সুইডেনের উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে একটি বিজয়

Rahin Chakma
Last updated May 16th, 2020

1224

featured image

সাম্প্রতিক একটি কোর্টের রায় সুইডেন এবং এর বাইরেও আদিবাসীদের অধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে।

জানুয়ারীর শেষের দিকে, আদিবাসী সামি রেইনডিয়ার পালক সম্প্রদায়, গির্জাস (Girjas), সুইডিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়ায়ে জয়ী হয়। সুইডিশ সুপ্রিম কোর্ট আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে তাদের বংশানুক্রমিক ভূমিতে বসবাসের দাবিকে আইনত স্বীকৃতি দেয় এবং সুইডেন রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়াই গ্যালিভারে (Gallivare)  গির্জাস সামি গ্রামকে তাঁদের অঞ্চলগুলিতে শিকার ও মাছ ধরার অধিকার প্রদান করে।

এই যুগান্তকারী রায়টি একটি জলবায়ু জরুরি অবস্থার মধ্যে আসে যা কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির  মধ্যে ফেলেছে। আদিবাসীদের ভূমি ও জীববৈচিত্র্য আঞ্চলিক প্রশাসনের মূল ব্যবস্থা যা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে। এ হিসাবে, গির্জাসদের (Girjas) তাঁদের ভূমির উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার লড়াইকেও জরুরি জলবায়ু পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত।

পৃথিবীর ভবিষ্যতকে বিঘ্নিত না করে পৃথিবীজুড়ে আদিবাসীদের বেঁচে থাকার ও উন্নতি সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবুও তাঁদের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সংকটকে সহ্য করতে হচ্ছে।

সুইডেন এবং নরও‍য়ে থেকে ফিন্ডল্যান্ড এবং রাশিয়া পর্যন্ত বর্তমানে সামি সম্প্রদায়ের পৈতৃক ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশগুলোর প্রভাবশালী জীবনধারা ও রাজনীতি দীর্ঘকাল ধরে সামি সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, খাদ্য সুরক্ষা, ঐতিহ্যবাহী জীবন-জীবিকা এবং ভূমির  সুব্যবস্থাপনার প্রতি হুমকি স্বরুপ। তবে চলমান জলবায়ু সংকটের কারণে হুমকি পূর্বের চেয়ে এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ।

সুইডেনের প্রায় অর্ধেক অঞ্চল সামিদের পৈতৃক ভূমি। যদি না উপনিবেশিক শাসকরা এই ভূমি চুরি না করতো তাহলে সুইডেন কখনও সমৃদ্ধশালী ও প্রগতিশীল হতে পারতো না, আজকে যা নিয়ে সে গর্ব করে।

সুইডেন এমন একটি মানসিকতার ফসল যা আদিবাসীদের ভূমি এবং মানুষকে তার সুবিধার্থে শোষণ করার পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে করে। এমনকি এই মানসিকতা এখনও তার রাষ্ট্র সমর্থিত নিষ্কাশন (Extraction) শিল্পগুলোতে আজও বেঁচে আছে যা আদিবাসীদের ভূমি গ্রাস করে, নীতিসমূহ যা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে  দেশান্তরি করতে বাধ্য করে এবং সামি সম্প্রদায়ের ভাষাগুলি নির্মূলের মতো অবিরাম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রচেষ্টা যা অপূরণীয় লোকসান এবং বহু প্রজন্মকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিজয়ের সত্ত্বেও গির্জাসের মামলাটি আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে সুইডেন তার উপনিবেশিক ইতিহাসকে স্বীকৃতি জানাতে এবং সম্বোধন করতে রাজি নয়।

বিচার চলাকালীন সময়ে রাষ্ট্র বিষয়টিকে একটি প্রশাসনিক বিবাদ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল। প্রকৃত পক্ষে যা ঘটেছিল তা হলোঃ জনগণের চুরি হওয়া জিনিষগুলো ফিরিয়ে আনার একটি ন্যায়ের লড়াই ।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এমনকি দাবি করার চেষ্টা করেছিলেন যে গির্জাসের আদিবাসী পরিচয় এই মামলার সাথে অপ্রাসঙ্গিক। 

আদিবাসী ও জনজাতিদের অধিকারের বিষয়ে সুইডেন এখনও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কনভেনশন ১৬৯- এ অনুসমর্থন করেনি, এই বিষয়টির উপর জোর দিয়ে তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, “সামিদের বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি জানাতে সুইডেনের কোনো বিশেষ বাধ্যবাধকতা নেই ” এবং শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আইনের উপর নির্ভর করে গির্জাদের পরিচয় এবং ভূমির সাথে তাদের সংযোগের বিষয়ে কোনো বিশেষ বিবেচনা না করে মামলাটি মূল্যায়নের জন্য আদলতকে আমন্ত্রণ জানান।

সামি যুব সমিতির সামিনুওরার (Saami Youth Association Saminuorra) জুলিয়া রেন্সবার্গ (Julia Rensberg) গত শরৎকালে মামলার চূড়ান্ত কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে তুলে ধরেছিলেন কীভাবে রাষ্ট্র একতরফাভাবে সামির উপর চাপানো আইন ও বিধিবিধানের মাধ্যমে বিরোধটি সমাধানের চেষ্টা করেছিল এবং যা কেবল রাষ্ট্রীয় এজেন্ডার সাথে খাপ খায়। তিনি বলেছিলেন যে “এই আইন কে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং কখন আইনগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল” – তা মনে রাখা দরকার।

প্রকৃতপক্ষে গির্জাসের বিরোধিতা করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, হান্স ফোর্সেল (Hans Forsell) সুইডেন রাষ্ট্র দ্বারা সামিদের (Saami) ভূমি অধিকার অস্বীকার করাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য উনিশ শতকের সেকেলে ও নির্মম বর্ণবাদী নথি উল্লেখ করতে লজ্জা পাননি। সুইডিশ সামি পিপলস ন্যাশনাল ইউনিয়নের (National Union of the Swedish Saami People) চেয়ারম্যান আসা লারসন ব্লাইন্ড (Asa Larsson Blind) উদ্ধৃত বাক্যটির প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছিলেন, “এটি বেশ মন খারাপ করার বিষয়।

প্রত্যেকেই জানেন যে এই নথিগুলির অস্তিত্ব রয়েছে, রাষ্ট্র বলেছিল যে তারা আর এই ধরনের বক্তব্য সমর্থন করবেনা। কেন তারা নথিগুলোর উপর ভর করে আইনী প্রক্রিয়া চালাতে চেয়েছিল আমি তা বুঝতে পারছিনা।”

যদিও গির্জাদের বিরুদ্ধে সুইডিশ রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তিটির বাক্যগুলি নিঃসন্দেহে বিরক্তিকর ছিল, তবুও যাঁরা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রের আদিবাসী অধিকারের প্রতি প্রতিষ্ঠিত মনোভাবের সাথে পরিচিত কারো কাছে এটি অবাক করার বিষয় নয়।

আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন উনিশ শতকের বর্ণবাদী নথিগুলো উল্লেখ এবং আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুসমর্থন প্রত্যাখ্যান ছাড়াও সুইডিশ রাষ্ট্র নবায়নযোগ্য শক্তির সমস্যাযুক্ত একটি আলোচনা ব্যবহার করে এই যুক্তি দেয় যে, বৃহত্তর পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উদ্বেগের জন্য অবশ্যই সামি সম্প্রদায়ের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হবে।

স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেবেকা লরেন্স (Rebecca Lawrence) যেমন ২০১৪ সালের একটি গবেষণাপত্রে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, সামিরা যে ভূমি ব্যবহার করে তা উপেক্ষা করে এটি এই যুক্তিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে যে, “প্রচন্ডভাবে দূষিত এবং শিল্পায়িত সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলের পরিবর্তে উত্তরের দিকে বায়ুশক্তির জন্য অধিকতর জায়গা রয়েছে।”

সামি সম্প্রদায়ের সাথে সুইডিশ রাষ্ট্রের আচরণটি ইউএন হাইকমিশনার অফিস এবং ইউরোপ কাউন্সিলের অফিসের মতো আন্তুর্জাতিক সংস্থাগুলির দ্বারাও বার বার সমালোচিত হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ের মূল যে সমস্যাটি রয়েছে তা আমরা আর উপেক্ষা করতে পারিনা। তবে জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকান্ড, প্রযুক্তি এবং নতুন চুক্তিগুলো দীর্ঘস্থায়ী টেকসই পরিবর্তন অর্জনে ব্যর্থ হবে যদি তারা আদিবাসীদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে উপনিবেশিক স্বার্থ এবং ক্ষতিকর কার্যসাধন পদ্ধতি বজায় রাখতে সহায়তা করে।

আদিবাসী সম্প্রদায়ের দুর্দশাগুলি উপেক্ষা করে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু বিপর্যয়ে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখার সময় সুইডেনের মত দেশগুলোকে আর তাদের সবুজ প্রশংসা-পত্র প্রদর্শন করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।

গতবছর মাদ্রিদে সিওপি২৫ (COP25) তে সামি ও ইনুইত কর্মীদের একটি প্রতিনিধি দল জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে “ভূমি ফেরত” আন্দোলনের গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল। জুলিয়া রেন্সবার্গ যিনি মাদ্রিদে এই আন্দোলনের অংশ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন,

“ভূমি আমাদের এবং আমরাই ভূমি। আমরা আমাদের আদিবাসী আত্মীয়দের সাথে সংহতি জানাতে এখানে এসেছি এবং আমরা আপনাদের সাথে আছি, পরিবেশ আন্দোলনের জোরে ধরে থাকা সবুজ উপনিবেশবাদের বিষাক্ত সংস্কৃতিটি ভেঙে ফেলার জন্য আমাদের অবশ্যই একত্রিত হতে হবে।”

সুইডেনের উপনিবেশবাদ
গত বছর মাদ্রিদের সিওপি২৫ (COP25)-এ সামি (Saami) ও ইনুইতের (Inuit) একটি প্রতিনিধি দল জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে “ভূমি ফেরত “ আন্দোলনের গুরুত্বের দিকে ‌দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল [ফ্লোরিয়ান কার্ল]

সুইডিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গির্জাসদের জয় প্রমাণ হিসাবে দেখা উচিত যে, সমস্ত বাধা স্বত্ত্বেও আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি টেকসই জলবায়ু পরিবর্তনের পথে দাঁড়ানো বৃহৎ এবং ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সক্ষম এবং তাঁরা সংকল্পবদ্ধ। গির্জাসকে ছাড়িয়ে সামির পক্ষে এই বিজয়ের অর্থ কী হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়, আদালতের এই সিদ্ধান্ত এই গ্রহে বেঁচে থাকার ও সাফল্যের জন্য সামাজিক উপায় খুঁজে পাওয়ার জন্য নতুন আশা জাগায়।

ইউরোপের সাপমি (Sapmi) থেকে শুরু করে আমাজন এবং কানাডার দাবি করা জমিগুলিতে ওয়েটসুয়েটেন (Wet’suwet’en) অঞ্চল পর্যন্ত আদিবাসী কর্মীরা আমাদের সকলের জন্য পরিবেশগত ও সামাজিক ভাঙন প্রতিরোধে সম্মুখভাগে অবস্থান করছেন।

আদিবাসীদের অস্বীকৃতি, কৃষ্ণবিদ্বেষ, বিরোধী পুরুষতান্ত্রিকতা এবং শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যকে ফিরিয়ে দেয় এমন সামাজিক অবকাঠামো ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রতিরোধ ও সম্প্রদায়গুলোকে সংগঠিত করার মাধ্যমে তাঁরা একাধিক ফ্রন্টে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। এটি হল একধরনের প্রতিরোধ, যা জলবায়ু সংকট এড়ানোর চাবিকাঠি।

অ-আদিবাসীদের অবশ্যই আদিবাসীদের মিত্র হতে হবে এবং গির্জার মত প্রগতিবাদী আদিবাসী দূরদর্শী নেতৃত্বর অনুসরণ করতে হবে। তবেই আমাদের সকলের জন্য ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক ও টেকসই ভবিষ্যতের প্রকৃত সুযোগ থাকবে।

অনুবাদকঃ Rahin Chakma

মূললেখাঃ https://www.aljazeera.com/indepth/opinion/victory-sweden-colonialism-200205092318758.html

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা