মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংক্ষিপ্ত জীবনী
3599
ক্ষমা গুণ, শিক্ষা গ্রহণের গুণ, পরিবর্তিত হওয়ার গুণ- এই তিন গুণের অধিকারী না হলে প্রকৃত বিপ্লবী হওয়া যায় না।
– এম. এন. লারমা
রাঙ্গামাটি শহরের অনতিদূরে মহাপুরম একটি বর্ধিঞ্চু গ্রাম। গ্রামের মধ্য দিয়েই ছোট নদী মহাপুরম প্রবাহিত। কিন্তু আজ সেই কর্মব্যস্ত বর্ধিঞ্চু গ্রাম মহাপুরম কাপ্তাই হৃদের অথৈ জলে বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি ও গৌরব।
এই মহাপুরম গ্রামেই জুম্ম জাতির জাগরণের অগ্রদূত, মহান দেশপ্রমিক নিপীড়িত মানুষের ঘনিষ্ট বন্ধু কঠোর সংগ্রামী, ক্ষমাশীল, চিন্তাবিদ, জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) ১৯৩৯ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতা শ্রী চিত্ত কিশোর চাকমা সেই গ্রামেরই জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, ধার্মিক ও সমাজসেবী। স্নেহময়ী মাতা পরলোকগতা সুভাষিণী দেওয়ানও একজন ধর্মপ্রাণা সমাজ হিতৈষীনি ছিলেন।
এম এন লারমার দুই ভাই ও এক বোন। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাধের ফলে জন্মস্থানের বাস্তুভিটা জলে মগ্ন হলে পানছড়িতে নববসতি স্থাপন করেন। এম এন লারমা মাতা পিতার তৃতীয় সন্তান। তাঁর একমাত্র বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা (মিনু) সবার বড়।
তিনিও বেশ শিক্ষিত। বড় ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা (বুলু) ১০ই নভেম্বর মর্মান্তিক ঘটনায় শহীদ হন। শহীদ শুভেন্দু লারমা রাজনৈতিক জীবনে একজন সক্রিয় সংগঠক, বিপ্লবী ও একনিষ্ঠ সমাজ সেবক ছিলেন।
ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু)। তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তিনি হচ্ছেন একজন বিপ্লবী নেতা, সংগঠক, সমাজ সেবক, নিপীড়িত জাতি ও জুম্ম জনগণের একনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু; মহান দেশপ্রেমিক ও কঠোর সংগ্রামী।
তিনি জনসংহতি সমিতির একজন নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। শান্তিবাহিনী গঠনে তাঁর অবদান ও ভূমিক সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ সালে মর্মান্তিক ঘটনায় এম এন লারমা শহীদ হওয়ার পর তিনি জনসংহতি সমিতির সভাপতির পদে নির্বাচিত হন। তিনি এম.এ. পাশ।
এম এন লারমা যৌবনকালে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। বিপ্লবী জীবনের কঠোর পরিশ্রমের পরবর্তীকালে তাঁর স্বাস্থ্য কিছুটা ভেঙে পড়ে।
তাঁর কথা মৃদু, কন্ঠস্বর গভীর, আচার ব্যবহার অমায়িক, ভদ্র ও নম্র। তিনি সৎ, নিষ্ঠাবান ও সুশৃঙ্খল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই সাধাসিধাভাবে জীবন যাপন করতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল তীক্ষ্ণ। তিনি সৃজনশীল মেধার অধিকারী ছিলেন।
কঠোর নিয়মশৃংখলা মেলে চলতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। অসীম ধৈর্য্য, সাহস, মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও কষ্ট সহিষ্ণুতার অধিকারী ছিলেন। এ সমস্ত গুণাবলী অর্জনে তিনি তাঁর পিতামাতার প্রভাবে প্রভান্বিত হয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালে তোলা তিন ভাই শুভেন্দু প্রবাস লারমা, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা, ছবি: এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনএবার কর্মজীবনের পরিচয়ে আসা যাক। ১৯৬৬ সালে তিনি দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরীতে যোগদান করেন। এরপর তিনি ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামে এক প্রাইভেট বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
তাঁর সুদক্ষ কর্মকৌশলের ফলে ঐ বিদ্যালয়টি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল খুবই আকর্ষনীয়।
অতি সহজে কঠিনতম বিষয়বস্তু সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিতে পারতেন। শিক্ষকতার জীবনে তিনি ছাত্রসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ করার প্রয়াস পেতেন।
তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারী মহাবিদ্যালয়ে আইএ ভর্তি হন এবং ১৯৬০ আইএ পাশ করেন। আইএ পাশ করে একই কলেজে বিএ তে ভর্তি হন।
তখন অধ্যয়নরত অবস্থায় রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত করে পাকিস্তান সরকার তাকে নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৩ সালে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় দীর্ঘ দুই বৎসরের অধিক কারাবরণ করার পর শর্তসাপেক্ষে ৮ই মার্চ ১৯৬৫ সালে মুক্তি পান।
সমাজ কল্যাণ বিভাগের অধীনে থেকে একই বছরে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৮ সালে বিএড পাশ করেন এবং ১৯৬৯ সালে এলএল বি পাশ করে একজন আইনজীবি হিসেবে চট্টগ্রাম বার এ্যাসোসিয়েশনে যোগদান করেন।
১৯৭৪ সালে চারু বিকাশ চাকমা বাংলাদেশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হলে ঐ মামলার আইনজীবি হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতা ও মহানুভবতার পরিচয় দেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল হতে আওয়ামীলীগ প্রার্থীসহ সকল প্রতিদ্বন্দীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তারপরে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ গণপরিষদে সদস্য থাকার সময়ে সরাকারি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালে লন্ডনে যান।
এবার আসা যাক রাজনৈতিক জীবনের পরিচয়ে। শ্রদ্ধেয় নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জীবনটাই হচ্ছে আগা গোড়া রাজনৈতিক মহান কর্মকান্ডে বিজড়িত। তিনি পরিবারের পরিবেশ থেকেই রাজনীতির হাতেকড়ি নেন।
বাল্যকাল থেকেই তিনি অধিকার হারা। জুম্ম জনগণের মর্মবেদনা অনুভব করতে পেরেছিলেন। প্রজা শ্রেণী যখন অভিজাত শ্রেণীর নিপীড়ন নির্যাতনে ও শোষণের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছিল তখন নেতার পিতামহ এইসব নির্যাতন নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে সেই যুগে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিলেন।
তাঁর পিতাও একজন প্রগতিবাদী হিসেবে সমস্ত শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আজীবন একজন সংগ্রামী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
সর্বোপরি তাঁর জেঠা কৃষ্ণ কিশোর চাকমা যিনি মহান শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী হিসেবে সর্বপ্রথম জুম্ম জনগণের মধ্যে শিক্ষার আলো দিয়ে জাতীয় চেতনা উন্মেষ সাধনে ব্রতী ছিলেন। সেই মহান ব্যক্তি থেকেও তিনি রাজনীতির অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই স্বীয় সমাজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন।
রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করার সময় একদিন জনৈক শিক্ষক মহোদয় ইসলামি ইতিহাসের উপর পাঠদানের সময় জুম্ম জাতির জাতীয় ইতিহাসের সম্পর্কে পক্ষপাত দুষ্ট কথা বললে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড়িয়ে শিক্ষক মহোদয়ের প্রতিবাদ করেন এবং শেষ পর্যন্ত মাননীয় শিক্ষক তা সংশোধন করে নিতে বাধ্য হন।
এভাবে তিনি ছাত্রজীবন থেকে স্বকীয় জাতীয় বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামী মুখর ছিলেন।
১৯৫৬ সালেই তিনি সর্বপ্রথম জুম্ম ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালের পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনে তিনি এক বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি তখন থেকেই অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে থাকেন। নিম্নোক্ত ঘটনার মাধ্যমে তাঁর পূর্ণ স্বাক্ষর মেলে।
তিনি তখন মেট্রিক পরিক্ষার্থী। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের মাননীয় সুপার ছাত্রাবাসের পরিক্ষার্থীদেরকে সুবিধামতভাবে আহারের সময় নির্ধারণ করে দিতে অনুমতি প্রদান না করলে পরিক্ষার্থীরা তারই নের্তৃত্বে অনশন ধর্মঘট করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ অনুমতি প্রদানে বাধ্য হন।
কলেজ জীবনে রাজনীতির বৃহত্তর চত্ত্বরে প্রবেশ করেন। এই সময়ে তিনি আগের চেয়ে আরো অধিক পরিমাণে জাতিগত শোষণ ও নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। ১৯৬০ সাল জুম্ম জাতির ভাগ্যকাশে এক কালো মেঘ।
কাপ্তাই জলবিদ্যুত প্রকল্পের বাস্তবায়নে জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তকরণে উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তান সরকারের এই হীন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
১৯৬০ সাল থেকে পাহাড়ী ছাত্র সমাজের নের্তৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। ১৯৬২ সালের ঐতিহাসিক পাহাড়ি ছাত্র সম্মেলন তারই নের্তৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর তিনি গ্রামে ফিরে আসলেন এবং জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিক চেতনায় উদ্ভুদ্ধ করতে থাকেন আর অপরদিকে পাহাড়ি ছাত্র সমাজকে একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে থাকেন।
অপরদিকে তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তানের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনেও পদচারণা করতে থাকেন। আর স্বজাতিকে কীভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করা যায় তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকেন।
এইভাবে ৬ষ্ঠ দশক পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণভাবে জুম্ম জনগণকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবব্ধ ও সচেতন করার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত সমাজ যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম সমাজকে অক্টোপাসের মতো আস্তেপৃষ্ঠে ধরে সামনে অগ্রসর হতে দিচ্ছিলনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতি যখন আপন জাতীয় সত্ত্বা ও বৈশিষ্ট্য হারাতে বসলো;
উগ্র ইসলামিক ধর্মান্ধ স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার যখন জুম্ম জাতিকে ধ্বংস করার জন্য একটার পর একটা হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল ঠিক সেই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে পাকাপোক্তভাবে ১৯৭০ সালে আবির্ভূত হলেন এম এন লারমা, বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল চিন্তাধারা মানবতাবাদ নিয়ে লুপ্তপ্রায় জুম্ম জাতির রক্ষাকবচ হিসেবে।
এম এন লারমা, ছবি: স্মারক গ্রন্থ, এম এন লারমাবিলুপ্ত প্রায় জুম্ম জাতির ভাগ্যকাশে দেখা দিল একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেখতে পেল ঘুমন্ত শিশুর চোখে আধুনিক জগতের সভ্যতার আলোক দিশা। চিনতে লাগলো নিজ জাতীয় সত্ত্বাকে।
খুঁজতে লাগলো আপন জাতীয় সত্ত্বা ও বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা করার মুক্তির পথ। ঠিক এমনি সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে এম এন লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
কিন্তু উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সুকৌশলে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করলো কিন্তু জনগণের ভাগ্য পরিবর্তিত হলো না।
শুরু হলো উগ্র বাঙ্গালী মুসলমান জাতীয়তাবাদের নির্মম শোষণ ও নিপীড়ন। মুক্তিবাহিনী ও সরকারী বাহিনীর অত্যাচার আর নির্যাতনে ক্ষত বিক্ষত হলো অক্ষম ও দুর্বল জনগণ।
বহু ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই করে দিল; শত শত মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করে দিল; রাইফেলের গুলিতে হত্যা করলো শত শত লোককে কত অশ্রু ঝরলো চোখে, কত রক্ত ঝরলো বুকে। হায়রে, হতভাগ্য পার্বত্য চট্টগ্রাম।
এইভাবে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন অগ্নি সংযোগ, নারী ধর্ষণ, হত্যা, ডাকাতি, লুঠতরাজ ও সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছিল তখন জুম্ম জাতি রক্ষা করার জন্য তাঁর নেতৃত্বে এগিয়ে আসলেন শিক্ষিত, প্রগতিশীল ও সচেতন জুম্ম সমাজ। দেশ, সমাজ ও দেশ রক্ষার ডাক দিলেন প্রিয় নেতা এম এন লারমা।
১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী এম এন লারমার নেতৃত্ত্বে গঠিত হলো, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”।
এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র ও প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন। জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষা ভাষী ১০টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি। সমিতির কাজ এগিয়ে চললো দুর্বার গতিতে।
তার গতি অপ্রতিরোধ্য। সে চললো রাইফেলের বেয়নটের মাথায়; সে চললো মেশিনগানের গুলির মুখে। কোন কিছু রোধ করতে পারলো না সমিতির মহান কর্মকান্ড।
১৯৭৩ সাল, শুরু হলো নিয়মতান্ত্রিক লড়াই। ৭ই মার্চ নির্বাচন হলো। বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়লাভ করলো এমএন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল থেকে।
দক্ষিণাঞ্চল থেকে জয়লাভ করলো চাথোয়াই রোয়াজা চৌধুরী। বিজয় উল্লাসে মেতে উঠল জুম্ম জনগণ। খুশীতে আত্মহারা জনগণের মুখে ধ্বনিত হলো –
এম এন লারমা জিন্দাবাদ
চাথোয়াই রোয়াজা জিন্দাবাদ
জনসংহতি সমিতি জিন্দাবাদ
এই স্লোগানে মুখরিত হলো পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশ বাতাস। পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী পুরুষ শিশু আবাল বৃদ্ধ বনিতা মনে করলো তাদের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার প্রস্তুত হলো। সুদৃঢ় ও সুগম হলো নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সংগ্রামের পথ।
বাংলাদেশের গণপরিষদের অধিবেশন বসলো। অধিবেশনে যোগদান করার জন্য গেলেন জনগণের দুই প্রতিনিধি। শুধু প্রতিনিধি নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের ভাগ্য নিয়ন্তা হিসেবে। শুরু হলো অধিবেশন যথানিয়মে।
এই অধিবেশনে জুম্ম জনগণের একমাত্র আশা ভরসার গনপ্রতিনিধি এম এন লারমা তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে নিপীড়িত, নির্যাতিত ও শোষিত জুম্ম জনগণের বাচার দাবি উত্থাপন করলেন।
তিনি দাবী জানালেন জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত আঞ্চলিক সায়ত্বশাসন। তিনি আবেগময়ী ও অনলবর্ষী ভাষায় তুলে ধরলেন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সরকারের আমলের নিপীড়িত নির্যাতন ও শোষণের কথা।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের আলাদা জাতিসত্ত্বার কথাও দাবী করলেন। তিনি আশা করেছিলেন যেহেতু আওয়ামীলীগ সরকারও বাঙ্গালি জাতির অস্তিত্ত্বের জন্য ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে সুতরাং জুম্ম জনগণের শোষণ ও বঞ্চণার উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
.
কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, যে বাঙ্গালীরা অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে সেই বাঙ্গালীরাই আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জুম্ম জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলো।
উগ্র বাঙ্গালি মুসলমান জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ শুধু ওখানেই ক্ষান্ত হয় নি। গনতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের মুখোশ পড়ে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সং বিধানের এক কলমের খোঁচাতেই জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব লুপ্ত করে দিতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ করলে- বাংলাদেশে যারা বসবাস করে তারা সবাই বাঙ্গালি নামে পরিচিত হবে।
১৯৭৩ সালে লংগদুর বনভান্তের বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসবে তৎকালীন মহিলা এমপি সুদীপ্তা দেওয়ানসহ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, ছবি: এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনআজীবন সংগ্রামী গণপ্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এই সংবিধানের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানালেন। তিনি সংযত ও দৃপ্তকন্ঠে জানালেন- ” একজন বাঙ্গালী কোনদিন চাকমা হতে পারে না অনুরূপ একজন চাকমাও বাঙ্গালী হতে পারে না”- এই বলে তিনি প্রতিবাদ স্বরুপ সংসদ কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন।
তারপর অধিবেশন শেষ করে তিনি তাঁর কর্মস্থলে ফিরে আসলেন। এদিকে তাঁর সহকর্মীরা অধিবেশনের ফলাফল শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি ফিরে এসে রাগে ও ক্ষোভে বললেন- ” না, এভাবে আর হবে না।
অন্য পথ ধরতে হবে।” তিনি বাংলাদেশ সরকারের হীন কার্যকলাপ তুলে ধরলেন। এরপর অনেক আলাপ আলোচনা হলো। আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো স্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে পুনরায় ডেপুটেশান দেওয়া হবে স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট।
এই ডেপুটেশানেও তিনি নেতৃত্ব দিলেন। যথাসময়ে ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক বসলো। এখানেও দাবী করা হলো জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থা ও অধিকার।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যুত্তরে এম এন লারমা সহ ডেপুটেশানের সকল সদস্য হতবাক ও স্তম্ভিত না হয়ে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বললেন –
” লারমা তুমি কি মনে কর। তোমরা আছ ৫/৬ লাখ বেশি বাড়াবাড়ি করো না। চুপচাপ করে থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না (হাতের তুড়ি মেরে মেরে তিনি বলতে লাগলেন) প্রয়োজনে ১, ২, ৩, ৪, ৫ – দশ লাখ বাঙ্গালী অনুপ্রবেশ করিয়ে তোমাদেরকে উৎখাত করবো, ধ্বংস করবো।”
এইভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিকার আদায়ের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেলো।
বাংলাদেশ সরকার কাছ হতে যখন কোন কিছু আশা করতে পারা গেল না তখন নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পাশাপাশি অনিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের কথাও এম এন লারমা ভাবলেন। অর্থাৎ স্বশস্ত্র সংগ্রামের কথা চিন্তা করতে লাগলেন।
অবশেষে, ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে “শান্তিবাহিনী”। পাশাপাশি এম এন লারমার বলিষ্ট নেতৃত্বে গড়ে উঠলো গ্রাম পঞ্চায়েত, মহিলা সমিতি, যুব সমিতি ও মিলিশিয়া বাহিনী।
১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ সাল, এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী বাকশালী সরকারের পতন হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলনের স্বার্থে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা অভ্যুত্থানের পরপরই আত্মগোপন করেন এবং তখন থেকেই সরাসরি আন্দোলনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন।
১৯৭৭ সালে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। জাতীয় সম্মেলন বেশ কয়েকদিন ধরে। পার্টির কার্য সুষ্ঠূ ও শক্তিশালী করার জন্য সর্বসম্মতি ক্রমে পুনরায় এম এন লারমাকে পার্টির সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হলো।
শুরু হলো আবার সরকারে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম। মহান নেতা এম এন লারমার নেতৃত্বে জুম্ম জনগণ আরো ঐক্যবদ্ধ হলো। পার্টি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো।
অপরদিকে সামরিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ এম এন লারমার শক্ত পরিচালনায় ও শিক্ষায় শান্তিবাহিনী ক্রমান্বয়ে এক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল মুক্তিবাহিনীতে গড়ে উঠলো। শান্তিবাহিনীর সদস্যদের সাহস, কষ্টসহিঞ্চুতা, ধৈর্য্য, মনোবল ও সামরিক দক্ষতা দেখে সরকারি বাহিনীর মনে ত্রাসের সঞ্চার হলো।
দেশ-বিদেশে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার সংগ্রামের কথা, শান্তিবাহিনীর বীরত্বের কথাও প্রচার হতে লাগলো।
যুগে যুগে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপ ধারণ করে আন্দোলনে কখনও হয়েছিল বিপ্লবী সংগ্রামী; আবার কখনও হয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল সুবিধাবাদী ও আপোষপন্থী।
আমাদের বিপ্লবী আন্দোলনেও প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী চিন্তাধারার লোকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রুপ ধারণ করে আসছিল। তারা কখনও সেজেছিল প্রকৃত দেশপ্রেমিক, কখনও সেজেছিল বিপ্লবী, কখনও সেজেছিল বাস্তববাদী প্রগতিশীল ব্যক্তি আবার কখনও হয়েছিল উগ্রজাতীয়তাবাদী।
সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরে অভিনব রুপ ধারণ করেছিল। কিন্তু এম এন লারমা অতি দক্ষতার সহিত সুকৌশলে এসবের মোকাবেলা করে আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল।
একদিকে বাংলাদেশ সরকার অন্যদিকে গৃহশত্রু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী – এই দুই শত্রুর সঙ্গে ক্রমাগত জনসংহতি সমিতি মোকাবেলা করে আসছে।
১৯৮২ সাল, জুম্ম জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এক দুর্যোগপূর্ণ দিন। এই বছরে এতদিনে লুকিয়ে থাকা সেই প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠী মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরেও ক্ষমতার লোভে উচ্চবিলাসী হয়ে সর্বাপোরী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুপ্তচর, দালাল ও ফক্করদের চক্রান্তে জড়িত হয়ে এক উপদলীয় চক্রান্ত শুরু করে দেয়।
১৯৮২ সালের ২৪ শে সেপ্টেম্বরে জাতীয় সম্মেলন শুরু হলো। এই উপদলীয় চক্রান্তকারীরা পার্টিরে নীতি ও কৌশল তথা নেতা ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করতে থাকে এবং স্বশস্ত্রভাবে ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ অপপ্রয়াস চালায়।
এই চক্রান্তকারীরা দ্রুত নিষ্পত্তির মতো অবাস্তব ও সস্তা স্লোগানে বিভ্রান্ত করে রাতারাতি দেশ উদ্ধারের নীতি ও কৌশল প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ অপপ্রয়াস চালায়।
কিন্তু এম এন লারমার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতার এবং তাঁর বলিষ্ট নেতৃত্বে ‘৮২ সালের জাতীয় সম্মেলন সুসম্পন্ন হয়। এই সম্মেলনেও তৃতীয়বারের মত সর্বসম্মতিক্রমে এম এন লারমা পার্টির সভাপতির পদে নির্বাচিত হন।
কিন্তু ক্ষমতালোভী চক্রান্তকারীরা সম্মেলনের রায় মেনে নিলেও চক্রান্তের নাটক এখানে শেষ হলো না।
সম্মেলনের পর এরা আবার নূতন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো অতি সংগোপনে, গোপন বৈঠকে তারা পার্টির সমান্তরাল আরেকটি পার্টি সৃষ্টি করে সেখানে একটি ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করলো। কমিটির নাম দিল জাতীয় গণপরিষদ।
এইভাবে উপদলীয় কার্যকলাপ ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে লাগলো। তবে বহিঃপ্রকাশ হলো ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি। চক্রান্তকারীরা কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ যখন সরিয়ে ফেলতে থাকে তখন ১৪ ই জুন কেন্দ্রীয় অনুগত বাহিনীর সাথে চক্রান্তকারীদের উস্কানীতে এক সংঘর্ষ বাঁধে।
এভাবে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। পার্টির সভাপতি এই সময় দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করে যেতে থাকেন। তাঁর দৃঢ়তা, ধৈর্য্য, সাহস, মহানুভবতা ও ক্ষমাশীলতায় এই গৃহযুদ্ধ অবসান করানোর পথ উন্মুক্ত হলো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ প্রতিক্রিয়াশীল, ক্ষমতালোভী দ্রুত নিষ্পত্তিবাদীরা তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রয়াসে পার্টির গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘন করলো। গৃহযুদ্ধ চলতে যাবে।
নদীর ধারে এম এন লারমা, ছবি: এম এন লারমা মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনজুম্ম জাতির বৃহত্তর স্বার্থ পার্টির সভাপতি বিবেদপন্থী উপদলীয় চক্রান্তকারীদেরকে পুনরায় বৈঠকে বসার জন্য আহ্বান জানালেন এবং বিবেদপন্থীদের সবাইকে ক্ষমা ঘোষণা করলেন।
এই ক্ষমা ঘোষণায় তিনি তাঁর মহানুভবতার ও ক্ষমাশীলতার এক নজির স্থাপন করে জাতীয় ইতিহাসে মহান নেতার পরিচয়ে আরেকবার স্বাক্ষর রাখলেন। যথারীতি উভয় পক্ষের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো।
বৈঠকে আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলন তথা জুম্ম জাতির মহান স্বার্থে গনতন্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ‘ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার নীতি ‘র ভিত্তিতে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
কিন্তু জুম্ম জাতীয় কুলাঙ্গার, উচ্চাভিলাষী ও ক্ষমতালোভী চক্রান্তকারীরা জাতীয় স্বার্থের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ও দালালদের উস্কানীতে উচ্চ পর্যায়ের গৃহীত সিদ্ধান্তের কালি শুকোতে না শুকোতেই ১০ই নভেম্বর ১৯৮৩ সালে
চরম বিশ্বাসঘাকতা করে এক অতর্কিত স্বশস্ত্র হামলায় গিরি, প্রকাশ, দেবেন, পলাশ চক্র প্রিয় নেতা এম এন লারমাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে গৃহযুদ্ধ এক মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়। এভাবে জুম্ম জাতির ভাগ্যাকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবনাবসান হলো।
যিনি জুম্ম জাতির জাতীয় উন্মেষ সাধন করেছিলেন, যিনি জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের লক্ষ্যে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জুম্ম জনগণের মহান পার্টি জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়েছে যারা পতাকাতলে ১০টি ভিন্ন ভাষাভাষী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন,
যার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতায় জুম্ম জাতি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েও আজ টিকে রয়েছে, সেই মহান চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদ এম এন লারমার অকাল মৃত্যুতে সমস্ত পার্টি, শান্তিবাহীনি তথা জুম্ম জনগণের মুক্তি সংরামে নেতৃত্বের যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়।
জুম্ম জাতির কর্ণধার, মহান দেশপ্রেমি এম এন লারমার অবদান জুম্ম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায়ের সংগ্রাম তথা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের চিরস্মরনীয় ও চির দেদীপ্যমান হয়ে থাকে।
তাঁর প্রদর্শিত পথ ও নির্দেশিত নীতিকৌশল আত্মনিয়ন্ত্রাণাধিকার আদায়ের সংগ্রামে একমাত্র দিশারী হয়ে থাকে। মহান নেতার আত্মত্যাগ তিতিক্ষা যুগে যুগে দেশের প্রতিটি মুক্তিকামীর এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণার উৎসস্থল।
তথ্যসূত্র : ১০ই নভেম্বর ‘৮৩ স্মরণে, জুম্ম সাহিত্য সংসদ (জুসাস),
প্রকাশকালঃ ১০ই নভেম্বর ১৯৯৯ ইং।
আরও পড়ুন – আমার চোখে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এম এন লারমা)
রক্তাক্ত ১০ নভেম্বর
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।