১২ বছর বয়সে জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম
567
মাত্র ১২ বছর বয়সে আমি আমার পরিবারের সাথে আমার জন্মভূমি, দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। মা তার অনেক আগে মারা গিয়েছিলেন। বাবা প্রথমে দেমাগ্রী এসে দেখে গিয়েছিলেন। তিনিই দেশে ফিরে আমাদের সবাইকে নিয়ে আবার দেমাগ্রী চলে এলেন।
বাবা না বললে আমি হয়তাে আসতাম না। দেমাগ্রী থেকে তারপর নেফায়, বর্তমান অরুণাচলে বসতি করি। সেটা কত সাল আমার মনে নেই। সবাই বলে ১৯৬৪ সাল হবে হয়তাে। আমি তখন ছােট।
বাবারা ছিলেন ৭ ভাই। আমরা ৬ ভাইবােন। দেমাগ্রী থেকে বাবারা আড়াই জন, মানে বাবাসহ দুই (২) ভাই আরেক ভাইপাে নেফায় চলে আসলেন। নেফায় আসাটা আমরা বর-পরং বলি, মানে অনেক দূরে বসতি করা।
কাপ্তাই বাঁধে ডুবে যাবার আগে আমাদের বাবাদের পৈত্রিক ভিটা ছিল শিলছড়ি বরকলে। কিন্তু পরে আমরা উগলছড়িতে চলে আসি। বগাছদা মৌজা, মারিশ্যা, রাঙামাটি। এখানেই আমার জন্ম। বাবা এখানেই বাগান বাগিচা করেন।
এই গ্রামেই আমাদের সবকিছু ছিল যা পানিতে ডুবে যায়। পানিতে ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত কোনাে বাঙালি এসব এলাকায় বসতি গড়ে তুলেনি। শুধু আমরাই আমরা। খুব শান্তিতে ছিলাম। জায়গা জমি নিয়ে কোনাে কাড়াকাড়ি ছিল না। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাে।
বড়পরং
কাপ্তাই বাঁধ হলাে। আমাদের জায়গা-জমি সব পানির নিচে ডুবে গেলে আমরা আরেকটু উঁচু জায়গায় বাড়ি করে থাকলাম কিছুদিন। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা আমাদের চার (৪) ভাইবােনকে নিয়ে চলে এলেন দেমাগ্রী। ভালাে জীবনেরআশায়।
এই দেমাগ্রীতে ছিলাম সেই বছর বিঝু পর্যন্ত। বিঝু শেষ হওয়ার পর ভারতের সরকার আমাদের নিয়ে রওয়ানা দিলো নেফা/ North Eastern Frontier Agency (NEFA)। সেটা কোথায় কেউ জানে না। নেফাতে পৌঁছাদে এক (১) বছরের ও বেশী এ সময় লেগেছিল।
দেমাগ্রী থেকে হাঁটাপথে আইজল তারপর বদরপ তারপর ট্রেনে করে মিয়াও/মি-তে লেডু ক্যাম্পে। এই লেড়তে চান, যান। বাবার যখন মারা যান অসুস্থ ছিলেন। অনেক কষ্ট হয়েছিল হাঁটতে, অনিচ আর দুঃখে তিনি মারা যান। দুঃখ বলতে অসহনীয় দুঃখ ।
নেফায় পৌছে আমাদের দুঃখের শেষ ছিল না। ঠাণ্ডা, পানি আর পানি। বর্ষাকাল এক বৃষ্টিতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। জঙ্গল আর খরস্রোতা নদী। বৃষ্টি হলেই সেই নদী ভয়ানক হয়ে ওঠে। এখানে রেশন পেলাম। এলাকাভিত্তিক চাকমা বস্তি বানিয়ে দিলাে সরকার।
নেফার বসতি করার পর অনেক অনেক বছর আমরা কোনাে স্থায়ী কিছু করার চিন্তা-ভাবনা করিনি। জীবনের জন্য যা প্রয়ােজন তা করে দিন কাটাতাম। জীবনে যা করিনি কিছু টাকার জন্য আমরা স্থানীয় লােকদের কাছে গিয়ে কাজ খুঁজতাম। ক্ষেতের কাজ করতে চাইতাম।
অন্যের বাড়িতে গিয়ে কাজ করা দেশে কল্পনাও করিনি। এইটা এক ধরনের পরিস্থিতি। আমরা প্রায় সকলেই ভাবতাম আমরা আবার দেশে ফিরে যাবাে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আমরা হয়তাে এইবার ফিরতে পারবাে। এই চিন্তা থেকে বাগান বাগিচা আমরা করিনি। কিন্তু দেশে ফেরা ছিল অসম্ভব। সেসব ভাবলে এখনাে মন কাঁদে। কী ছিলাম এখানে এসে কী হয়ে গেলাম। তাে যখন বুঝলাম দেশে ফেরা আর হবে
তখন বাগান বাগিচা করা শুরু করলাম আমরা। কত বছর আর আগে হবে এইতাে ১২/১৫ বছর আগে। আসার পর থেকে বুড়ােদের মুখে ছিল শুধু ফিরে যাওয়ার কথা। তাদের কথায় স্বপ্নে ছিল দেশে ফেরার ভাবনা। বর্তমানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
যাদের জন্ম এখানেও তারাও অনেকে নাতি দেখেছে। তারা আর ফিরে যাবে না। কারণ তারা আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করেনি। তাদের জন্ম অরুণাচলে। তারা দেশকে চেনে আমাদের গল্পের মধ্য দিয়ে।
দেশকে দেখতে আসা
অনেক বছর পর আমি দেশে বেড়াতে আসি। নেফায় যাওয়ার ২৫ বছর পরে হবে। খুঁজে খুঁজে দিদি নােনাবুড়িমার বাড়িতে চলে আসি। সেখান থেকে আমার জন্মস্থান উগলছড়ি। এখন এখানকার হেডম্যান হচ্ছে হেমরঞ্জন। হেমরঞ্জনের পরিবার আমাদের গ্রামের বাবার লাগানাে বাগান ভােগ করছে এখন।
তার স্ত্রী আমাকে নিয়ে গেল বাবার নিজ হাতে গড়া বাগানে। সেই বললাে চলাে তােমার বাবার লাগানাে গাছের ফল খাবে। তাহলে উনার আত্মা শান্তি পাবে। সে সময়টা ছিল কাঁঠাল পাকার সময়।
বাগানে বসে বাবার লাগানাে বিশাল পুরােনাে কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল খেলাম। অদ্ভুত অনুভূতি। বাবা মা কেউ নেই আমরাও ধরতে গেলে নেই-ই। সেই বাবা মার লাগানাে গাছের ফল আমি খাচ্ছি আরেক দেশ থেকে এসে। চোখের পানি গাল বেয়ে নামছিল আর আমি ভাবছিলাম। অনুভব করছিলাম সবাইকে।
শেষ বয়সে এসে ভাবি আমাদের আর দেশে ফেরা হবে না সেটা নিশ্চিত। আর হয়তাে আমরা ফিরতেও চাই না। আমার এখন এখানেই সবকিছু। সেখানে আর কিছুই নেই। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালাে না।
তাছাড়া এখানে জন্ম নেওয়া আমাদের ছেলেমেয়েরা কেউই দেশে ফিরতে চায় না। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি বাবাদের ৭ ভাই আমাদের ৬ ভাইবােনের ছেলেমেয়েরা যাতে একে অপরের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে পারে। আমার ছেলেমেয়েরা যেন একবার হলেও দেশে ফিরে আত্মীয়স্বজনকে দেখে আসে।
লেখকঃ অমিয় চাকমা দায়ন, অরুণাচল ভারত।
তথ্যসুত্রঃ “কাপ্তাই বাঁধ: বরপরং – ডুবুরীদের আত্মকথন” – সমারী চাকমা।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।