সাঁওতাল লোককাহিনী: ধন্যি বটে মন্ত্রী
855
এ সেই আদিকালের কথা। তবে ঠিক কোথায়, কোন রাজ্যে যে এ ঘটনা ঘটেছিল তা কেউ জানে না। তবু সবাই বলে ঘটনাটার কথা। আদ্দিকালের সেই নাম না জানা রাজ্যে ছিল এক রাজা। বিরাট বিরাট বড় রাজা সে। সারা দেশটারই রাজা ছিল সে।
সারা দেশের সেই একমাত্র রাজার ধন-দৌলত যে কত ছিল তার কোন লেখাজোখা নেই। অবশ্য থাকবে কি করে? তখন যে লেখাপড়ার প্রায় চলই ছিল না সে রাজ্যে।
তবু বলা হয়, রাজার ছিল অঢেল টাকা, প্রচুর সোনা-দানা, ছিল গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, হাতি, ঘোড়া, উট, গাধা, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তার। রাজার কাছে কাজ করত যে কত লোক তারও নেই কোনো হিসেব। মন্ত্রী, পাইক, পেয়াদা আরও কত কে? সব মিলিয়ে রাজা ভারি সুখী। ভারি আনন্দ তার মনে।
আনন্দের চোটে রাজা রোজই ভাবে, এ পৃথিবীতে আমার চেয়ে বড় নেই কেউ। আমি—আমিই একমাত্র বড়। রাজা রোজই ভাবে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না কাউকে কথাটা। আর পারে না বলেই রাজা ভাবে, আচ্ছা, কেউ কি কোনদিন বুঝতে পারবে না আমার মনের কথাটা।
অনেক ভেবে-চিন্তে রাজা ঠিক করে, না, যাচাই করে দেখতে হবে। একবার লোকে আমার মনের কথাটা বোঝে কিনা? এই না ভেবে রাজা একদিন তাকে তার সব চাকরবাকর, পাইক-পেয়াদা, মন্ত্রীপ্রধানমন্ত্রীকে। সবাই হাজির হতেই রাজা বলে, আর কি কেউ বাকি আছে আসতে?
সবাই বলে, না মহারাজ, একমাত্র প্রজারা ছাড়া সবাই হাজির আমরা। প্রজাদের কি ডাকব? না, না আমি শুধু ডেকেছি তোমাদের। জানতে চাই একটা কথা। আমি যা জিজ্ঞেস করব তোমরা তার উত্তরটা দাও।
বলুন, বলুন মহারাজ। বলছি রাজা একটু সময় নেয়। তারপর বলে, আচ্ছা বল তো, আমার মনে কোনো চিন্তা আছে কিনা ? বলতো, আামি কি ভাবছি ?
রাজার এ হেঁয়ালিতে সবাই কেমন যেন ভড়কে যায়। বুঝতে পারে না কি উত্তর দেবে তারা। তাদের ভাব দেখে রাজা বলে, না, না, এখানে একসঙ্গে সবার বলার দরকার নেই। এক এক করে একজন করে বলে যাও তোমরা তোমাদের কথা।
তারপর অনেকক্ষণ ধরে- একে একে এল সবাই। কেউ কিছু বলল, কেউ একদম চুপচাপ, কিন্তু রাজার মনের কথাটি বলতে পারল না কেউ। দীর্ঘ্শ্বাস ফেলে বলে রাজা, না, কেই না, তোমরা কেউ পারলে না, আমার মনের কথাটা বলতে।
রাজা এবার বলে প্রধানমন্ত্রীকে, মন্ত্রী, আমি তোমাকে একমাস সময় দিলাম, এর মধ্যে রাজ্য থেকে তুমি এমন একজনকে ধরে নিয়ে এসো, যে আমার মনের কথাটা বলতে পারে।
রাজায় হুকুম পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর চক্ষু চড়কগাছ। এমন লোক সে কথায় পাবে—যে বলতে পারবে রাজার মনের কথা ? তবুও, হুকুম যখন রাজার, তখন তামিল করতেই হবে তা। তাই মন্ত্রী শুরু করে তেমন লোকের খোঁজ, যে পারবে রাজার মনের গোপন কথাটি বলতে।
কিন্তু না, তেমন লোক পাওয়া যায় না একটিও। দুর্ভাবনায় মন্ত্রীর ঘুম যায়, খাওয়া বন্ধ হয়। শেষে যখন একমাসের আর দু’দিন বাকি, তখন বন্ধ করে দেয় রাজসভাতেও যাওয়া। সেই ভোরে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় বসে মন্ত্রী গালে হাত দিয়ে।
সময় গড়িয়ে যায় মন্ত্রী বসে থাকে ঠায়—সেই একইভাবে। সূর্যি ঠাকুর এবার মাঝ আকাশে বসে কটমট করে চায় চারিদিকে যেন বলে, দুপুর হ’ল—যাও চান করে সব খেয়ে নাও।
মন্ত্রীর কিন্তু হুশ নেই, বসে থাকে সেই একইভাবে। মন্ত্রীর ভাব দেখে তার ছোটমেয়ে এসে বলে, বাবা, কি হয়েছে, কী ভাবছ তুমি সকাল থেকে এখানে বসে বসে?
মন্ত্রী কোনো কথা বলে না, বসে থাকে সেইভাবেই। মন্ত্রীর মেয়ে বলে, কি হয়েছে, বলবে তো? আমরাও তো তোমার চিন্তা দূর করতে পারি।
মন্ত্রী চায় মেয়ের দিকে। কথা বলে না একটাও, মেয়ে বলে, বল না, কি হয়েছে? মন্ত্রী একটা বড় শ্বাস ফেলে বলে, কি আর বলব? তুমি তো আমার ছোট্ট মেয়ে, তুমি আর কি করবে ?
তবু বলেই দেখ না, আমি তো একটা কিছু ব্যবস্থা করলেও করতে তবু বলেই দেখ ন পারি? মেয়ের কথায় এত দুঃখেও হেসে ফেলে মন্ত্রী। তারপর একসময় বলে তার সংকটের কথা। বলে, আর মাত্র দুদিন সময় আছে, আমি যে কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
মেয়ে কিন্তু সে কথা শুনে বলে, এই, আমি তো ভেবেছিলাম, কী, না কী ? নাও তুমি উঠে চান খাওয়া করে নাও তো। আমি ঠিক দিনে তোমাকে তেমন লোক দিয়ে দেব।
মেয়ের কথায় মন্ত্রী কিছুটা যেন স্বস্তি পায়। তারপরেই ভাবে, মেয়ে হয়তো আমার নাওয়া খাওয়ার জন্য একথা বলল। না হলে আমি মন্ত্রী, আমি খোজ পেলাম না এতদিনে, আর ও শুনেই কিনা বলল, তেমন লোক আছে ওর সন্ধানে ?
মন্ত্রী আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, যা আছে কপালে তাই হবে। মিথ্যে ভেবে তো কুলকিনারা পাব না, তার চেয়ে চান করে খেয়ে নিই।
দেখতে দেখতে এসে যায় সেই দিন। ঘুম থেকে উঠেই মন্ত্রী বলে মেয়েকে, কইরে, কোথায় তোর সেই লোক ?
আছে, তৈরিই আছে। তুমি এখন খেয়েদেয়ে নাও। মন্ত্রী মনে মনে বলে আর খাওয়া। হয়তো, এটাই শেষ খাওয়া। রাজার মনের কথা বলতে না পারলে প্রাণটা কি আর থাকবে ধড়ে ? তবুও মেয়ের কথামতই কাজ করে মন্ত্রী।
ওদিকে মন্ত্রীর মেয়ে ডেকে এনেছে তাদের রাখালকে। বোবা কালা রাখালটা থাকে বাড়ির এক কোণায় আর মন্ত্রীর বাড়ির গরু ছাগল চড়ায়। তিনকুলে ওর থাকার মধ্যে আছে শুধু তিনটি ভেড়। ওই নিয়েই সুখে থাকে ও।
তা সেই বোবা কালা রাখালকে ডেকে এনে খাইয়ে দাইয়ে মন্ত্রীর মেয়ে বলে, তোমাকে যেতে হবে বাবার সঙ্গে রাজসভায়। রাজা যা জিজ্ঞেস করবে, উত্তর দিও তার। মাথা নাড়ে রাখাল।
মন্ত্রী ততক্ষণে খেয়েদেয়ে পোশাক পরে তৈরি। হাঁক মেরে বলে মেয়েকে, কইরে, কোথায় তোর লোক। মেয়ে বলে, এই যে বাবা ।
রাখালকে দেখেই অনেক দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলে মন্ত্রী। বলে, ও যে বোবা, কালা। ও কি করে জবাব দেবে রাজার কথার ?
মেয়ে বলে, বাবা, ও যদি না পারে, তাহলে আর কেউ বলতে পারবে না রাজার মনের কথা, তুমি নিয়েই যাও না কেন।
মন্ত্রীর তখন ডুবন্ত মানুষের কুটো ধরার অবস্থা। ভাবে হবেও বা। তাছাড়া প্রাণটা তো এমনিও যাবে, অমনিও যাবে। তবু দেখা যাক ব্যাপারটা।
সারা রাজ্যের মানুষ সেদিন ভেঙে পড়েছে রাজসভায়। রাজার মনের কথা বলার মতো লোকটি কেমন, কীই বা রাজার মনের কথা তা জানতে সবাই জড়ো হয় রাজসভায়।
ঠিক সময়ে রাজা বসে সিংহাসনে। মন্ত্রী তার আসনে। পাশেই থাকে সেই রাখাল। রাজা বলে, মন্ত্রী, পেয়েছে তেমন লোক।
হ্যাঁ মহারাজ। হাজির কর তাকে। রাজার আদেশে মন্ত্রী সেই রাখালকে দাড় করিয়ে দেয় রাজার সামনে। রাজা তাকিয়ে থাকে সেই রাখালের দিকে আর বোবা-কালা রাখাল ড্যাবড্যাবিয়ে দেখে রাজাকে।
রাজা হঠাৎ-ই দেখায় তাকে একটি আঙুল। সঙ্গে সঙ্গে রাখাল দেখায় তাকে দু’টি আঙুল। রাজার মুখটা বেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রাজা এবার তিনটি আঙুল দেখায়।
তিনটি আঙুল দেখার সঙ্গে সঙ্গে রাখাল কিন্তু জোরে মাথা ঝাঁকায়। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটা দেয় মন্ত্রীর বাড়ির সেই কোণের দিকে।
ব্যাপার দেখে মন্ত্রী ভেবে পায় না কিছু ! কিন্তু রাজা ভারি খুশি। খুশির হাসিতে মুখটা যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে রাজার। ওদিকে যারা মজা দেখতে এসেছিল তারা কিছু বুঝতে না পেরে মাছের মুখের মতো হাঁ করে থাকে।
রাজা তার পেয়াদাকে বলে, যাও আবার ফিরিয়ে আনো ওই লোকটাকে। দুই পেয়াদা ছোটে। রাখাল কিন্তু কিছুতেই আসে না। রাজা বলে, বেশ ওকে একাই থাকতে দাও।
তারপর মন্ত্রীর দিকে ঘুরে বলে, মন্ত্রী, তুমি ঠিক লোককেই এনেছ। আমি ঠিক যা ভাবছিলাম—তাই বলে দিয়েছে। সত্যি, তুলনা হয় না ওর। আর তুমিও ভারি কাজের মন্ত্রী, বড় কাজের মন্ত্রী। তবে আবারও বলছি, তোমরা এতগুলো লোক পারলে না, কিন্তু দেখ, ও সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল আমার মনের কথা।
সত্যি কথা বলতে কি, কি যে ঘটল তা কেউই বুঝতে পারল না। এমন কি মন্ত্রীও মনে মনে বলতে থাকে, ওরা দুজনে দুজনকে শুধু আঙুল দেখাল তাতেই বলা হয়ে গেল মনের কথা ! কিন্তু কথাটা যে কি তা তো জানা হল না !
মন্ত্রী ভাবে রাজাকে জিজ্ঞেস করবে, কি করবে না ! শেষে জয় হয় কৌতূহলেরই! তাই রাজাকে বলে মন্ত্রী, মহারাজ, অপরাধ না নেন তো একটা কথা বলি।
বলো মহারাজ, আপনারা দুজনে যা বুঝতে পারলেন, তা আমরা কেউই কিন্তু বুঝতে পারিনি। তাই কথাটা কি হল, তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন তাহলে আমার মানে আমাদের সবার বড় সুবিধে হয়।
ও তোমরা বুঝি বুঝতে পারনি। বেশ শোনো তাহলে, আমিই বঝিয়ে দিচ্ছি তোমাদের। রাজা বলেন, আমি একটা আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি কি একা রাজা, না আর কেউ আছে ?
উত্তরে দুটো আঙল দেখিয়ে বলল, না, আপনারা দুজন আছেন, আপনি রাজা আর ঠাকুর রাজা। সে কথায় আবার আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনজন রাজা নেই ? উত্তরে ও ভীষণভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না, মাত্র দুজন রাজা—আমি সত্যি কথা বলতে কি জান, আমিও দিনরাত ভাবি, এই পৃথিবীতে কি শুধু আমি একাই রাজা? নাকি আর কেউ আছে?
কিন্তু ও আমাকে বলে গেল, না, আমরা দুজন রাজা আছি এই বিশ্বে—আমি আর ঠাকুর। সত্যি সত্যিই তাই। এই পৃথিবীতে আমরা দুজনই শুধু বড়।
রাজার কথাটা বিশ্বাস করল মন্ত্রীও। বিশ্বাস করল আর সবাই। সেদিন সন্ধ্যেবেলা সভায় কাজকর্ম সেরে মন্ত্রী ফেরে বাড়িতে। ফিরেই ডাক দেয় সেই বোবা-কালা রাখালকে।
রাখাল আসতেই মন্ত্রী জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আজ সকালে রাজা তোমাকে কি জিজ্ঞেস করেছিল আর তুমিই বা কি উত্তর দিলে তার কিছুই বুঝতে পারলাম ! বলতো কি হয়েছিল ? রাখাল তখন ইঙ্গিতে বলে সব কথা।
রাখাল বলে, রাজা আমার কাছে একটা ভেড়া চাইল । আমি বললাম, তুমি রাজা, একটা নেবে কেন, তুমি দুটো ভেড়া নাও, আমি তোমাকে দুটোই দেব। এবার রাজা তিনটে ভেড়া চাইল । কিন্তু আমার তিনটে ভেড়াই যদি রাজা নিয়ে নেয়, তাহলে আমি থাকব কি করে ? তাই ছুটে চলে এলাম রাজসভা থেকে। পেয়াদা আসতেও তাই যাইনি।
রাখালের কথা শুনে মন্ত্রী থামল। মন্ত্রী ভাবে, যে যার ভাব বুঝেছে কিন্তু জান বেঁচেছে তার। আর এটা সম্ভব হয়েছে তার ছোট্ট মেয়েটির জন্যই। মন্ত্রী তাই তার ছোট্ট মেয়েটিকে আদর করতে থাকে আরো আরো অনেক বেশি করে।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।