আমার দেখা এক কীর্তিমান পুরুষ শ্ৰী নােয়ারাম তঞ্চংগ্যা কার্বারী
774
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে পাক-ভারত উপমহাদেশে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসন চলছিল অত্র পার্বত্যাঞ্চলেও তার আওতার বহির্ভূত ছিল না। সেই সময়ে এখানকার বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলাের স্পর্শে আসা তাে দূরের কথা শতকরা ৮০-৯০ জনই ছিল অশিক্ষিত।
ইতিহাস পাঠে বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে জানা যায় যে, তখনকার দিনে বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা ছিল সামান্যতম ব্যবসা কেন্দ্র মাত্র। শহরের মধ্যে হাতে গােনা গুটি কয়েক শিক্ষিত লােকের বাস।
শতকরা পাঁচ কি দশ জন লােক শিক্ষিত ছিল কিনা সন্দেহ। আর বর্তমান তিন পার্বত্য জেলার সম্মিলিত নাম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে সভ্যতা বলতে কি জিনিস? তা বুঝে উঠার কোনাে অবকাশ ছিল না।
অত্র তিন পার্বত্য জেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তন্চংগ্যা, বম, পাংখােয়া, লুসাই, ম্রো, চাক, খুমী ইত্যাদি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর লােকের বসবাসের জায়গা ছিল। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অত্র পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর লােকেদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা আস্তে আস্তে প্রসারিত হতে থাকে।
বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মধ্যেও শিক্ষার আলাে ছড়াতে আরম্ভ করে। চট্টগ্রামে গুটিকয়েক ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য ও ইসলামিক সুফি-সাধকগণের আনাগােনা এবং পরবর্তীতে তাদের অনুসারীগণের আগমনে ফারসি, আরবি ভাষাভাষীদের ন্যায় বাংলার আদিরূপ পালি, সংস্কৃত ও পরবর্তীতে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা হতে থাকে। যেহেতু বাংলার নবাবগণ ঢাকা কেন্দ্রিক রাজ কার্যাদি সম্পাদন করতেন।
কেবল ঢাকাতেই শিক্ষিত লােকের হার তুলনামূলক ভাবে বেশি ছিল। এদিকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে পরবর্তীতে ফেনী, নােয়াখালী হয়ে কুমিল্লা জেলা পর্যন্ত শিক্ষার প্রসারতা লাভ করে। ১৮৬০ সনের পূর্বে বর্তমান কুমিল্লা জেলা এবং তদসংলগ্ন জায়গার নাম ছিল ত্রিপুরা জেলা । অবশ্য তা ছিল ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের আগে, অর্থাৎ ভারতপাকিস্তান বিভক্তের ও আগের কথা।
আসল কথায় আসা যাক- অজ আমি যাঁর সম্পর্কে লিখছি তিনি হলেন শ্রী নোয়ারাম তন্চংগ্যা (কার্বারী), সম্পর্কে আমার ‘তালই ’ হন। আমার দাদার শ্বশুর মহাশয়। বুঝতে পারছেন সম্পর্কে তালই- পুতরা সম্পর্ক।
সেই ইংরেজীতে যখন বৌদি ‘শান্তিকা’ আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে আসলেন তখন থেকেই তালই শ্রী নোয়ারাম বাবুর পরিবারের সাথে উটা-বসা শুরু হয়। তালই এই পরিবারে তালই মাউই, বড় ছেলে, বড় ছেলের বউ, মেজ ছেলে, মেজ ছেলের বউ, দুই ছোট ছেলে ও সবার কনিষ্ঠ এক মেয়ে, নাম রেনুকা। আর বড় ছেলে ঘরের নাত-নাতনীরা সবাই মিলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। অবশ্যই এই তথ্য পরিচিতি হওয়ার পর জেনেছিলাম।
১৯৬৪ ইংরেজীতে বৌদি বউ হয়ে আসার পর বিষু উপলক্ষ্যে বেড়াতে যাবার সময় অমি ও দাদা – বৌদিদের সঙ্গে গেলাম। সঙ্গে আমার একমাত্র দিদি ; চাচাতাে বােনও গেলেন। আমি তখন হাফ পেন্ট পরা চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ।
নতুন জায়গা নতুন পাড়ায় যেহেতু গিয়েছি লজ্জা-লজ্জা ভাব। অচেনা অপরিচিত জন, কিছু সংকোচ ভাব আমার মনের মধ্যে কাজ করছিল। দেখা হলাে বয়সে সবচেয়ে ছােট তালত ভাই অজিত কুমার তন্চংগ্যার সাথে। সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।
চন্দ্রঘােনা ব্যাপটিস্ট মিশন জুনিয়র হাই স্কুলের বাের্ডিং স্কুলে পড়তাে। তার সাথে দেখা হওয়ায় আমার তখন খুব লজ্জা লাগছিল। বিরাট একান্নবর্তী পরিবার। দুই দিন থাকার পর বুঝতে দেরি হল না যে, তালই এর পারিবারিক অবস্থা তৈতম্বুর! কে পরিবারের সদস্য, কে কাজের লােক চেনার কোনাে উপায় ছিল না। খেতে বসলেই বুঝা গেল পরিবারের সদস্য-সদস্যার সংখ্যা কত।
এর আগে প্রথম দিন বুঝতে পারি নাই যে, পরিবারটি কত বড় ! পরিবারের পুরুষ সদস্য ও কাজের লােকদের সাথে বারান্দায় তালই- মাউই ও খেতে বসেছিলেন। আর অন্দর মহলে তথা রান্নাঘরে খাওয়ায় বসে ছিলাম পরিবারের বউ-ঝি ও কাজের মহিলা সদস্যারা । আমার এখনও এ দৃশ্য চোখে ভেসে আসে।
প্রথম দিন তত কিছু খেয়াল করিনি। দ্বিতীয় দিন খেয়াল করলাম অতিথি ও পরিবারের সদস্য-সদস্যারা সহ সম্মিলিত ভাবে খাওয়ার আয়ােজন হয়।। আদরের দেবর ছিলাম কিনা বৌদির অনুরােধে আমার খাবার ব্যবস্থা হল অন্দর মহলে মহিলা সদস্যাদের সাথে।
খাওয়ার আগে মনে মনে লােকসংখ্যা গণনা শুরু করলাম দেখলাম বারান্দায় কসার থালার সংখ্যা ১২টা, আর ১০/১২টা কাসার বাটিতে নানান প্রকারের তরি-তরকারি। আর অন্দর মহলে কাসার থালায় ভাত বাড়া হয়েছে ১২টা, সঙ্গে তরকারির বাটি ১০/১২টা। কাসার থালাগুলাে দেখতে ঝিক ঝিক করছিল।
মনে মনে ভাবছিলাম তালই এর পরিবারটা আসলে স্বচ্ছল! আমরা যারা অতিথি ছিলাম তাদের থালাগুলাে রাখা হয়েছে ১০/১২ ইঞ্চি উচু ‘ভােজন বেড়ে’। আধুনিক যুগের ছেলে-মেয়েরা “ভােজন বেড় ” চিনবে না। ভােজন বেড় হল বিশেষ আসন; যাতে খাবারের থালা অনায়াসে রাখা যায় এবং খাওয়ার সুবিধাজনক বিশেষ আসন।
সম্মানিত বা অতি প্রিয় অতিথি আসলে আপ্যায়নে ব্যবহৃত হতাে। লজ্জা পেলেও সত্যি বলতে কি আমি কিন্তু দম্ভর মতন থত্ মত্ খেয়ে গিয়েছিলাম- এ আয়ােজন দেখে। যেহেতু এক মাসে বসে একটা বড় পরিবার যে কি ভাবে চলে এটাই আমার প্রখম ধারণা। কেউ আগে খাবে, কেউ পরে খাবে- এ হবে না! এ হবে না! – শ্লোগানের মত এই পরিবারের মূল মন্ত্র।
পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে তালই এর। দক্ষতা, সাম্যের নৈতিকতা ভরা নীতি আমার খুবই আশ্চর্য লাগলাে। এতোগুলাে লােকের খাওয়ার আয়ােজন! দেখে মনে হলাে কোন মেলায় খাওয়া-দাওয়া করছি। ছােট হলেও বুঝলাম পরিবারটার একটা আলাদা সৌন্দর্য বৈশিষ্ট্য আছে। একত্রে ২৪ জন লােকে এক সাথে খেলাম কোন উচ্ছ বাচ্য নেই, নেই কোন হৈ-হুল্লোড়! ছিল না কোন কাজের মেয়ের বা লােকের হাতে কাসার প্লেটের ধােয়া বা নাড়ার ঝন্ -ঝনানি শব্দ।
আজ ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে তখনকার দিনে যেখানে শতকরা ৯০ জন লােকই অশিক্ষিত ; সেই ১৯৬৪ সন হতে অদ্যাবধি প্রায় ৫১ বৎসর আগে তালই এর পরিবারিক অবস্থা সাক্ষ্য দেয় ১৯৬০ ইংরেজিতে কাপ্তাই বাঁধের আগে এ অঞ্চলের স্বচ্ছল পরিবারগুলাের পারিবারিক জীবন মান কেমন ছিল।
তালই পরিবারের মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে শিক্ষিত না হলেও আচার-আচরণে শিক্ষিত। ঐ পরিবারে দেখেছিলাম তখনকার দিনেও ৩ ব্যান্ড রেডিও- চেঞ্জার, গ্রামােফোন হারমােনিয়াম, তবলা, অঞ্জন ইত্যাদি ইত্যাদি ছিল। পারিবারিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল ঐতিহ্যবাহী। প্রতি পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ সঙ্গীত গাওয়া হতাে গ্রামবাসী যুবকরা মিলে আর আবালবৃদ্ধ বনিতারা তা শ্রবণ করতাে। বেড়াতে গেলে আমিও তাদের দলে যােগ দিতাম, বুদ্ধ কীর্তনে ।
আমার এ পরিবারের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ১৯৬৪ ইংরেজি সন থেকে ১৯৯৭ ইংরেজি পর্যন্ত তালই এর মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ বৎসরের মধ্যে সময়ে সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে তার সান্নিধ্যে আসার সুযােগ হয়েছিল।
ভারতে আশ্চর্য লাগে একটা জুমিয়া পরিবারের তখনকার দিনের তৈতম্বুর সম্পন্ন অবস্থা সম-সাময়িক কালে দুই-চারশত পরিবারের মধ্যে দেখা মেলা ভার। তিনি খুবই হাসি-খুশি স্বভাবের ও মিশুক প্রকৃতির লােক ছিলেন। বেড়াতে গেলে খেয়াল করতাম উনি যা কিছু বলছেন যেন বলার পরও শেষ হচ্ছে না; কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হতাে “তারপর?” অর্থাৎ শেষ হয়েও যেন গল্পের শেষ হতাে না; কথাগুলাের মধ্যে যেন যাদুকরীর ছোঁয়া ও আকর্ষণ তৈরী করতেন।
কথাগুলাের মধ্যে ছিল ছন্দ; যেন কথার মালা। শত গল্পের মধ্যে ও শ্রোতার বিরক্তি বােধ হতাে না। আসলে খুব স্বল্প শিক্ষিত হয়েও বাংলায় যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন, কথায় কথায় বাক্ধারা, উপকথা, প্রবাদ-প্রবচন আওড়াতেন। কথায় কথায় ভারত-রামায়ণ প্রসঙ্গ তুলতেন; আর ব্যাখ্যা দিতেন।
বলতে গিয়ে যদি দেখেন শ্রোতার মনােযােগ নেই তখন “থাক” সে কথা বলে একটু রসপূর্ণ হাসি দিতেন। শ্রোতা বুঝতে পারতেন না যে তাঁর অমনােযােগিতার কারণেই তিনি কথা বন্ধ করে দিয়েছেন। ভারত রামায়ণের তত্ত্ব কথা, গীতা, পুঁথি, পাঁচালী পাঠেও ছিলেন বড় পটু।
একজন ব্রাহ্মহিন্দু ধর্মশাস্ত্র বিশারদ ও জন্ম কুষ্ঠি গণনা করে আমাকে দেখাতেন। তিনি কত বৎসর বাঁচবেন, কখন কার শনি দশা, কার বৃহস্পতি প্রভৃতি বিষয়েও বলতেন। কথায় কথায় খনার বচন, চানৈক্য এর শ্লোক, গােপাল ভাঁরের হাসির গল্প হুবহু উদ্ধৃতি করতেন। শুনলেই মনে হতাে না যে, তিনি কেবল বাল্যশিক্ষা পাস করা কোন ব্যক্তি।
তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য দেখে আমি বিমােহিত হয়ে যেতাম আর মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে হা করে কেবল শুনতাম আর শুনতাম। আমার জানা মতে তিনি কেবল বাল্যশিক্ষা পাস শেষ করেছেন। তার কখনও বাচনভঙ্গি উচ্চারণ মনে হতাে না যে তিনি স্বল্প শিক্ষিত। আসলে তিনি ছিলেন একজন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি। তিনি প্রচুর বই-পুস্তক পড়তেন । বিভিন্ন বই পড়ে পড়ে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। রতি শাস্ত্র সম্পৰ্কীয় প্রচুর জ্ঞান রাখতেন।
তিনি নিঃসঙ্কোচে এই বিষয়ে আলাপ করতেন, যদিও সম্পর্কে তালই-পুতরা। রতি শাস্ত্র মতে নারী ও পুরুষ কত জাতের আছে ক্রমান্বয়ে বলে যেতেন। কে পরিনী, কে শঙ্কিনী, কে হস্তানী, জাতের ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন জাতের পুরুষের কোন মহিলা সম্পর্কে মিল-অমিল বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতেন।
শুধু তাই নয়, তিনি একজন দক্ষ কবিরাজও বটে। বনাজি ঔষধ রােগীদের সঠিকভাবে নির্বাচন করে সেবা দিতেন। হাজারাে রকমের ঔষধি গুণ সম্পন্ন লতা, গুল, গাছ-গাছালির বিশেষ বিশেষ রােগে ব্যবহার জ্ঞানে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। বনেবাদাড়ে বা কোথাও কাজে গেলে বা কোথাও হাঁটতে হাঁটতে দেখিয়ে দিতেন এটা অমুক অসুখের ঔষধ, সেটা সমুক অসুখের ঔষধ ইত্যাদি।
আমার তালত-ভাইয়ের মুখে শুনেছি সে বাবার সাথে কোথাও কাজে গেলে জঙ্গলের দু-পাশে কেবল ঔষধি গাছ-গাছালির গুণাবলি পরিচয় করিয়ে দিতেন। শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে যেতাে। তাঁর সঙ্গে হাঁটায় একটা বিরক্তিকর অবস্থায় পড়তে হতাে তাকে। তাছাড়া, তিনি একজন নাম করা বৈদ্যও ছিলেন। তাঁর বৈদ্যালি বই (নিজস্ব হরফে) ছিল প্রচুর। এই বই গুলাে রাখা হতাে ছয়টি সাম্মায় (বাক্সে)।
এক একটি বাক্স প্রায় ত্রিশ থেকে বত্রিশ ইঞ্চি মাপের আধুনিক স্যুটকেসের মত বড়। এক একটিকে সাম্মা বলা হত। এই সামাগুলাে বানানাে হতাে তখনকার দিনের ডুলু বীশ নামক এক প্রকার বাঁশের নীল (বাকল) বেত দিয়ে। এই বাঁশের নীল বেত দিয়ে বানানাে বাক্স খুবই শক্ত ও টেকসই হতো।
এক একটি বৈদ্যালি বইকে তিন ভাঁজে বা কোনটা বড় হলে চার ভাঁজে ভাঁজ করা হতাে । এক একটি সাম্মায় ৩০/৪০ টা বই রাখা থাকত। যখন আমি তাঁদের বাড়িতে যেতাম তখন দেখতাম নিজ পাড়া বা বিভিন্ন পাড়া থেকে ঔষধ পত্রের জন্য আসলে তখন ঐ বৈদ্যালি বইগুলাে থেকে তথ্য ও ব্যবস্থাপত্র মাফিক ঔষধ দিতেন।
তার বিনিময়ে কোনাে টাকা কড়ি দিতে হতাে না। কেউ কিছু দিলে হাসি মুখে নিতেন বা কেউ না দিলে যে বিমুখ হতেন তা না। তিনি বুঝতেন কার থেকে নেবেন, কার থেকে নেবেন না। তবে বাহিরে কোথাও গেলে দূরে গিয়ে চিকিৎসা করলে তখন রােগী যা দিতেন তাই নিতেন কোনাে অবস্থাতে জোর-জবরদস্তি করতেন না। এটাই তাঁর ধর্ম ।
অধিকাংশ লােকেই বিনা মূল্যেই ঔষধ নিতেন; যেহেতু কম বেশি আত্মীয় স্বজন বা প্রতিবেশী। শতকরা ১০/২০ জনে টাকা পয়সা দিতেন। ঔষধ গুলির বেশির ভাগই জংলীর গাছ-গাছালির। মধ্যে মধ্যে মুদির দোকান থেকে কবিরাজির বিভিন্ন প্রকারের।
মাল-মশলা যেমন- জাইফল, লঙ, গােল মরিচ, কোয়াফ চিনি, পিপৈ, সরিষা, তীল, কালো তীল, লবঙ্গ, হরিতকি, বহেরা, কালাে জিরা, মিঠা জিরা, সাদা চন্দন, লাল চন্দন আর কত কি হাজারাে রকমের উপকরণ কিনতে হতাে।
আসলে দামি দামি উপকরণ লাগে প্রকৃত অর্থে ঔষধ বানাতে। ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অত্যন্ত সুুগভীর! নিজ গ্রামের, সমাজের কি রাষ্ট্রের দূর্গটনা কিংবা দুঃসময়ে তিনি থাকতেন অত্যন্ত চিন্তাশীল।
তাই সমাজের কিছু লােক তাঁর অবর্তমানে রসিকতা করে নাম দিয়েছিলেন “চিন্তামুণি” হিসাবে। তিনি তাঁর পরিবারের ও পরিবার সংশ্লিষ্ট যে সকল কাজের লােক ছিলেন প্রত্যেকের ব্যক্তি বিশেষের খোঁজ-খবর ঘনিষ্ঠ ভাবে রাখতেন, ফলে সকলেই শ্রদ্ধার চক্ষে দেখতাে।
শুধু তাই নয়; প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজের গ্রাম বা পাড়া ছাড়া অন্য প্রতিবেশী আরও দুই পাড়া যেমন- বলসু গাছের মইনপাড়া ও সাপছড়ি আগা মইন পাড়ার বিষয়াদিও দেখতে হতাে তাঁকে। যেহেতু তখন সেই পাড়াগুলােতে কার্বারী ছিলেন না। তিন পাড়া মিলে তখন প্রায় ৩০/৪০ পরিবার বসবাস করতো।
বর্তমানে তিন পাড়াতে পায় ৭০/৮০ পরিবার হয়েছে। অবশ্য পরবর্তীতে দুই পাড়াতে সরকার কার্বারী নিয়ােগ দিয়েছে। তিনি অতি সূক্ষ্ম ও সুগভীর চিন্তা করে কর্ম পরিকল্পনা করতেন। পুত্র ও পুত্রবধূদের মধ্যে পারস্পরিক সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য মধ্যে মধ্যে পরস্পর পরস্পরের আত্মীয়দের কাছে বেড়ানাের পরামর্শ দিতেন সেটা আসলে পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সেতু বন্ধন রচনার কৌশল।
একটা বৃহৎ যৌথ পরিবারকে এই ধরনের সমন্বয় সাধন রেখে সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনে ধরে রাখা অত্যন্ত কষ্ট সাধ্য কাজ। তাঁর চিন্তা চেতনা, জ্ঞান গম্ভীর দূরদর্শীতা, বাস্তব সম্মত কাজ সেই যুগে তাঁর সমকক্ষ আর আমাদের সমাজের। কেহ ছিলেন না।
এ জন্য স্থানীয় মৌজার হেডম্যান, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও অন্যান্য কার্বারীগণ তাঁকে সমীহ, সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর সান্নিধ্যের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতেন। তিনি অতি দূর-দৃষ্টি সম্পন্ন লােক ছিলেন। তাঁর দূরদর্শীতার কারণে তাঁর উত্তরসূরীগণ বর্তমান সভ্য সমাজের এক একজন সদস্য। দেশ বিদেশে তাঁর বংশধরেরা অবস্থান করছেন তার সংক্ষিপ্ত বংশ পরিচয় নিম্নরূপঃ- (তালত ভাই শ্রী অজিত কুমার তন্চংগ্যা প্রদত্ত তথ্যমতে)।
১ম বংশঃ পিতা- চরণ তন্চংগ্যা (কাবারী) জনাঃ ১৮০২ ইং মৃত্যুঃ ১৮৮৮ইং মাতা- চান্দেবী তন্চংগ্যা জানঃ ১৮১১ ইং মৃত্যুঃ ১৮৯২ ইং ।
২য় বংশঃ পিতা-কৃষ্ণ তন্চংগ্যা (কার্বারী) জন্মঃ ১৮৬০ ইং মৃত্যুঃ ১৯৫৩ ইং মাতা- ফুল কুমারী তন্চংগ্যা জন্মঃ ১৮৭১ ইং মৃত্যুঃ ১৯৪৯ ইং
৩য় বংশঃ ১) চন্দ্র সেন তনচংগ্যা জনঃ ১৯০৪ ইং মৃত্যুঃ ১৯৬৮ ইং
২) রজনী সেন তনচংগ্যা জন্মঃ ১৯০৬ ইং মৃত্যু! ১৯৩৮ ইং
৩) তরনী সেন তনচংগ্যা জনঃ ১৯০৮ ইং মৃত্যুঃ ১৯২৭ ইং
৪) নােয়ারাম তনচংগ্যা (কার্বারী) জন্মঃ ১৯১১ ইং মৃত্যুঃ ১৯৯৭ ইং।
৫) পঞ্চরত্ন তনচংগ্যা জনঃ ১৯১৩ ইং মৃত্যুঃ ১৯৬০ ইং
৬) সুধন্য তনচংগ্যা জনঃ ১৯১৫ ইং মৃত্যুঃ ১৯৮৫ ইং ।
৭) হীরণ্য তন্চংগ্যা জন্মঃ ১৯১৮ ইং মৃত্যুঃ ২০০৫ ইং।
শ্রী নােয়ারাম কার্বারীর পিতা শ্রী কৃষ্ণ কার্বারী ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন রাজনীতিবিদ ও এম, পি, (অবিভক্ত ভারতবর্ষের) শ্রী কামিনী মােহন দেওয়ানের সঙ্গে কলিকাতার সফর সঙ্গী হতেন।
তাঁর মুখে শুনেছি, ১৯৪৭ সনের দেশ বিভাগের সময় অত্র পার্বত্যাঞ্চল ও দ্বিধা-দন্ডের মধ্যে পড়েছিল যে- এই অঞ্চল কি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে? নাকি ভারতের সাথে যুক্ত হবে? বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড যে জায়গায় অবস্থিত আছে তথায় ছিল তখনকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। সেই জায়গাতে পতাকা উড়ানাের জন্য শ্রী কৃষ্ণ কার্বারীর পক্ষে তাঁর পুত্র হিসেবে তাঁকেও আসতে হয়েছিল।
পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ও রাজনীতিকগণের সাহচর্যে থেকে থেকেই তাঁর দূরদর্শীতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। তাছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্য, মেধা ও মনন শ্রী নােয়ারাম কার্বারীর রক্তে প্রবাহিত হয়েছিল।
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন স্বচ্ছল ব্যক্তি। তাঁর ভাষ্য মতে, অভাব-অনটন জীবনে হয় নাই, এক রকম সুখেই কেটেছে তাঁর জীবন। তিন কন্যা ও চার পুত্র সন্তান রেখে পরিণত বয়স ৮৬ বৎসর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দুই দিন আগে জ্ঞাতিগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত উপদেশ ও আর্শীবাদ “ক্যাসেট” করে রাখা হয়েছিল।
এ ক্যাসেটের বিদায় বাণী, উপদেশ শুনলে এখনও আত্মীয়রা না কেঁদে পারেন না। বড় থেকে ক্রমান্বয়ে ছোটদের একে একে নাম ডেকে ডেকে পুষ্পমাল্যের মত কথার মালা গেঁথে ছন্দে ছন্দে উপদেশ ও আর্শীবাদ দিয়েছিলেন। বৃদ্ধাবস্থায় মৃত্যুর পূর্বে শেষ মুহূর্তে সৎ জ্ঞানে গুছিয়ে কথা বলা, তা আবার হুশ রেখে লাখের মধ্যে দুই একজন দেখা মিলবে কিনা সন্দেহ।
ব্যক্তি জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। অগাধ পুণ্যরাশির ফলে, মৃত্যুর পূর্ব চিন্তা ও চেতনা রেখে দৃঢ় মনের অধিকারী হয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন; কেননা তিনি যে মৃত্যুর কোলে ধাবিত হচ্ছিলেন তাতেও তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। তাঁর আদর্শ, নীতি শিক্ষা ও উপদেশ আমার জীবনে পাথেয় হবে ও চির ভাস্মর হয়ে থাকবে।
লেখকঃ লগ্ন কুমার তনচংগ্যা, শিক্ষক, রাজস্থলী, রাংগামাটি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।