পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িকতার উৎসমুখ
2143
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায়শই দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং তার ভিতরকার রূপ ছেড়ে বাইরে এসে সৃষ্টি করেছে মারামারি-খুনোখুনি’র মত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যাকে সোজা কথায় আমরা দাঙ্গা বলে চিহ্নিত করে থাকি। এবং এটি স্বাভাবিকভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানরত দুই জাতির জাতিগত দ্বন্দ্ব। একদিকে পাহাড়ি আর অন্যদিকে সরকার কর্তৃক অভিবাসিত বাঙালি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই পাহাড়ি আর বাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাবের সৃষ্টি একদিনে হয়নি; পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টির ইতিহাস বেশি দীর্ঘ নয়, আবার একেবারে ইদানিং কালেরও নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্টি, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, ঘৃণা সৃষ্টির ব্যাপারে বুঝতে হলে ইতিহাসের পাতায় কিছুটা চোখ বুলাতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালি সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি একদিনে হয় নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টির ইতিহাস বেশি দীর্ঘ নয়, আবার একেবারে ইদানিং কালেরও নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্টি, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, ঘৃণা সৃষ্টির ব্যাপারে বুঝতে হলে ইতিহাসের পাতায় কিছুটা চোখ ভুলাতে হবে।
আনুমানিক ৫৯০ সালে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন খীসা কর্তৃক রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), খারং দেশ, কাঞ্চন নগর (কাঞ্চন্দেশ) ও কালজয় (কুকি রাজ্য) প্রভৃতি রাজ্য বিজিত হলে বিশাল পার্বত্য রাজ্য চাকোমাস এর পত্তন ঘটে।
১৬১৫ সালে পর্তুগীজদের মানচিত্রে তৎকালীন চাকমা রাজ্য #চাকোমাস, ছবিঃ ফেসবুকচাকমা রাজা জনুর সময় রাজ্যসীমা ছিল পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাফ নদী), পশ্চিমে সীতাকুন্ড পাহাড় দক্ষিনে সমুদ্র ও উত্তরে চাইচাল পর্বতশ্রেণী।
১৫৫০ সালে JOAO DE BARROS নামে জনৈক পর্তুগিজের আঁকা মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীরে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে চাকোমাস (CHACOMAS) নামে একটি রাজ্যের সন্ধান পান। এর অবস্থান শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ পূর্বে এবং আরাকানের উত্তরে অর্থাৎ বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পর্যন্ত।
উপরে উল্লেখিত ইতিহাস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠি তথা চাকমা জনগোষ্ঠী কোন ভিনদেশ থেকে এই বঙ্গে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। চাকমারা প্রথমে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে চাকোমাস রাজ্যের পত্তন ঘটায়।
তারপর একে একে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকজন পার্শবর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমার থেকে চাকোমাস রাজ্যে এসে বসবাস শুরু করে। ১৯০৮ সালে শ্রী সতীশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক লিখিত “চাকমা জাতি (জাতীয় চিত্র ও ইতিবৃত্ত)” গ্রন্থে এই বিষয়ের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন।
ইংরেজরা এদেশে আসার অনেক আগে “চাকমা রাজা আর বাঙালি রাজারা একসাথে আরাকানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত”। এই থেকে প্রমানিত হয় তখন চাকমা রাজা আর বাঙালি রাজাদের মধ্যে বেশ ভাল একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দৌল্লাকে পরাজিত করে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠা। বাংলা বিজয়ের পর ইংরেজরা চোখ রাখল পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা চাকোমাস রাজ্যের দিকে।
সে সময় বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর পরিমাণে কার্পাস তুলা জন্মাত এই কারণে এই রাজ্যের আরেক নাম ছিল “কার্পাস মহল”। পরে অবশ্য নামকরণ করা হয় Chittagong Hill Tracts.
১৭৭০ ও ১৭৮১ সালে চাকমা রাজা দৌলত খাঁর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ ও চাকমা রাজার জয়লাভ।চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর সাথে ইংরেজদের পর পর তিন বছর(১৭৮৩, ১৭৮৪, ১৭৮৫) যুদ্ধ।
১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর কলকাতায় বড়লাটের কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা এবং বাৎসরিক ৫০০ মন কার্পাস তুলা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা।
ইংরেজদের সাথে চাকমা রাজার শান্তি প্রতিষ্ঠার ফলে চাকমা রাজা বাৎসরিক ৫০০ মন তুলা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করল অন্যদিকে নিজ রাজ্য শাসনের ক্ষমতা নিজের হাতেই থেকে গেল।
ফলে ব্রিটিশ শাসিত এত বৃহৎ পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে ছোট্ট এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম, চাকমা রাজার দ্বারা পরিচালিত স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে থেকে গেল।
১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ প্রতিনিধি লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রবর্তন। সারা পাক-ভারত জুড়ে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা কার্যকরী হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম নির্ভর চাকমা রাজ্যে কার্যকর হল না। এর কারন – (১) রাজতন্ত্র, (২) জুমিয়াদের এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে জুম চাষের উদ্ভাস্তু জীবন।
১৯০০ সালে জারি হল C.H.T REGULATION,1900 Act. ১৯০০ সালের ১ মে জারি হওয়া এই আইনের মাধ্যমে বাইরের কেউ যাতে পার্বত্যবাসীর সহজ-সরল জীবন যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে তার জন্য পার্বত্যবাসীদের জন্য এক প্রকার শাসনবিধি চালু করা হল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে জন্ম নিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নিল পাকিস্তান আর ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের। চাকমা রাজার দ্বারা স্বায়ত্বশাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাকিস্তান অংশের সাথে যোগ করা হল।
সেই থেকে শুরু হল পার্বত্যবাসীর ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ আর বাঙালিদের অবাধ অনুপ্রবেশ। ১৯৪৭ সালের আগে যে সব বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করত তাদের সবাই বিভিন্ন ব্যাবসার কাজে নয়তো চাকরির কারণে বসবাস করত।
পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৪৮ সালে “পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ রেগুলেশন ১৮৮১” বাতিলকরণ।
পাকিস্তান আর পাকিস্তান পূর্ব পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন আদমশুমারিঃ
১৯৪১ সাল-পাহাড়ি ৯৭.০৬% বাঙালি ০২.৯৪%
১৯৫১ সাল-পাহাড়ি ৯৩.৭১% বাঙালি ০৬.২৯%
১৯৬১ সাল-পাহাড়ি ৮৮.২৩% বাঙালি ১১.৭৭%
পার্বত্য চট্টগ্রামে এভাবে দ্রুত বাড়তে লাগল বাঙালি জনসংখ্যা। তবুও তখনো পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা মারামারির মত ঘটনা ঘটে নি। কারণ সে সময় যে সব বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসের জন্য গিয়েছিল তাদের সবাই নিয়মতান্ত্রিকভাবেই গিয়েছিল আর এরা কেউ পাহাড়িদের জমি কেড়ে নিয়ে বসবাস শুরু করে নি, ফলে মারামারিও হয়নি।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৯৯ হাজার ৯ শ ৭৭ জন লোক জমি হারা ও বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। এতে মোট চাষ যোগ্য জমির ৫৪.০৬% অর্থাৎ ৫৪ হাজার একর আবাদি জমি প্লাবিত হয়।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকারের পুনর্বাসনে অবহেলা ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৫০ হাজার নর-নারী উদ্ভাস্তু হয়ে ভারতে আর ৩০ হাজার নর-নারী উদ্ভাস্তু হয়ে বার্মায় গমন।
এর ফলে পার্বত্য এলাকার মধ্যে পরিবেশগত ভারসাম্যের বিরাট একটা পরিবর্তন হল। সাথে সাথে পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার মধ্যেও বিরাট একটা পরিবর্তন হল।
এম.এন. লারমা চট্টগ্রাম কলেজে পড়ার সময় বাম রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি পার্বত্য এলাকার জনগনকে জানিয়েছিলেন যে, কাপ্তাই বাঁধের সুফল পাহাড়িদের জন্য নয়, এটি পাকিস্তান সরকারের একটি ষড়যন্ত্র।
ফলে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। এম.এন. লারমার নেতৃত্বে তৎকালীন সচেতন পাহাড়ি জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের আওয়ামিলীগ প্রধান সাইদুর রহমানের পাহাড়ি-বিরোধী মনোভাবের কারণে তাদেরকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনে বাধা দেন।
১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে জন্ম হল স্বাধীন বাংলাদেশের।
১৯৭২ সালে রচিত হল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যার চারটি মূলনীতি হল- জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র।
১৯৭২ সালের সংবিধানে সন্নিবেশিত হল “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে; বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন”।
তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (এম.এন.লারমা) এর প্রতিবাদে সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি একজন চাকমা। আমার বাপ-দাদা চৌদ্ধ পুরুষ কেউ বলে নাই আমি বাঙালি।
একজন চাকমা কখনো বাঙালি হতে পারে না তেমনি একজন বাঙালি কখনো চাকমা হতে পারে না। এই সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরুং, চাক এদের কথা বলা হয় নি।
এই মানুষদের কথা আমি বলতে চাই। পৃথিবীর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত, আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র, সেখানে আমরা দেখি তাদের সংবিধানে বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। জানিনা, আমরা কি আপরাধ করেছি!
আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়। এর পর এম. এন. লারমা প্রতিবাদ স্বরূপ সংসদ কক্ষ ত্যাগ করলেন।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের নিকট ৪ দফা দাবী সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবীনামা পেশ করা হলে শেখ মুজিব এম. এন. লারমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “লারমা তুমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর তাহলে এক লাখ, দুই লাখ, তিন লাখ, দশ লাখ বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকিয়ে দেব। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমি তোমাদের সংখ্যালগু করে ছাড়ব”। এর পর থেকে শুরু হল আন্দোলন, সংগ্রাম।
১৯৭২ সালে বিভিন্ন গণদাবী ও ছাত্রদাবীর প্রেক্ষিতে রাঙ্গামাটির দেয়ালে দেয়ালে লিফলেট ও পোষ্টার শোভা পায় এবং ৯ জুন জেলা প্রশাসকের কাছে পাহাড়ি ছাত্র সমিতির স্মারকলিপি পেশ।
১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটির স্টেডিয়ামে এক নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক পাহাড়িদেরকে বাঙালিতে পরিণত করার ঘোষণা।
পাহাড়িদের উপর নির্যাতন,জুলুম ও ধর্ষনের প্রতিবাদে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী গঠিত হয় “শান্তি বাহিনী” বা ‘‘PEACE FORCE’’। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চলল রাজপথে আন্দোলন, সংগ্রাম।
দীর্ঘ এই চার বছরে কোন ফল পাওয়া গেল না, উল্টো বেড়ে চলল নির্যাতন, জুলুম। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানি এম. এন. লারমাকে অস্ত্র ধরার পরামর্শ দিলেন।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পথ পরিবর্তনের ফলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হয় শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম।
১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিলাইছড়ি আর্মড পুলিশ ক্যাম্প এবং খাগড়াছড়ির বেতছড়িতে পুলিশের নৌকায় সফল হামলার মধ্য দিয়ে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র কার্যকলাপের সূচনা।
১৯৭৯ সালে ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং এর জন্য ৬৫ কোটি টাকাও বরাদ্ধ করা হয়। এই ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে পুনর্বাসনের পর থেকেই মূলত পাহাড়ি-বাঙ্গালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার পথচলা শুরু।
অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশাল এলাকা। এখানে জায়গা-জমির কোন অভাব নেই, অনেক জমি পতিত রয়েছে। জমি আছে, কিন্তু চাষ করে খাওয়ার মানুষের অভাব।
যারা এই ধরনের ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে চলেন তারা আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস কিছুই জানেন না, তাই এই ধরনের চিন্তা ধারণ করেন।
যেখানে জমির অভাবে ১৯৬০ সালের কাপ্তাই বাঁধের ফলে ৮০ হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও বার্মায় চলে যেতে বাধ্য হয় সেখানে জমি কোথায়?
তার উপর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল, কাপ্তাই বাঁধের নিচে তলিয়ে যাওয়া ৫৪ হাজার একর চাষযোগ্য জমি, সরকারি অফিস-স্থাপনা, আর্মি-পুলিশ-বিজিবির জন্য বিশাল বিশাল সংরক্ষিত এলাকা তাহলে জমি কোথায়?
বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশাল অংশ (বাংলাদেশের মোট সেনাবাহিনীর ৩ ভাগের ১ ভাগ) রয়েছে, তাদের ক্যাম্পের জন্য দখল করে রেখেছে একটি বিশাল পরিমাণ জমির অংশ। তাহলে জমি কোথায়? এত বড় সংখ্যক বাঙালি পুনর্বাসন করবে কোথায়? তাহলে উপায়?
হ্যাঁ জমি আছে, উপায় আছে। পাহাড়িরা যে জমিতে বসবাস করছে সেই জমি। পাহাড়িরা ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তান বা বাংলাদেশ অংশের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না ফলে ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যকরী না হওয়ায় আর পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সরকার এই ব্যাপারে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সচেতন না করায় কেউই জমি-জমার দলিলপত্র বা বন্দোবস্ত প্রথার দিকে হাঁটল না।
তাছাড়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের অধিকাংশ অশিক্ষিত হওয়ায় এবং রাজতন্ত্রের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব ভুমি ব্যাবস্থা চালু থাকায় যে জমিতে পাহাড়িরা বসবাস করছে সেই জমি সরকারের কাছে খাস জমি।
যেই জমিটি পাহাড়িরা চৌদ্ধ পুরুষ ধরে ভোগ করে আসছে, রাজাকে খাজনা দিয়ে যাচ্ছে সেই জমিটি এক চুটকিতে কোন এক বাঙালির হয়ে গেল।
সামরিক সরকার সেই জমির দলিলপত্র বাঙালি পরিবারটির নামে করে দিল, যেই জমিতে চৌদ্ধ পুরুষ ধরে বসবাস করছে কোন পাহাড়ি পরিবার। সামরিক সরকার “মানুষ নয়, জমি চাই” নীতি অনুসরন করল।
তাছাড়া অধিকাংশ বাঙালিদের মধ্যে উগ্র জাতিয়তাবাধী চেতনা বিদ্যমান থাকায় পাহাড়িদেরকে এরা সাপ-ব্যাঙ খাওয়া নিচু জাত বলে মনে করত এবং নাক সিটকিয়ে এড়িয়ে চলত। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা সংগঠিত হয় ১৯৮০ সালে।
পার্বত্য ইতিহাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর সেটেলার দ্বারা সর্বপ্রথম গণহত্যা হয়েছিলো কাউখালী বাজার কলমপতিতে (রাঙামাটি) ২৫/৩/১৯৮০ সালে। পাহাড়ি ভাই-বোনদের মিটিং এর মধ্যে ডেকে গুলি করা হয়েছিলো।
হত্যা করা হয়েছিল ৩০০ জন এবং ১০০০ এর বেশি পাহাড়ী মানুষ রিফিউজি হিসেবে ভারতের ত্রিপুরায় পালিয়ে যায়। ঐ জায়গাগুলো আজ বাঙালিদের দখলে। পরিকল্পণাকারী সেনা কর্মকর্তারা প্রমোশন পেয়েছিলো।
১৯৮০ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা প্রেস ক্লাবে তিনজন সংসদ সদস্য (যারা উক্ত ঘটনার অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন) শাহজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন ও উপেন্দ্রলাল চাকমা ঘটনার বর্ননা করেন।
১৯৮১ সালে এক লক্ষ বাঙালি পরিবারকে ৫ একর জমি ও নগদ ৩ হাজার ৬ শ টাকা দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যাবস্থা।
২৬/৬/১৯৮১ সালে বানরাইবাড়ি, বেলতলী ও বেলছড়িতে সেটেলার বাঙালিরা প্রত্যক্ষ সেনা মদদে ৫০০ পাহাড়ি হত্যা করেছিলো এবং পাঁচ হাজার পাহাড়ি ভারতে শরনার্থী হিসেবে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলো।
১৯/৯/১৯৮১ সালে ৫০০ জুম্ম ভাই বোনের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই পৈশাচিক হিংস্রতায় সেনা এবং সেটেলার মিলিত বাহিনী তেলাফং, আসালং, গৌরাঙ্গপাড়া, তবলছড়ি, বরনালাসহ মোট ৩৫ টি পাহাড়ি গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো যার ফলে ১০০০ জুম্ম নিহত হয়েছিলো, অগনিত পাহাড়ি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো আর বাংলাদেশ সরকার আজো এই ঘটনার কথা অস্বীকার করে এবং পরবর্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেয়া হয়েছিলো মাত্র ১৮ ডলার করে।
১৯৮৩ সালের ২৬ জুন; ১১,২৬ ও ২৭ জুলাই এবং ৯,১০,১১ অগাস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সেটেলার বাঙালিদের মিলিত বাহিনী গোলাকপতিমাছড়া, মাইচ্ছাছড়া, তারাবনছড়ি, লোগাং, তারাবুনিয়া, মারমাছড়া, জেদেমাছড়া ইত্যাদিতে হামলা চালায়।
এতে ৮০০ জন মানুষ হত্যা করা হয় এবং হাজারের উপরে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাহাড়িদের পুড়ে যাওয়া এই সব জায়গা পরিষ্কার করে বাঙালি বসতি স্থাপন করা হয়।
৩১/৫/১৯৮৪ সালের ভোরবেলা শান্তিবাহীনি গোরস্থান, ভুষণছড়া ও ছোটহরিনার তিন বিডিআর ক্যাম্প আর ক্যাম্পের কাছের সেটেলারদের গুচ্ছগ্রামে আক্রমণ করে। এতে সরকারি হিসেবে ৩২ জন এবং বেসরকারি হিসেবে ১০০ জনের মত সেটেলার বাঙালি নিহত হয়।
এর প্রতিশোধ হিসেবে সেনা-সেটেলার মিলিত বাহিনী, ৩০৫ নং সেনা ব্রিগেড, ২৬নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) ১৭ নং ব্যাটালিয়ন মিলে নিরস্ত্র পাহাড়ি গ্রাম (হাটবাড়িয়া, সুগুরী পাড়া, তেরেঙ্গা ঘাট, ভূষণছড়া, গোরস্তান, ভূষণবাঘ ইত্যাদি) আগুনে জালিয়ে দিয়েছিলো।
সরকারি মতে ৫২ জন আর বেসরকারি মতে ৪০০ পাহাড়ি নিহত হয়েছিলো। এই নিহতদের মাঝে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলো শিশু ও নারী। অনেক পাহাড়ি নারী সেনা দ্বারা গনধর্ষনের পর হত্যা করা হয়েছিলো। আর ৭০০০ পাহাড়ি রিফিউজি হতে বাধ্য হয়েছিলো ভারতে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ ১৯৮৪ সালের ৫ জুন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন।
১৯৮৪ সালের ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ বিষয়ক সচিব জনাব সুলতান মাহমুদ ও তার তিন সঙ্গিকে বান্দরবানের চিম্বুক রেস্ট হাউস থেকে শান্তিবাহিনী কর্তৃক অপহরন।
⇓
১৯৮৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শান্তিবাহিনীর হামলায় দুইজন সেনাবাহিনী অফিসার নিহত।
১৯৮৬ সালের ২৯ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়িতে শান্তিবাহিনী বিডিআর ক্যাম্প আক্রমণ করেছিলো। তার ফলশ্রুতিতে সেনা আর সেটেলাররা সেখানকার গোলাকপতিমাছড়া, কালানাল, ছোট কর্মপাড়া, শান্তিপুর, মিরিজবিল, কেদেরাছড়া,
পুজগাং, লোগাং, হাতিমুক্তিপাড়া, নাপিতপাড়া, দেওয়ানপাড়া প্রভৃতি পাহাড়ি গ্রামগুলোর মানুষজনকে একটা মাঠে ডেকে জড়ো করে তাদের উপর নির্বিচারে গুলি করেছিল। লাশ হয়েছিলো ১০০ পাহাড়ি, এমনকি মিরিজবিল এলাকার এক ৭০ বছরের পাহাড়ি বৃদ্ধা পর্যন্ত রেহাই পাই নি।
পানছড়ির ঠিক একদিন পর ২/৫/ ১৯৮৬ সালে মাটিরাঙ্গাতে যেই পাহাড়িরা ভারতে পালাচ্ছিলো, সেই নিরস্ত্র দেশত্যাগী মানুষের উপর সেনারা এলোপাথারি গুলি চালিয়ে ৭০ জন পাহাড়িকে হত্যা করে।
এই হত্যা যজ্ঞের দুই সপ্তাহ পার হতে না হতেই ১৮ ও ১৯/০৫/১৯৮৬ তাং মাটিরাঙা থেকে প্রায় ২০০ জন ত্রিপুরা নারী পুরুষের দল যারা বাঁচার আশায় শিলছড়ি থেকে ভারতীয় সীমান্তের দিকে পার হচ্ছিলো তারা তাইদং, কুমিল্লাটিলা গ্রামের মাঝামাঝি এক সরু পাহাড়ি পথ পাড়ি দেবার সময় বাংলাদেশ বিডিআর এর ৩১ ব্যাটালিয়নের জোয়ানরা তাদের উপর হামলা চালায়।
যার ফলে প্রায় ১৬০ জন পাহাড়ি নিহত হয়, এমনকি গুলির হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আহতদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঐ ঘটনার বেঁচে যাওয়া অল্প কিছু সাক্ষী আজো আছে।
৮, ৯, ১০ আগস্ট ১৯৮৮ সালে হিরাচর, সার্বোতলী, খাগড়াছড়ি, পাবলাখালীতে আনুমানিক ১০০ পাহাড়ি জুম্মকে নির্মম ভাবে হত্যা ও গুম করা হয়। সেনা ও সেটেলারদের দ্বারা ধর্ষনের শিকার হয় অনেক পাহাড়ি নারী।
৮/৫/১৯৮৯ সালে লংগদুতে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ অজ্ঞাত নামা লোকের হাতে খুন হন। এর দায় চাপানো হয় শান্তিবাহীনির কাঁধে।
এর জের ধরে সেনা সৃষ্ট ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি নামক সশস্ত্র সেটেলারদের দল সেনা মদদে অমানুষিক হত্যা যজ্ঞ চালায়। এতে নিহত হয় ৪০ জন পাহাড়ি। পুড়িয়ে দেয়া হয় বৌদ্ধ মন্দির।
এমন কি তৎকালীন সাবেক চেয়ারম্যান অনিল বিকাশ চাকমার স্ত্রী, সন্তান ও নাতিকে পর্যন্ত নির্মম হত্যা যজ্ঞের শিকার হতে হয়। সেটেলাররা আজো অনিল বিকাশ বাবুর সমস্ত জমি দখল করে রেখেছে।
১৯৮৯ সালের ৯ মে খাগড়াছড়ির পানছড়িতে শান্তিবাহিনীর হামলায় ৫ জন বিডিআর সদস্য নিহত। ১৯৮৯ সালের ৩১ মে সাবেক সংসদ সদস্য উপেন্দ্রলাল চাকমার ভারতের ত্রিপুরার শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় পার্থনা।
১৯৯০ সালের ২৫ জুলাই শান্তিবাহিনী রাঙ্গামাতিতে রেডিও রিলে স্টেশনে হামলা চালিয়ে কিছুক্ষন তা দখল করে রাখে। ১৯৯০ সালের ১৪ অক্টোবর রাঙ্গামাতিতে সেটেলার বাঙালি কর্তৃক ১৪ জন পাহাড়ি নারী ধর্ষিত।
১৯৯০ সালের ২৭ ডিসেম্বর পুনর্বাসিত বাঙালি কর্তৃক ৪ পাহাড়ি হত্যা। ১৯৯১ সালের ২৪ মার্চ বরকল থেকে ছোটহরিণাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চে শান্তিবাহিনীর হামলায় ২ জন পুলিশসহ চারজন নিহত।
১৯৯২ সালের ২ ফেব্রুয়ারী মারিশ্যা থেকে রাঙ্গামাতিগামী বোটে দুইটি বোমা বিস্ফোরিত হলে এতে একজন বাঙালি যাত্রী নিহত ও বোটের ড্রাইভার গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনার জের ধরে সেটেলার বাঙালিরা পাহাড়ি যাত্রীবাহী বোটে হামলা চালায়।
এতে ৩০ জনকে হত্যা করা হয়। ১৪ জনের লাশ পাওয়া যায় এবং বাকি লাশগুলো পানিতে হারিয়ে যায়। দুইজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সেই বোটে করে দুটি কেরোসিনের টিন বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
এই থেকে বিস্ফোরণ হলেও বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোতে প্রচার করা হয় শান্তি বাহিনী এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
১০/০৪ /১৯৯২ সালে লোগাঙে পাহাড়িদের বিরুদ্ধে হত্যা যজ্ঞ চালানো হয়। কাহিনীর সুত্রপাত। এক পাহাড়ি মহিলা তার গাবাদি পশু চড়াতে গ্রামের অদূরে গিয়েছিলো।
সেখানে দুই জন সেটেলার বাঙালি তাকে ধর্ষণ চেষ্টা চালালে এক পাহাড়ি যুবক বাধা দেয় এবং তাকে সেখানেই হত্যা করা হয়।
এতে সেই দুই সেটেলার বাঙালিও আহত হয়। আহত সেটেলাররা পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পে অভিযোগ করে যে শান্তিবাহীনিরা তাদের হত্যা চেষ্টা করেছে।
এর জের ধরে সেনা-সেটেলার দল মিলে প্রায় ১৫০০ পাহাড়ি জনসংখ্যা অধ্যুষিত গুচ্ছ গ্রামগুলোতে হামলা চালায়, এতে করে প্রায় ৪০০ পাহাড়ি নিহত হয়।
প্রায় ৮০০ পাহাড়ি বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। আশে পাশের গ্রামগুলো থেকে প্রায় ২০০০ হাজার পাহাড়িকে শরনার্থী হতে হয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।
২০ এপ্রিল ১৯৯২ খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় ফিরে ২১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি (রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মি ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ) কর্তৃক লোগাং হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করে বিবৃতি প্রদান।
২৭ এপ্রিল ১৯৯২ বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার লোগাং হত্যাকান্ডের স্থান পরিদর্শন করে তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী।
১৭/১১/১৯৯৩ সালে নানিয়ারচর বাজারে পাহাড়িদের শান্তিপুর্ন র্যালীতে অতর্কিতে হামলা চালায় সেটেলার বাহিনী। এর নেতৃত্বে ছিলো সেটেলারদের সংগঠন পার্বত্য গণ পরিষদের নেতা মোঃ আইয়ুব হোসাইন এবং তদানীন্তন বুড়িঘাট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ।
পাহাড়ি ছাত্ররা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলে পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্প থেকে পাহাড়ি ছাত্রদের উপর এলোপাথারি গুলি চালানো হয়। এতে নিহত হয় ২৯ জন পাহাড়ি আর আহত হয় শতাধিক।
১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ বান্দরবান জেলা সন্মেলনকে কেন্দ্র করে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সংগঠন পার্বত্য গণ পরিষদের হরতাল আহব্বান ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের মিছিলে হামলা। ৪ জন পাহাড়ি ছাত্রের মৃত্যু, ২৮ জন পাহাড়ি আহত এবং ২৪৭ টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
১৯৯৬ সালের ১১ জুলাই রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থানার লাইল্যেঘোনা থেকে হিলউইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণ। ১৯৯৬ সালের ২৬ জুলাই ৯ বাঙালি অপহৃত।
১৯৯৬ সালের ৭ আগস্ট রাঙ্গামাটির কাউখালি থানার ওসিসহ ৬০ জন বাসযাত্রী অপহৃত। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর।
১৯৮১ সালে এক লক্ষ বাঙালি পরিবারকে ৫ একর জমি ও মাসিক রেশনের প্রতিশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়, জমির দলিলও সেভাবেই দেওয়া হয়। কিন্তু আদৌ কি পাহাড়িদের বসবাসের জমি বাদেও এই পুনর্বাসন করা বাঙালিদের জন্য ৫ একর জমি ছিল? না, ছিল না।
পুনর্বাসিত সেই বাঙালিটি গিয়ে দেখে তার দলিলের নির্দেশিত জায়গায় বসবাস করছে কোন এক নাক চেপ্টা পাহাড়ি। আর দলিল দেওয়ার সময় বাঙালিটিকে বুঝিয়ে দেওয়া হল “দেশ আমার, মাটি আমার”।
তাছাড়া বাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে মুসলিম বাঙালিদের অনেকের মধ্যে পাহাড়ি বিদ্বেষী মনোভাব আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল যার প্রমাণ পাওয়া যায় এম.এন. লারমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনে বাধা প্রধানের মাধ্যমে।
আগেকার দিনে হিন্দু-মুসলিম একে অপরকে যেভাবে নাক ছিটকে চলত তখনকার মুসলিম বাঙালিরাও পাহাড়িদেরকে নিম্ন শ্রেনীর জাত মনে করে নাক ছিটকে চলত। কারন এরা সাপ খায়, ব্যাঙ খায় এদের সাথে চলা মানে জাত খোয়ানো।
পাহাড়িরা অন্য দেশ থেকে এই দেশে এসে বসবাস শুরু করেছে। এই দেশ বাঙালির, নয় কোন অন্য দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা নাক চেপ্টা পাহাড়ির। যার প্রমান আমরা পায় শ্রদ্ধেয় পরিচালক তানবির মোকাম্মেল কর্তৃক তৈরিকৃত ডকুমেন্টারি “কর্ণফুলির কান্না”তে।
এখানে আশির দশকে কুমিল্লা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত জনৈক বাঙালি বলেন, “পাহাড়িরা আমাদের সাথে গেঞ্জাম করে, বলে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এই দেশ আমার, আর ওরা বিদেশ থেইকা আইসা বলে এই জমি তাদের।
সরকার কি এগুলো দেখে না? তারপর পরিচালক প্রশ্ন করেন তাহলে পাহাড়িদের দেশ কোথায়? জনৈক বাঙালির ক্রুদ্ধ উত্তরঃ থাইলন, থাইলন। তাদের দেশ হল থাইলন (থাইল্যান্ড)। এই হল ব্রেইন ওয়াশ আর উগ্র বাঙালি জাতিয়তাবাদী মানসিকতা।
ফলে শুরু হল পাহাড়ি আর সেটেলার বাঙালি দন্ধ। সেটেলার বা পুনর্বাসিত বাঙালিটি সরকারের দেওয়া জমির দলিল দেখিয়ে পাহাড়িটিকে উদ্দেশ্য করে বলছে এই জমি আমার।
আর পাহাড়িটি তার ভোগ-দখলি স্বত্বের দলিল দেখিয়ে বলছে চৌদ্দ পুরুষ ধরে বসবাস করছি, এই জমি আমার। ফলে অনিবার্যভাবে পাহাড়ি আর সেটেলার বাঙালি মারামারি বেঁধে গেল। কিন্তু পাহাড়িটির জোর কম, রাষ্ট্র নেই পাশে।
কিন্তু অন্য দিকে বাঙালিটির সব আছে। আইন আছে, রাষ্ট্র আছে, আর্মি আছে, পুলিশ আছে, দলিল আছে। ফলে অবধারিতভাবে পাহাড়ি পরিবারটি উচ্ছেদ হয়ে গেল। বাঁচার প্রয়োজনে পাহাড়ি পরিবারটি আরো বেশি করে জঙ্গলমুখী হল। এখানেও বাঁধা আসল।
বন বিভাগ বলছে এই জমি আমার, তুমি এখানে বসবাস করতে পারবে না। সেটেলার বাঙালিরা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে শুরু করল পাহাড়িদের উপর হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ।
ফলে এইসব কারণে পাহাড়িদের মনেও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকল আর সৃষ্টি হল সেটেলার বাঙালি বিরোধী মনোভাব। পাহাড়িদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা উপরে উল্ল্যেখিত এই সব গণহত্যা, বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ, পাহাড়ি নারীদের ধর্ষণ, বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
অন্যদিকে, বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছে বিভিন্ন সরকার ও উগ্র ধর্মান্ধ বিদেশি শক্তি। এভাবেই পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক মনোভাবের সুত্রপাঠ।
পাহাড়িরা দিন দিন নিজ ভূমিতে হয়েছে পরবাসী, আর বাঙালি জনসংখ্যা বেড়েছে হু হু করে জ্যামেতিক হারে। সেই ১৯৪১ সালে পাহাড়ি-বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত কত ছিল আর বর্তমানে কোন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে তা সর্বশেষ আদমশুমারি ফলাফলের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা আরো বেশি পরিষ্কার হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা (আদমশুমারি ২০১১)
মোট: ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ২১৪ জন
আদিবাসি/পাহাড়ি/জুম্ম জনসংখ্যা: ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৪১ জন
বাঙালি জনসংখ্যা: ৮ লাখ ০৬ হাজার ৬৭৩ জন
রাঙামাটি
মোট: ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন
আদিবাসী/পাহাড়ি/জুম্ম: ৩ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৩ জন
বাঙালি: ২ লাখ ৫৫ হাজার ৬১ জন
বান্দরবান
মোট: ৪ লাখ ৪ হাজার ৩৩ জন
আদিবাসী/পাহাড়ি/জুম্ম: ১ লাখ ৭২ হাজার ৪০১ জন
বাঙালি: ২ লাখ ৩১ হাজার ৬৩২ জন
খাগড়াছড়ি
মোট: ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯৬৭ জন
আদিবাসী/পাহাড়ি/জুম্ম: ৩ লাখ ১৬ হাজার ৯৮৭ জন
বাঙালি: ৩ লাখ ২১ হাজার ৯৮০ জন
জাতিগত নির্মূলীকরণ তত্ত্বের এই কূটকৌশলের ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রতা একটি বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে। ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ মানসিকতা এই ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আগুনে ঘি ঢালার মত উসকে দিচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী মুসলিম বাঙালিরা চায় পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য ধর্মের কোন লোক থাকবে না।
মুখে সরাসরি এই কথাগুলো উচ্চারণ না করলেও ফেসবুকে সমঅধিকার আন্দোলন, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ সহ উগ্র বাঙালিদের বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপে এদের মানসিকতার যথার্থ প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
এরা ছোটকাল থেকেই বড় হয় ভুল ইতিহাস জেনে, পাহাড়ি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে। ২০১৩ সালের বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে এসেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণী মনে করে পাহাড়িরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
যেখানে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেণীর একটি অংশ এই ধরনের ইতিহাস শিখে সেখানে অশিক্ষিত বাঙালিরা হুজুগে মাতাল হবে এই ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। পার্বত্য এলাকার বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টিতে সামরিক বাহিনী সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভুমিকা রেখেছে।
সামরিক বাহিনী শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যেই পাহাড়ি বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সৃষ্টিতে কার্যকর ভুমিকা রেখেছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে পার্বত্য এলাকার সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রন করেছে।
কোন সংবাদ প্রকাশের আগে সেনাবাহিনীর গ্রীন সিগন্যাল পেলেই তারপর সেই সংবাদ প্রকাশ করা যেত। এর সাথে সাথে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছিল পদলেহনকারী পেটুয়া সাংবাদিক বাহিনী।
যেই সব সাংবাদিক সেনাবাহিনীর সহায়তায় আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল জায়গা, বাগান ও অট্টালিকার মালিক। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ১৯৯৭ সালের আগ পর্যন্ত দেশের মানুষ কোন সময় সঠিক তথ্য পায় নি। যেই তথ্য জেনেছে তা সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট একমুখী সংবাদ।
ফলে আজ দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে পাহাড়িরা সংগ্রাম করেছিল স্বাধীনতার জন্য, কোন বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামে যেতে পারে না আর গেলে চাকমারা ধরে ধরে মারে, পাহাড়িরা খুব হিংস্র, পাহাড়িরা বাঙালিদের দেখতে পারে না, পার্বত্য চট্টগ্রামে অঢেল ভুমি পতিত রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব কথা শুধুমাত্র ধারণার উপর ভিত্তি করে নয়, গত ৭ বছরের অধিক সময় ধরে সমতলের বাঙালিদের সাথে মিশে মিশে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ইসলামি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এরা পার্বত্য এলাকার মুসলিমদের মধ্যে প্রচার করছে উগ্র ধর্মান্ধতা। পাহাড়িরা হল বেধর্মী আর বেধর্মীর সাথে বন্ধুত্ব করা পাপ। এরা সাপ, ব্যাঙ, শুয়োর ইত্যাদি হারাম খাবার খায়। তাই এদেরকে এখন মুসলমান বানানো ফরজ কাজ হয়ে গেছে।
তার জন্য এরা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর বাধার মুখে পড়ে উঠছেনা।
তা না হলে এত দিনে জোর-জবরদস্তি করে কতজন পাহাড়িকেই যে ইসলাম ধর্ম গ্রহনে বাধ্য করতো তার হিসেব নেই। জোর করে পেরে উঠবে না জেনে এরা এখন লোভের ফাঁদে ফেলে মুসলিম বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যার ফলে আমরা দেখি বান্দরবানে অবস্থিত “উপজাতিয় মুসলিম উন্নয়ন সংস্থা” কিংবা কিছুদিন আগে ঢাকার সবুজবাগ থানার একটি মাদ্রাসা থেকে উদ্দারকৃত ১৬ জন ত্রিপুরা শিশু।
যাদের পরিবারকে লোভের ফাঁদে ফেলে বাধ্য করা হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহনে। বর্তমানে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে গ্রাস করছে সেই ব্যাপারে নিচের এই তথ্য থেকে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যাবে।
২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে মজজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডা/বিহার এর সংখ্যাঃ
মসজিদ -মোট ২২৯৭; খাগড়াছড়ি-৬৯৫; রাঙ্গামাটি-১২১৩; বান্দরবান-৩৮৯
মাদ্রাসা -মোট ১৫৬২; খাগড়াছড়ি-৮৬৯; রাঙ্গামাটি-৩৫১; বান্দরবান-৩৫২
প্যাগোডা/বিহার -মোট ১৪৭১; খাগড়াছড়ি-৮১৭; রাঙ্গামাটি-৪৪৯; বান্দরবান-২০৫
মন্দির – মোট ৪১৫; খাগড়াছড়ি-৩২৪; রাঙ্গামাটি-৬৯; বান্দরবান-১০
গির্জা –মোট ৩৬৬; খাগড়াছড়ি-১২৫; রাঙ্গামাটি-১২২; বান্দরবান-১১৯
১৯৯৭ সালের চুক্তি পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক মনোভাব অনেকটা প্রশমিত করতে পারতো। কিন্তু বিভিন্ন সরকার এই চুক্তিকে নিয়ে ভোটের রাজনীতি করার ফলে চুক্তি হওয়ার দীর্ঘ ১৫ বছর পরেও সাম্প্রদায়িক মনোভাব কোন অংশে তো কমেনি, বরং বেড়েছে।
শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে শান্তি আসার কথা থাকলেও শান্তি আসে নি। উপর্যুপরি দেখতে পাই চুক্তির পরেও মহালছড়ি দাঙ্গা, বাবুছড়া দাঙ্গা, দীঘিনালা দাঙ্গা, মেরুং দাঙ্গা, মাটিরাঙ্গা-গুইমারা দাঙ্গা, খাগড়াছড়ি দাঙ্গা, বাঘাইছড়ি দাঙ্গা, রাঙ্গামাটি দাঙ্গা।
এই সব দাঙ্গা-হাঙ্গামা-ধর্ষণের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটা পাহাড়ি শিশু পরবর্তিতে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা পাবে না তো, অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা পাবে?
এই ব্যাপারে বাবুছড়া দাঙ্গার ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাঠ করি। আমি তখন উঠতি বয়সের কিশোর। দীঘিনালা থেকে বাবুছড়া ১২ কিলোমিটার দুরত্বের রাস্তা। এর মধ্যে কোন বাঙালি পরিবার নেই।
বাবুছড়া বাজারের কাছে বাঙালিদের গুচ্ছ গ্রাম আর গুচ্ছ গ্রামের কাছেই পুলিশ ফাঁড়ি। তার আরো কিছু দূরে সেনা ছাউনি। সেটেলার বাঙালিদের এই গুচ্ছগ্রামের আগে পিছে আর কোন বাঙালি বসতি নেই, শুধুমাত্র পুলিশ ফাঁড়ি আর সেনা ক্যাম্প।
এই দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা ছিলো এই সেটেলার বাঙালিদের কিন্তু তার বদলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো পাহাড়িরা। অনেক পাহাড়িদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আর আহত হয় অনেকে নিহত হয় কয়েকজন।
বিপরীত দিকে কোন সেটেলার বাঙালির বাড়ি পুড়ে যাওয়া বা কেউ আহত হওয়ার কথা শুনি নি। সেদিন এই ঘটনার প্রতক্ষদর্শী কয়েকজনের মুখে শুনেছি, সেনাবাহিনী সেটেলার বাঙালিদেরকে উৎসাহ দিয়েছে পাহাড়িদের বাড়ি পুড়িয়ে দিতে।
সেনাবাহিনী অস্ত্র উচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যাতে পাহাড়িরা কোন ব্যারিকেড তৈরি করতে না পারে আর এই সুযোগে সেটেলার বাঙালিরা ইচ্ছামত দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুটপাত করতে পারে নির্বিঘ্নে।
সেই দাঙ্গায় আমাদের বাড়ির পাশের এক কাকা মরতে মরতে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন ছিল বাবুছড়া বাজারের সাপ্তাহিক বাজার। তিনি জমিতে ফলানো বেগুন বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবুছড়া বাজারে।
হতাত করে দাঙ্গা শুরু হলে তিনি প্রাণ ভয়ে বেগুনের ঝুড়ি ফেলে রেখে দৌড়ে আশ্রয় নেন একটা দোকানের মধ্যে। কিন্তু বিধিরাম, সেই দোকান ছিল এক সেটেলার বাঙালির। সেই দোকানদার আশ্বাস দিয়েছিলেন কিছু হবে না, আপনি নিরাপদে চলে যেতে পারবেন।
কিন্তু কিছুক্ষন পরে সেই দোকানদার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে এসে দোকানের মধ্য থেকে সেই কাকাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে দা দিয়ে মাথায়, সারা গায়ে কোপাতে থাকে। পরে মৃত মনে করে মাইনি নদীতে ফেলে দেয়।
সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে অনেকদিন যাবৎ পাঞ্জা লড়ে ফিরে আসেন মৃত্যুর মুখ থেকে।
এই ঘটনার অনেকদিন পরে এক বাঙালি আইসক্রিম ওয়ালা সেই কাকার বাড়ির পাশ দিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতে করতে যাচ্ছিল। সেই বাঙালি আইসক্রিম ওয়ালাকে দেখে একটা দা দিয়ে তেরে যান মারার জন্য।
পরে বাড়ির পাশের আত্মীয়-স্বজন কোনরকমে বুঝিয়ে শান্ত করে এই বলে যে, “তোমাকে মেরেছে অন্যরা, তাদের প্রতিশোধ তুমি এর উপর দিয়ে নিতে চাইছ কেন”? এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হচ্ছে কিভাবে।
যখন একটা পাহাড়ি, বাঙালিদের দেওয়া আগুনে তার বাড়ি-ঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়, যখন বাঙালিদের দ্বারা কোন পাহাড়ি নারী ধর্ষিত হয় তখন তার বাবা-ভাইয়ের কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আশা করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।
এই সব ধর্ষণ, খুন বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা হলে তখন হইতো বলা যেত এতে পাহাড়িদের দোষ আছে, সাম্প্রদায়িক চেতনা আছে। কিন্তু যেই ঘটনাগুলো বছরের পর বছর দেখতে দেখতে একটা পাহাড়ি ছেলে বড় হয় তখন সেই ছেলেটির চোখে যদি বাঙালি বিদ্বেষের আগুন খেলা করে তাতে দোষ ছেলেটিকে দেওয়া যায় না।
এর জন্য সম্পুর্ণ দোষ বর্তায় রাষ্ট্রের উপর। কারণ রাষ্ট্র ব্যার্থ হয়েছে পাহাড়ি ছেলেটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ দিতে। যেখানে রাষ্ট্রই তার সাথে বৈমাত্রেয়, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত ব্যবহার করে সেখানে পাহাড়িটির সহিংস পথ বেঁচে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পাহাড়িদের উপর পরিচালিত এতগুলো হত্যা, ধর্ষন, লুটপাতের কোন সুষ্ঠু বিচার আজ পর্যন্ত কোন পাহাড়ি পেয়েছে বলে শোনা যায় নি। রাষ্ট্র যদি পুরো একটা জাতির সাথে বৈমাত্রেয় আচরণ করে, আইন শুধু বাঙালিদের জন্য এমন মনোভাব পোষণ করে তাহলে সেখানে পাহাড়িদের সহিংস পথ বেঁচে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পাহাড়িরা সাম্প্রদায়িক হয়-হচ্ছে ঘটনার ভুক্তভোগি হিসেবে। বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই ভুক্তভোগি কথাটি তেমন একটা প্রযোজ্য নয়। তবে এই বাঙালিরাও যে একেবারেই ভুক্তভোগি নয় সেই কথাটিও বলা যাবে না। কথায় আছে, “নগরে আগুন লাগলে দেবালয় এড়ায় না”।
এই সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পাহাড়িরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বাঙালিরাও কম-বেশি ক্ষতির শিকার হয়।
সেটেলার বাঙালিদের দেওয়া আগুনে বাড়ি-ঘর হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া, ধর্ষিত হওয়া পাহাড়ি মেয়েটির বাবা-ভাই নিশ্চয় সারাদিন বসে বসে বসে বিলাপ করবে না। তারাও চেষ্টা চালাবে প্রতিশোধ নেওয়ার।
এই প্রতিশোধ চেষ্টা সফল হলে হইতো আগুন জ্বলবে কোন বাঙালির বাড়িতে। যেই বাঙালিটির বাড়ি পুড়ে যাবে তার মনেও তখন সৃষ্টি হবে পাহাড়ি বিদ্বেষী মনোভাব। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির এই চক্রাকার ঘুর্ণন চলছে সেই ১৯৮০ সালের পর থেকে।
তবে আজ পর্যন্ত পাহাড়িদের কাছে কোন বাঙালি নারী ধর্ষিত হওয়া দূরে থাক কোন বাঙালি নারী সামান্য যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে আজ অবধি শোনা যায় নি।
অথচ পাহাড়ি নারীরা বছরের পর বছর ধরে বাঙালিদের যৌন লালসার শিকারে পরিণত হচ্ছে। যেই পাহাড়ি সমাজের মধ্যে ধর্ষণ বলে কোন ব্যাপার ছিল না, সেই পাহাড়িরা নারীরাই আজ ধর্ষিত হচ্ছে বাঙালি জনগোষ্ঠির কাছে।
পাহাড়িরা নারী-পুরুষ একসাথে মিলেমিশে ক্ষেত-খামারে-জুমে কাজ করে, বৈসাবিসহ সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসাথে মিলেমিশে হাঞ্জি, জগড়া, দ-চুনি পান করে অথচ শোনা যায় নি কোন পাহাড়ি রমণী তার প্রতিবেশী অন্য একজন পাহাড়ির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে।
২০০৭ থেকে ১০১২ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের উপর সহিংসতার চিত্রঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা বলতে শুধু চাকমা, মারমা নয় এর সাথে জড়িত আছে মুরুং, হাজং, পাংখো, বোম, লুচাই, চাক ইত্যাদি। এদের কারো ভাষার সাথে কারোর মিল নেই, অনেক ক্ষেত্রে নেই সংষ্কৃতির মধ্যেও মিল। মিল শুধু এক জায়গায়, তা হল এরা সবাই নাক চেপ্তা, চোখ ছোট মঙ্গোলয়েদ গোত্রের মানুষ।
এরা সবাই যে যার জাতির জাতিয়তাবাদী চেতনা বহন না করে সবাই মিলে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনা ধারণ করার ফলে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাধী চেতনা ধারণ করা বাঙালিদের তুলনায় কম।
অনেকগুলো সম্প্রদায় মিলে যখন জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনা ধারণ করে তখন স্বভাবতই তাদের মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেকগুলো জাতি মিলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনা চর্চার ফলে তারা বাংলাদেশের বাঙালিদের তুলনায় অনেক বেশি পরিমানে অসাম্প্রদায়িক।
কথায় আছে, “সঙ্গদোষে লোহা ভাসে”। যারা নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করতো বা যে সব স্থায়ী বাঙালি (১৯৮০ সালের আগে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে বসবাস শুরু করা) আছে, তাদের বংশধরদের মধ্যেও আজ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বীজ রোপিত হয়ে গেছে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে।
বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম পালনকারী বাঙালিদের মধ্যে বাঙালিত্বের চেয়ে ইসলামের প্রভাব বেশি থাকার ফলে তাদের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক চেতনা বেশি পরিমাণে বিদ্যমান।
পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যেকার এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব ১৯৯৭ সালের চুক্তি অনুযায়ী ভুমি ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে অনেকাংশে লাঘব করা যেত। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে সবচেয়ে বেশি জিইয়ে রেখেছে ভূমি বিরোধ আর সেনাশাসন।
কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের দীর্ঘ ১৫ বছরেও বিএনপি আর আওয়ামিলীগ সরকার এই ব্যাপারে কোন ধরনের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহন করে নি, বরং বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহন করে শান্তি প্রক্রিয়াকে করেছে দীর্ঘায়িত।
তথ্যসূত্রঃ
১. দৈনিক পূর্বকোণ ৩রা ডিসেম্বর ১৯৯৭
২. জুম্ম সংবাদ বুলেটিন ১০ নভেম্বর ২০০৫
৩. পরিষদ-বিতর্ক রিপোর্ট,খন্ড ২,সংখ্যা ৯,২৩ অক্টোবর ১৯৭২
৪. কাপেং ফাউন্ডেশন রিপোর্ট; Types Of Violence Against Indigenous Women In CHT (2007-2012)
৫. Bangladesh Buearu of Stastic (ওয়েবসাইট)
৬. Massacre in CHT (www.angelfire.com/ab/jumma/massacre.html)
লেখকঃ এডিসন চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।