অতীত, বর্তমান ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের হিল চাদিগাঙ

Jumjournal
Last updated Jan 27th, 2021

739

featured image

ভূমিকা

অতীত আর বর্তমানকে নিয়েই ভবিষ্যৎ। এক সময় এসব নিয়ে মানুষ খুব একটা ভাবেনি। প্রকৃতির খেয়াল-খুশী মাপিক যখন যা ঘটেছে, তা মানুষ নীরবে মাথা পেতে নিয়েছে।

কার্যকারণ সম্পর্কে মানুষের কোন কৌতুহলও জাগেনি। অধুনা কিন্তু পৃথিবীর কোন কিছুই মানুষের নজর এড়াতে পারে না। সব কিছুই মানুষের নখ দর্পণে। মানব সমাজ বিকাশের এক পর্যায়ে প্রকৃতির কাছে অসহায় মানুষ, হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আক্রমণ থেকে বাাঁচার জন্য সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে।

নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় আয়ত্ব করতে হয়েছে টিকে থাকার অভিনব কায়দা-কৌশল। অতীতের সে সবই এখন ইতিহাস; যার কাছ থেকে সম্যক ধারণা নিয়ে মানুষ আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছে। সে যাই হোক,এখন ইতিহাস পর্যালোচনা নয়।

বিষয়টা হচ্ছে, ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে প্রসঙ্গক্রমে তার অতীত ও বর্তমানের দিকে কিছুটা আলোকপাত করা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে সমগ্র দেশের এক দশমাংশ জায়গা জুড়ে দশ ভিন্ন ভাষাভাষী ১৩টির অধিক আদিবাসী জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি, পার্বত্য চট্টগ্রাম।

ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে জেলা ঘোষণার পর “পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা” নামকরণ হয়। আর তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বলা হয় ‘‘ চিটাগং হিল ট্রেক্টটস্’’ বা চলতি ভাষায় “হিল চাদিগাঙ”।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদদৌল্লার পরাজয়ের পর বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামল।

’৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়। জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়ে ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করে।

তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভাগ্যাকাশ কালো মেঘাচ্ছন্ন হয়। ব্রিটিশ-ভারতে সব জুম্মরা ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিন্দা তথা এক মায়ের সন্তানের মত।

প্রথমতঃ দেশ বিভাগ, দ্বিতীয়ত কাপ্তাই বাঁধের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কালের বিবর্তনে আজকে তারা উত্তরকূল্যা, দেজকূল্যা আর দক্ষিণকুল্যা হিসেবে (ভারত -বাংলাদেশ-বার্মা) তিন প্রতিবেশী রাজ্যের অধিবাসী।

পাকিস্তান শাসনামল থেকে আজকে (১৯৪৭-২০১৮) বাংলাদেশ শাসনামল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭১ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুঞ্জিভূত সমস্যার পরিণতি হচ্ছে আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংকট; যা পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই সংকট নিরসন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষে জাতিধর্মবর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে বিশ্বের সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতা অনস্বীকার্য।

এক নজরে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সময় স্বাধীন রাজার আমল ছিল। “১৭২৪ সালে চাকমা রাজ্য মোগলদের দ্বারা আক্রান্ত হলে চাকমা রাজা দলবলসহ রোসাঙ্গ রাজ্যে পশ্চাৎপচরণ করেছিলেন।

কিছুদিন পর তিনি চাকমা রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। রোসাঙ্গ (আরকান) রাজ তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। অতীতে চাকমা রাজ্যে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল। তাদের মধ্যে চাকমা,রিয়াং,ত্রিপুরা ও মারমা ইত্যাদি জাতিসমূহ ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে চাকমা এবং ত্রিপুরাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল।

ত্রিপুরারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী আর চাকমারা হলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এই ধর্মীয় বিভেদ থাকা সত্ত্বেও চাকমাদের সাথে ত্রিপুরাদের কোন সময়েই সম্পর্কের অবনতি হয় নাই। চাকমাদের সাথে ত্রিপুরাদের সু-সম্পর্ক বর্ণনা প্রসঙ্গে মিঃ জে.পি.মিলস্ লিখেছেন, “ÒIn every way their (the tripuras)material culture appears to be identical with that of the Chakma.” ” অতীতে মারমাদের সাথে চাকমাদের সম্পর্ক ত্রিপুরাদের মতো যথেষ্ট হৃদ্যতাপূর্ণ নাহলেও অমিত্রতাসূলভ ছিল না।” [সূত্রঃ পৃষ্ঠা ১৪, ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম (১৭৭২-১৭৯৮),লেখক-অধ্যাপক,ড.সুনীতি ভূষণ কানুনগো]।

মং সার্কেল রাজবাড়ীর সাথে রাঙ্গামাটির চাকমা রাজবাড়ীর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মং রাণীর নাম রাণী নীহার বালা রায়,বাবা নলিনাক্ষ রায়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে তারা উভয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাদের মধ্যেকার মেলামেশা বর্তমানেও ঘনিষ্ট পর্যায়ে।

চাকমা পাড়া ও মারমা পাড়া পারস্পরিক সংলগ্ন এলাকায় হওয়াতে পরস্পরের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও চেহারা না দেখে এমনি কথার মধ্য দিয়ে চাকমা, মারমা চেনাই যায়না। দেশ বিভাগের সময় সকল জুম্মরা ভারত,বার্মা ও বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছড়িয়ে পড়ে। যাহোক, মূল কথায় আসা যাক।

মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল প্রায়ই একটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। ১৮৬০ সালের আগে চট্টগ্রাম অ লটি কখনো ত্রিপুরা মহারাজা,কখনো আরাকান রাজা,কখনো মোঘলদের অধীনে ছিল। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন ঘটেছে ১৪১৮ সালে।

চাকমা রাজার প্রথম বসতি হয় কদমতলী (বান্দরবন), তারপর রাঙ্গুনিয়ায়। ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা জেলা করার পর চন্দ্রঘোণাতে জেলা সদর দপ্তর স্থাপিত হয়।পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর চন্দ্রঘোণা থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থান্তরিত হলে ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শে চাকমা রাজ দফতর রাজানগর থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর হয়।

উল্লেখ্য, ১৮৬৯ সালের ১ জানুয়ারী চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙ্গামাটিতে জেলা সদর দফতর স্থানান্তরিত হয়।[সূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ইতিকথা-শরদিন্দু শেখর চাকমা]। মূলতঃ ১৪১৮ সালে চাকমা রাজার শাসনকাল শুরু হয়। তার আগে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ত্রিপুরা মহারাজার শাসিত রাজ্য।

‘‘সপ্তদশ শতকে অর্থাৎ ১৬৬৬খ্রীঃ আওরঙ্গেেজবের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম মোঘল অধিকারে আসে। ১৬৭০ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলার নবাব মির কাশিম পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পুরো চট্টগ্রামের শাসনভার ব্রিটিশ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে তুলে দেন। তবে মোগল ও ইংরেজ শাসন নীরবে চাকমারা মেনে নেয়নি।

রাজা জানবক্স খাঁর নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে (১৭৭২) যুদ্ধ শুরু হয়। বেশ কয়েক দফা (সম্মুখ যুদ্ধ বাদেও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে) যুদ্ধে জয়লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত ১৭৮৫ সালে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আর চাকমাদের সাথে সমজোতা চুক্তি হয়। তারপরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন পুরোপুরি কায়েম হয়।

১৮৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে চাকমা সার্কেল,মং সার্কেল ও বোমাং সার্কেল এই তিন সার্কেলে বিভক্ত করে। পরবর্তীতে প্রত্যেকটি সার্কেল অনেকগুলি মৌজায় বিভক্ত করে দেয়া হয়। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে ১৮৮১ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ আ্যাক্ট,১৮৮১’ চালু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

১৯০০ সালের ১ মে ব্রিটিশ সরকার বহুল পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি- ১৯০০ (Chittagong Hill Tracts Regulation 1900 Act) জারী করে। ১৯০০ সালের ১৭ মে কলকাতা গেজেটে এটি প্রকাশ করা হয়। এই আইন কার্যকর হওয়ার পরও বহুবার সংশোধন করা হয়েছিল। ১৯০০ সালের আইন ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছিল।

তাই এই আইনের অন্তর্নিহিত কতিপয় ধারা জুম্মদের জন্য চরম অবমাননাকর ও প্রতিক্রিয়াশীল হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নেতৃবৃন্দ কিন্তু ওই এলাকার ভূমিতে তাদের অধিকারসহ জুম্ম জাতিগোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণে ১৯০০ সালের শাসনবিধিকে রক্ষাকবচ হিসেবে মনে করতো।

কারণ ১৯০০ সালের আইন সংশোধন এবং পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে সমতলের জাতীয় সংগ্রামের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হলেও এই আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে অ-উপজাতীয়দের (বাঙালি) অভিবাসনের প্রবল ¯্রােতকে বহুলাংশে রোধ করতে সক্ষম হয়েছিল।” (সূত্রঃ জুম পাহাড়ে শান্তির ঝরনাধারা-ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি,পৃঃ২৫, পৃঃ২৬,পৃঃ২৭)। তাই পাকিস্তানামল এবং আজকে বাংলাদেশ আমলের মতো করে ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চাটাগ্রামে বহিরাগত সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ অবাধে ঘটতে পারেনি।



জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের গতিধারাঃ

১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। দেশ বিভাগের আগেই (পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজাসহ) উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা অমুসলমান বিধায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টা চালান।

তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতির নেতা ¯স্নেহকুমার চাকমা ও কামিনীমোহন দেওয়ানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মহাত্মাগান্ধী, আচার্য কৃপালিনী,সর্দার বল্লভ ভাই পেটেল ও কংগ্রেস সভাপতি ড.রাজেন্দ্রসহ প্রমূখ কংগ্রেস নেতৃবর্গের সাথে সাক্ষাৎ করে ভারতে তাদের অন্তর্ভূক্তির ব্যাপারে আলোচনা করেন।

কিন্তু র‌্যাডক্লিব কমিশন পাহাড়ীদের এই দাবী মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করে। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে নিজেদের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে অমুসলিম উপজাতীয়দের মধ্যে সৃষ্ট দ্বিধাগ্রস্থ মনোভাবের কারণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর মনে তাদের (উপজাতীয়দের) বিরুদ্ধে প্রতিহিংসপরায়ণ মনোভাবের সৃষ্টি হয়।

ব্রিটিশ শাসকরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন,তারই জের হিসেবে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর তাদের একতরফা জবরদস্তিমূলক সিদ্ধান্তসমূহ চাপিয়ে দিতে থাকে। পক্ষান্তরে ১৯০০ সালের শাসনবিধির আড়ালে দেশের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের মধ্যে একদিকে আত্মমূখীন মনোভাব,অন্য দিকে এক ধরণের এলিনিয়েশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্টি হয়।(সূত্রঃ জুম পাহাড়ে শান্তির ঝরণা ধারা-ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-পৃষ্ঠা ২৫)।

শুরুতে এভাবে পাকিস্তানে জুম্মদের নাগরিক জীবনের সূত্রপাত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দু’দশকাধিককাল ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বিমাতাসূলভ রাজনৈতিক যুগের অবসান ঘটে; ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর,দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তাক্ত স্বাধীনতার যুদ্ধের মাধ্যমে।

স্বাধীন রাজার আমল থেকে রাঙ্গামাটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের কেন্দ্র বিন্দু ও প্রাচীন শহর। ’৭১-এর মুক্তি যুদ্ধের সময় পাক সেনারা সর্বপ্রথমে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি শহরের দখল নেয়। তখনকার পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘জুম পাহাড়ে শান্তির ঝরণাধারা’ বই-এ উল্লেখ করা হয় যে,-“তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি এমনই উভয় সংকটাপন্ন ছিল যে, পাকিস্তানী দালালদের চাপের মুখে উপজাতীয় সমাজপতিরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন নাকরে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে বাধ্য হন।

এপ্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা হয় যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের বিশ্বাসী পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পাহাড়ী জনগণকে কখনোই সুনজরে দেখেনি। ১৯০০ সালের আ্যাক্ট বহাল থাকলেও ১৯৪৮ সালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ফ্রন্টিয়ার পুলিশ অ্যাক্ট -১৮৮১ বাতিল করে দেয়া হয়। (সূত্রঃ জুম পাহাড়ে শান্তির ঝরণা ধারা-ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-পৃষ্ঠা ২৫)।

পাকিস্তানের আমলে এভাবে লুপ্ত হয় পাহাড়ী পুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব। এরকম পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তান সরকারের প্রতি জুম্মদের বীতশ্রদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধে জুম্মদের অংশ গ্রহণ প্রসঙ্গে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও বলতে হয়, স্বভাবগতভাবে সাধারণ জুম্মরা ছিল সহজ-সরল প্রকৃতির।

তাদের এই সহজ-সরলতার সুযোগে সকল সরকারের আমলে জুম্মরা কেবল শাসিত-শোষিত হয়েছিল। প্রতিটি সরকারের আমলে শাসকগোষ্ঠীর শাসন শোষণের জগদ্দল পাথরের চাপে জুম্মদের সভ্যতার বিকাশ দ্রুত ঘটতে পারেনি। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী দ্বারা জুম্মদের সম্পর্কে যারযার মনগড়া মন্তব্য করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল জুম্মদেরকে।

তাদের সাংবিধানিক অধিকার সম্পর্কে কোন সরকার আমল দেয়নি। ফলে শাসকগোষ্ঠীর এক কলমের খোচায় একটা ধারা সংশোধন আর এক কলমের খোচায় একটা আইন প্রণয়ণ ছিল ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। অথচ সে সবের কোনটাই সহজে জুম্মদের দৃষ্টি গোচর হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নিজস্ব প্রথাগত রীতিনীতি দিয়ে জুম্মদের সমাজ চলে আসছিল। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্র্কিত কোন সরকারী আইন রদ-বদল নিয়ে সাধারণ জুম্মরা খবর নেয়ার জরুরী প্রয়োজনবোধ করেনি।

১৭৭২-১৭৯৮ খ্রীঃ দফায় দফায় চাকমাদের সাথে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর যে যুদ্ধ, সেযুদ্ধে চাকমারা পরাজিত হলেও তাতে করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জুম্মদের মধ্যে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল বলা যায়। সেই থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনের জন্য ভাগ কর শাসন কর নীতিকে সুকৌশলে প্রয়োগ করার উদোগ নিয়েছিল দেশ বিভাগের সময়।

তাই ব্রিটিশ চলে যাবার সময় যাদের সাথে জুম্মদের খাওয়া-দাওয়া,পোষাক-পরিচ্ছদ,কথা-বার্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আদৌ মিল নেই, সেই মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। সেই দিন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জন্য আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়েছিল।

উগ্র ইসলামিক ধর্মান্ধ পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর সাথে সহজ-সরল জুম্মরা পেরে উঠেনি। অপরদিকে জুম্ম সমাজ সামন্ততন্ত্রে আবদ্ধ থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্তিশালী জুম্ম জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠতে পারেনি। শেষতক সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান সরকারের করা দেশদ্রোহীতার মামলা মাথায় নিয়ে স্নেহকুমার চাকমা এবং গণেশিয়াম দেওয়ানের মতো জুম্ম নেতৃবৃন্দকে দেশছাড়া হতে হয়েছিল।

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার মামলা করলেও তাতে করে তাদের অনুস্মৃত আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটাতে পারেনি। ¯স্নেহবাবুরা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের যে বীজ বপন করেছিলেন (তৎকালীন, পাকিস্তান, ভারত.বার্মা ইত্যাদি), যেখানে রয়েছেন সেই বীজ স্বযত্নে রক্ষা করেছিলেন। হয়েছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ।

একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ¯স্নেহ কুমার চাকমা ও তাদের পূর্ব পুরুষদের জন্ম ভূমি। তাই ভারতের মাটিতে তাদের সমাধি রচিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সাথে তাদের ছিল অবিচ্ছেদ্য নাড়ীর টান।

জীবদ্দশায় ¯স্নেহবাবুরা প্রতিনিয়ত নিজেদের জন্মভূমির কথা, জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা নিয়েই জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছিলেন। আদিবাসী জুম্ম জাতীয় সংস্কৃতি নিয়েই তারা পরিপুষ্ট হয়েছিলেন। ভারত বিভক্তির আইন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অমুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ভারতে অন্তর্ভূক্ত হবার কথা।

তাছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতে অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে স্নেহবাবুদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা। ভারত বিভক্তির সময় শুরু থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য সেরকম একটা সংবিধি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য্য ছিল।

তাই হতে পারেনি বিধায় ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে অদ্যাবধি জুম্মরা বার বার প্রতারিত হয়ে আসছে। অতীতের ব্যর্থতার ইতিহাস পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের নবীন প্রজন্মকে বার বার পীড়া দেয় ও আন্দোলিত করে। তাই ’৪৭ সালে সেই আন্দোলনের পুনজাগরণ হয়েছে ষাট দশকে।

বলতে হয় পঞ্চাশ দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারত ডোমিনিয়নে অন্তর্ভূক্তির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যেমনি তৎকালীন ছাত্র নেতা ¯স্নেহবাবু চাকমার অভ্যূদয়, তেমনি তদানীন্তন পাকিস্তানের আমলে ষাট দশকের ছাত্র নেতা (১৯৫৬) মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএনলারমা)’র অভ্যূদয় ঘটেছিল কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের যথাযথ পূনর্বাসনের দাবীতে সংঘটিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।

তাঁর অভ্যূদয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিক উস্মোষিত হয়। তাই ১৯৪৭, ১৯৫৬, ১৯৬০, ১৯৬২, ১৯৭২,১৯৭৩, ১৯৮৬ ও ১৯৯৭ সাল পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্ম নিয়ন্তণাধিকার আদায়ের আন্দোলনে একেকটি মাইল ফলক হিসেবে পরিচিহ্নিত।

প্রসঙ্গতঃ যেটুকু না বললে নয়,তা হচ্ছে পাকিস্তানের গণপরিষদ কর্র্তৃক ১৯৫৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। পাকিস্তানের এই শাসনতন্ত্রে “১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি” দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘পৃথক শাসিত অঞ্চলরূপে’ ঘোষণা করা হয়।

১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এই দ্বিতীয় শাসনতন্ত্রেও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্রে ব্যবহৃত “পৃথক শাসিত অঞ্চল” শব্দের পরিবর্তে “উপজাতীয় অঞ্চল” শব্দ ব্যবহার করে “১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি” কে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন পরিচালনার আইন ঘোষণা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “উপজাতীয় অঞ্চলের মর্যাদার স্বীকৃতি” দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম শাসনতন্ত্র ঘোষিত হয়। এই শাসনতন্ত্রে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের যতটুকু আইনগত অধিকার “১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে নিহিত ছিল তাও ক্ষুন্ন হয়ে যায়।

১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের আজ পর্যন্ত এখানে উল্লেখের অবকাশ না থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে এর বেশী কিছু বিজ্ঞমহলের কাছে সবই প্রকাশ্য দিবালোকের মতো পরিস্কার।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে অতীতে যে কোন সময়ের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে ব্যাপক হারে বেআইনী সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৬ সালের ২জুলাই থেকে ১৯৮৯ সালের জুন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতিতে দফায় দফায় ৬২ হাজার জুম্ম নরনারী ভারতের মাটিতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।

তখনো পর্যন্ত স্নেহবাবুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় শরনার্থীরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় লাভ করে। লাগাতার ১২ বছর ধরে শরনার্থীরা আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আশি দশকে ¯স্নেহবাবুর সম্পাদিত, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে প্রচারিত “টেলিগ্রাফ” নামে একটি অনিয়মিত ইংরেজী প্রত্রিকা বের হতো।

এই পত্রিকা পার্বত্য চট্টগ্রামের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল। ১৯৮৭ সালের ২১ জুলাই আগরতলায় স্নেহ কুমার চাকমা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়।

ষাট দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ৫৪,০০০.০০ একর আবাদী জমি কাপ্তাই বাঁধে জলমগ্ন হওয়ার পিছনে ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কূট উদ্দেশ্য। কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প প্রনয়ণ এবং বাস্তবায়ন দৃশ্যত: দেশের শিল্পোন্নয়ন হলেও মূলত: জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করণ তথা জুম্মজাতি সমূহের নির্মূলীকরণ উদ্দেশ্য-লক্ষই ছিল মুখ্য।

তাই “কাপ্তাই বাঁধ মরণ ফাঁদ” শ্লোগানে ষাট দশকের ছাত্র-যুব সমাজের একমাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র সমিতি-এর ছাত্রদের প্রতিবাদে রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছিল। আসলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের জন্য কাপ্তাই বাঁধ কোন প্রয়োজন ছিল না।

বস্তুত একটি জাতিকে কীভাবে বিলুপ্তি ঘটাতে হয় তারই একটি মডেল ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাপ্তাই হাড্রোলিক প্রজেক্ট। তখন থেকেই শুরু হওয়া জুম্মদের উদ্বাস্তু করণ প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত রয়েছে।

তারই ধারাবাহিকতায় সরকারী উদ্যোগে বনায়ন ও বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে জুম্মদের ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি হচ্ছে জাতিগত নির্মূলীকরণ কার্যক্রমের অংশ। তাই এই পার্বত্য চট্টগ্রামের আলাদা বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের লক্ষে এই কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য প্রতিরোধ সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের তৎকালীন অর্থনীতিঃ

মানব সমাজের সকল স্তরে অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে কোনদিন রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারেনি। অর্থনীতি মানব সমাজের অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথ নির্দেশক হিসেবে সমাজ পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

অর্থনৈতিক বিকাশের এক পর্যায়েই বিশ্বে রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটেছে। গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রের শাসন কাঠামো। এভাবে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবন বিকাশের উচ্চতর পর্যায়ে এসে এক সময় বিশ্বব্যাপী কায়েম হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ। তাতে ঔপনিবেশের অধীন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সমূহ হয়েছে ঔপনিওবশিক শাসন-শোষণের শিকার।

কালের বিবর্তনে স্বাধীন রাজার আমলের এই পার্বত্য চট্টগ্রামও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। ১৭৭৭ সালের পূর্বে,স্বাধীন রাজার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল, বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল।

জুম চাষের মতো একটি সরল উৎপাদন ব্যবস্থাই ছিল এই অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। স্বল্প পরিশ্রমে অঢেল শষ্যের ভান্ডার ছিল জুম্মদের অতীতের পার্বত্য চট্টগ্রাম। ব্যাপক হারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ ও তাদের দ্বারা জুম্মদের ভূমি বেদখল হয়।

এলোপাথারী বনধ্বংসের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে উঠে। পাহাড়ী ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে মাছ,কাকরা আর চিংড়ি মাছ সমৃদ্ধ চিকন ছড়াছড়ি।হ্রাস পেয়েছে বন্য শাকশব্জীর প্রাচুর্যতা। জুমেও আগের মতো আর ফসল হয় না। ফলে জুম ও কৃষি নির্ভর জুমিয়া অর্থনৈতিক মেরুদ্বন্ড ভেঙ্গে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা দেশান্তর হওয়ার ইহাও একটি অন্যতম কারণ।

এক সময় জুম চাষের পাশাপাশি বনজ সম্পদই ছিল জুম্মদের সহায়ক আয়ের উৎস। সমতল চট্টগ্রামের বাঙালিদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের বনজ সম্পদের ব্যবসা ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে কুরূপ পাতা (করদি পাদা) ছিল সমতল চট্টগ্রামের বাঙালিদের জন্য একটি অত্যন্ত আবশ্যকীয় গৃহস্থালীর উপকরণ।

সমতল চট্টগ্রামাঞ্চলের বাঙালিরা ঘরের ছাউনি বানাতে শনের বদলে এই কুরূপ পাতা সমধিকভাবে ব্যবহার করতো; যা ছিল শনের চেয়ে বহুলাংশে টেকসই। অধিকন্তু কুরূপ পাতার-ছাউনি ঘর ছিল আরামদায়ক ও অগ্নিরোধক হিসেবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদও বটে। আধুনিক সভ্য যুগে গৃহ সজ্জায় মানুষের যে আসবাব পত্রের প্রয়োজন রয়েছে এক কালে সমগ্র চট্টগ্রামাঞ্চলে সেসব আসবাব পত্র তৈরীর যাবতীয় কাঁচামালের উৎস ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের গভীর বনাঞ্চল।

পার্বত্য চট্টগ্রামের গাছ, বাঁশ, গোলাক-বেত,শন ইত্যাদির সিংহভাগ অংশ সমতল চট্টগ্রামাঞ্চলের বাঙালি ব্যবসায়ীরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করতো। তখন তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সাথে প্রতিবেশীর মতো উঠাবসা করতো। তাদের মধ্যে পাহাড়ী-বাঙালি বলে এমন কোন সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিলনা।

পাকিস্তান আমলে এশিয়ার বৃহত্তম পেপার মিল হিসেবে খ্যাত “চন্দ্রঘোণা কর্ণফূলী পেপার মিল” চলতো চেঙ্গী, মেয়নী, কাসলং,শঙ্খ ও মাতামুহরী বনাঞ্চলের বাঁশ দ্বারা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের উপর একচ্ছত্র অধিপতি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা।

দেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাধে সেটেলার বাঙালি অনুপ্রবেশ ঘটার পর হারিয়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বনজ সম্পদের প্রাচুর্যতা এবং বনের উপর জুম্মদের ঐতিহ্যগত অধিকার।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের যাবতীয় বনজ সম্পদ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকারীভাবে বনায়ন, সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ,পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ইত্যাদি নানা নামে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের প্রথাগত ভূমি অধিকার উপেক্ষা করে বন, ভুমি অধিগ্রহণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবাদী জমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে জুম্মদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ আজ হুমকীর সম্মুখীন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম সমাজ আকন্ঠ সামন্তবাদে নিমজ্জিত থাকায় ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে শক্তিশালী জুম্ম জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে জুম্মরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং ভারত,পাকিস্তান ও বার্মায় চলে যায়।

এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা দফায় দফায় বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। বিশেষ করে বার্মায় (মায়ানমার) বসবাসকারী জুম্মরা উত্তরকূল ও দেজকূলে বসবাসকারী জুম্মদের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কিন্তু উত্তরকূল ও দেজকূলের জুম্মরা অনুকূল ভৌগলিক পরিবেশে বসবাস করার কারণে নিকট প্রতিবেশীর মতো হওয়ায় এপাড় ওপাড়ের বিভিন্ন পালা-পার্বনের সময় তারা এখনো মিলিত হয়ে থাকে। জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের অর্থনীতি সর্বত্র কৃষি ও জুমচাষের উপর নির্ভরশীল। তাই উভয় কূলের জুম্মদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবন এক ও অভিন্ন হওয়ায় তাদের মধ্যে প্রগাঢ় ভ্রাতৃত্ত্ববোধ অটুট রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান দীর্ঘ ৭১ বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা হচ্ছে রজনৈতিক সমস্যা। পাকিস্তান আমলে এসমস্যা আদৌ লাঘব হয়নি। ‘৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান শাসনামলের এ সমস্যা আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ‘৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার শুরুতে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু বিধি বাম প্রথমতঃ তৎকালীন সরকারের উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী, দ্বিতীয়ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বলবৎ থাকায় এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা প্রকৃতিগতভাবে সরল ও গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন। তাই ১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পদ্ধতি ফিরে আসার পর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে ’৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তি সম্পাদিত হয়; যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি তথা শান্তি চুক্তি হিসেবে সমধিক পরিচিত।

এচুক্তির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,তৃতীয় পক্ষীয় কোন রাষ্ট্রের মধ্যস্থতা ছাড়াই সরকারের প্রতি সরল বিশ্বাস রেখেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।

তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ও চুক্তি বাস্তবায়নের স্বার্থে অনেক বিষয় চুক্তিতে না লিখে উহ্য রাখা হয়েছিল। সেটাই অলিখিত চুক্তি হিসেবে উল্লেখ্য। এই ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রসঙ্গ এখন ঘরে-বাইরে সর্বত্র বহুল আলোচিত একটি আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ কার্যালয়ে, অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রসঙ্গে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাববিনিময় হয়। কিন্তু দেশে এচুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হতাশাব্যঞ্জক।

কারণ, চুক্তিতে তার প্রথম অধ্যায়ে “চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে এচুক্তি কার্যকর হবে।’এমনটা উল্লেখ থাকলেও আজকে চুক্তি সম্পাদনের পর ২১ বছরেও চুক্তির মৌলিক অনেক ধারা এখনো অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে।

বর্তমানে সমগ্র দেশের সর্বমোট ৬৪ টি জেলার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের (রাঙ্গামাটি পার্বত্যজেলা, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা) তিন পার্বত্য জেলার পরিস্থিতি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ইত্যাদি সব দিক থেকে হুমকীর সম্মুখীন।

তার কারণ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশ ও জাতির গৌরব, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও সেনা শাসন। অবশ্য দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়, দেশের ৬১টি জেলায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও সেখানে সেনাশাসন নেই। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুসারে সেনাক্যাম্প সরানো হয়নি।

বরং বৃদ্ধি করা হয়েছে। বলবৎ রয়েছে সেনা শাসন,যাতে করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদনকারী সরকারের স্ববিরোধী ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে।

’৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় জুম্ম নেতৃবৃন্দের দাবী-দাওয়া উপেক্ষা করে র‌্যাডক্লিপ কমিশনের সীমানা নির্ধারণ, পাকিস্তানের আমলে ষাট দশক থেকে জুম্মদের মতামত যাচাই ব্যতিরেকে দফায় দফায় ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির বিভিন্ন ধারা-উপধারা রদ-বদল, ষাট দশকে কাপ্তাই হাইড্রোলিক প্রজেক্ট বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ আমলে এসে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে দেশের নাগরিক তথা জুম্মদের বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ২০১১ সালের ৩০ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন ইত্যাদি পদক্ষেপসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুন্ন করেছে।

আজ জুম্মদের নিজস্ব ধর্ম, কৃষ্টি,সংস্কৃতি ইত্যাদির বিকাশ ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে,যা বলা বাহুল্য। ’৪৭ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েও যেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান হয়নি; তেমনি ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে চেয়েও জাতীয় পর্যায়ের কতিপয় আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের অসহযোগিতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে পারেনি।

তারপর ’৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ৪ দফা ভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবী পেশ করা হয়। তাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়।

উপরন্তু জুম্মদের বিচ্ছিন্নতাবদিী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরিশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেও চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্মরা প্রতারণার শিকারে পরিণত হতে চলেছে।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস যে,জুম্ম জাতির মতো একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতি যুগ যুগ ধরে এভাবে প্রতারিত হওয়ার ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। বর্তমানে স্বেেদশে পরবাসীর মতো হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জীবন-যাপন।

ইতিমধ্যে নিঃস্ব আদিবাসী জুম্মরা ইসলামিক সম্প্রসারণবাদের আক্রমণ থেকে রেহায় পাবার জন্য নিজস্ব সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে বিভিন্ন ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। যারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে জলাঞ্জলী দিতে পারেনি সেসব জুম্মরা জন্মভূমি ও প্রৈত্রিক ভিটে-বাড়ী ছেড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করেছে।

সমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রেহায় পাবার জন্য এবং জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের জন্য জুম্ম জাতিকে বাধ্য হয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এআন্দোলন নিছক সমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রেহায় পাবার জন্য অস্তিত্ব সংরক্ষণের আন্দোলন; এ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করার কোন সুযোগ নেই।

’৪৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভূীক্তর প্রতিবাদ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের বসবাসের জন্য ন্যূনতম অনুকূল পরিবেশ ছিল। অন্ততঃ ঠিক যতদিন পর্যন্ত ১৯০০ সালের শাসনবিধি কার্যকর ছিল।

এই বিধির মূল ধারা (পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল) সংশোধনের পর থেকে পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ঘণীভূত ঘণীভূত হয়ে উঠে। আজকে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন ব্যর্থ হলে জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অচিরেই মুসলমান অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত হতে বেশী দিন লাগবে না।

সম্প্রতি জুম্ম আর অনুপ্রবেশকারী সেটেলার বাঙালির অনুপাত হচ্ছে জুম্ম ৪৯% জন আর সেটেলার বাঙালি ৫১% জন, যা ’৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ছিল জুম্ম ৯৭.৫% জন আর বাঙালি ২.৫% জন।

১৯৪৭-২০১৮ এই ৭১ বৎসরের মধ্যে যে অনুপাতের তারতম্য তা থেকে এটাাই নিশ্চিৎ যে আগামী এক-দুই দশকের মধ্যে জুম্মদের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে যাবে। তাই সমূহ বিলুপ্তির হাত থেকে রেহায় পাবার জন্যই জুম্মদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের এই আন্দোলন।

শুরু থেকেই এই আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিমেষে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানবতাবাদী, ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র থেকে আন্তরিক সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে আসছে। তাদের এই আন্দোলন পৃথিবীর যেকোন জাতির জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনের পক্ষে।

এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ’৭২ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বাংলাদেশ সংবিধানের আওতায় জুম্মদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের দাবী জানিয়ে আসছিল।

১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তিনিও বাংলাদেশ সংবিধানের আওতাধীনেই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সংসদে দাড়িয়ে অকুতোভয়ে ও নিঃসংশয়ে দেশের আপামর জনগণ তথা জুম্ম জনগণের কথা বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে অন্তর্ভূক্তির কথা বলেছিলেন। দেশের নাগরিক হয়ে সেদেশের সাংবিধানিক অধিকার দাবী করা,সংবিধানের অধীনে জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের অধিকার চাওয়া হচ্ছে, দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

সেই জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলা অগণতান্ত্রিক। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হলে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হতো না। সুতরাং এই আন্দোলন হচ্ছে দেশের সার্বভৌমত্বকে অক্ষুন্ন রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।


পার্বত্য চট্টগ্রামের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। উন্নয়নের পূর্ব সর্ত হলো শান্তি। আজ থেকে ২০ বছর আগে সম্পাদিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে অচিরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংকট নিরসন হতো; প্রতিষ্ঠিত হতো শান্তি।

আর জুম্মদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কাঙ্খিত উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হতো। কারণ এই চুক্তির আওতায় তাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সর্বত্র সৃষ্টি হতো একটা গতিশীল প্রবাহ। বাংলাদেশ স্বাধীনোত্তর কাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে অনেক দেশী-বিদেশীী সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামে খনিজ সম্পদের উৎস অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে আসছিল।

তদুদ্দেশ্যে আশি দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশে প্রায় সময় অনুসন্ধানী হেলিকপ্টার উড়তো এবং সম্ভাব্য স্থানে ল্যান্ড করে শিলা ও মৃত্তিকা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের কতেক এলাকায় খনি থেকে জ্বালানী তেল ও কয়লা নির্গত হতে দেখা যায়। স্থানীয় লোকজন রান্না ও কাপড় আয়রনিং কাজে ঐ কয়লা ব্যবহার করে থাকে।

পার্বত্যাঞ্চলের খনিজ ও বনজ সম্পদ সদ্ব্যবহার করতে পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন অনায়াসে সম্ভব হতো। সম্ভব হতো জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নের সাথে সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন।

কিন্তু পার্বত্য চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের প্রক্রিয়া হাতে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ষাট সালে পাকিস্তানের শাসনামলে শিল্পোন্নয়নের জন্য কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়ে কর্ণফূলী নদীতে কাপ্তাই নামক স্থানে বাঁধ দেয়া হয়েছিল।

পাকিস্তানের সেই শিল্পোন্নয়ন পরিকল্পনা কতটুকু সফল হয়েছে সেটা সাধারণ মানুষের কাছে পরিস্কার নয়। কিন্তু আজকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিপক্ক অবস্থায় ভূগর্ভের অভ্যন্তরে পড়ে থাকা খনিগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট জুম্মরা অবহিত আছেন।

এগুলো উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারলে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন সমগ্র বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়নে তেল,গ্রাস ও কয়লা খনিগুলো নিশ্চয় উল্লেখযোগ্যভাবে উপকারে আসতো।


জুম্মদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতু বন্ধন ও রেগাঃ


মানব সমাজ, সভ্যতার যে স্তরেই থাকুক নাকেন তার সাথে একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক জীবন থাকে। সমাজের মানুষ শুধুমাত্র খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এর বাইরেও তার প্রয়োজন অবসর ও চিত্ত বিনোদন।

মানুষের চিত্ত বিনোদনের সাধারণ মাধ্যম হচ্ছে সঙ্গীত। মানুষ মাত্রেই সঙ্গীতপ্রিয়,অন্যথায় বন্য হিংস্রতা মানুষের মাথায় চেপে বসতো। যেকোন মানুষ হয় গান গায়, নাহয় অন্যের গান শুনে অথবা অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

একজন শিল্পানুরাগী জুম্মও তাই ঘামে ভিজে, রৌদ্রে পুড়ে সারাদিনভর জুমের কাজে ব্যস্ত জুমিয়া বা কৃষক ফসল ভরা জুম দেখে মনের আনন্দে গান গায়। আর অবসর সময়ে বাঁশী, ধুধুক ও শিঙা ইত্যাদি বাজিয়ে গান ধরে।

তাঁর জীবনের সুখ-দুঃখ,হাঁসি-কান্না,বিরহ-বেদনার কথা গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে। পাঠিয়ে দেয় এপাহাড়ের জুম ঘর থেকে ও পাহাড়ের জুম ঘরে, মাঠে প্রান্তরে। জুম্মদের সরল জীবন জীবিকার সাথেও জড়িত রয়েছে সরল জুম্ম সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা। লোক সাহিত্যই জুম্মদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

বেঙ্যমা-বেঙ্যমী পক্ষী, রংরাং-সুদত্তুপি, কুচ্চবেঙ শহরত্তুন ফিরানা, দুলুকুমারীর পচ্চন,হ-বি-ড-বি পচ্চন ইত্যাদি কয়ে-বলে নানা-নানীরা কচি-কাঁচাদের মাতিয়ে রাখতো। এসব গল্প বা রূপকথার কাহিনী সব মৌখিক, এখনো লিখিতভাবে হয়তো খুব কমই পাওয়া যাবে।

প্রাচীনকালে প্রবীনদের কাছে রামায়ণ, মহাভারত ছিল আকর্ষণীয়। অবসর মূহুর্তে রামায়ন মহাভারতের নানা পর্ব পাঠ করে নিজেদের মজিয়ে রাখতো। তরুণ-তরুণীদের কাছে গেংখুলী গীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। চাদিগাঙছাড়া পালা ছিল গেঙখুলী গীতের মধ্যে সবচেয়ে করুণ পালা।

এই পালা নাকি সমৃদ্বশালী গ্রামের মাঝখানে শুনতে গেলে গ্রাম ভেঙে যায়।এই রকম একটা সংস্কার জুম্মদের মধ্যে প্রচলিত থাকায় চাদিগাঙছাড়া পালা শুনতে হলে গ্রাম থেকে দূরে জঙ্গলের মাঝখানে গিয়ে এই পালা শুনার রেওয়াজ প্রবর্তিত হয়েছিল।

জুম্মরা কীভাবে কীকারণে সমতল চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তার করুণ কাহিনীর বর্ণনা এই পালার মধ্যে ছিল বলে লোকশ্রুত। আর ছিল বৎসরের বিভিন্ন সময়ে মৌসুমী ফসল বুনা ও তুলার সময়ে জুম্মদের স্বরচিত বারোমাসী পালা গান।

তাছাড়াও রাধামন-ধনপুদি পালা,চান্দবী বারো মাস, তান্যাবীর পিত্তি, ইত্যাদি প্রেম উপখ্যান সম্বলিত পালা গান ছিল তরুন-তরুণীদের মুখে মুখে। সম্প্রতি ঠেঙাভাঙা গান নামে জুম্মদের মধ্যে আরেক প্রকার পালা গান শুনা যায়।

প্রতিবেশী রাজ্য মিজোরামে গানের লহরী অনুকরণে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামেও গাওয়া হয়। বিশেষ করে প্রেমিক-প্রেমিকা সেজে সামনাসামনি এই পালা গান শিল্পিরা গেয়ে থাকেন। যেখানে প্রেমিক-যুগল তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মনের কথা ব্যক্ত করে।

পৃথিবীর সব প্রান্তের জুম্মরা এই সব শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী। সাম্প্রতিককালে জুম্ম সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরেকটা বিষয় দেখা যায়। তাহচ্ছে একই অর্থ, একই সুর ও ছন্দ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় একই মঞ্চে একটি দলীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। শিল্পিদের সবার গায়ে গান সংশিল্ষ্ট সব জাতি সমূহের পোষাক শোভা পায়।

সঙ্গীতাঙ্গনে এই যে জুম্ম সাংস্কৃতির ধারা, তাহচ্ছে সত্যিকার অর্থে জুম্ম জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। বার্মায় যে সমস্ত চাক জাতিগোষ্ঠীভূক্ত সম্প্রদায় বসবাস করতেছে তাদের নিজস্ব ভাষা দিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতিকে সাজাতে শুরু করেছে।

তাদের এতিহ্যবাহী পোষাক আধুনিক ঢঙে ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক মঞ্চে সগৌরবে হাজির হচ্ছে। চাকমাদের বেলায়ও অনুরূপভাবে শিল্প চর্চা চলছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ইউটিউবে এবং এফবিতে সেসব দেখা যায়। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ থেকে যেসব জুম্ম পর্যটক এবং তীর্থযাত্রী বার্মা (মায়ানমার) সফরে যায়, তারা এখন নগদ মুদ্রা সঙ্গে নেয়ার বদলে,পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম নারীদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড়(পিনোন,খাদি ইত্যাদি)সঙ্গে করে নিয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে,সেখানে চাকমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের নামে ডাকা হয় না; সেখানে চাকমাদের পরিচয় “দৈনাক” নামে। চাক দেরও এখানের মতো করে ডাকা হয় না। সেখানে চাকদের পরিচয় “সাক” নামে। ভাষাগত ক্ষেত্রেও সাক (চাক) আর চাকমা (দৈনাক) দের ভাষা পার্বত্য চট্টগ্রামের চাক ও চাকমাদের ভাষার অনুরূপ। তবে উচ্চারণভঙ্গী বার্মার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বার্মিজ ভাষার ধাসে।

এক জাতি ভিন্ন দেশের অধিবাসী হলেও জুম্মদের ভাষা এক। ভাষা লেখার হরফ এক। দেশ আর অঞ্চল ভেদে তাদের কন্ঠস্বর বা উচ্চারনভঙ্গী অপেক্ষাকৃত আলাদা।কিন্তু তাদের চলন-বলন,জীবন-জীবিকা, সামাজিক রীতি-নীতি একই সূত্রে গাথা।

তাদের জন্ম অনুষ্ঠান মৃত্যু অনুষ্ঠান, সর্বোপরি অর্থনৈতিক জীবন এক হওয়ায় তাদের সামগ্রিক জীবন প্রবাহ এক ও অভিন্ন। তাই তারা জুম্ম জাতি হিসেবে পৃথিবীর সব প্রান্তে নিজেদের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকে।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তারা নিজের ভাষায় বক্তব্য দিয়ে পরিচয় দিয়েছে যে,পার্বত্য চট্টগ্রামে দশ ভিন্ন ভাষী আদিবাসী জুম্ম আছে; যারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে নিয়োজিত।

উত্তরকূল, দেজকূল, গোমেতকূল আর বোঙ্কুল ইত্যাদি হচ্ছে দেশ জুম্মদের দেয়া নাম। এক সময় জীবনজীবিকার তাগিদে জুম্মরা জুম চাষ করতে করতে ঘুরে-ফিরে এসমস্ত এলাকায় অস্থায়ী বাসস্থান গড়েছিল।

সে সূত্রে এখন জুম্মরা ভিন্ন দেশের অধিবাসী হলেও তাদের আত্মিক বন্ধন অটুট রয়েছে। আন্তর্জাতিক ভৌগলিক সীমানা জুম্মদের এই বন্ধনকে ছিন্ন করতে পারেনি।সব দেশের জুম্মদের কাছে লোক সাহিত্য এক ও অভিন্ন ধারায় প্রবাহমান। যে যেখানে বসতি গড়েছে সেই পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখেই সে সমস্ত লোক সাহিত্য চর্চা হয়ে থাকে।

যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফূলী নদীর নাম কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে কিংবদন্তী কাহিনী আছে। অনুরূপভাবে গোমতী নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী ত্রিপুরা রমণীর অজগড় সাপের সাথে বিয়ের কাহিনী ইত্যাদি রূপ কথা বা পচ্চন জুম্মদের পরস্পরকে গভীর সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে।

রাধামন-ধনপুদির পালা,চাদিগাং ছাড়া পালা ইত্যাদি পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের জুম্ম গেংখুলীরা (চারন কবি) একই ভাবে গেয়ে থাকে। অতি সম্প্রতি অরুনাচল ও বার্মার চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম গাথাও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গেঙখুলীদের মতো করে গেয়ে থাকেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি হারিয়েছে তার উর্বরতা ক্ষমতা আর জুম্মরা হারাতে বসেছে তাদের পুরোনো জাতীয় কৃষ্টি,সংস্কৃতি।

বাংলাদেশের বাইরে যারা বসবাস করছেন তাদের কাছে উগ্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয়তো এখনো ঘটেনি। তবে ভবিষ্যতে যে ঘটবেনা সেকথা হলফ করে কেউ বলতে পারে না। কারণ, বিশে^র বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর শাসক শ্রেণীর সংস্কৃতি অন্যান্য শাসিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে গ্রাস করে থাকে।

সেটা হতে পারে জীবন-জীবিকা বা চাকরীর সুবাদে, হতে পারে চর্চার অভাবে, চেতন-অবচেতন মনে ইত্যাদি নানাভাবে। যেমন ইউরোপে অভিবাসিত জুম্মদের শিশুরা এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে আসলে জুম্মদের ভাষা বুঝেনা।

তাদের পিতামাতা কর্মসংস্থানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্যাগ করে সেখানে গেছেন। কাজে যাবার সময় চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে পিতামাতারা তাদের সন্তান-সন্তুতিদের রেখে যান। এভাবে দিনের অধিকাংশ সময় শিশুরা অভিবাসনকারী দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠতে থাকে। আচাব ব্যবহার কথা বার্তাও সেদেশের ধাসে গড়ে উঠে।

জুম্মরা ঐহ্যিগতভাবে অতিথি পরায়ণ। জুম্মদের মধ্যে ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর লোকজনরা অতিথিকে সাক্ষাৎ নারায়ণ বলে মনে করতো। বাড়ীতে অতিথির আগমন ঘটলে তাতে তারা নারায়ণের আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করে থাকে।

প্রতিবেশী রাজ্যে বসবাসকারী জুম্মরা অপূর্ব আতিথেয়তায় পরস্পরকে আপ্পায়ন করে থাকে। এককথায় বাঙালিদের বেলায় যেমন এপাড় বাংলা ওপাড় বাংলা আর জুম্মদের বেলায় হচ্ছে দেশকূল, উত্তর কূল আর দক্ষিণ কূল।

এই অঞ্চলের জুম্মরাই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসিন্দা,যারা বাঘ-ভালুকের সাথে লড়াই করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আবাদ করেছে। ভিন্ন রাষ্ট্রের ভূ-খন্ডে বসবাস করলেও তারা এখনো যেন একই পরিবারেই সদস্য।

একই অঞ্চলের বাসিন্দা দেশকূল-উত্তরকূলের জুম্মরা ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের (রিয়াং, ত্রিপুরা,মিজো,উচই,চাকমা ইত্যাদি) জুম্মদের কাছেও পরস্পরের নিকটতম প্রতিবেশী, যারা বারো মাসের তেরো পার্বনে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে থাকে।

আজো ভারতে ফি-বছর অনুষ্ঠিত কুম্ভ মেলা, পৌষ চংক্রান্তি মেলা চলাকালে ভারত-বাংলাদেশ উভয় সরকারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠান উপলক্ষে (আদিবাসী জুম্ম) সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য সীমান্ত পাড়াপাড় উন্মুক্ত রাখা হয়।

তারা বৈটিত্র্যময় সংস্কৃতির ধারক-বাহক ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম হিসেবে প্রায় ৫০০ শতাধিক বছরের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের উত্থান-পতন,শাসন-শোষণের নীরব স্বাক্ষী। উভয় কূলের জুম্মদের এই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক মেইল বন্ধন উত্তরকূল এবং দেশকূলের জুম্মদের বিকাশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই ক্ষেত্রে “রেগা” নামে আদিবাসী জুম্মদের একটি ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, এই সংগঠনের কাজের ধারাবাহিকতায় ভারতের আদিবাসী সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিঝু উপলক্ষে বিশেষ সফরে এসে থাকে।

দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০১৬ সালের ২৪/২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আদিবাসী লেখক ফোরামের সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে আগত বিশিষ্ট লেখক, গৌতম লাল চাকমা।

বিশিষ্ট কবি ও শিক্ষক, প্রাইয়ারী মঘ চৌধুরী ও এডভোকেট মঙ্গল দেব ব্রহ্মণ প্রমূখ। ২০১৮ সালে রাঙ্গামাটির সাংস্কৃতিক ইনিস্টটিউট প্রাঙ্গনে বিজু মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিজু উপলক্ষে আেেয়াজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন বিশিষ্টি শিল্পি নিরঞ্জন চাকমা ও শান্তি বিকাশসহ ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আগত জুম্ম শিল্পিবৃন্দ।

তারপর সপ্তাহ খানেকের ব্যবধানে আসাম থেকে আগত অহমিআ শিল্পি বৃন্দ রাঙ্গামাটির আসামবস্থীতে আসামীদের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ভাব বিনিময়মূলক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দান শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও গান পরিবেশন করেন।

অনূষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার ২৯৯ আসনের সংসদ সদস্য (এম.পি), শ্রী ঊষাতন তালুকদার প্রধান অতিথি এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ উপস্থিত থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভারতের আসাম রাজ্যের অহমিআ শিল্পিদের পরিবেশিত মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।

ভারত-বাংলাদেশ-এর আদিবাসী সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ও সংরক্ষণে এধরণের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ আদিবাসী জুম্মদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশকে উত্তরোত্তর অনুপ্রাণীত ও উৎসাহিত করবে। বৃহত্তর জুম্ম জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখবে।

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের নির্ধারিত ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে নাগরিক জীবন সীমাবদ্ধ। কিন্তু একটা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারা কোন রাষ্ট্রীয় ভৌগলিক সীমানায় আবদ্ধ থাকতে পারে না।

যেমনি বিশ্ব কবি রবিন্দ্র নাথ ঠাকুর আর বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্য ধারা এপাড় বাংলা ওপাড় বাংলার বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সংস্কৃতির কোন সীমারেখা নেই। যেমন একটা ভাষা ব্যবহার যে কোন মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। সেই ১৯৭০ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গিরিসুর শিল্পি গোষ্ঠীকে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

গ্রামফোন যুগে যে আদিবাসী গিরিসুর শিল্পি গোষ্ঠীর যাত্রা আজকে সেই আদিবাসী সংস্কৃতি আর সেই পুরোনো জায়গায় থেমে নেই। ডিজিটাল যুগে এসে আধুনিক জুম্ম শিল্পি ও সাহিত্যকরা নানা ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইউটিউবে এবং নানারকম সামাজিক যোগাযোগের ম্ধ্যাম পর্যন্ত তাদের শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসনতান্ত্রিক ধারার সাথে সংগতি রেখে জুম্মদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। শাসনতান্ত্রিক অধিকার যখন যেরকম ছিল আদিবাসী জুম্মরা ঠিক ততটুকুই নিজেদের সংস্কৃতি চর্চা করার সুযোগ লাভ করেছিল।

যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতো তাহলে জুম্মরা বৃহত্তর বাঙালি সংস্কৃতির সমপর্যায়ে নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে পারতো। যেকোন জাতির শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সেজাতির কৃষ্টি-সংস্কৃতি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

পরিস্থিতির শিকার হয়ে যারা যেখানে গিয়েছে সেখানে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে ও নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। তাতে অবশ্য ব্যতিক্রম যে ঘটেনি সেটা বলা যায় না। তবে জুম্মদের অধিকাংশই নিজেদের সংস্কুতিকে সহজে হারাতে চায়না।

সে জন্য দেশকূল-উত্তরকূল দু’কূলের জুম্মদের মধ্যে “রেগার” মতো সাংস্কৃতিক সেতু বন্ধন রচনা করা সম্ভব হয়েছে। দেজকূল-উত্তরকূলসহ অন্যান্য সর্বত্র জুম্মদের মধ্যে পোষাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, সামাজিক রীতিনীতি, নাচ-গান, কথা-বার্তা,রুচি-অভিরুচি,ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান ইত্যাদি সর্বত্রই সাদৃশ্য বজায় রয়েছে।

বৌদ্ধ প্রধান কিংবা সনাতন ধর্ম প্রধান দেশের জুম্মরা যেখানেই থাকুক না কেন,তাদের চিনে নিতে কোন সমস্যা হয়না। সেখানে উগ্র সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো দুর্ঘটনার দৃষ্টান্ত কম। সেখানে সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা আছে।

কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়েছে জুম্ম সংস্কৃতি পরিপন্থী উগ্র ইসলামিক সম্প্রসারনবাদের আগ্রাসন। রয়েছে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব বিলোপ সাধনের হাতিয়ার হিসেবে যৌনসহিংসতা। সব দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ পার্বত্য চট্টগ্রামকে সুখী-সমৃদ্ধশালী পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিণত করার জন্য সকল জুম্মদের সুখে-দুখে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। তাই সর্বত্র জুম্ম জাতীয় ঐক্য অনস্বীকার্য।

উপসংহারঃ


খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে গেলে যে কোন মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পুরণ হওয়া চায়। তার জন্য জীবিকার সন্ধানে মানুষ বিশ্বময় চষে বেড়ায়। কেহ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে দাবী দাওয়া আদায়ের আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। অন্যথায় ভোগান্তি ছাড়া তাদের আর কোন গত্যন্তর থাকেনা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরাও তাই করতে বাধ্য হয়েছে। ’৪৭ সালে  বাবুরা আন্দোলন করেছিলেন। ব্যর্থ হয়ে তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে লক্ষাধিক জুম্ম সীমান্ত পাড়ি জমিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যের উদ্দেশ্যে।

কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ জুম্মদের হয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে মহান নেতা এমএনলারমাকেও ’৬২ সালে কারা বরন করতে হয়েছে ’৬২ সালে। কিন্তু তখনকার জুম্ম ছাত্র-জনতার ঐক্যশক্তির কাছে হার মেনে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে।

কারামুক্তির পর আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। তাঁর সংগঠিত আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আজকে পার্বত্য চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হলে ’৪৭ সালের মতো উপর্যূপরি প্রতারিত হতে হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদেরকে।

অতীতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার কথা আলোচনা হলেও বেঙ্গল বর্ডার এওয়ার্ড কমিশনের চেয়ারম্যান,স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিপের এক কলমের খোচায় তা ভন্ডুল হয়ে যায়। আজকের দিনেও দেশের শাসকগোষ্ঠীর একটি মহলের একদেশদর্শিতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত পর্যায়ে।

অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে বার বার উদ্বাস্তু হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে দেশে-বিদেশে।বিদেশ অবিভাসন দ্বারা জীবনজীবিকার ঠাঁই হতে পারে কিন্তু কোন জাতির অস্তিত্ব সংরক্ষণ হতে পারে না।

সুতরাং জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ নিজ দেশ্ইে করতে হয়। তবে সব কাজে সফলতার ভিত্তি হচ্ছে ইস্পাত কঠিন ঐক্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও তাই।বিভেদ নয়, প্রয়োজন সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ইস্পাত কঠিন জুম্ম জাতীয় ঐক্য।

অন্যথায় শাসকগোষ্ঠী সর্বত্রই ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জুম্মদের মধ্যে অর্ন্তকলহ জিইয়ে রাখার সুযোগ নিয়ে থাকবে। দুঃখজনক হলেও একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে,আজকে দেশের একটি স্বার্থাণ্বেষী মহল পার্বত্য চুক্তি পরিপন্থী কার্যকলাপ এবং চুক্তি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর জনমত গঠনে লিপ্ত রয়েছে।

শান্তিকামী জুম্ম জনগণের ভাগ্য নিয়ে চিনিমিনি খেলা করাার অধিকার কারো নেই। জুম্মরা নিজেদের অস্তিত্ব সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সব কিছুই করার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং হিল চাদিগাঙের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ গড়া এবং জুম্মদের ভাগ্য নির্ধারন করার ক্ষমতা জুম্মদের হাতেই।

হিল চাদিগাং
হিল চাদিগাং

জুম্মদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটবে। হিল চাদিগাঙের রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।নিজের ভিটেবাড়ী ছেড়ে জুম্মদের আর কোথাও বড় পরঙ যেতে হবে না। সেরকম উজ্জ্বল সম্ভাবনাময়,সুখী ও সমৃদ্ধশালী হিল চাটিগাঙের দিকে তাকিয়ে জুম্মরা যুগ যুগ ধরে বেঁচেছিল,বেঁচে আছে এবং থাকবে।

লেখক: ধীর কুমার চাকমা; রাজনৈতিক কর্মী।

তথ্য সূত্র ও টীকা

*ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম (১৭৭২-১৯৯৮)
*সূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ইতিকথা-শরদিন্দু শেখর চাকমা]
* “জুম পাহাড়ে শান্তির ঝরনাধারা”-ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি,পৃঃ২৫, পৃঃ২৬,পৃঃ২৭)।

টীকাঃ
জাতি পরিচয়- “আজ থেকে ৫০০ বছর আগে ডি ব্যারোসের মানচিত্রে চাকমাদের যে বসতি অ ল দেখানো হয়েছে এখনো পর্যন্ত সেই অ লটিই চাকমাদের মূল ভূখন্ড রয়ে গেছে। ড.বুকানন যিনি চাকমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন,

তিনি তাঁর গ্রন্তের কোথাও চাকমাদের Tribe বা Tribel নামে উল্লেখ করেন নাই। তিনি চাকমাদের `a nation’ কিংবা Ô-a people’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত পন্ডিত সতীশ ঘোষ তাঁর গ্রন্থে নামকরণ করেছেন ‘চাকমা জাতি’ নামে।

(সূত্রঃ ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম(১৭৭২-১৭৯৮) অধ্যাপক ড.সুনীতি ভূষণ কানুন গো।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা