স্নেহ কুমার চাকমার জীবনালেখ্য

Jumjournal
Last updated May 10th, 2021

1554

featured image

১৯৪৭ সালে ভারত – পাকিস্তান বিভক্তের সময়ে জুম্ম জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া এক অবিসংবাদিত সংগ্রামী নেতা স্নেহ কুমার চাকমার ৩২ তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ।

১৯৮৭ সালের ১৮ই জুলাই পরলোক গমন করেন তিনি। মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাই এই মহান নেতাকে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বদেশী আন্দোলন, অযৌক্তিক – অন্যায় ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনি – মিনি খেলা চলছিল তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে ছিলেন এই মহান নেতা।

শুধু তাই নয় , তৎকালীন পাহাড়ের সামন্তীয়দের দোর্দণ্ডপ্রতাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তৎকালীন সামন্তীয়রা চাইতেন না সাধারণ জনগণ থেকে নেতৃত্ব উঠে আসুক, শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণ করুক, ঘুণে ধরা সমাজের হাল ধরুক।

তৎকালীন সামন্তীয়দের কাছে অর্থ – বিত্ত , প্রভাব – প্রতিপত্তি, পূর্ব পুরুষের সামাজিক অবস্থানই ছিল যোগ্য নেতৃত্বের অন্যতম মাপকাঠি।

কামিনী মোহন দেওয়ান তার আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ “পার্বত্য চট্টলের এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী” তে স্পষ্ট ভাবেই স্নেহ কুমার চাকমা সম্পর্কে লিখেছেন “স্নেহ কুমার চাকমা আমার অনুগ্রহপৃষ্ট ব্যক্তি মাত্র।

আমার সাহায্য ব্যতিরেখে তাহার পক্ষে রাজনৈতিকক্ষেত্রে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। বিশেষতঃ সে উচ্চ শিক্ষিত হইলেও এক অপরিনত বয়সের যুবক মাত্র।

তাহার কিংবা তাহার বংশীয় কাহারও বর্তমান পূর্ব জীবনের অর্জিত আর্থিক বা সামাজিক কিংবা অন্য কোন প্রকার সম্মান , প্রভাব – প্রতিপত্তি কিছুই নাই।”

(পৃষ্ঠাঃ ২৫০-২৫১) তৎকালীন চাকমা রাজা, কামিনী মোহন দেওয়ান কিংবা কামিনী মোহন দেওয়ানের মত যারা সামন্তীয় ব্যবস্থার সাথে আস্তে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন তারা কেউই স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি।

এইটা শুধু শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নয় আদর্শিক অবস্থান থেকেও তারা স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বকে তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এভাবেই স্নেহ কুমার চাকমা শুধু রাজনীতিতে নয় , সামন্তীয় ধ্যান – ধারণার বিরুদ্ধেও হেনেছিলেন এক চরম আঘাত।

সামন্তীয় দোর্দণ্ডপ্রতাপের বিরুদ্ধে শুধু স্নেহ কুমার চাকমাকে নয় , স্নেহ কুমার চাকমার পরবর্তী যারা রাজনীতিতে এসেছেন, জুম্ম জাতির মহান নেতা এম এন লারমাকেও সেই সামন্তীয়দের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। (এখানে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ নেই । তাই সে সম্পর্কে আর বেশি কিছু আলোচনা করছি না)

স্নেহ কুমার চাকমার জন্ম ১৯১৪ সালে, বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার খবং-পুজ্জি গ্রামে। তার পিতা শ্যাম চন্দ্র চাকমা ছিলেন একজন কৃষক এবং একি সাথে চাকমা বর্ণমালার একজন শিক্ষকও। তবে তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না।

তার মাতা মান কুমারী চাকমা ছিলেন গৃহিণী এবং একজন সুদক্ষ হস্ত বুনন শিল্পী। স্নেহ কুমার চাকমা নিজ গ্রাম থেকেই নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষা এবং ছোট মহাপুরম থেকে উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

১৯২৭ সালে, তিনি রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। উল্লেখ্য , সেসময় রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ছিল জেলার এক মাত্র উচ্চ বিদ্যালয়।

আসলে সেসময় উচ্চতর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে এসে চতুর্থ শ্রেণীতে হাই স্কুলে ভর্তি হওয়াটাই ছিলো সাধারণ রীতি। কিন্তু ১৯২৭ সালে যখন তিনি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হতে যান তখন চতুর্থ শ্রেণীতে কোন সিট খালি ছিল না।

তাই প্রধান শিক্ষক তাকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু স্নেহ কুমার চাকমা তাতে রাজি না হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য প্রধান শিক্ষক তাকে একটা পরীক্ষা নেন।

সেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ায় তিনি পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পান । ১৯২৯ সালে যখন তিনি ক্লাস সেভেনে পড়েন তখন লাহোর কংগ্রেস সেশনে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য তার মা তাকে একটি নিজ হাতে বুনা খাদি পাঠিয়ে দেন যেটা দিয়ে তিনি ঐ প্রদর্শনীতে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেন। সেই পুরস্কার সনদে মতিলাল নেহেরু এবং তাঁর পুত্র জওহরলাল নেহেরু উভয়েরই স্বাক্ষর খোদিত ছিল ।

মূলত স্কুল জীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । সেসময় গোটা ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলনের মহড়া চলছিল। পিছিয়ে ছিল না পার্বত্য অঞ্চলের ছাত্ররাও।

স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৩০ সালে স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে স্কুলে ধর্মঘট ডাকা হয়। তখন তিনি ছিলেন সবে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।

ছাত্রদের নেতৃত্বে এটাই বোধহয় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ছাত্র ধর্মঘট। এর আগে এই ধরনের ধর্মঘটের উল্লেখ আর কথাও পায়নি। এই ধর্মঘট এগিয়ে যায় প্রধান সড়ক হয়ে খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালার দিকে।

প্রথমে তারা বুড়িঘাট বাজারে, সেখান থেকে পরে নান্যাচর বাজারে ধর্মঘটের মহড়া দেয়। সেদিন নান্যাচর বাজারে তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার পর দোকানীরা একে একে নিজেদের দোকান থেকে সব ধরনের বিদেশী পণ্য ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

“Nanierchar was a big market place. We determined to do a befitting job there. As I began to speak, the crowd complained of not having a view of me. Khagendra swung me up on his shoulders and held me tight. As I spoke for half an hour the shop keepers one by one stole to their shops and threw out whichever was foreign.” ( Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-34 )

নান্যাচর বাজারে ধর্মঘটের এক সপ্তাহের মধ্যে তারা খাগড়াছড়ি বাজারে ধর্মঘট করলেন। সেদিন ছিল বাজার বার। সব মিলিয়ে তাদের দলের সংখ্যা ৫০ জনেরও কম।

কিন্তু সেদিন তারা ছিল মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। যখন তিনি ‘স্বদেশী’ বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন তখন শোরগোল উঠলো যে, তাঁরা বক্তাকে দেখতে পাচ্ছেন না।

অবশ্যই তার বন্ধু খগেন্দ্র আগের থেকেই একটা বুদ্ধি করে রেখেছিলেন এবং সেভাবে তাকে পাশের এক বিশাল বটবৃক্ষের ডালে তাকে বসিয়ে দিলেন।

যেহেতু খাগড়াছড়ি ছিলো তার নিজের এলাকা, তাই তিনি ভীতি, সন্ত্রস্ত না হয়ে স্বতস্ফুর্ত ভাবে এক ঘন্টার বেশি বক্তৃতা দিলেন এবং সবশেষে সকল বিলেতি পণ্যে পুড়িয়ে ফেলার আহ্বান জানালেন।

কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বাজারের সব খোলা জায়গায় বিলেতি পণ্যে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলে সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সেদিন লক্ষ লক্ষ রুপির মূল্যের পরিমাণ পণ্য খাগড়াছড়ি বাজারে পোড়ানো হয়েছিলো।

“As I began to deliver a swadeshi speech, the first of its kind in this part of india again there was a shout that I could not be seen and khagendra had a ready plan. He immediately lifted me up on big branch of the large banian tree…………………………. Khagrachari was my native place, khabang pajya lying a mile west of it. Amidst successive plaudits and awe I spoke more than an hour and at last called for all bilati goods to fire. Within minutes all the open spaces of the market places heaped up into mountains and dozens of tin loads of socony kerosene were sprayed over them for easy combustion…………………………a couples of lakhs of rupees worth of foreign goods turned into ashes at khagrachari”. ( Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-35 )

খাগড়াছড়ি বাজারে ধর্মঘটের পরেরদিন সকালে তিনি তার দলের ২৫ জনকে সাথে নিয়ে বাড়িতে যান। সেসময় তার বাবা তার দিকে মুখ তুলেও তাকাননি। আর মা যখন দেখলেন ছেলে তার হাতে বোনা ধুতি পরিহিত, তখন তিনি স্ব – গৌরবে বিমোহিত হয়ে গেলেন।

তবে তিনি তার ছেলের চেয়ে বরং তার ছেলের বন্ধুদেরকেই বেশি অভ্যর্থনা জানালেন। পরে তার ছেলেকে বলেছিলেন ‘why don’t you go back to your studies, now, for our better equipment.’

এই ধর্মঘটের পর স্কুল কর্তৃপক্ষ স্নেহ কুমার চাকমাকে ছয় মাসের জন্য বহিস্কার করে। অবশ্যই পরে তাকে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।

অষ্টম শ্রেণীতে পাশ করার পর যখন তিনি নবম শ্রেণীতে উঠলেন তখন ঘনশ্যাম দেওয়ানের সহযোগিতায় শরৎচন্দ্র তালুকদার, বিজয় চন্দ্র চাকমা, কনক বরণ দেওয়ান সহ তারা একসাথে কুমিল্লার ময়নামতি অভয় আশ্রমে চলে আসেন।

ডা. নিপেন চন্দ্র বোস এবং ডা. প্রফুল্ল ঘোষ তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। কিন্তু মাত্র আট দিন পরে কুমিল্লার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কতৃক তাদের গ্রেফতার করে আবার রাঙামাটিতে ফেরত পাঠানো হয়।

এই ঘটনায় ঘনশ্যাম দেওয়ানকে অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এদিকে কনক বরণ দেওয়ানের পিতা তার পুত্রকে নাবালক হিসেবে দেখিয়ে এই অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এই ঘটনার দায়ে ঘনশ্যাম দেওয়ানকে তিন বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্যই তৎকালীন রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সতীশ সেনগুপ্ত সবার শাস্তি মকুবের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।

১৯৩২ সালে, তখন তিনি দশম শ্রেণীতে। সেবছর স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক দিজেন্দ্রালাল চক্রবর্তী এস কে ঘোষ এবং শঙ্কর সেনের সাথে চক্রান্ত করে প্রধান শিক্ষক সতীশ সেনগুপ্ত সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়ে দিলেন, তিনি নাকি এই স্কুলের পলিটিক্যাল এক্টিভিস্টদের প্রশ্রয় দেন।

ফলশ্রুতিতে প্রধান শিক্ষক সতীশ সেনগুপ্তকে বদলি করা হয় ভোলাতে। এই চক্রান্তের মধ্য দিয়ে দিজেন্দ্রালাল চক্রবর্তী প্রধান শিক্ষকের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিলেন।

পরে এই দিজেন্দ্রালাল চক্রবর্তী তাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করে ব্রিটিশদের কাছে সাধু সাজতেন যাতে তার জায়গাটা পাকাপোক্ত হয়।

উল্লেখ্য, শঙ্কর সেন ছিলেন সেসময়কার জেলার এস ডি ও, যিনি মেদিনীপুরে সন্ত্রাসী (তৎকালীন ব্রিটিশদের চোখে বাংলার বিপ্লবীরা ছিল সন্ত্রাসী) দমন করেছিলেন এবং পরে সেই তথাকথিত সন্ত্রাসীদের দ্বারাই শঙ্কর সেন আক্রান্ত হন। তাই কিছু সময় নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য বদলি হয়ে এসেছিলেন এই বন পাহাড়ে।

১৯৩২ সালের শেষের দিকে এক মিথ্যা মামলায় স্নেহ কুমার চাকমাকে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং দু বছরের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে ১৯৩৩ সালেই ছিল তার মেট্রিক পরীক্ষা। অবশেষে পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগের অধিকর্তা মিস্টার জেনকিন্সের সহযোগিতায় মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে আবার তাকে জেলে দেয়া হয় । পরীক্ষা রেজাল্ট যখন প্রকাশ করা হয় তখনও তিনি জেলের ভিতর। পরীক্ষায় গোটা রাঙামাটি জেলার মধ্যে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন।

“I was declared the district scholar of Chittagong Hill Tracts, in the matriculation examination of 1933”.

যেদিন তিনি জেল থেকে ছাড় পেলেন সেদিনই ছিল কলেজে ভর্তি হওয়ার শেষ দিন। সেসময় চট্টগ্রাম কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।

তাই, শুধুমাত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের বিশেষ বিবেচনায় তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। পরে ১৯৩৭ সালে তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ চট্টগ্রাম কলেজ থেকে যথাযথভাবে বিএ পাশ করেন।

তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ‘এম এ’ তে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রায় শেষও করেছিলেন কিন্তু পরীক্ষা দেননি ।

তিনি লিখেছেন “ Politics dragged me away from books to the platform “. ১৯৩৭ সালে স্নাতক শেষ হওয়ার পর তাকে সরকারি চাকরি করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন । “ I rejected all offers of government job” .

স্কুল জীবন থকে রাজনীতির শুরুটা হলেও মূলত কলেজ জীবন থেকেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে সেসময়কার ভারতীয় নেতাদের সংস্পর্শে আসেন তিনি।

তিনি লিখেছেন, ঘনশ্যাম দেওয়ানই ছিলেন আমার রাজনৈতিক গুরু( My political guru was Ghanasyam Dewan)। ঘনশ্যাম দেওয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আরেক অগ্রপথিক। ১৯২৮ সালে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় “চাকমা যুব সংঘ”।

দেশ বিভাগের পর তিনি ভারতে চলে যান এবং ষাট দশকে ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হন। ( সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম; পৃষ্ঠা – ৬ )

ঘনশ্যাম দেওয়ানের মাধ্যমেই প্রথম মহেন্দ্র বড়ুয়া নামের একজন গোপনে তাদের সাথে রাঙ্গামাটি শহরে দেখা করতে আসেন।

তৎকালীন চট্টগ্রাম অনুশীলন সমিতির একজন নেতা চারু বিকাশ দত্তের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ঘনশ্যাম দেওয়ান।

জানা যায় , সেসময় অনুশীলন সমিতি এবং উগ্রপন্থী দলের কিছু কিছু সদস্য ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে আত্মগোপন করে থাকার জন্য মাঝে মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন  (সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম; পৃষ্ঠা – ৬)

স্নেহ কুমার চাকমা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতি বেশ অনুরাগী ছিলেন । ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে নেতাজী চট্টগ্রাম আসলে ‘যাত্রা মোহন সেন’ হলে তাঁর সাথে স্নেহ কুমার চাকমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

আজাদ হিন্দ ফৌজ কোহিমায় থাকা অবস্থা পর্যন্ত নেতাজির সাথে স্নেহ কুমার চাকমার যোগাযোগ ছিল।

“It is during my college life in Chittagong that I came in close political connection with Subhas Chandra Bose which continued upto his arrival at kohima with the Azad Hind Fouz”. ( Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-xii )

স্নেহ কুমার চাকমা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সুস্পষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যেই নিহিত আছে এদেশের মানুষ প্রকৃত মুক্তির পথ।

তিনি লিখেছেন “ Only Subhas Chandra Bose had a comparatively clearer conception and inclination for us, and we, too, placed greater faith on Subhas Babu’s Method of independence than on other alternatives “(Sneha Kumar Chakma, The partition and the chakmas; Page-39)

যাহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষের দিকে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাবে, যাওয়ার আগে দেশটাকে দু ভাগে ভাগ করে দিয়ে এটা বোঝা যাচ্ছিল। চলছিলো হিসাব নিকাশ, অঙ্ক কষাকষির খেলা। ১৯৪০ এর পর হইতে তিনি প্রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেই ছিলেন। কিন্তু ভারতভাগ যখন এটা প্রায় নিচ্ছিত তখন তিনি সেই ব্যস্ত সময়ের কথা বলতে গিয়ে লেখেন “I was busy, terribly busy, to save my district from the sword of the butcher”.
তিনি ১৯৪৪ সালে সিমলায় অনুষ্ঠিত “Wavell Conference” এ যোগদান করেন। সেখানে সর্ব ভারতীয় নেতাদের কাছে তিনি অনুরোধ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে রাখার।

দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া উপমহাদেশের একপাশে সকল মুসলিম জনগণকে নিয়ে পাকিস্তান ও অন্য পাশে সকল হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীদের নিয়ে ভারত গঠিত হওয়ার কথা ছিল।

সে সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে অবশ্যই ভারতের সাথেই অন্তভূক্ত করার কথা। কেননা সেসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে অমুসলিম জনসংখ্যার হার ছিল 97% এবং মুসলিম জনসংখ্যার হার ছিল মাত্র 3%।

সেসময় তিনি পণ্ডিত নেহ্রু এবং মাওলানা আজাদের সাথেও আলাপ করে, তারা সবাই আশ্বাস দিয়েছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে ঠেলে দেয়া হবে না।

এ ভি ঠক্করকে সভাপতি করে ১৯৪৬ সালে গঠিত সর্ব ভারতীয় “ Excluded Areas sub-committee” র co-opted সদস্য নির্বাচিত হন স্নেহ কুমার চাকমা।

১৯৪৭ সালের গোঁড়ার দিকে সর্ব ভারতীয় কমিটি একটি দল রাঙামাটি আসে। এই অঞ্চলের মানুষ কি ধরনের শাসন চাই তা খতিয়ে দেখা এবং সে অনুযায়ী হাইকমান্ডের কাছে রিপোর্ট করা, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই কমিটি রাঙামাটি আসে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ভারতের সাথেই অন্তভূক্তির জন্য স্নেহ কুমার চাকমারা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহ্রু, বল্লভ ভাই প্যাটেল সহ তৎকালীন কংগ্রেসের বাগা বাগা নেতাদের সাথে দেখা করেন।

অবশেষে পূর্ব নির্ধারিত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্নেহ কুমার চাকমা তার দলবল নিয়ে প্রকাশ্যে রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এই পতাকা তিন দিন পর্যন্ত উত্তোলিত ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামকে কোন অংশে জুড়ে দেয়া হবে তখনো তা ঘোষিত হয়নি।

মাত্র দু দিন পর, ১৭ ই আগস্ট রেডিওতে ঘোষণা করা হয় বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান রেডক্লিফ পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তান অংশের সাথে জুড়ে দেয়।

২১শে আগস্ট পাকিস্তানের বেলুচ- রেজিমেন্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।

অযৌক্তিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়াকে স্নেহ কুমার চাকমা সহজে মেনে পারেনি। তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মনস্তির করেন।

বিদ্রোহে ভারতীয় নেতাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য তিনি ভারতে চলে যান।

তিনি লেখেন “ I left rangamati same day ( August 19th, 1947) for Tripura with 8 armed volunteers and crossed to sabroom on August 21th , 1947.”

এর পর তিনি নতুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সাথেও দেখা করেন। তবে, তিনি আর কোন আশানুরূপ আশ্বাস পাননি।

জানা যায়, তৎকালীন ভারতীয় নেতাদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে সবচেয়ে সহযোগী ছিলেন বল্লভ ভাই প্যাটেল।

পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিতে ক্রুদ্ধ হন বল্লভ ভাই প্যাটেল। (সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম; পৃষ্ঠা -১৫, এলেন ক্যাম্বেল জনসন, মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন,পৃষ্ঠা – ১৩৯)

১৯৮০ সালে এইচ এন পণ্ডিত “ Radcliffe Sowed, The Chakamas Reap “ শিরোনামে অমৃত বাজার পত্রিকাতে লেখেন , রাজনৈতিক চাপে বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য অনুতপ্ত হন স্যার সিরিল রেডক্লিফ।

হিন্দু – মুসলমান এলাকা চিহ্নিত করার জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল দু’হাজার পাউন্ড । সেই টাকা তিনি নেন নি। জানিয়েছিলেন নীরব প্রতিবাদ।* (সিদ্ধার্থ চাকমা, প্রসঙ্গঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম; পৃষ্ঠা -১৫)।

এই লেখাটা স্নেহ কুমার চাকমার “The partition and the chakmas” বইয়ের ১৯৪ পৃষ্টায়ও সংযোজন করে দেয়া আছে ।

“ Sir Cyril Radcliffe was commissioned primarily to separate the muslim areas from the rest of the country. But in spite of this vaunted honesty and impartiality he had to act against his conscience, which perhaps explain why at the end he declined to accept the sum of 2000 pounds which had been stipulated as his fees for assignment.”

পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলে তিনি আর এদেশে ফেরত আসেননি, ভারতেই থেকে যান। ১৯৫১ সালে তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনেই প্রথমবারের মত কংগ্রেসে নাম লেখান।

১৯৫৩ সালে তিনি কলকাতা থকে ত্রিপুরাতে স্থানান্তরিত হন। সেখানে গিয়ে তিনি “আদিবাসী সংঘ”, “আদিবাসী সংসদ” এবং সর্বশেষ ট্রাইবাল ইউনিয়ন গঠন করেন।

এরপর তিনি ত্রিপুরার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং শোষিত – পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার আদায়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

জীবনের শেষদিকে তিনি ধর্মীয় কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বুদ্ধের দর্শন ও চর্চা তথা বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল লেখেন। চাকমাদের মধ্যে তিনিই প্রথম “International Buddhist Conference “ এ অংশগ্রহন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ‘টেলিস্কোপ’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা