সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড় নাকি সাতাড়?
1505
বেশকিছুকাল পেছন থেকেই শুরু করছি। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু ও পর্যটন শহর পোখারাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সবমিলিয়ে তিন সপ্তাহ ছিলাম।
এই সুযোগে ভেবেছিলাম নিজের জাতির কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারলে মন্দ হয়না। তাই একটু খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম কাছে পিঠে হড়1 কাউকে পাওয়া যায় কিনা।
কাঠমান্ডুতে থাকা অবস্থায় নেওয়ার জনগোষ্ঠীর এক নেপালি আদিবাসী বন্ধুকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে কি আশেপাশে হড় গ্রাম আছে নাকি বা তার পরিচিত কোন হড় আছে কিনা। সে প্রথমে বুঝতে পারছিলনা।
পরে তাকে বলেছিলাম এখানে সাঁওতালরা বা সান্তালরা কোথায় আছে। কিন্তু এরপরেও সে বুঝতে পারছিলনা। পরে হড়’দের ব্যাপারে আরো অনেক তথ্য দেওয়ার পরও সে যখন হড়’দের চিনতে পারছিলনা তখন আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।
যাই হোক নেপালে হড়’রা আছে বিষয়টি জানলেও আগে আসলে বিস্তারিত ঘাটাঘাটি করা হয়ে ছিলনা। সেইবার প্রথম মিজ গুগলের সাহায্য নিয়ে নেপালের হড়’দের অবস্থান, লোকসংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে ধারনা নিলাম।
পরে ফেইসবুকেও একটু সার্চ দিলাম ফ্রেন্ড লিস্টে নেপালের কেউ আছে কিনা। পেয়ে গেলাম দুই তিন জনকে। তাদের বেশ কয়েকজনকে ইনবক্স করলাম। শেষ পর্যন্ত দুই জনের সাড়াও পেয়েছিলাম।
ফোন নাম্বার নিয়ে কথা বলেছিলাম তাদের সাথে। আমি যে কাজে গিয়েছিলাম তার বাইরে আমার সময় সুযোগও কম ছিল। নেপালের কাঠমান্ডু বা পোখারা থেকে হড়দের বসবাস অনেক দূরে মোরাং ও ঝাপা জেলায় বেশী।
তারপরও ভেবেছিলাম সময় পেলে ঘুরে আসা যায় কিনা। কিন্তু শেষপর্যন্ত কপালে ছিলনা তাই বোধহয় কারও সাথেই সশরীরে দেখাটা হয়ে ওঠেনি।
যাই হোক দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে কাজের ফাঁকে একদিন পোখারায় International Mountain Museum এ যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ ছবির ফ্রেমে একজন হড় নারীর দেখা পেয়ে গেলাম।
একটি বোর্ডের মধ্যে নেপালের বিভিন্ন আদিবাসীদের ছবি ও তাদের ভৌগলিক অবস্থান দেখানো হয়েছে। সেখানে হড় নারীটির ছবির নিচে লেখা ‘সাতাড়’ (Satar)। আমি তখন ঐ নেপালি আদিবাসী বন্ধুকে ছবিটি দেখিয়ে বললাম এদের কথায়তো সেইদিন বলছিলাম।
তখন সে বলে উঠলো তুমিতো হড়, সাঁওতাল, সান্তাল বলেছিলে তাই বুঝিনি। আমরা নেপালে সাতাড় বলে ডাকি। আমি একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিয়েছিলাম।
সাঁওতাল, সান্তাল, সাতাড় ইত্যাদির মধ্যে কোনটি সঠিক এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক ফেইসবুক বন্ধুদের টুকটাক লেখালেখি বলতে হয়তো স্ট্যাটাস দেওয়া বা কমেন্ট দেওয়া দেখেছি।
কিন্তু নিজে কখনো ব্যাপারটি নিয়ে খুব বেশী ভাবিনি। নেপালের অভিজ্ঞতা আমাকে এই ব্যাপারে একটু ভাবিয়ে তুলেছিল। আসলেইতো কোনটি সঠিক?
নেপালে যে সাতাড় বলে সেটি ঠিক নাকি আমরা বাংলাদেশে সাঁওতাল বা সান্তাল বলি সেটি ঠিক নাকি ভারতে সাঁওতাল, সান্তাল এর পাশাপাশি সান্থাল, সান্তাড়, সাঁওতা বলে আমাদের যে পরিচিতি আছে সেগুলো ঠিক।
আসলে এগুলোর মধ্য থেকে যদি শুধু একটির কথা বলি তাহলে কোনটি ঠিক? সাঁওতাল, সান্তাল ইত্যাদি নাম নিয়ে অনেকেই কিন্তু বিভ্রান্তিতে থাকে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেসও করেছে কোনটি সঠিক।
আমার নিজের বেড়ে ওঠা, যতটুকু নিজের সমাজকে দেখেছি সেই অভিজ্ঞতা থেকে নিজের একটি সিদ্ধান্ত মনে মনে ছিল। তারপরও একটু ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে খুব বেশী কিছু পেলামনা।
যা সামান্য পেয়েছি এবং বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলেই সাঁওতাল, সান্তাল বা অন্য নামগুলোর নাম বিতর্ক বা নামের বানান বিতর্ক সমাধানের একটা পথ এই লেখার মধ্য দিয়ে শুরু হবে বলে আশা এবং বিশ্বাস করছি।
হড় সমাজের বাইরের মানুষদের দ্বারা হড়’দের নামের এই বিভিন্নতা নিয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ভেদে ও অঞ্চল ভেদে পার্থক্যটা দেখা যায়। যেমন আগেই বলেছি নেপালে নেপালী জনগণ হড়’দের সাতাড় বলেন। বাংলাদেশের বাঙালি জনগণ সাঁওতাল বলেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষীরাও সাঁওতাল বলেন। হিন্দী ভাষীরা ও ঝাড়খন্ডের অঞ্চলের মানুষেরা সান্থাল বা সান্তাল বলেন। উড়িষ্যার জনগণ সান্তাড় বলেন।
ইংরেজী ভাষীরা সান্ঠাল/সান্টাল বলেন। এখানে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের আলাদা আলাদা উচ্চারন ও অঞ্চলভেদে উচ্চারনের পার্থক্যের কারনেই এরকমটা হচ্ছে বলে সহজে অনুমেয়।
এটাতো গেল অন্যরা কিভাবে বলছেন বা লিখছেন তবে আমরা নিজেদের মধ্যে হড় পরিচয় দিলেও অন্যদের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে সাঁওতাল, সান্তাল ইত্যাদির কোন একটি ব্যবহার করছি।
হড়’দের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে’র মতো প্রখ্যাত লেখক হয়তো কমই আছে। তাঁর লিখিত কিছু বই পড়েছি তাতে তিনি বেশীরভাগ জায়গাতেই ‘সাঁওতাল’ এই বানানটি ব্যবহার করেছেন।
তাঁর মতো পশ্চিমবঙ্গের বেশীরভাগ হড় লেখকদের লেখায় এই বানানি বেশী ব্যবহুত হয়েছে। আবার অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেমন ঝাড়খন্ডের লেখকদের মধ্যে সাঁওতাল বা সান্তাল দুটোর ব্যবহার মোটামুটি সমানভাবে দেখেছি। কিছু জায়গায় এই বানান দুটির বাইরে সান্তাড় বা সান্থাল দেখা যায়।
উড়িষ্যা অঞ্চলের হড়দের মধ্যে সান্তাড় বানানটি বেশী দেখা যায়। নেপালেতো আগেই বলেছি যে সেখানকার হড়রা অন্যদের কাছে নিজেদের সাতাড় বলে পরিচয় দেয় বা অন্যরা তাদের সাতাড় নামে চেনে।
ভূটানেও নাকি কিছু হড় আছে তবে সেখানে তাদের ব্যাপারে আমি মোটেও অবগত নই। আর বাংলাদেশে মূলত দুই ধরনের বানানের ব্যবহারই দেখা যায়।
একটি হচ্ছে সাঁওতাল আর অন্যটি সান্তাল।প্রোটো-অস্ট্রলয়েড জাতি গোষ্ঠীর এই মানুষেরা নিজেদের ভেতর হড় নামে পরিচিত হলেও বাইরের লোকজন তাদেরকে সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড়, সাতাড় ইত্যাদি নামেই চেনে।
হড় নামকরন এর ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে’র বঙ্গ সংস্কৃতিতে প্রাক বৈদিক প্রভাব বইতে পাওয়া গেল আর্যরা এদেশের অনার্য গোষ্ঠীগুলিকে দাস, দস্যু, অসুর বলে অভিহিত করতো। ঋগে¦
দ সংহিতার ‘বিজানীহি আর্য্যান যে চ দসব্যঃ, অয়মেতি বিচাকদ বিচিন্বন দাস আর্য্যম’ ইত্যাদি কথা থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। এরই প্রতিবাদে খেরওয়ালরা নিজেদের হড় অর্থাৎ মানুষ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছিল এবং আজ পর্যন্ত সাঁওতালরা নিজেদের মধ্যে হড় নামেই পরিচয় দিতে পছন্দ করে।
এ প্রসঙ্গে H. H. Resley তাঁর ‘The People of India’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন- “According to Mr. Skresfsrud the name Santal is a corruption of saontar and was adopted by the tribe after their sojour for several generations in the country about saont they were said to have been called Kharwar, the root of which, khar, is a variant of hor, ‘man’ the name which all Santals use among themeselves”
উপরের দুটি উদ্ধৃতিতেই খেরওয়াল শব্দটি দেখা যাচ্ছে। আসলে হড়’রা এই খেরওয়াল বংশেরই একটি অংশ। খের অর্থাৎ পাখির বংশধর।
আর্যরা আসার পরে এই অঞ্চলের মানুষদের বয়াংসি বা পক্ষী জাতীয় বলে বর্ণনা করেছেন। এই বয়াংসি বলতে খেরওয়াড় জনগোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়েছে।
কেননা সাঁওতালি পুরানে সাঁওতালদের আদি পিতা-মাতা পিলচু হাড়াম-পিলচু বুডহির জন্ম হয়েছে হাঁস-হাঁসিল নামক পাখি থেকে।খেরওয়াড় বা খারওয়াড় বা খেরওয়াল নামকরন গুলো সামষ্টিক নামকরন। এখনকার আদিবাসী পরিচিতির মত।
পন্ডিত কলেয়ান হাড়াম কথিত ও Screfsrud লিখিত “হড়কোরেন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কাথা” গ্রন্থে পাওয়া যায়- ‘চাম্পা ধাবিচ আলে আর মুন্ডাকো, বিরহড়কো, কুঁড়বিকো এমানতেনকো খারওয়ার ঞুতুম তেলে বিকাউঃ ক কান তাঁহেকানা…..।’
অর্থাৎ চাম্পা পর্যন্ত আমরা এবং মুন্ডারা, কুড়মিরা, বিরহড়রা এবং আরও অনেকেই খারওয়ার নামে অভিহিত হতাম…..।
এই গ্রন্থ অনুযায়ি চাম্পা নামক স্থানে অবস্থানকালীন পর্যন্ত এই বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের খারওয়ার নামে অভিহিত করতেন।
এখানে চাম্পা নামক যে স্থানটির কথা বলা হচ্ছে সেটি মূলত সিন্ধু উপত্যকা। যেখানে গড়ে উঠেছিল বিশাল সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতা আসলে সাঁওতালদের সভ্যতা বা খেরয়াড়দের সভ্যতা।
এখানে খেরওয়াল বংশের বিভিন্ন গোষ্ঠীদের ভাষার বৈশিষ্ট্য ধরে বিচার করলে যে কয়েকটা জাতির নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো: (১) অসুর (২) মুন্ডা (৩) সাঁওতাল (৪) হো বা লাড়কা কোল (৫) বিরহড় (৬) খাড়িয়া বা খেড়িয়া (৭) শবর (৮) কোরওয়া (৯) কোড়া বা কোড (১০) করকু (১১) করমালী বা কলহে (১২) মাহালি (১৩) ভূমিজ (১৪) গদব (১৫) তুরি (১৬) কুড়মি (১৭) যুয়াং।
খেরওয়াল ভাষা গোষ্ঠীর এই জাতিগুলো যখন আর্যদের আক্রমনে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায় তখন তারা আর্যদের দিকু বা বিদেশী আখ্যা দেয় বলে অনুমান করা হয়।
আর্য সভ্যতার পূর্বে যে বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষ ছিলেন তা আলোকপাত করতে গিয়ে “G.A. Grierson তাঁর “Linguistic Survey of India” গ্রন্থে লিখেছেন- Santali, Mundari, Bhumij, Koda, Ho, Turi, and Korwa are only slight differing forms of one and the same language. All these Tribes are accounting to Santali traditions decended from the same stock and were once known as Kherwars or Kharwars.”
সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড় বা সাতাড় নামকরনের আরো বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরাডোটাসের বিবরনে (Herodotus) ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থার অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।
তিনি সিন্ধু ও বালুচিস্তানের প্রাচীন অধিবাসীদের তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি শ্রেনীকে তিনি সাঁওতাল/সান্তাল হিসেবে নাকি উল্লেখ করেছিলেন।
আদিবাসী রাজা সান্তার শাসনামলে সান্তাল/সান্তাড় নামকরন হয় বলেও কিছু জায়গায় পাওয়া যায়। এছাড়া সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সীমান্তরক্ষী হিসেবে নাকি হড়’রা কাজ করতো। অনেকে মনে করেন এ থেকেও সাঁওতাল নামকরন আসতে পারে (সীমান্ত>সামন্ত>সাঁওতাল)।
এ কারনে বেশীরভাগ নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন যে সংস্কৃতি শব্দ সামন্ত থেকেই সাঁওতাল, সান্তাল ইত্যাদি নামগুলো এসেছে এবং অন্য সমাজের মানুষেরাই এই নামকরনগুলো করেছেন।
এ প্রসঙ্গে W. B. Oldham বলেছেন, Santal is an abbreviation of Samantawala which is derived from a Sanscrit word Samanta, another name given to the country around Saont.
সাঁওতাড় কাথা রেনাঃ কেদ নামক একটি প্রবন্ধে শ্রীবায়ার বাসকে বলেছেন, ‘অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মানুষেরা চীন হতে ভারতে আসে। তাদের কাছে চীন হচ্ছে ‘চৗই’।
চীনের একটি অঞ্চলের নাম ‘খিউরথিচ’ থেকে চৗই এসেছে এবং অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীরা যখন ভারতে ছোটনাগপুরে এসে বসবাস শুরু করে তখন তাদেরকে ‘চাওথিচ’ বলা হতো।
এ থেকেই ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমায় চাওথিচ > চাওথিচিয়াল > চাওথিরাল > চাওথাল > সাঁওতাল নামটি আসে।
সাত দিশৗম অর্থাৎ সাত অঞ্চলে বসবাস করার পরেই এ ভারতবর্ষে এসে হড়’দের নামকরন সাঁওতাল হয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
হড়’দের ইতিহাস লিপিবদ্ধ না থাকলেও এটা সহজেই স্বীকার করা যায় যে হড়’রা সৃষ্টির পর থেকেই তাদের প্রথম নিবাস ‘হিহিড়ি পিপিড়ি’ থেকে নানা কারনে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতে করতে শেষ পর্যন্ত চাম্পা দেশে অর্থাৎ ভারতবর্ষের সিন্ধু উপত্যকায় এসে তাদের স্থায়ী নিবাস শুরু করে।
এভাবে হড়’দের স্থানান্তরিত হওয়ার যে চিত্রটি পাওয়া যায় তাহলো অনেকটা এরকম: হিহিড়ি পিপিড়ি>খোজ কামান>হারাতা বুরু>সাসাং বেডা> জৗরপি দিশৗম (সিঞ দুয়ৗর, বৗই দুয়ৗর) >আইরে দিশৗম>কায়েন্ডে দিশৗম>চৗই দিশৗম>চাম্পা দিশৗম (এয়ায় নৗই দিশৗম)।10 এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া নিয়েও হড়’রা তাইতো গান গেয়েছে:
হিহিড়ি পিপিড়িরেবোন জানামলেন, খোজ কামানরেবোন খোজলেন, হারাতারেবোন হারালেন,
সাসাং বেডারেবোন জৗতএনা হো।
অর্থাৎ হিহিড়ি পিপিড়িতে আমরা জন্মেছিলাম, খোজ কামানে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম, হারাতাতে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম, সাসাং বেডাতে আমরা গোত্র (পদবী) ভাগ করেছিলাম।
তবে বিশেষ করে সান্তাল নামকরনের পিছনে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের ক্ষেত্রে সাঁওতাল উচ্চারন করতে না পারার কারনে সান্তাল উচ্চারনটি পরিচিতি পায় এবং যেহেতু সে সময়টাতেই খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের মাধ্যমে হড় ভাষায় বাইবেল লিখে ধর্ম প্রচার করা ও পরবর্তীতে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ করার আগ্রহ থেকে ইংরেজী Santal বানানটি পরিচিত হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে The Santals and their Ancestors গ্রন্থে D. Barka Kisku লিখেছেন, ÒThe name (Santal) was given to them by the Britishers. This the Santals admit to have received from the English. When they entered the Damin-i-koh in the last phase of the 18th and the begining of the 19th Century.”
এখন প্রশ্ন থেকে যায় সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড়, সাতাড় ইত্যাদি বিভিন্ন উচ্চারন ও বানানের মধ্যে থেকে কোনটি সঠিক? এখানে খুব সহজ একটি উত্তর হচ্ছে কোনটিই সঠিক নয় আবার ভুলও নয়।
আগেই বেশ কয়েকবার বলেছি যে এরা নিজেদের মধ্যে হড় শব্দটিই ব্যবহার করেন। আর সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড়, সাতাড় ইত্যাদি নামগুলো অন্যদের দেয়া।
তাই এইসব নাম নিয়ে যদি কেউ বিতর্ক করেন তাহলে সেটা নেহাতই উদ্দেশ্যমূলক হবে। পরিশেষে বলবো হড় সমাজের লোকজনকে যে যেভাবেই ডাকুক বা পরিচয় করুক বাংলাদেশ, ভারত, নোপল, ভূটানসহ পৃথিবীর সকল হড়’রা নিজেদের যে পরিচয় যুগ যুগ ধরে ধারন করে এসেছেন সেটিই ঐতিহাসিক সত্য।
লেখকঃ মানিক সরেন।
তথ্যসূত্র:
1. সাঁওতাল, সান্তাল, সান্থাল, সাঁওতাড়, সান্তাড় বা সাতাড় জাতি বলতে যাদের আমরা বুঝি তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে ‘হড়’ (বাংলা অর্থ-মানুষ) শব্দটি ব্যবহার করেন। অন্য জাতির মানুষের কাছ পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে সাঁওতাল, সান্তাল, সাতাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন।
2. হেমব্রম, পরিমল; সাঁওতালদের ইতিহাস সন্ধানে; পৃ-৩৪-৩৫
3. হেমব্রম, পরিমল; প্রাগুক্ত; পৃ ৩৫-৩৬
4. হেমব্রম, পরিমল;প্রাগুক্ত; পৃ-৩৭
5. হেমব্রম, পরিমল; প্রাগুক্ত; পৃ-৩০
6. হেমব্রম, পরিমল; প্রাগুক্ত; পৃ-৩৫
7. বাসকে, ধীরেন্দ্রনাথ; বঙ্গ সংস্কৃতিকে প্রাক বৈদিক প্রভাব; পৃষ্ঠা ৫৫
8. Cf. J. TROISI, Tribal Religion …, p. 26.
9. ৪র্থ বর্ষ, ১৬শ সংখ্যা, লাহান্তি পত্রিকা।
10. পন্ডিত কলেয়ান হাড়াম কথিত ও Rev. L. O. Screfsrud লিখিত গ্রন্থ ‘হড়কোরেন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃ কাথা’(Horkoren Mare Hapramko Reak Katha)
11. হেমব্রম, পরিমল; প্রাগুক্ত; পৃ-৫০বি:দ্র: এই লেখাটি ভবিষ্যতে আরো বেশী পরিপূর্ণ করে তুলতে আপনাদের সহযোগিতা ও পরামর্শ কামনা করছি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।