পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপরেখা

Jumjournal
Last updated Sep 1st, 2021

4674

featured image

ভূমিকা:

শিক্ষার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি পশ্চাৎপদ অঞ্চল। শিক্ষা-দীক্ষায় এখানকার যারা অগ্রসর হয়েছেন তাদের মাত্র গুটি কয়েকজন এ অঞ্চলের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা-ব্যবস্থাপনা-অবস্থা কিংবা অবস্থান, শিক্ষানীতি, শিক্ষা সমস্যা-সংস্কার,

শিক্ষার ইতিহাস-ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা, প্রকাশ-বিকাশ ঘটিয়েছেন। অথচ শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা প্রচলন ও প্রসার যে কোন রাষ্ট্রে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় ভূমিকা, সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য কার্যাবলীর প্রধান অংশ।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টিকে উপেক্ষার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহৎ অংশ আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী জনগণের জাতিগত বিকাশ হয়নি।

তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অব্যবস্থা, ভাষা ও সংস্কৃতির দুরাবস্থা সব কিছুর মূলে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবর্তিত ও প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা-ব্যবস্থাপনা বহুলাংশে দায়ী।

যেহেতু শিক্ষা মানুষকে সচেতন হতে শেখায়, সাজিয়ে-গুছিয়ে চিন্তা করতে শেখায়, এমনকি কতকগুলো গণতান্ত্রিক বোধের জন্ম দেয়।

পাশাপাশি তার পারিপার্শ্বিক  বৈরিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার চিন্তা চেতনায় তমিশ্রা কাটায় শিক্ষা। কিন্তু এ শিক্ষার ধরণ-ধারণা কি হবে, কি শেখানো হবে, কোন পদ্ধতিতে, কোন ব্যবস্থায় তা আমল (Cognizance) দেয়া দরকার।

এখানে প্রশ্ন আসবে পাঠ্য বিষয় ও বস্তুর, পাঠ্য ভাষার মাধ্যম, বিজ্ঞান সম্মত গণতান্ত্রিকতাবোধ ও বাস্তব জীবন-জীবিকার মান সম্মত শিক্ষা প্রসারের দৃষ্টিও।

তাই প্রয়োজন দুর্গম পশ্চাৎপদ পার্বত্য এলাকার সকল আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে মেয়েদের বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ ব্যবস্থায় শিক্ষা দেবার।

যে শিক্ষার হাতিয়ার দিয়ে আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী মানুষের জীবন যাপনের মান (Life style) উৎকর্ষ সাধন করবে ও জাতিগত বিকাশ এবং প্রকাশের নিজস্ব ক্ষেত্র নিজস্ব ধারা তৈরী করবে, আলো আর অন্ধকারের যে পার্থক্য আছে তা দুরীভূত করবে। অল্প বিশ্বাস-অজ্ঞানতার বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল


শিক্ষা সম্প্রসারণের অতীত ইতিহাস:

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর-বালক-বালিকাদের শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু হয়েছিল অতীতে সাধারণত বৌদ্ধ মন্দিরে। এটা তাদের কাছে কিয়ং বা কেয়াং নামে পরিচিত।

তাই জনবসতিবহুল ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছল প্রতিটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামে কিয়ং বা কেয়াং থাকা মানেই সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্ম চাঞ্চল্য ও সমৃদ্ধতার পরিচয় বহন করে।

পালি ভাষায় প্রাচ্য শিক্ষা (Oriental education) ও বৌদ্ধ ধর্মের নানা শাস্ত্রীয় শিষ্টাচার (Hymn) এই বৌদ্ধ মন্দির গুলোতেই শেখানো হতো বৌদ্ধ পুরোহিত, ভিক্ষু ও শ্রমণ কর্তৃক।

প্রায় ক্ষেত্রে এই বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে অনেকটা আবাসিক স্কুলের মতো বৌদ্ধ মন্দির সংযুক্ত পালিটোল বা আশ্রম স্থাপিত যা গ্রামের স্বচ্ছল ও স্বাবলম্বী বৌদ্ধ উপাসক-উপাসিকাদের আর্থিক সাহায্যপুষ্ট ও পরিচালিত।

অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দির মাত্রই ছিল এক একটি আবাসিক কেন্দ্র। ভিক্ষুদের নির্জনে আধ্যাত্নিক জ্ঞান চর্চার প্রয়োজনে প্রথমে সেইগুলোর উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু ক্রমশঃ তাদের রূপ বদলালো।

পরিবর্তিত হলো শিক্ষা কেন্দ্রে। যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে আসতো শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষা কেন্দ্র কিয়ং-এ প্রবেশের অর্থাৎ ভর্তির নিয়মেও ছিলনা তেমন কঠোরতা।

এখানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীকেও সযত্নে শিক্ষা দেয়া হতো। এসব কিয়ং-এ শিক্ষার্থীরা বিনা বেতনে শিক্ষা নিতো। এমনকি খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে বাসস্থান ও পোষাক-পরিচ্ছদ-বিছানাপত্র সব কিছুই ছিল বিনা খরচায়।

ধর্মপ্রবণতা, উদারতা ও সহনশীলতা পার্বত্যবাসীদের চরিত্রে একটি বিশেষ গুণ। সৎ কাজে শ্রম দেয়া-দান করা-সেবা যত্ন নেয়া ও একে অপরকে সহযোগীতা করা এসব গুণের পরিচয় ভুরি-ভুরি মেলে তৎকালীন পার্বত্য এলাকায়।

আদিবাসী জনগোষ্ঠী পরিবারের প্রধান, গৃহকর্তার মৃত্যুর পর পরিবারের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, অস্থাবর সম্পত্তির সিংহভাগ অংশ এই বৌদ্ধ মন্দির কিয়ং এ অকপটে দান করে দেয়া হতো।

অনেক সময় রাজা কিংবা হেডম্যান, কারবারী, রোওয়াজা, ফাইনসী, তালুকদার, গ্রামের মোড়লগণ মিলেমিশে এ গুলোর ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতেন। এজন্য পঠণ-পাঠণ, ভরণ-পোষণ কোন দিক দিয়ে অসুবিধা হতোনা।

সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি চলতো বিশেষ বিশেষ বিষয়ের শিক্ষাদান। এরূপ বৌদ্ধ মন্দির কিয়ং এর মধ্যে চিৎমরম বৌদ্ধ বিহার, মহামুনি বৌদ্ধ বিহার, রোয়াংছড়ি বৌদ্ধ বিহার, রাজস্থলী বৌদ্ধ বিহার জনসাধারণের দৃষ্টি বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে।

এদিকে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বত্র এ ধরণের বৌদ্ধ বিহার সংযুক্ত পালিটোল শিক্ষাকেন্দ্রের অস্তিত্বের সংখ্যা ছিল ২০টি।

অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব শিক্ষাকেন্দ্রে শুধু ধর্মশিক্ষা (Hymn) শেখা হতো তা নয়, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ব্যবহারিক ও প্রাত্যহিক কাজ কর্মে-কায়িক শ্রমও দিতে হতো।

হাতে-কলমে কাঠের কারিগরী কাজ হতে শুরু করে কৃষি ক্ষেত খামার বাগান পরিচর্যার কাজেও পারদর্শীতা অর্জন করার সুযোগ ছিল।

এখানে মারমা ভাষার অক্ষর জ্ঞান শেখা সহ ভেষজ চিকিৎসা (Herbal treatment) শাস্ত্র, গ্রহ নক্ষত্রের পরিচিতি সমেত জ্যোতিঃশাস্ত্র (Astrology), কৃষি শিক্ষা, গণনা-শিল্প-স্থাপত্য, নির্মাণ কৌশল ও কাঠের কারিগরী শিক্ষা পর্যন্ত প্রবর্তিত ছিল।

এ ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন ছিল ষোড়শ ও সতের শতকের অর্থাৎ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পূর্ব যুগে।

মুখে মুখে ও বংশ পরম্পরায় এ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যম হলেও এসব শিক্ষা দীক্ষার প্রভাব বিস্তৃত ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে সুদূর প্রসারী এক Homogeneous Customary তে একাত্ন হয়ে।

এসব শিক্ষা কেন্দ্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থী মনোযোগ সহকারে পাঠোভ্যাস করতেন, তাদের সামনে প্রদীপ জ্বলতো, এই প্রদীপের আলোতে প্রতিফলিত হতো তাদের স্নিদ্ধ, কর্মঠ, সহজ সরল ও হাস্যোজ্বল জীবন চিত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়ে


আধুনিক শিক্ষার সূচনা: 

পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষার সূচনা মূলতঃ মোঘল আমল পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনামলে এবং তাও ছিল প্রধানত সমাজের উঁচু শ্রেণী বিত্তবান, সম্পদশালী রাজ পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এসব শিক্ষা সাধারণ মানুষের জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং এ আধুনিক শিক্ষা সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে সামাজিক শ্রেণী বিন্যাসের উত্তরণ ঘটিয়েছিল।

সাধারণ মানুষের ছেলে মেয়েদের পক্ষে এসব শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ মোটেই ছিলনা বলা যায়।

কিয়ং এর শিক্ষা পাঠ শেষে কিংবা একটু বয়স বাড়লে এদের দূরবর্তী বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যমের প্রাইমারী বা মিডল এন্ট্রান্স স্কুলে শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ থাকে না।

মূলতঃ ভাষাগত পার্থক্য, শিক্ষা ব্যবস্থাপনার তারতম্য ও ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ এদের পক্ষে খুবই কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠে।

এছাড়া পশ্চাৎপদ ও দুর্গম প্রত্যন্ত এই পার্বত্য জনপদে প্রতিষ্ঠিত স্কুল গুলোর লেখাপড়ার মান এতই অবনতিশীল যে, যা রয়েছে তা দিয়ে প্রাইমারী স্কুলের চৌকাঠ পার হবারও এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনা।

তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম মাত্রই এক একটা আধুনিক শিক্ষা বঞ্চিত জনপদ।

এ সমস্ত কারণে দেশে একান্ত অপরিহার্য বাংলা ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষা এদের জন্য সুদূর পরাহত।

তবুও এই অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক বিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়ে ছিলো একমাত্র সমতলবাসী বাঙালীদের সাথে ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি উৎপাদিত কৃষি পণ্য দ্রব্য ও লৌহজাত শিল্প আদান প্রদানের জন্য।

এভাবে ধীরে ধীরে কালক্রমে একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণের জন্য উৎসাহী হতে দেখা যায়।

সমগ্র এলাকায় আদিবাসী সমূহ পরস্পর থেকে বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস ও বিশেষ কোন প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর শাসন ব্যবস্থা ছিল না বলে তাদের বিশেষ কোন ভাষা Lingua Franca এর রূপ ধারণ করেনি।

তবুও এই অঞ্চলে যখন ব্রিটিশ আমলে শাসন ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে উঠে অর্থাৎ ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম Regulation প্রণয়ন করে তখন থেকে এখানে কিছু সংখ্যক মধ্যবিত্ত আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদেরকে ইংরেজী ও বাংলার মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের উদ্যোগী হতে দেখা যায়।

ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণের কাছে আধুনিক শিক্ষা বিস্তৃতি না হবার অন্যতম ও মূল কারণ শিক্ষার সুযোগ সুবিধার অভাব।

কিছু সংখ্যক সৌভাগ্যবান আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠির ছেলে মেয়ের আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েও অধিকাংশ ছেলে মেয়ের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে বাড়ি থেকে বহুদূরে ভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়াশুনা এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।

অতএব স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে তৃণমূল পর্যায়ে আধুনিক শিক্ষা বিস্তার লাভ করতে পারেনি। মূলতঃ সামন্তপ্রভূ ও গুটিকয়েক আভিজাত পরিবারের মধ্যে এ আধুনিক শিক্ষার সুযোগ সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।


শিক্ষাবোর্ড গঠন ও পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার উত্তরণ:

চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জন্য একটি স্বতন্ত্র ও আলাদা শিক্ষা বোর্ড গঠন করে।

এই শিক্ষা বোর্ডে শিক্ষা ব্যবস্থা সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে এই কমিটিতে তিন সার্কেলের প্রধান তিন রাজা বাহাদুর, রাজাদের অধীনস্থ তিন হেডম্যান ও একজন Bapitist Christian Missionary এর Sister সহ ৭ সদস্য ভূক্ত অংশগ্রহণ মূলক জন প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ কমিটি সদস্যবর্গের প্রচেষ্টায় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত গুটি কয়েক জনহিতৈষী সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তাগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পাশ্চাত্য আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের জন্য প্রাথমিক স্তরে কয়েকটি বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হন। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে মিডল ইংলিশ স্কুল ও ইংরেজী হাই স্কুল স্থাপন করে।

এসব স্কুলে প্রাথমিক ভাবে আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজীর পাশাপাশি চাকমা ও মারমা ভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলন রাখা হয় এবং সীমিত সংখ্যক আসনের হলেও দূরদূরান্ত থেকে আগত আদিবাসী পাহাড়ী ছাত্রদের জন্য বিনা খরচায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

এ ধরণের সরকারী বোর্ডিং স্কুলের মধ্যে চন্দ্রঘোনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাঙ্গামাটিতে মিডল ইংলিশ স্কুল উল্লেখযোগ্য।

মূলতঃ ব্রিটিশ রাজত্বকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে মাত্র ১০টি এ ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক বোর্ডিং স্কুল ছিল বলে জানা যায়।

পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, সাধারণ বিজ্ঞান ও ধর্ম বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এ আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র শতকরা ৪.১ জনের মতো, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ নগণ্য শিক্ষিতের হার শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলে, হয়তো এই অর্ধশতকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হার অন্ততঃপক্ষে ৪১ শতাংশে উন্নীত হতে পারতো।


অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন: 

ব্রিটিশ রাজত্বের পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের আধুনিক শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে আমুল পরিবর্তন ঘটে।

এককালীন উপনিবেশিক পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার D.K. Power এর নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করে।

তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিল্প কারখানায় শ্রম যোগান ও সরকারকে প্রশাসনিক কাজে সহায়তার লক্ষ্যে স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা।

এই উপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কাঠামো গড়ে তোলা হলেও স্থানীয় জনগণের জীবন ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বাস্তব মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পারেনি।

তবুও এ অবৈতনিক শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে Bilingual ভিত্তিক একে অপরের ভাব বিনিময় তথা মানবিক প্রকাশ বিকাশের যোগাযোগ মাধ্যম অগ্রগতি লাভ করে।

তাছাড়া কাপ্তাই বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্যে জীবিকার বিকল্প হিসাবে শিক্ষাকে পুঁজি হিসাবে বেছে নিয়ে ব্যাপক শিক্ষা সচেতনতা সৃষ্টি করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে গড়ে উঠে প্রচুর অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল। গড়ে উঠে কারিগরি ও পেশা বৃত্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

যেমন – পাক সুইডিশ ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজি, রাঙ্গামাটি নার্সিং ট্রেনিং সেন্টার, প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট, নারানগিরি কৃষি পাইলট হাই স্কুল, টাইপ রাইটিং, কার্পেন্টারী, ওয়েল্ডিং যুব ইত্যাদি।

পাকিস্তান আমলের প্রথম সিকি শতাব্দীকাল পর্যন্ত এখানে প্রায় ৩৯১টি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল, ১১টি হাই স্কুল ও ১টি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ গড়ে উঠে।

এই অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সূচনা এবং এটিই এই অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

কাপ্তাই বাঁধের পরবর্তী অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত হার ১৮.২ শতাংশ বৃদ্ধি লাভ করে।

তাছাড়া খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচেষ্টায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃতি ঘটে। ফলে আদিবাসীরা নূতন জীবন নূতন দৃষ্টিতে আত্মসচেতন হয়ে উঠে।

পাশাপাশি পেশা-বৃত্তিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈচিত্র্য আসে। পেশা পরিবর্তন, অবস্থান পরিবর্তন, জীবনবোধের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্ম উন্নয়নের স্পৃহা জাগরিত হয়ে থাকে।

জীবনের সকল সমস্যাকে বাস্তবতার নিরীক্ষে বিচার করে দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলার সৎ সাহস সঞ্চারিত হয়ে বিজ্ঞান সম্মত যুগোপযোগী বাস্তব ও জীবনমুখী উচ্চ শিক্ষা লাভের অদম্য উৎসাহ জেগে উঠে।

এই অর্জিত বাস্তবতা (Obtained reality) পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের ফলশ্রুতি।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্কুলের প্রাত্যহিক সমাবেশ


স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় শিক্ষানীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি ও প্রতিবন্ধকতা: 

পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার অবস্থা বাংলাদেশের অপরাপর এলাকার তুলনায় অত্যন্ত শোচনীয়। দুর্গম জনপদ, ভৌগোলিক অবস্থা, যোগাযোগের অব্যবস্থা, ভিন্ন সাংস্কৃতিক সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক, প্রতিকূল জীবন ধারায় প্রবাহিত পার্বত্য জনজীবন।

অধিকন্তু বিগত আড়াই দশক ধরে সংঘাতময় পরিস্থিতি এই অঞ্চলে শিক্ষার ব্যবস্থা নানাভাবে ব্যাহত।

বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা নীতি অনুসারে এখানে সরকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় ছাত্র-ছাত্রীর অভাব, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গ্রামগুলো বিক্ষিপ্ত (Scattered) অবস্থায় (বিরাজমান) থাকা এবং শিক্ষকের অপ্রতুলতা, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি প্রতিকুলতা কারণে এখানে সরকারী পর্যায়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

তাছাড়া, পার্বত্য এলাকার স্কুলগুলোতে পাঠদান পদ্ধতি, মেধাবী শিক্ষকের অপ্রতুলতা, নিম্ন মানের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত পরিদর্শনের অভাব, বৈষম্য মূলক শিক্ষা ব্যবস্থা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার অভাব, শিক্ষার্থীর অভিভাবকের দারিদ্রতা, উচ্চতর শিক্ষায় ত্রুটিপূর্ণ কোটা ব্যবস্থাপনা ও মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ অনুপস্থিতির কারণে এখানকার শিক্ষার মান ক্রমশ অবনতি হচ্ছে।

১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে জরীপকৃত আদমশুমারীর রিপোর্ট ও জেলা পরিসংখ্যান রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখলে এ অঞ্চলের শিক্ষার মান, স্কুলের সংখ্যা ও স্কুল ত্যাগী বা Drop out ছেলেমেয়েদের হার সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।

আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার বিস্তৃতি না হবার ফলে শিক্ষার সুযোগ সুবিধাদি থেকেও বঞ্চিত। অধিকাংশ আদিবাসী পাহাড়ী ছেলে মেয়ে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে বাড়ি থেকে বহুদূরে মহানগরের ভিন্ন পরিবেশে থাকা খাওয়ার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়াশুনা করা এদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।

সাম্প্রতিককালে পার্বত্য অঞ্চলে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা ও ভর্তির সমস্যার আবর্তে সে সুযোগও ব্যাপকভাবে গ্রহণীয় হয়নি।

এমনকি এসব এলাকায় প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজ গুলোতে শিক্ষার মান এতই নিম্নস্তরের যে উচ্চতর শিক্ষার জন্য প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মতো যোগ্যতাও এদের হয়ে উঠেনা।

শিক্ষার বঞ্চনা, অফিস-আদালতে বিড়ম্বনা, ব্যবহৃত ভাষা, নিয়ম কানুন, রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা আদিবাসী (নৃ-জনগোষ্ঠী) ছেলেমেয়েদের শিক্ষার প্রতি বিমুখ ও পশ্চাৎমুখী করে রেখেছে।

এ পশ্চাৎপদতার কারণে শিক্ষাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের কাছে অর্থবহ করে তুলতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।


মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের যৌক্তিকতা:

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা কারিকুলাম মূলতঃ বাংলাভাষী শিশুদের জন্যই রচিত এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয় বস্তত মুসলিম সাম্প্রতিক পরিমণ্ডলকে নিয়ে বিরচিত হওয়ায় বাঙালী শিশুদের জন্যই বেশী উপযোগী।

তবুও এটা বাস্তব সত্য যে বিভিন্ন জরিপ ও পরিসংখ্যান রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে শুধু ১ম শ্রেণী থেকেই শতকরা অন্তত ৩০ জন শিশু স্কুল ত্যাগ করে।

অর্থাৎ স্কুল ত্যাগী এই Drop out percentage এই সংখ্যায় প্রমাণ করে আমাদের দেশে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পাঠের বিষয়বস্তু ও পাঠদান পদ্ধতি আমাদের দেশের শিশুর মনমানসিকতাকে আকর্ষণ করতে পারছে না।

কাজেই মাতৃভাষা ভিন্ন স্বীয় সংস্কৃতি বিবর্জিত শিক্ষা নিতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদিবাসীর (নৃ-জনগোষ্ঠী) শিশুদের অবস্থা কত শোচনীয়তা শতকরা হিসাবে Statistical data আকারে প্রকাশের অবকাশ থাকে না।

এছাড়া আমাদের পার্বত্য এলাকার আদিবাসী শিশুদের বাংলা ভাষার মাধ্যমেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু করতে হয়।

ফলে মাতৃভাষার সাথে তারতম্যের কারণে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা গ্রহণের যে সব সমস্যার সৃষ্টি হয় তার Basic Knowledge হেরফেরের কারণে এমনকি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব বিস্তৃত।

কেননা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষায় ভাষাগত দুর্বলতার কারণে শিক্ষায় দুর্বল ভিত্তি গড়ে উঠে। এটি নিঃসন্দেহে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অন্যতম প্রায়োগিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

অথচ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষার বিষয়বস্তু আরো সহজে বোধগম্য হবে।

এতে শিক্ষার্থীর সহজাত বুদ্ধি, মৌলিক চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির বিকাশ সাধন সহজতর হবে।

এটা বাস্তব সত্য যে, ইংরেজী ভাষা শিক্ষা সামগ্রিকভাবে যেমন এদেশবাসী সকলের জন্যই কষ্টসাধ্য, তেমনি বাংলাভাষা শিক্ষাও আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের বেলায় কোনরূপ অনায়াসলব্ধ বিষয় নয়।

কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীদের ইংরেজী ভাষা জ্ঞানের যেরূপ শোচনীয় অগ্রগতি ঠিক তেমনি এদেশের আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদেরও আলোচ্য সংকট সম্পর্কে ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

এই ভাষাগত ব্যবধান ও বাধার কারণেও আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা-দীক্ষাসহ অফিস আদালতে ও জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে প্রচন্ড বেগ পেতে হয়।

মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব অনুধাবন করে আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে এদের নিজ নিজ ভাষায় লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে তো বটেই।

এ ব্যাপারে International Labour Organization ৪০ তম অধিবেশন Convention 107 এর ২৩(১) ধারায়ও সুস্পষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে যে, আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠী শিশুদেরকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান করার।

এদিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তির (খ) অনুচ্ছেদের ৩৩নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলনের বিষয়টিকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে।

এখানে আরও একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, শুধুমাত্র প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রচলন করলে হবে না।

আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীভূক্ত ভাষাসমূহকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করতে হবে।

আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার অফিস আদালতে, কোর্ট কাচারীতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিচর্চা কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে হলেও এ ভাষাকে কার্যকরী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। তা হলেই আদিবাসী ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটবে, আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারবে।

শিক্ষা বিস্তারের দিকে তাকিয়েই শুধু মাতৃভাষায় শিক্ষার কাজ করণীয় তা না। আদিবাসীদের সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করতে হবে, তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ব্যাপারে সাফল্যসূচিত অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় পদক্ষেপ সমূহের অভিজ্ঞতার থেকেও আমরা সুশিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

এখানে আরও একটি বিষয়ে বলে রাখা দরকার, সচরাচর যে সব দেশে শোষণ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান সেখানে নিজ নিজ মাতৃভাষা ভিত্তিক লেখাপড়া করার ব্যবস্থা প্রচলন স্বীকার করেনা।

ভাষার মর্যাদা কিংবা স্বীকৃতির প্রশ্নই আসেনা, গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠী কখনো এসব চিন্তা ভাবনা করবে না। করতে হবে আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশের জনগণকে।


প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ মালা:

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার্থে অভিন্ন সামগ্রিক বিধি ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। তবুও বাস্তবতার নিরীক্ষে ভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ মন্ডলে ও ভিন্ন অবস্থানগত কারণে তথা ব্যতিক্রম ক্ষেত্র বিশেষে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জাতীয় সংগতি এবং সমন্বিত অগ্রগতির স্বপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের অন্তরায় ক্ষেত্রসমূহকেও যথাযথ বিবেচনায় এনে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অন্তত শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো আবশ্যক।

আদিবাসী (নৃ-জনগোষ্ঠী) মানুষের চিন্তা চেতনা, ভাব বিনিময়, জীবন যাপনের মান সবকিছু উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রয়োজন মূলতঃ শিক্ষার বিস্তৃতি।

যে শিক্ষা আদিবাসী জনগণের চিন্তার তমিশ্রা কাটাবে। এতে এদের মধ্যে হিংসাত্নক ও হীন মনমানসিকতা দূরীভূত হয়ে সম-মনোভাবাপন্ন হতে সহায়তা করবে এবং সর্বোপরি জাতীয়তার উন্মেষ ও ঐক্যগঠনের মনোভাব বিকাশেও বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

অতএব দৃষ্টি কোণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অতীব জরুরী। কিভাবে হবে তাই ভাবতে হবে। ইতিপূর্বে শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের চিন্তা চেতনা সম্প্রসারণ করতে হবে।

প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ বিবেচনায় সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।

হতে পারে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ননীতি সুনির্ধারণকল্পে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একটি বিশেষ শিক্ষা কমিশন কিংবা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা, আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠী ছেলে মেয়েদের জন্য প্রতিটি থানা পর্যায়ে অন্তত একটি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক কারিগরি ও পেশাবৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সংযুক্ত আবাসিক হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা,

শিক্ষা বিমুখ নৃ-জনগোষ্ঠী শিশুদের দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা, আদিবাসী ছেলে মেয়েদের আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে তাদের মাতৃভাষাসহ আকর্ষণীয় ভিত্তিতে ও প্রয়োজনে সেখানে নিয়োগ দানের শর্ত শিথিল করে সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের মধ্য থেকে শিক্ষক নিয়োগ দান করা,

আদিবাসী জনগোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম কিংবা শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচী কিংবা উপার্জনমূলক আধুনিক কৃষি শিক্ষা কর্মসূচী প্রনয়ণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান, আদিবাসী শিক্ষা কর্মসূচীকে সফল করার লক্ষ্যে B. Ed পর্যায়ে বিশেষ শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের উচ্চতর শিক্ষার পথ সুগম করার লক্ষ্যে প্রচলিত কোটা বৃদ্ধি, ভর্তির সঠিক নীতিমালা প্রনয়ণ ও শিক্ষা ঋণ ব্যবস্থা প্রচলন করা।

আর এসব সংস্কারের কর্মসূচী গৃহীত হলেই শিক্ষা বঞ্চিত এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভিত রচিত হতে পারে।


উপসংহার:

জাতীয় উন্নয়নের ধারা সর্বস্তরে শ্লোগান একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখী পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১২টি ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বদৌলতে আজ এরাও বেঁচে থাকার জন্যে ছটফট করছে।

আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মত ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশল, সম্বলিত জীবন যাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আগামী প্রজন্মকে কিভাবে নতুন সুখের আলো দেখাবে, বর্তমান প্রজন্মকে কিভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপনের পথ দেখাবে, তারই সমস্যাসংকুল চিন্তায় চিন্তিত পর্বতমূখী আদিবাসী সমাজ।

পথের নিশানা সে সমাজের হাতের নাগালে নেই, তবুও পরস্পরের প্রতি সহযোগীতা, সহমর্মিতা ও সৎবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর সভ্য মানব সমাজ যেন তাদের বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে আসে।

সচরাচর একটা জনগোষ্ঠী যেভাবে যে পর্যায়ে জাতিগত সুযোগ সুবিধার উপাদান গুলো অর্জন করে থাকে আনায়াসে ঠিক সে পর্যায়ে যাতে এসব পিছিয়ে পড়া আদিবাসী নৃ-জনগোষ্ঠীভূক্ত মানুষের জীবন যাপনের মান উৎকর্ষ সাধন ঘটে।

এতে তাদের মধ্যে নাগরিক বোধ গড়ে উঠবে, রাষ্ট্রীয় সামগ্রিক কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে এরাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।


লেখক: মংক্যশোয়েনু নেভী


তথ্যসূত্র:

১। Bangladesh District Gazatteers – Chittagong Hill Tracts. Editor- Muhamad Ishaqe. Dhaka 1972.
২। Tagazjyoti, Buddha Jayanti Annual. Editor-Hemendra Bikash Chowdhury. Calcutta. 1985.
৩। District Statistic- Chittagong Hill Tracts. 1986- Bangladesh Bureau of Statistics.
৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি শিক্ষা – সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী: অংশীদারিত্বের নতূন দিগন্ত সম্পাদনা – হাফিজ রশিদ খান, বান্দরবান – ১৯৯৩
৫। Government needs to reform primary education policy for mirorities. By-Dr. A.H.M. Zehadul Karim, Dhaka Courier, Vol.10, Issue-3, 20 August, 1993.
৬। বাংলাদেশের শিক্ষা মাধ্যম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সমাজ সাংগু, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, শৈঅংপ্রু, বান্দরবান, ১৯৯৪।
৭। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসীদের স্ব-স্ব ভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব – হেমল দেওয়ান, জুমঈসথেটিকস কাউন্সিল, রাংগামাটি, ১৯৯৮।
৮। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা: স্বরূপ ও সংস্কার – মঙ্গল কুমার চাকমা
৯। Forum for Environment and Sustainable Development in the Chittagong Hill Tracts, Rangamati, 1998.

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা