১৯৬০ সনে সংস্কার) অনুসরণ করা হয়।
মিজৌ হ্লাম দান অনুসরণ করার পাশাপাশি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় তিন স্তর বিশিষ্ট সামাজিক আদালতের মাধ্যমে তাদের যাবতীয় সামাজিক বিরোধ নিষ্পন্ন হয়ে থাকে।
মূলতঃ বোমাং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসকারী লুসাই জনগোষ্ঠী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের তুলনায় সংখ্যাগত ভাবে যতো ছোটই হোক না কেন তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও গোত্রগত শৃঙ্খলা এবং শাসন সংহত রাখতে সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য বিশেষ কিছু নিয়ম, রীতিনীতি ও প্রথা তারা অনুসরণ করে।
এছাড়াও লুসাই সমাজে এমন কিছু লোকবিশ্বাস ও রীতিনীতির প্রচলন আছে, যেগুলো মৌখিকভাবে প্রচলিত।
এসব রীতিনীতি ও প্রচলিত প্রথা পুরুষানুক্রমিকভাবে সমাজে অনুসরণের মাধ্যমে প্রথাগত আইন রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যেমনঃ- অতীতে লুসাইদের সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস এবং ভূতপ্রেত, অপদেবতা ও পাথিয়েন বা সৃষ্টিকর্তার পূজা পদ্ধতি ও নিয়ম, রীতি-নীতি, পান্ডুলিপি আকারে তন্ত্র-মন্ত্র, ঝাড়ফুক, তাবিজ/মাদুলি লিখন বা প্রস্তুতকরণের বিষয়, ভেষজ চিকিৎসার বিষয়, অলিখিত ও মৌখিকভাবে প্রচলিত বংশানুক্রমিক আচার-অনুষ্ঠান।
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে এ সকল বিষয় অনেক ক্ষেত্রে দ্বান্ধিক। এতদ্সত্ত্বেও লুসাই সমাজে প্রয়োজনের তাগিদে এসব রীতিনীতি, কৃষ্টি, লোকবিশ্বাস ও প্রচলিত প্রথা অনুসরণ করা হচ্ছে, যদিও এসবের অনুশীলন পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেছে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক পরিবর্তনের কারণে।
সুপ্রাচীনকাল হতে আদিবাসী সমাজের স্মৃতি ও শ্রুতি নির্ভর এ সকল রীতিনীতি ও প্রথাকে সমাজের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন রূপে বিধিবদ্ধ আকারে সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের তাগিদে এখানে গ্রন্থনা করা হলো, যার অপরিসীম আইনী গুরুত্ব রয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে লুসাই জনগোষ্ঠীর সমাজপতি বা সর্দার ”লাল” এর কর্তৃত্বাধীনে সমাজের বিচার ও শাসন কার্য নিম্পন্ন হতো।
‘লাল’ কে সহায়তার জন্য উপা (কাউন্সিলর), পুইথিয়াম (পুরোহিত), জালেন (নিরপেক্ষ) এবং রামহুয়ালতু (ভূমি বিশেষজ্ঞ), টলাংআউ (ঘোষক) এবং থিরদেং (কামার) এসব পদবীধারী নিযুক্ত হতো।
পরবর্তীতে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় হেডম্যান, কার্বারী ও সার্কেল চীফ পদ সৃষ্টির মাধ্যমে তিনটি স্তরের সামাজিক বিচার কাঠামো দ্বারা সামাজিক বিরোধ নিস্পন্ন হয়ে আসছে।
লুসাই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ তাদের সামাজিক দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনের পাশাপাশি সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা ভোগ যেমন করে, তেমনি সামাজিক শাসন, রীতিনীতি এবং শৃঙ্খলা সহ নিজেদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে কিছু বিধি নিষেধও তারা মেনে চলে।
পাশাপাশি ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি আনুগত্য থেকে উদ্ভুত আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও প্রথা অনুসরণের মাধ্যমে লুসাই জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের উদ্ভব হয়েছে।
১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের আওতায় সৃষ্ট কার্বারী, হেডম্যান, সার্কেল চীফ এ তিনটি স্তরের সামাজিক আদালত হতে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত ও প্রতিবিধানের আওতায় তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আইনের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে এভাবে- ‘আইন অর্থ কোনো আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, প্রজ্ঞাপন ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতা সম্পন্ন যে কোনো প্রথা বা রীতি’।
প্রথাগত আইন সম্পর্কে অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যায় যা কিছুই থাকুক না কেন সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা। অনুসারে প্রথাগত আইন অবশ্যই বাংলাদেশে প্রচলিত সকল ধরণের আইনের সমকক্ষ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের বিচার ব্যবস্থা
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকমা সার্কেলে আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন চাকমা চীফ/চাকমা রাজা; বোমাং সার্কেলে আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন বোমাং চীফ/বোমাং রাজা মং সার্কেলের চাকমা ব্যতীত আদিবাসীদের সমাজের প্রধান বিচারক হলেন মং চীফ/মং রাজা।
তাঁদের অধীনস্থ সার্কেলে তাদের অধীনস্থ আদালতগুলিই হলো সংশ্লিষ্ট আদিবাসী সমাজের জন্যও সর্বোচ্চ (আদিবাসী) আদালত।
তাঁরা স্ব স্ব সার্কেলের আদিবাসীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচার করে থাকেন এবং স্ব স্ব মৌজার হেডম্যানদের বিচারের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে তাদের আদালতে আপীল করা হলে সে বিচারও করে থাকেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্কেলে চীফ/রাজাদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলিতে ডেপুটি কমিশনারের আদালতে আপীল করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা সার্কেলে চাকমা চীফ রাজার অধীনস্থ মৌজাগুলিতে স্ব স্ব মৌজা হেডম্যান হলেন ঐ মৌজার আদিবাসী সমাজের মূখ্য বিচারক।
তিনি তার আদালতে নিজে এবং প্রয়োজনে তার মৌজা বিভিন্ন গ্রামপ্রধান কার্বারীদের/সমাজপতিদের (বিশেষ কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ক্ষেত্রে তাদের সমাজপতিদের যেমনঃ -লুসাই, পাংখোয়া, বমদের ”লাল” প্রমূখদের) সহযোগিতায় সামাজিক বিচারাদি সম্পন্ন করেন।
অধিকন্তু তার পরিচালনাধীন মৌজার গ্রামপ্রধান কার্বারীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তার আদালতে কোনো আপীল পেশ করা হলে তাও বিচার করে থাকেন। হেডম্যান আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ/রাজার আদালতে আপীল করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মৌজাগুলির অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলি সংশ্লিষ্ট গ্রামপ্রধান কার্বারী তার আদালতে কোনো অভিযোগ হলে তার বিচার করেন; প্রয়োজনে হেডম্যানের নিকট প্রেরণ করেন।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যে সকল গ্রামে কার্বারী অনুপস্থিত সেখানে বসবাসকারী ঐ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমাজপতিগণ সামাজিক বিচারাদি সম্পন্ন করে থাকেন।
লুসাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন প্রয়োগের অধিক্ষেত্র
বাংলাদেশে লুসাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের অধিক্ষেত্র হিসেবে মূলতঃ চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেলে বসবাসকারী লুসাই জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য। যে সকল আইনের আওতায় লুসাই সমাজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা বা বিরোধসমূহের নিষ্পত্তি হচ্ছে এবং হয়, তা নিম্নরূপঃ-
ক) ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪০ নং বিধি;
খ) ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন সংশোধনী (২০০৩ সনের ৩৮নং আইন) আইনের ৪(৪) ধারা;
গ) তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন (১৯৮৯ সনের ১৯, ২০ ও ২১ নং আইন)-এর ৬৬ ধারামতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি সামাজিক বিচার এবং ১ম তফশীলের ২৩নং কার্যাবলীর অধীনে;
ঘ) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের ২২(ঙ) ধারার আওতায় (ক্ষমতাবলে) লুসাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনকে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতে সমম্বয় ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে লুসাই জনগোষ্ঠীর উপর প্রয়োগ ও প্রযোজ্য হয়।
৬) পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন (২০০১ সনের ৫৩নং আইন) এর ৬নং ধারামতে (ক) পুনর্বাসিত শরণার্থীদের ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা, (খ) আবেদনে উল্লেখিত ভূমিতে আবেদনকারী, ক্ষেত্রমতে সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও রীতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল।
লুসাই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন যার উপর প্রযোজ্য নয়
ক) যদি তিনি ঘোষণা বা সামাজিক আচার-আচরণে লুসাই পরিচিতি ত্যাগ করেন;
খ) লুসাই কোনো পুরুষ বা মহিলা যদি ধর্মান্তরিত ও জাতিচ্যুত হয়ে ভিন্ন জনগোষ্ঠী হতে স্ত্রী বা স্বামী গ্রহণ করেন এবং লুসাই সামাজিক রীতিনীতি ও প্রচলিত প্রথা পরিহার করেন। মূলতঃ (১) জন্মগতভাবে যিনি লুসাই তথা লুসাই পরিবারে জন্মগ্রহণকারী, (২) পিতা লুসাই জনগোষ্ঠীর সদস্য, (৩) একজন লুসাই পুরুষের ঔরসে ও একজন লুসাই মহিলার গর্ভজাত ভূমিষ্ট সস্তান কিংবা অবৈধ সন্তানও লুসাই বলে গণ্য হয়।
ব্যাখ্যা: লুসাই জনগোষ্ঠীভুক্ত একজন আদিবাসী পুরুষের ঔরসে জনুগ্রহণকারী ব্যক্তিই লুসাই পরিচয়ের অধিকারী। লুসাই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত কোনো পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশুর সামাজিক পরিচিতি লুসাই বলেই স্বীকৃত হয়। তবে মাতাকে লুসাই নারী হতে হয় এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজেকে লুসাই হিসেবে পরিচয় দান করে, এরূপ একজন লুসাই-এর ঔরসে জন্মগ্রহণকারী এবং দত্তক সূত্রে লুসাই পরিবারে লালিত সন্তানও লুসাই পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করে।
জন্ম, মৃত্যু, বিবাহে সামাজিক বাধ্যবাধকতা: জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ মানব জীবনের এ তিনটি অধ্যায়কে লুসাই জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের দ্বারা সমাজসিদ্ধ করেছে। এসব রীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে লুসাই সমাজে অলক্ষ্মনীয় করা হয়েছে।
শিশুর জন্মশুদ্ধি ও সামাজিক আচার: আদিবাসী লুসাই পরিবারে পুত্র সন্তান জন্মের পাঁচদিন পর এবং কন্যা সন্তান জন্মের তিনদিন পর আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাড়ির সামনে একটি লম্বা পরিপক্ক গাছ (সার অংশটি) পুঁতে রাখা হয়।
একটি গয়াল বা একটি শূকর বধ করে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। অনুষ্ঠানে মদ এবং নৃত্যগীত পরিবেশনেরও আয়োজন থাকে। লুসাই দম্পতির প্রথম সন্তানের বেলায় পিতৃকুলের পিতামহ-পিতামহী নামকরণ করেন।
পরবর্তী সন্তানদের বেলায় স্ত্রী অথবা স্বামী যেকোনো জন নামকরণ করতে পারে। বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী লুসাইরা এসব সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পরিবর্তে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি ও আচারঅনুষ্ঠান অনুসরণ করে।
সৎকার রীতি: লুসাই সমাজে কারো মৃত্যু হলে গ্রামবাসীরা সবাই মৃতের জন্য শোক প্রকাশ করতে সমবেত হয়। লুসাই সমাজে মৃত্যুর পর মৃতদেহ কবর দেয়া হয়।
সমাজের আদি রীতিতে মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে পশু বলি দিয়ে ভোজের আয়োজন করা হতো। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর এ রীতির প্রচলন বর্তমানে নেই।
লুসাই সমাজে কারোর স্বাভাবিক মৃত্যুতে গ্রামের মধ্যে নির্ধারিত স্থানে কবর দেয়া হয়। দুরারোগ্য বা সংক্রামক ব্যধিতে ভুগে বা দূর্ঘটনাজনিত কারো মৃত্যু হলে গ্রামের বাইরে কবর দেয়া হয়।
সকারের জন্য মৃতদেহকে স্নান করানোর পর ভালো কাপড় পরিয়ে বাড়ির একটি কক্ষে রাখা হয়। মৃত ব্যক্তিকে শেষ দেখার জন্য আসা লোকজনকে আপ্যায়ন করা হয়।
মৃতের পরিবারে প্রতিদিন খাদ্য ও পানীয়ের কিছু অংশ মৃতের উদ্দেশ্যে রাখা হয়। মৃতের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সকলে তিন-চারদিন পর্যন্ত শোক প্রকাশের জন্য আসে।
কফিন তৈরী করে মৃতদেহ এক মাস পর্যন্ত কফিনে রাখার পর শবের করোটি, বাহু ও পশ্চাদদেশের অস্থি পরিষ্কার করে বংশের চিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়ার রীতি ছিল।
এসব অস্থি সংরক্ষণের দায়িত্ব থাকতে পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রের ওপর। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী লুসাই জনগোষ্ঠী বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে কবর দেয় এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে।
লোকবিশ্বাস: লুসাই জনগোষ্ঠীর লোকবিশ্বাস অনুযায়ী তাদের কারো মৃত্যুর পর মৃতের আত্মা ”মিথিখুয়া” নামক মৃতপূরীতে বাস করে। মিথিখুয়াতে অবস্থান কালে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের বিচার হয়।
কর্মফল অনুসারেই তারা স্বর্গে (পিয়াল রাল) যেতে পারবে। পৃথিবী ছেড়ে মিথিখুয়াতে যাবার মাস হিসেবে (থি টিন থলা) আগষ্ট মাসকেই ধরা হয়।
তাই লুসাই সমাজে আগষ্ট মাসে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান বা বিনোদনমূলক কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় না। বর্তমানেও এই রীতি মানা হচ্ছে।
এই জনগোষ্ঠী আদিতে সৃষ্টিকর্তা বা ”পাথিয়েন” বিশ্বাস করতো। পশুবলি দিয়ে শিব পূজা ও নদী পূজা করার প্রচলনও লুসাই সমাজে ছিল। বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করাতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক রীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও লুসাই সামাজিক প্রথা: আদিবাসী লুসাই জনগোষ্ঠী এককালে জড়োপাসক ও সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী ছিল। তারা ভূতপ্রেত, অপদেবতা ইত্যাদি বিশ্বাস করতো, যে কারণে লুসাইদের পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও লুসাই জনগোষ্ঠী তাদের খ্রিস্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি সমাজের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি ও প্রথাকে সামাজিক শাসন ও শান্তিশৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রাখার সহায়ক হিসেবে বিশ্বাস করে।
লুসাই জনগোষ্ঠীর এরূপ বিশ্বাস ও সামাজিক স্বীকৃতির বদৌলতে তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের উদ্ভব হয়েছে। জন্মসূত্রে একজন লুসাই যতক্ষণ পর্যন্ত স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ঘোষণার মাধ্যমে কিংবা আচার-আচরণ দ্বারা ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কুষ্টি, রীতিনীতি ও প্রথা পরিত্যাগ না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি লুসাই হিসেবে গণ্য হন।
তথ্যসূত্র:
১। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮।
২। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ (২০০১ সনের ৫৩নং আইন)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।