icon

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকান্ডে মৌজা হেডম্যান ও কার্বারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে

Jumjournal

Last updated Aug 18th, 2020 icon 1667

১২ এপ্রিল, ২০০৪

৫০৮৯বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। উত্তর পূর্ব সীমান্তে ভারত এবং দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্ত বরাবর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বপ্রান্তে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থার মত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশে অসংখ্য নদ নদীর জালে আবদ্ধ এক বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মত পাহাড় পর্বতগুলো ছড়িয়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

মাঝে মাঝে উপত্যকা অধিত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছে নদী আর স্রোতস্বিনী তাদের অববাহিকায় কোথাও অপরিসর জমি খন্ড আর কোথাও বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। পাহাড় পর্বতগুলোর অধিকাংশই শিলাময়, বাকী পাহাড়গুলো বিভিন্ন জাতের মূল্যবান বৃক্ষরাজি এবং আগাছার জঙ্গলে পূর্ণ।

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় একসঙ্গে যেমন রৌদ্রস্নাত হয়না, একসঙ্গে সাঁঝের আঁধারও ছড়িয়ে পড়ে না। সূর্যোদয় কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় পর্বতগুলো প্রথম প্রথম রৌদ্রস্নাত হয়ে আলোয় ঝলমল হয়ে ওঠে, কিন্তু সাঁঝের বেলায় উপত্যকা-অধিপত্যকা এবং কন্দর গুলোতেই প্রথম আঁধার নেমে আসে।

অথচ বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চলে সকাল সন্ধ্যা সর্বত্র একই সময়েই আলো আঁধার খেলা করে সমানভাবে। বাংলাদেশের তিনদিকে স্থলভাগ, একদিকে সীমাহীন সমুদ্র। এর দক্ষিণ প্রান্তে সমুদ্রের বেলাভূমী।

সমুদ্র তার পবিত্র জল দিয়ে বাংলাদেশের পাদদেশ ধুইয়ে দিচ্ছে। মানব বসতির ক্ষেত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রাম পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

এখানকার মূল অধিবাসীরা যারা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো বা মুরং, পাংখোয়া, বম, লুসাই, খিয়াং, খুমি, চাক দশ ভাষাভাষী এই এগারটি জাতি গোষ্ঠীকে সুপরিচিত, তারা মঙ্গোলীয় নর গোষ্ঠীর মানুষ।

indigenous men
indigenous men

বর্তমানে অন্য জাতি গোত্রের লোক বসতি ঘটলেও এক সময় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠীর লোকজনই এককভাবে স্থায়ী অধিবাসী ছিল।

এই সব কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকসমাজ বাংলাদেশের বৃহত্তর বাঙালী সমাজ থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এখানে দশ ভাষাভাষী এগারটি পৃথক জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই স্ব-স্ব বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য আছে এবং নিজেদের প্রচলিত সমাজ বিধান রয়েছে।

এই কারণে বৃটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রাম Excluded Area বা শাসন বহির্ভূত এলাকা অর্থাৎ পৃথক শাসিত এলাকা রুপে শাসিত হয়ে এসেছে।

পাকিস্তানী আমলে ১৯৫৬ ও ঙ ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রনয়ণ করা হলে সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসিত ও উপজাতীয় এলাকার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হয়।

অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে এবং অধিবাসীদের স্বকীয় সমাজ বিধান অনুসারে তাদের সামাজিক বিচারাদি নিষ্পন্ন করার লক্ষ্যে তিনটি সার্কেল গঠন করতঃ চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল নাম দিয়ে যথাক্রমে চাকমা ও বোমাং এবং মং সম্প্রদায় এর তিনজন সার্কেল প্রধানের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।

সার্কেল প্রধানগণ (Circle Chief) এর মধ্যে চাকমা সার্কেল প্রধান ও বোমাং সার্কেল প্রধান উভয়ই পূর্ব হতে রাজা উপাধি ধারণ করে আসছিলেন। সার্কেল প্রধানগণ স্ব-স্ব সার্কেলের জনগোষ্ঠীর জাতীয় বা সামাজিক বিচার নিষ্পত্তিতে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তাঁরা রাজা উপাধি ধারণ করেন।

সার্কেল প্রধান বা রাজা যে জাতি গোষ্ঠীর লোক, তাঁর অধীনস্থ সার্কেলে বসবাসকারী অপর জাতি গোষ্ঠীর লোকের সামাজিক বিচার নিষ্পত্তিতে সার্কেল প্রধান বা রাজা সেই বিচার প্রক্রিয়াধীন ব্যক্তির স্বজাতীয় মুরুব্বিদের পরামর্শ গ্রহণ পূর্বক বিচার নিষ্পত্তি করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চাকমা সার্কেলে প্রধান বা রাজা চাকমা জাতিসত্ত্বার ব্যক্তি হওয়ায় তাঁর সার্কেলে বসবাসরত মারমা জাতিসত্ত্বার লোকের সামাজিক বিচারে মারমা জাতিসত্ত্বার মুরুব্বির পরামর্শ গ্রহণ করে সামাজিক বিচার নিষ্পন্ন করে থাকেন।

তিনটি সার্কেলের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে মৌজা ভাগ করে প্রত্যেক মৌজায় এক একজন মৌজা হেডম্যান নিয়োগ করা হয়েছে। মৌজার সেরা ব্যক্তিকেই প্রধানতঃ মৌজা হেডম্যান নিযুক্ত করা হয়।

এই মৌজা হেডম্যানগণ স্ব-স্ব মৌজার প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় এবং প্রশাসনের কাজে ডেপুটি কমিশনার (বর্তমানে জেলা প্রশাসক) কে সর্ব প্রকার সহায়তা দানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত।

মৌজা হেডম্যান নিজ মৌজাবাসীর জাতীয় বা সামাজিক বিচার নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করেন সার্কেল প্রধান বা রাজার প্রতিনিধি রূপে। তিনি সামাজিক বিচার করার ক্ষমতায় ক্ষমতাবান।

জুমঘর
জুমঘর

তিনি সংশ্লিষ্ঠ গ্রাম বা পাড়ার কার্বারী ও স্থানীয় মুরুব্বিদের সহায়তায় সামাজিক বিচার সমাধা করেন। জটিল ব্যাপারে রাজার আদালতে মামলা স্থানান্তর করা হয় মাত্র।

জাতীয় বা সামাজিক বিচারে প্রত্যেক হেডম্যান বিচার প্রক্রিয়ায় তাঁর ক্ষমতা ও একটিয়ার অনুসারে একজন অনারারী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ভোগ করেন।

আবার প্রত্যেক মৌজায় গ্রাম বা পাড়া ভিত্তিক পূর্বকথিত একজন কার্বারী নিযুক্ত করা হয়। তাতে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনকে সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এই কার্বারীগণ মৌজার সামাজিক বিচার কার্য্যে এবং খাজনা আদায় ও প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে মৌজা হেডম্যানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা সেই সব করতে দায়বদ্ধ থাকেন।

বলা বাহু্ল্য যে, বাংলাদেশের অন্যত্র এইরকম প্রশাসনিক ব্যবস্থা কোনদিন ছিলনা, এখনো নেই। ইদানিং বি, এন, পির নেতৃত্ত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট সরকার যুগান্তকারী গ্রাম সরকার প্রবর্তন করে তৃণমূল পর্যায়ে যেমন প্রশাসনকে সম্প্রসারিত করেছেন, তেমনি উন্নয়ন কর্মকান্ডকে গতিশীল ও টেকসই করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন।

মৌজা হেডম্যানগণ একদিকে মৌজার প্রধান ব্যক্তি হিসেবে মৌজাবাসীর প্রতিনিধি সরকারের কাছে, অপরদিকে সরকারের প্রতিনিধি রূপে মৌজার প্রশাসনিক কাজে সরকারকে সহায়তা প্রদান করে থাকেন। এই হিসেবে দ্বৈত ভূমিকা পালনকারী মৌজা হেডম্যান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

মৌজা হেডম্যানের মর্যাদা এখনো আছে। তবে বৃটিশ আমলে তাদের মর্যাদা বর্তমান আমলের চেয়ে অধিক ছিল । পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেইন লুইন (Captain T.H. Lewin) মৌজা হেডম্যানদের তাঁর বাংলোয় আমন্ত্রণ করে যত্ন ও

সমামানের সঙ্গে খাদ্য পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। একথা তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ A Fly on the wheel-এ লিখে গেছেন। তখন প্রত্যেক বছর নিয়মিত হেডম্যান দরবার বসানো হত।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে রাঙ্গামাটিতে শেষ হেডম্যান দরবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার তেত্রিশ বছর পর হলেও বছর কয়েক আগে রাঙ্গামাটি পৌর মিলনায়তনে হেডম্যান দরবার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ইহা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মৌজা হেডম্যানগণকে চিরদিন অবহেলা করা হয়েছে। খাজনা বা রাজস্ব আদায়সহ সাধারণ প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজের সহায়তা মৌজা হেডম্যানগণ নির্বিবাদে করে থাকেন।

সার্কেল প্রধান বা রাজা খাজনা আদায়ের জন্য বৎসরের একটি নির্ধারিত দিবসে (সুদিন মাসে) পূণ্যাহের আয়োজন করে। সেই দিন ঐতিহ্যপূর্ণ রাজকীয় পোষাকে সজ্জিত হয়ে পাত্রমিত্রসহ রাজা দরবারে বসেন।

সমাগত মৌজা হেডম্যানগণ সংবৎসরের আদায়কৃত খাজনা দরবারে রাজার নিকট দাখিল করেন। আদায়কৃত খাজনার যৎসামান্য কমিশন হেডম্যানগণ পেয়ে থাকেন। এতদ্ব্যতীত তাঁদের আর কোন পুরস্কার নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বর্তমানে মৌজা হেডম্যানগণকে যৎসামান্য মাসিক ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।

গ্রামের কার্বারীদেরও মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে যা হেডম্যানগণকে দেয় ভাতার তুলনায় কম। ভাতা প্রদানের মাধ্যমে হেডম্যান ও কার্বারীগণ যে সরকারী কাজে সহায়তা করেন তারই স্বীকৃতি বলে ধরে নেয়া যায়।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য বহু বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) কাজে নেমেছে। খোদ জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচীর (UNDP) অধীনে উন্নয়নের কাজ শুরু করা হচ্ছে।

স্থানীয় এন.জি.ও.দের মধ্যে আমার জানামতে টংগ্যা, সি.আই.পি.ডি গ্রীণহিল, প্রশিকা, আশিকা, কারিতাস, ব্র্যাক, জাগরনী মহিলা সমিতি এবং নিউ এন.জি.ও ফোরাম ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশন প্রভৃতি পার্বত্য চট্টগ্রামে জালের মত ছড়িয়ে আছে।

তাদের মধ্যে অনেকের কাজ তৃণমূল পর্যন্ত প্রসারিত হলেও উন্নয়ন কাজে মৌজা হেডম্যানদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ রাখা হয়েছে বলে কোন নজির নেই। ফলশ্রুতিতে তাদের কাজের সাফল্য তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। অনেক এনজিও ব্যর্থ কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ইতিমধ্যে।

সুবলং, রাঙ্গামাটি
সুবলং, রাঙ্গামাটি; ছবিঃ ইন্টারনেট

অনেকের মতে, এনজিওদের কার্যক্রমে মৌজা হেডম্যানদের অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার ফলেই এই রকম হয়েছে। কেননা, মৌজার প্রধান ব্যক্তি মৌজা হেডম্যানের প্রভাবাধীণ হচ্ছে- মৌজাবাসী, তাই কোন কার্যক্রমে মৌজা হেডম্যানকে উপেক্ষা করা হলে মৌজার অধিবাসী সবাইকে উপেক্ষা করা হয় বলে তাদের সহযোগীতা পাওয়া যায়না।

আর মৌজাবাসীর সহযোগিতা না পাওয়ার অর্থ মৌজার উন্নয়ন কাজ অথর্ব হয়ে যাওয়া।

অতএব, পার্বত্য চট্টগ্রামে টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম সফল করার স্বার্থে উন্নয়ন কার্যক্রমে মৌজা হেডম্যানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।


লেখক : শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply