২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ও আদিবাসী শিশু : নতুন দিনের যেন প্রতিধ্বনি শুনি

Jumjournal
Last updated Dec 7th, 2020

911

featured image

হিমা রাণী কখনও ভাবেননি তিনি স্কুল শিক্ষিকা হবেন। তাঁর মাতৃভাষা ককবরক। নিজের মায়ের ভাষায় পরিচালিত স্কুলের শিক্ষিকা হতে পেরে তিনি খুবই গর্বিত।

প্রথম যখন তিনি এই স্কুলে পড়ানো শুরু করেন, তখন গ্রামের আগ্রহী বয়স্কজনরা ভীড় জমিয়ে দেখেতে আসতেন। লজ্জায় তিনি বাচ্চাদের সাথে নাচ-গান করতে চাইতেন না।

আজ তিনি মাতৃভাষায় পরিচালিত স্কুলগুলোর পুরস্কারপ্রাপ্ত সেরা শিক্ষিকাদের একজন। তিনি এর আগে বাংলায় পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি বলেন ‘নিজের ভাষায় পরিচালিত ক্লাসে শিশুরা যতখানি স্বত্বস্ফুর্ত, ঠিক ততখানি কোনঠাসা অন্য ভাষায় পরিচালিত স্কুলে।

সব শিশুকে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করা সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। ২০১৫ সালের মধ্যে সব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হলে শিশুদের জন্য প্রয়োজন স্বাচ্ছন্দ্যময় শিখন-পরিবেশ।

বিভিন্ন গবেষণা তথ্য হতে জানা যায়, এখনও প্রায় অর্ধেক আদিবাসী শিশুকে মৌলিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে স্বল্প সংখ্যক শিশু যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের মধ্য থেকে ৬০ শতাংশই ঝড়ে পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডির মধ্যে বাকীরা মাধ্যমিক স্কুলের চৌকাঠ পার হওয়ার আগেই পড়ালেখায় ইস্তফা দেয়।

অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলসহ বহু আদিবাসী অঞ্চল অনেক দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। এ কারণে অন্যান্য উন্নয়ন-সেবার মতোই তাদের কাছে শিক্ষার আলো সহজে পৌঁছতে পারে না।

আদিবাসী শিশুশিক্ষার এই বাস্তবতা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রথম সরকারি দলিলগুলোর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) এবং জাতীয় দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রের কথা উল্লেখ করা যায়।

তবে সবচেয়ে প্রগতিশীল ও অগ্রসর উদ্যোগ হিসেবে যে দলিলের কথা বলতেই হয়, সেটি হল ২০১০ সালে গৃহিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ-কে কো-চেয়ারম্যান করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়।

চার মাসের মধ্যে কমিটি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে শিক্ষানীতির খসড়া পেশ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা ওয়েবসাইটে দিয়ে জনমত সংগ্রহন করে এবং পরে সংশোধন পরিমার্জন করে মন্ত্রীসভায় তা অনুমোদন করা হয়।

এ শিক্ষানীতিতে ৩০টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং শিক্ষা-স্তর নির্বিশেষে ১৭টি প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে। একাত্তর পৃষ্ঠার এই শিক্ষানীতিতে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল এবং কুদরাত-এ খুদা কমিশন রিপোর্ট থেকে শুরু করে বাংলাদেশে সকল শিক্ষানীতি /শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবের ধারাবাহিকতার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর গুরুত্বপূর্ন কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

–    শিক্ষা ব্যবস্থা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থাৎ ধর্ম, ছেলে-মেয়ে, আর্থ-সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থান, আদিবাসীসহ সকল জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী নির্বিশেষে সকলকে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না।
–    শিক্ষা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দেশে বিরাজমান আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ত।
–    নৈতিক শিক্ষা জোরদার করা হবে। সকল ধমের্র শিক্ষা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নিশ্চিত করা হবে।
–    বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পেশায় বিভিন্ন পর্যায়ের দক্ষতা সৃষ্টির কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে; জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে উচ্চমানের গবেষণার ব্যবস্থা করা হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর বিশেষত্ব

–    প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের বাধ্যতামূলক বিষয়সমূহ হবে: বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান।

–    মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের বাধ্যতামূলক বিষয়সমূহ হবেঃ বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা।
–    প্রত্যেক ধারায় এসকল বিষয়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।
–    প্রাথমিক স্তর থেকে নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
–    ৫+ বছর বয়স্ক শিশুদের জন্য প্রাথমিকভাবে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। পরবর্তীকালে তা ৪+ বছর বয়স্ক শিশু পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে।
–    নতুন শিক্ষা কাঠামোয় ১ম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর হিসেবে বিবেচিত হবে।
–    ২০১০-১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে।
–    ২০১৪ সালের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নাগরিককে সাক্ষর করে তোলা হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ও আদিবাসী শিশু

সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষার ইতিহাসে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। আদিবাসীদের প্রেক্ষিত থেকেও এই শিক্ষানীতির বেশ কিছু ইতিবাচক সুপারিশ রয়েছে।

সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- (ক) জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতি হিসেবে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্রজাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো; (খ) আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা শিখতে পারে সেজন্যে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা; (গ) আদিবাসী এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা; (ঘ) প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল জাতিসত্তার জন্যে স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা; এবং (ঙ) যেসব এলাকায় হালকা জনবসতি রয়েছে প্রয়োজন হলে সেসব এলাকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা।

বর্তমান শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করার জন্য যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে সেগুলো অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু এগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।

বিশেষ করে আদিবাসীদের সমাজ-বাস্তবতার আলোকে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা- সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, অধিদপ্তর, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ইত্যাদি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের কার্যকর ভূমিকা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা ভাববার অবকাশ তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশে এখনও আদিবাসী শিশুদের নিজেদের ভাষায় পড়ালেখা করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ কার্যকারিতা পায়নি।

ভাষাগত পার্থক্যের কারণে তাই এখনও অনেক আদিবাসী শিশু স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে এবং ভর্তি হওয়া শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি এখনও প্রাথমিক শিক্ষার চক্র শেষ হওয়ার আগেই ঝড়ে পড়ছে। এই দায় আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়।

আধুনিকতম এই রাষ্ট্রীয় দলিল তখনই স্বার্থকতা লাভ করবে, যখন তার প্রতিটি আকাঙ্খা আলোর মুখ দেখবে।

জাতীয় শিক্ষানীতির আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা বিষয়ক নীতিগুলো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য এ বছরের ৪ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক এক সভা আয়োজন করে।

সভায় আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে কর্মরত বাংলাদেশের এনজিওগুলোর নেটওয়ার্ক ‘এমএলই ফোরাম’ থেকে পাঁচজন প্রতিনিধি এই সভায় অংশগ্রহণ করেন। অধিদপ্তরের এই সদর্থক উদ্যোগ আদিবাসী ভাষা ও শিক্ষা বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরকে আশার আলো দেখায়।

এ সভার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ৬ এপ্রিল ফোরামের সচিবালয় গণসাক্ষরতা অভিযানে বিশেষ সভা আহবান করে আশু করণীয় বিষয়গুলোর উপর একটি সুপারিশমালা গ্রহণ করে তা ইমেইলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত গ্রহণ করা হয়।

এমএলই ফোরাম ও আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের মতামতের সাথে মিল রেখে আদিবাসী শিশুদের জন্য কার্যকর শিক্ষা দানের কিছু সুপারিশ নিচে তুলে ধরা হল-
প্রাথমিকভাবে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন।

পর্যায়ক্রমে তা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে। উচ্চ শিক্ষা স্তরেও আদিবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য পরিপূরক হিসেবে অনুরূপ উদ্যোগ থাকতে হবে।

পরিক্ষিত সফল উদাহরণগুলো অনুসরণপূর্বক হরফ বিষয়ক বিতর্কগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠিকেই হরফ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সরকার এবং বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলো কর্তৃক বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে ।

মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষার সাথে কিভাবে সংযোগ ঘটাতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট এবং একক পদ্ধতি শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবি কর্তৃক বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে নির্ধারিত হওয়া দরকার।

এ ক্ষেত্রে এমএলই ফোরামের সুপারিশ হল –
(১) প্রাক-প্রাথমিক স্তরে সম্পূর্ণরূপে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা কাঠামোর আওতায় শিক্ষাক্রম, পুস্তক ও খেলনাসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ উন্নয়ন করতে হবে।

(২) প্রথম শ্রেণীতে মাতৃভাষায় শিক্ষার পাশাপাশি নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য বাংলা পড়ানো হবে। আনুপাতিক হারে মাতৃভাষার প্রাধান্য থাকবে। বাংলা বইয়ে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় শব্দের সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিশব্দের (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ছবিযুক্ত) ওয়ার্ডবুক ও অন্যান্য সহায়ক উপকরণ তৈরী ও সরবরাহ করতে হবে।

(৩) দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে মাতৃভাষা, বাংলা ও ইংরেজীর প্রাধান্যের আনুপাতিক হার হবে প্রথমে মাতৃভাষা, তারপর বাংলা ও পরে ইংরেজী। বাংলা ও ইংরেজী বইয়ে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় শব্দের সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিশব্দের (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ছবিযুক্ত) ওয়ার্ডবুক ও অন্যান্য সহায়ক উপকরণ তৈরী এবং সরবরাহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা ও ইংরেজীর আনুপাতিক হার বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রমের বর্তমান ব্যবস্থাকে সংশোধনের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এনসিটিব কর্তৃক তা করার উদ্যোগ নিতে হবে।

এছাড়া আপাতত চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলন করার আগ পর্যন্ত এই দুইটি শ্রেণীতে সংশ্লিষ্ট আদিবাসীদের প্রচলিত সাহিত্য, কৃষ্টি, জীবন-ধারণ প্রক্রিয়া, লোককথা, লোকজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে মাতৃভাষায় লেখা সহপাঠ পড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পর্যাপ্ত আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ভিত্তিক ভাষা-চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদিবাসী ভাষাভাষী শিক্ষক নিয়োগ ও বদলী করা প্রয়োজন।

এ জন্য প্রয়োজনে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা যেতে পারে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অফিসসমূহে অগ্রাধিকারভিত্তিতে আদিবাসী কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে শিক্ষানীতির সংশ্লিষ্ট বিষয় বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তরান্বিত হতে পারে।

বাংলাদেশের আদিবাসীদের জনসংখ্যা ও তাদের ভাষার পরিস্থিতি বিষয়ক কোন সঠিক পরিসংখ্যান এখনও নেই। তাই তাদের জনসংখ্যা, ভাষা-পরিস্থিতি, হরফের বর্তমান অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি।

আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করার জন্য উপকরণ তৈরী, গবেষণা, পরীবিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে (এনসিটিবি, ডিপিই, পিটিআই ইত্যাদি) ভাষাভিত্তিক পৃথক ইউনিট গঠন করা দরকার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটগুলোকে এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

আদিবাসী ভাষায় শিক্ষা চালু বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে ঐকমত্য সৃষ্টি তথা সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার।

এই প্রক্রিয়ার সাথে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা পর্যায়ে এসব পরিষদের বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ জেলা পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে গৃহিত প্রাথমিক শিক্ষা ও আদিবাসী ভাষা উন্নয়ন সাধনের ক্ষেত্রে সমন্বয় করার জন্য আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। তাদের এই সমন্বয় সাধনের ভূমিকাকে জোরদার করা দরকার।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ বিশেষায়িত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও মেধার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সাথে যৌথভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

বহু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্বেও আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে রয়েছে অনেক ইতিবাচক ও সহায়ক পরিবেশ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনসমূহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, দারিদ্র বিমোচন কৌশল, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি ও জাতীয় শিক্ষানীতির কথা এ ক্ষেত্রে এক নিঃশ্বাসে উল্লেখ করা যায়।

এসব রাষ্ট্রীয় দলিলের অঙ্গীকার এবং বর্তমান সরকারের রূপকল্প ও জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দেশের আদিবাসীসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠির শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।

সময়োচিত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এই লক্ষ্যগুলো অর্জন সম্ভব হবে না। তাই যতদ্রুত আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখিত অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নে সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে, ততই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের পথে।

লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা