সুহৃদ চাকমা: চাকমা সাহিত্যের এক ক্ষণজন্মা পুরুষ
3691
চাকমা সাহিত্যের কথা উঠলেই একজন মানুষের নাম চির ভাস্বর হয়ে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তিনি সুহৃদ চাকমা। ডাক নাম লককন। সাদাসিদে সহজ সরল এক সাধারণ মানুষ কিন্তু মেধার মননে সাধারণ ছিলেন না, ছিলেন অসাধারণ। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি। চাকমা সাহিত্যের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ সমালোচনা নিয়েই কাজ করলেও মূলত চাকমা ভাষার গবেষণা নিয়েই তার কৌতুহল ছিল সবচেয়ে বেশি।
তবে তাঁর সাহিত্য চর্চার বয়স খুব একটা বেশি নয়। অল্প বয়সেই পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু এ সাহিত্য চর্চার অল্প সময়টাতেও তিনি যে রচনা সম্ভার আমাদের জন্য রেখে গেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর।
আধুনিক চাকমা সাহিত্যের বয়সও তো খুব একটা বেশি নয়। ষাট দশকের শেষ এবং সত্তর দশকের প্রথম দিকে আধুনিক চাকমা সাহিত্যের পথ চলা শুরু বলা যায়। সে সময় সুগত চাকমা এবং দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমারাই ছিলেন মালঞ্চের মালাকর।
সুগত চাকমা ছিলেন তুখোড় রোমান্টিক। সেই রোমান্টিকতাই গাঁ ভাসিয়েছেন অবলিলায়। মাঝে মাঝে ছ্যাক খাওয়া তরুণের মত আর্তনাদ করেছেন। সে আর্তনাদ কবিতায় ধরা দিয়েছে। এ কবিতাগুলো সুহৃদ চাকমা কবিতা হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তিনি এ কবিতাগুলোকে কবিতা না বলে পদ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ মূল্যায়ন যথার্থ কিনা পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমিও একজন সচেতন পাঠক হিসেবে বলবো সুহৃদ চাকমা মূল্যায়ন যথার্থ। এ যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেন একজন শুদ্ধ কবিতা ভক্ত।
সুহৃদ চাকমা শুধু একজন শুদ্ধ কবিতা ভক্ত ছিলেন না, ছিলেন একজন আধুনিক কবি। মেধায় ও মননে তিনি চাকমা কবিতাকে অনেক দূরে নিয়ে গেছেন। সমকালীন বিষয়গুলো টেনে নিয়ে প্রবল আকর্ষণে কবিতায় অনুষঙ্গ করে নিয়েছেন। নিরলসভাবে নির্মাণ করেছেন কবিতার চিত্রকল্প।
তিনি কবিতাকে সহজসাধ্য কাজ মনে করতেন না, শ্রমসাধ্য কাজ মনে করতেন। কবিতার প্লট, চিত্রকল্প ও শব্দয়নের ক্ষেত্রে তাঁর যে উপলব্ধি ‘বার্গী’ কাব্যগ্রন্থের একটি পাতা উল্টালেই তা সহজে চোখে পড়বে। কবি হিসেবে তিনি যতটা সফল ঠিক তেমনি প্রাবন্ধিক হিসেবেও সমান উজ্জ্বল।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধ লেখায় আছে নিজস্ব স্টাইল ও স্বাতন্ত্রবোধ। তিনি সহজ, সরল ও ঋজু ভঙ্গীতে লিখেছেন। কঠিন বিষয়গুলো সহজ ও সাবলীলভাবে তুলে ধরতে পারতেন। তাঁর চাকমা সাহিত্যের ইতিহাস, বর্ণ এবং ভাষা সংক্রান্ত লেখাগুলো এক কথায় খুবই চমৎকার। ভাষা সংক্রান্ত তাঁর লেখাগুলো ছিল মূল্যবান তাৎপর্যময়। চাকমা ভাষা সম্পর্কে তাঁর একটি নিজস্ব অভিমত ছিল। সে অভিমত প্রকাশ করতে তিনি কোন বিচলিত বোধ করেছেন বলে মনে হয়না।
গবেষণার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল ঝোঁক। ভাষা সংক্রান্ত রচনাগুলো ছিল তাঁর নিরলস গবেষণার ফসল। মেধা, মনন ও সৃষ্টিশীলতার সংমিশ্রণে তাঁর লেখা হয়ে উঠতো অপরূপ। আমি জানি চাকমা ভাষা সম্পর্কে তার কৌতুহল নিবৃত্ত হয়নি। ভাষা সম্পর্কে কাজ করার তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল।
চাকমা ভাষার উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে তাঁর যে উপলব্দি বা অভিমত তা কিন্তু তিনি পূর্ণাঙ্গভাবে বলে যেতে পারেননি। তাঁর অকাল অন্তর্ধান তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে ভাষা সম্পর্কে আমরা আরো অনেক জানতে পারতাম। জাতি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু পেত। বঞ্চিত হলাম কিন্তু আমরাই, হলো জাতি।
গল্প তিনি বেশি লেখেননি। কিন্তু যে’কটি গল্প লিখেছেন তাঁর প্লট, বিষয়, বক্তব্য ও উপস্থাপনা রীতিই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে গল্পকার হিসেবে। কবিতার পাশাপাশি গদ্যের প্রতি ছিল তাঁর আগ্রহ। তিনি উপলব্ধি করেছেন গদ্য ছাড়া একটি ভাষা বিকশিত বা সমৃদ্ধ হতে পারেনা। উপন্যাস লেখার ইচ্ছা ছিল। উপন্যাস লেখার ক্ষমতাও ছিল, হয়তো একসময় উপন্যাসও লিখতেন।
কিন্তু লেখা হলনা। পোড়া জুমের ছাই ভস্মে স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস যদি তিনি থাকতেন তাহলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চাকমা উপন্যাস চাই’র উপযুক্ত উত্তর দিতেন তিনিই প্রথম।
সাহিত্যের আরো একটি জটিল শাখা সাহিত্য সমালোচনা। এ সাহিত্যে সমালোচনাও সুহৃদ চাকমা ছিলেন অনন্য। তাঁর একটি অপার গুণ ছিল সত্য বলার। তিনি যাই দেখতেন এবং উপলব্ধি করতেন তা অকপটে বলতেন। সত্যকে প্রকাশ করতে গিয়ে বিচলিত বোধ করতেন না।
তাঁর যে’কটি সমালোচনা চোখে পড়ে, সেগুলো পর্যালোচনা করলেই বুঝা যাবে তাঁর সমালোচনা সাহিত্যের মান কতটা উচ্চ মার্গীয়। ক্ষুরধার সমালোচনার জন্য তিনি অনেকের বিরাগভাজনও হয়েছিলেন। চাকমা সাহিত্যের জনৈক খ্যাতিমান কবি তো (নিজেকে চাকমা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ মনে করেন?) তাঁকে সহ্যই করতে পারতেন না।
তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত কোন সংকলন বা গবেষণা পত্রিকায় সুহৃদ চাকমার কোন লেখাই তিনি ছাপাননি। কিন্তু সুহৃদ চাকমাতো সুহৃদই; তিনি তো হতো দরিদ্র ছিলেন না, কোন করুণার প্রয়োজন ছিলনা কিন্তু দরিদ্র ছিলেন তো ঐ কবি সাহিত্যিক নামধারী জ্ঞান পাপীরা। সুহৃদ চাকমাকে ঐ জ্ঞান পাপীদের কোণ ভৎসর্না করতে দেখিনি তেমনি সম্মানের আসনেও যে বসিয়েছেন তাও দেখিনি।
১৯৮০ সালের শেষ দিকে একটি সংগঠন গড়ার জন্য তিনি খুবই অতুৎসাহী হয়ে ওঠেন। তার প্রিয় শিক্ষালয় “জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে দিঘীনালা বাড়ি যাবার পথে এবং দিঘিনালা থেকে জাহাঙ্গীর নগর যাবার পথে তিনি রাঙ্গামাটি অবস্থান করতেন। ঐ সময় আড্ডা চলতো দিনারাত। ঐ আড্ডায় মৃত্তিকা, বীর, কৃষ্ণতো থাকতোই। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার জন্য যে একটি সংগঠনের দরকার তা পর্যালোচিত হত ঐ আড্ডায়। ঢাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েও ঢাকায় নিয়মিত আলোচনা হতো তাঁর। সেসব আলোচনার কথা তিনি আমাদের জানাতেন নিয়মিত।
এভাবেই ঢাকা, রাঙ্গামাটি এবং চট্টগ্রামের সাহিত্য সংস্কৃতিমনা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই দাঁড়িয়ে যায় একটি সংগঠন। যে সংগঠনটি বর্তমানে জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক) নামে পরিচিত। যে সংগঠনটি গড়ার পেছনে সুহৃদ চাকমাকে পৌরহিত্যর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে প্রভূত সময় ও নিরলস শ্রম। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে তিনি জাক’কে চালিয়েছেন এবং অন্যদের দিয়ে চালিয়ে নেয়ার মজবুত ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন।
আজ জাক বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ছোট ছোট আদিবাসী জাতির সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছে। তুলে ধরার চেষ্টা করছে তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে রক্ষার জন্য নিরন্তর সংগ্রামে জাক অবিচল।
সেই সংগঠনের ২৫ বর্ষ পূর্তি আয়োজন করতে যাচ্ছে জাক আগামী ২৪-২৮ ফেব্রুয়ারী, ০৫ পাঁচদিন ব্যাপী এক অনুষ্ঠানমালার মধ্যে দিয়ে।
সুহৃদ (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮; মৃত্যুঃ ০৮ আগস্ট, ১৯৮৮), তুমি জাক’র ক্ষণজন্মা এক পুরুষ। এই দিনে তোমার কথা মনে পড়ে।
তোমাকে সগৌরবে অভিবাদন।
লেখক: শিশির চাকমা
সুহৃদ চাকমা স্মারক গ্রন্থ (পৃঃ ৪২-৪৫)
সুহৃদ চাকমা সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন – কবি সুহৃদ স্মরণে
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।