সাঁওতালি ভাষা শিক্ষা
3727
সাঁওতালি ভাষার লিপির নাম অলচিকি (ᱚᱞᱪᱤᱠᱤ)। অল(ᱚᱞ) মানে লেখা আর চিকি(ᱪᱤᱠᱤ) মানে অক্ষর বা লিপি এই দুটি শব্দের মিলিত রূপ অলচিকি (অল+চিকি) অর্থাৎ লেখার জন্য বর্ণমালা বা অক্ষর।
পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু কিশোর বয়সে সাঁওতালি ভাষার লিপির অভাব গভীরভাবে বুঝতে পারেন, আর এই অভাববোধ থেকেই সাঁওতালি ভাষার লিপি অলচিকি-র আবিষ্কার। ১৯২৫ সালে তিনি এই লিপি বিঞ্জানসম্মত ভাবে আবিষ্কার করেন।
তাঁর আবিষ্কৃত লিপির বিচিত্র ছন্দ, গ্রামীণ লোকজীবনে, প্রতিদিনের চোখে দেখা নানা রকম দৃশ্য বা সুপরিচিত উপাদান খেকে নেওয়া। বলাবাহুল্য, এই যুক্তাক্ষরহীন বর্ণমালা সাঁওতাল জনজীবনের রূপ ও রসে ছন্দিত এবং মনোবিঞ্জানসম্মত।
এখন সে সব কথা থাক পরে আলোচনা করা হবে, এখন সাঁওতালি বর্ণমালার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
সাঁওতালি বর্ণমালাঃ-
বাংলায় উচ্চারণ লিখে সাঁওতালি বর্ণমালার যদিও সঠিক উচ্চারণ করা সম্ভব নয় তবুও উচ্চারণ করার সুবিধার্থে সাঁওতালি বর্ণমালার নিচে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে উচ্চারণ উল্লেখ করা হলঃ
আগের পর্বের পোস্টে সাঁওতালি বর্ণমালা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আজকে সাঁওতালি সংখ্যা শিখে নেওয়া যাক। সংখ্যা কে সাঁওতালিতে বলে এ্যল(ᱮᱞ)।
সাঁওতালি সংখ্যাঃ-
সাঁওতালি সংখ্যা গুলির নিচে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে উচ্চারণ উল্লেখ করা হলঃ-
সাঁওতালি ভাষায় পৃথিবী মানে ধারতি বা অত। এই অত বা ধারতিতেই সমস্ত প্রাণীকূলের সৃষ্টি। পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু-র আবিষ্কৃত অলচিকি লিপিও এই অত থেকেই তৈরি হয়েছে।
পৃথিবী বা অত দেখতে অনেকটাই গোলাকার। এই গোল চিত্র থেকেই অলচিকির সমস্ত বর্ণ গঠিত হয়েছে। কিভাবে বর্ণগুলি অত খেকে সৃষ্টি করেছেন পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু। এখন আমরা সেটা দেখে নিই। নিচে চিত্র দেওয়া হলঃ–
সবুজ গোল চিত্রে দেখানো অংশ গুলি থেকে হলুদ কালিতে চিহ্নিত করা অংশ বাদ দিলে প্রকৃত বর্ণ গুলি পাওয়া যাবে।এইভাবে প্রত্যেকটি বর্ণ তিনি অত বা পৃথিবী থেকে আবিষ্কার করেন।
পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু আবিষ্কৃত লিপির বিচিত্র ছন্দ, গ্রামীণ লোকজীবনে, প্রতিদিনের চোখে দেখা নানা রকম দৃশ্য বা সুপরিচিত উপাদান খেকে নেওয়া। প্রকৃতির কোন উপাদান ও মানব জীবনের প্রতিদিনের চোখে দেখা কোন বিষয়গুলি থেকে তিনি কোন বর্ণ আবিষ্কার করেছেন, সেটি আমরা পরের পোস্টে আলোচনা করব।
পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু আবিষ্কৃত লিপির বিচিত্র ছন্দ, গ্রামীণ লোকজীবনে, প্রতিদিনের চোখে দেখা নানা রকম দৃশ্য বা সুপরিচিত উপাদান থেকে নেওয়া।
প্রকৃতির কোন উপাদান ও মানব জীবনের প্রতিদিনের চোখে দেখা কোন বিষয়গুলি থেকে তিনি কোন বর্ণ আবিষ্কার করেছেন, সেটি আমরা আজকে আলোচনা করব। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ-
ᱚ(অ)- জ্বলন্ত অগ্নিশিখা চিত্র (দহনরূপ) থেকে নেওয়া। দহন অর্থাৎ সাঁওতালিতে ল।
ᱛ(অত)- পৃথিবীর গোলরূপ থেকে বর্ণটির রূপ কল্পনা। সাঁওতালিতে অত।
ᱜ (অগ)- মাটির নিচে, কোনো গর্তের ভিতর থেকে কোনো জন্তুকে আগুনের ধোঁয়া দিয়ে যে ভাবে বের করা হয়, তাকে সাঁওতালিতে অগ্ বলা হয়। গলা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত মুখের চিত্ররূপ।
ᱝ(অং)- মুখের দুই ঠোঁট দিয়ে ফুঁ দিয়ে বাতাস বের করার দৃশ্যরূপ।
ᱞ(অল)- লেখার সময় হাত দিয়ে কলম ধরার দৃশ্যরূপ। সাঁওতালিতে অল বলা হয়।
ᱟ(আ)- কোদাল দিয়ে মাটি খোঁড়ার দৃশ্যরূপ। খনন অর্থাৎ সাঁওতালিতে লা।
ᱠ(আঁক)- হাঁস বা পায়রা দম নিয়ে ডাকার সময় তাদের গলাদেশের (গলার) তলার দিক বাতাসে ফুলে ওঠে। সেই পরিচিত দৃশ্য থেকে বর্ণরূপের সৃষ্টি।
ᱡ(আজ)- পরিচিত কোনো মানুষকে বাঁ হাত দিয়ে দেখানোর সময় দেহের যে ভঙ্গি, সেই দৃশ্যরূপ থেকে, তাঁর বর্ণময় রূপ।
ᱢ(আম)- কোনো মানুষকে ডান হাত দিয়ে দেখানোর সময় দেহের যে ভঙ্গি, সেই দৃশ্যরূপ থেকে উৎপত্তি হয়েছে বর্ণের।
ᱣ(আ)উ- আনন্দের উচ্ছ্বাস দৃশ্যে বা বিশেষ কৌতূহল প্রকাশের সময় হাতের চিত্ররূপ।
ᱤ(ই)- গাছের ডালকে বাঁকানো কিংবা যে কোনো নমনীয় জিনিসকে বাঁকানোর দৃশ্যরূপ। সাঁওতালিতে লিউয়াত বলা হয়।
ᱥ(ইস)- চাষের জ্ন্য লাঙ্গলের ব্যবহার। সেই লাঙ্গলের গায়ে লম্বা কাঠের অংশকে ‘ইস’ বলে। কৃষিকর্মের প্রধান উপকরন লাঙ্গলের বিশেষ দৃশ্যরূপ।
ᱦ(ইহ)- বিশেষ আবেগের মুহূর্তে, হাত তুলে ‘ইহ্’ ধ্বনি-উচ্চারণের দৃশ্যরূপ।
ᱧ(ইঞ)- নিজেকে ডান হাত দিয়ে দেখানোর সময় নির্দশিত দৃশ্যরূপ জাত।
ᱨ(ইর)- ধান-কাটা বা ঘাস-কাটাকে সাঁওতালিতে বলা হয় ‘ইর্’ ‘কাস্তে’ অর্থাত্ ‘দা’ দিয়ে কোনো কিছু শস্য কর্তনের (অর্থাত্ কেটে ফেলার) দৃশ্যরূপ।
ᱩ(উ)- জল তোলার একধরনের ছোটো হাতা বা পাত্রের দৃশ্যরূপ। নদীর বালি সরিয়ে, এ রকম হাতা দিয়ে জল তোলা হয়। হাঁড়ি থেকে ভাত তোলার যন্ত্রকে সাঁওতালিতে বকাঃ বলা হয়।
ᱪ(উচ)-উঁচু জায়গাকে সাঁওতালিতে উচ বলে। পাহাড়-পর্বতের চূড়া কিংবা উঁচু টিলার দৃশ্যরূপ।
ᱫ(উদ্)- বর্ষাকালে বনভূমিতে বা লোকালয়ের নরম মাটিতে, নরম ছত্রাক বা ব্যাঙের ছাতা মাথা তোলে। তার দৃশ্যরূপ সাঁওতালি ভাষায় বলা হয় উদ্।
ᱬ(উঁড়)- উড়ন্ত মৌমাছির দৃশ্যরূপ।
ᱭ(উয়)- কাউকে ডাকা হলে,সাড়া দেওয়ার শব্দ উয়। সাড়া দেওয়ার সময় হাত দুটির নীচু ভঙ্গির দৃশ্যরূপ।
ᱮ(এ)- তরল প্রবাহের চিত্ররূপ। সাঁওতালিতে ল্যে বলা হয়।
ᱯ(এফ)- আসা-যাওয়ার পথে দেখা না হওয়াকে সাঁওতালি ভাষায় এপড়ে বলা হয়। একজন এক পথে, আর এক জন অন্য পথে গিয়ে, পরে পরস্পরের দেখা হওয়ার দৃশ্যরূপ।
ᱰ(এড)- হাঁটুর উপর দিক মুড়ে, মাটির উপর বসার বিশেষ ভঙ্গির দৃশ্যরূপ থেকে বর্ণের সৃষ্টি।
ᱱ(এন)- দুটি পা দিয়ে শস্য মাড়ার (দলন পদ্ধতি) সময় দুটি পায়ের দৃশ্য থেকে বর্ণের সৃষ্টি। পা দিয়ে শস্যাদি মাড়াকে (মর্দন) সাঁওতালি ভাষায় এন বলে।
ᱲ(এড়)- পথ চলার সময় বিপদপূর্ণ জায়গা এড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য সরূপ। এড়িয়ে যাওয়ার অর্থে সাঁওতালিতে এড় বলা হয়।
ᱳ(ও)- ও-ধ্বনি উচ্চারনের সময়, মুখমন্ডলে অধর ওষ্ঠের যে আকৃতি হয়, সেই দৃশ্যরূপ থেকে বর্ণটির গড়ন।
ᱴ(ওট)- উটের চিত্ররূপ থেকে বর্ণের উৎপত্তি।
ᱵ(ওব)- মাথার চুলের বাঁকানো ভঙ্গির চিত্ররূপ। সাঁওতালিতে উব বা ওব মানে চুল।
ᱶ(ওঙ্)- উচ্চারনের সময় নাক দিয়ে যে ধ্বনি বের হয়, তার চিত্ররূপ থেকে বর্ণটির সৃষ্টি।
ᱷ(ওহ্)- বিরক্তি বা ক্ষোভ প্রকাশের সময় জোরালো উচ্চারণ।
ᱸ(মু টুডাঃ)- নাসিক্য ধ্বনির উচ্চারণ কালে ব্যবহৃত। স্বরবর্ণের পরে উপরের দিকে বসানো হয়।
ᱹ(গাহালা টুডাঃ)- আ-কার নয়, এমন ধ্বনিযুক্ত শব্দের উচ্চারণের সময় স্বরবর্ণের পরে নিচের দিকে বসে।
ᱻ(রেলা)- দুটি দীর্ঘায়ু স্বরকে যুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ᱼ(ফারকা)- স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। কিংবা তার স্বরকে দ্বিধাবিভক্ত করে।
ᱽ(অহদ্)- কোনো বস্তুকে মুষ্টিবদ্ধ করে, টেনে বের করাকে সাঁওতালিতে বলে হয় হদ তার আদল। অঘোষিত ধ্বনিকে ঘোষিত করের জন্য এর প্রয়োগ। সংগ্রামী মুষ্টিবদ্ধ হাতের বলদৃপ্ত চিত্ররূপ।
লিখবার সুবিধার জন্য সাঁওতালি বর্ণমালাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-১) ছাপা অক্ষর ও ২) হস্ত লেখা ।
১) ছাপা অক্ষরঃ যে অক্ষর দিয়ে বই ছাপানো হয় বা বিভিন্ন বই এ যে অক্ষর গুলো আমরা ছাপানো আকারে দেখে থাকি সে গুলোই ছাপা অক্ষর। নিচে দেওয়া হলঃ-
২) হস্ত লেখাঃ লিখবার সুবিধার জন্য বর্ণগুলোকে সহজ ভাবে লেখার পদ্ধতি। নিচে দেওয়া হলঃ-
কোন ছাপানো অক্ষর হাতে লেখার সময় কিভাবে লিখতে হয়, সেটা নিচে দেওয়া হলঃ-
সাঁওতালি ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সৃষ্টিধর্মী চেতনার অধিকারী এবং সেই ভাষা প্রকাশের জন্য বিঞ্জান সম্মত লিপির স্রষ্টার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানিয়ে ওড়িষার আদিবাসী মহাসভা পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু কে ‘গুরু গমকে’ উপাধিতে সম্মানিত করে।
‘অলচিকি’ স্রষ্টা নিজের সৃষ্টি জনমানসে যুক্তি গ্রাহ্য করার জন্য ভারতের নানা প্রান্তে ছুটে গেছেন এবং অসাধারন বাগ্মিতায় নিজের বক্তব্যকে জনগণের কাছে হৃদয়গ্রাহী ও যুক্তিসিদ্ধ হিসাবে তুলে ধরেছেন।
সেই অসাধারন বাকনৈপুন্যে প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় তৎকালিন ওড়িষার উন্নয়ন মন্ত্রী রামজিৎ সিং বারিহা ‘ A great orator with charming voice’ শোভন উক্তিতে তাঁকে সম্মানিত করেন।
অলচিকি লিপি সৃষ্টির উৎস-এর চিত্র নিচে দেওয়া হলঃ
অলচিকি লিপিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ১) আড়াং চিকি (Sound) ও ২) জাপাঃ আড়াং চিকি (Sound) ।
নিচের চিত্রে দেখানো হয়েছে-
আড়াং (Sound) চিকিকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ১) রাহা আড়াং (Vowel) ও ২) কেচেদ আড়াং (Consonant) ।নিচে চিত্রে দেখুন-
কেচেদ আড়াং (Consonant) চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ১) পারহাড় কেচেদ আড়াং ২) তাপুঃ কেচেদ আড়াং ৩) রাড়াং কেচেদ আড়াং ও ৪) জেতলেদ কেচেদ আড়াং। নিচের চিত্রে দেখানো হল-
জাপাঃ আড়াং চিকির ব্যবহার সম্পর্কে আজকে আলোচনা করব। জাপাঃ আড়াং চিকি গুলি নিচে দেখানো হল-
মু টুডাঃ- নাসিক্য ধ্বনির উচ্চারণ কালে ব্যবহৃত হয়। রাহা আড়াং চিকির পরে উপরের দিকে বসানো হয়। নিচে দেখানো হল-
গাহালা টুডাঃ- আ-কার নয়, এমন ধ্বনি উচ্চারণের সময় ব্যবহৃত হয়। রাহা আড়াং চিকির পরে নিচের দিকে বসানো হয়। নিচে দেখানো হল-
রেলা- রাহা আড়াং চিকি গুলিতে ব্যবহৃত হয়। দুটি দীর্ঘায়ু স্বরকে যুক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। নিচে দেখানো হল-
ফারকা- রাহা আড়াং ও কেচেদ আড়াং কে দূরে রাখতে সাহায্য করে। নিচে দেখানো হল-
অহদ- অঘোষিত ধ্বনিকে ঘোষিত করার জন্য এর প্রয়োগ করা হয়। অঘোষিত ধ্বনির স্বরকে দ্বিধাবিভক্ত করে। নিচে দেখানো হল-
Source : https://adibasinews.wordpress.com/
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।