খেয়াং রূপকথা: প্রেইঙ্যামঃ লা কোঃমঃ (বুদ্ধিমান ও ধনী লোক)

Jumjournal
Last updated Oct 9th, 2020

893

featured image

একদিন প্রেইঙামঃ (বুদ্ধিমান) এবং কোঃমঃ (ধনী লোক)-এর মধ্যে গলায় গলায় ভাব ছিল।

কিন্তু ক্ষমতা নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে গেল দু’জনের। প্রেইঙ্যা-র (বুদ্ধি) জোর বেশি না কোঃ (ধন)-এর জোর বেশি। একজন বলল, আমার। আরেকজন বলল, না, আমার ।

এভাবে অনেকক্ষণ দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হওয়ার পর এক বন্ধু প্রেইঙ্যামঃ বলল, আমরা কথা বেশি না বাড়িয়ে চল দুজনেই পরীক্ষায় নেমে পড়ি।

তারপর না হয় বুঝা যাবে কার ক্ষমতা কত বেশি। এই প্রস্তাবে কোঃমঃ-ও রাজী, ঠিক আছে তা-ই হবে।

এই বলে দু’বন্ধু কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে মস্ত বড় এক বটগাছের নীচে বসল। দুজনে একই রাস্তার মাথায় দুটি ফুল গাছ রোপণ করল।

প্রেইঙ্যামঃ কোঃমঃ-কে বলল, তুমি এ রাস্তা দিয়ে প্রথমে যাবে। যদি তুমি বিপদে পড় তাহলে তোমার লাগানো ফুল গাছের ডাল মরে যাবে।

এভাবেই আমি তোমার বিপদের কথা জানব। ঠিক আমার বেলায়ও তা-ই ঘটবে।

 ঠিক আছে—- বলে পরীক্ষায় নামল কোঃমঃ (ধনীলোক)। পথ চলতে চলতে এক গভীর বনে পৌছে গেল। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, এক সুন্দরী মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।

তার পাশে একটি বিন ও বুক (কাঁচি ও ডাট)। যখন কোঃমঃ ঐ বিন ও হুক এক করল সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল।

মেয়েটি বলল, কে আপনি? আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। এখুনি ঋষিপ (ঋষি মশাই) এসে পড়বেন।

কোঃমঃ মেয়েটিকে বলল, এই গভীর জঙ্গলে কি করতে এসেছ ? মেয়েটি বলল, আমাকে ঋষিপ বন্দী করে রেখেছে।

আমার মনে খুবই দুঃখ। কোঃমঃ মেয়েটিকে বলল, এই রাস্তায় কোন দিকে যাওয়া যায়।

মেয়েটি বলল, এক বড় রাজার রাজ্যে পৌছা যায়। কিন্তু সাবধান পথে দুটি পুকুর আছে। ডান দিকের পুকুরের পানি মানুষের গায়ে ছিটালে মানুষ বানর হয়ে যায়।

আর বাম দিকের পুকুরের পানি বানরের গায়ে ছিটালে বানর মানুষ হয়ে যায়।

 কোঃমঃ (ধনী লোক)-এর সাথে একটি টিয়ে পাখি ছিল, সে টিয়ে পাখিটিকে সঙ্গে নিয়ে আবার বনের পথ ধরে যেতে লাগল।

চলতে চলতে এক রাজ্যে এসে পৌছাল। ঠিক তখনই সেই দেশের রাজা ঘোষণা করলেন, যে আমার নিকট সাত আড়ি সোনা এবং সাত আড়ি রূপা আনতে পারবে আমি তার সঙ্গে আমার মেয়ের (রাজকন্যার বিয়ে দেব।

এই কথা শুনে কোঃমঃ তো মহাখুশী। কারণ তার টিয়ে পাখিটা তাকে যা চায় তা-ই দিতে পারে।

টিয়ে পাখিটাকে সঙ্গে নিয়ে কোঃমঃ (ধনী লোক) চলল রাজার কাছে।

রাজ দরবারে গিয়ে রাজাকে বলল, মহারাজ, সাত আড়ি সোনা সাত আড়ি রূপা দিয়ে আমি আপনার মেয়েকে (রাজকন্যাকে) বিয়ে করতে রাজী আছি।’

| সন্ধ্যা হলে রাজা তার রানী, মন্ত্রী, সৈন্য, সামন্তকে ডেকে বসালেন।

তাদের মাঝখানে কোঃমঃ (ধনী লোক)-কে বসিয়ে বললেন, ‘এবার দাও আমার সোনা-রূপা। কোঃমঃ তার টিয়ে।

পাখিটাকে বলল, ও আমার টিয়ে, তুমি বমি করে রাজাকে সোনা ও রূপা দাও। টিয়ে সোনা বমি করতে লাগল।

যখন ছয় আড়ি সোনা বমি করল রাজা বললেন, ঠিক আছে পরে এক আড়ি দিও। এখন রূপা দাও। টিয়ে পাখি রূপা বমি করতে লাগল। যখন ছয় আড়ি হল রাজা।

বললেন, হয়েছে হয়েছে পরে এক আড়ি দিও। পরদিন রাজা মহা-ধুমধামে তার কন্যার (রাজকন্যা) সঙ্গে কোঃমঃ (ধনী)-এর বিয়ে দিলেন।

কোঃমঃ খুবই আনন্দ-ফুর্তিতে দিন কাটাতে লাগল।

কয়েকদিন পর রাজকন্যা তার স্বামী কোঃমঃ-এর কাছ থেকে টিয়ে পাখিটাকে চাইল।

কোঃমঃ তার স্ত্রী রাজকন্যাকে সেই টিয়ে পাখিটাকে খাঁচার ভিতরে করে আটকিয়ে দিল।

রাজকন্যার মাথায় খারাপ বুদ্ধি ঢুকল। সেই পাখিটার গলা কেটে সে অন্য টিয়ে পাখি খাঁচায় আটকিয়ে কোঃমঃ-কে ফিরিয়ে দিল।

কোঃমঃ আনন্দ-ফুর্তিতেই দিন কাটাতে লাগল।

কয়েকদিন যেতে না যেতেই রাজা কোঃমঃ-এর কাছ থেকে সেই বাকী পাওনা দুই আড়ি সোনা-রূপা চাইলেন।

কোঃমঃ বলল, ঠিক আছে। সন্ধ্যায় পাওনা সোনা ও রূপা সবার সামনে দিয়ে দেব। সন্ধ্যা হলে রাজা, রানী, মন্ত্রী, সৈন্য এক জায়গায় মিলিত হলেন।

কোঃমঃ টিয়ে পাখিটিকে নিয়ে সবার মাঝখানে বসল এবং খাঁচা থেকে টিয়ে পাখিটি বের করে বলল, ও আমার টিয়ে, তুমি রাজার এক আড়ি সোনা এবং এক আড়ি রূপা বমি করে দিয়ে দাও।

কিন্তু দুর্ভাগ্য! এই টিয়ে পাখিটি তো আসল নয়, কেমন করে সোনা-রূপা বমি করবে ?

সবাই হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন এবং বললেন, কোথায়? তোমার টিয়ে তো কিছুই বুঝেনা।

কোঃমঃ মহাবিপদে পড়ল। তারপর মারতে মারতে তার টিয়েটিকে মেরে ফেলল। এখন উপায়?

রাজা তার পাওনা না পেয়ে তাঁর কন্যার সঙ্গে কোঃমঃ-এর বিবাহ বিচ্ছেদ করলেন এবং কোঃমঃ-কে রাজদরবারের দিন মজুরের কাজে নিয়োগ করলেন, যতদিন পর্যন্ত না ওই বাকী পাওনা শোধ হয়।

কোঃমঃ (ধনী লোক) তার টিয়ে পাখিটাও হারাল এবং তার স্ত্রী রাজকন্যাকেও হারাল।

আর প্রেইঙ্যামঃ (বুদ্ধিমান) ওদিকে দেখল যে, কোঃমঃ-এর লাগানো ফুল গাছের ডাল মরে গেছে। প্রেইঙ্যামঃ ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য পথ চলা শুরু করল।

চলতে চলতে এক গভীর জঙ্গলে এসে পড়ল। সেও দেখল, সেখানে পালং-এ এক সুন্দরী ঘুমিয়ে আছে।

পাশে একটি বিন ও স্নক (কাঁচি ও ডাঁট) আলাদাভাবে পড়ে আছে। প্রেইঙামঃ সেই বিন ও হূক এক করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল।

প্রেইঙামঃ মেয়েটিকে বলল, এখানে কেন এসেছ ? মেয়েটি উত্তরে বলল, ঋষিপ আমাকে এখানে এনে আটকে রেখেছে।

আমার মনে খুবই দুঃখ । প্রেইঙ্যামঃ মেয়েটিকে বলল, রাস্তা কোনদিকে দেখিয়ে দিবে ? মেয়েটি বলল, সোজা এই পথ ধরে যাও।

কিন্তু সাবধান! মাঝ পথে দুটি পুকুর দেখতে পাবে। ডান দিকের পুকুরের পানি মানুষের গায়ে ছিটালে মানুষ বানর হয়ে যায়, আর বাম পাশের পুকুরের পানি বানরের গায়ে ছিটালে বানর মানুষ হয়ে যায়।

প্রেইঙ্যামঃ দু’টি বাঁশের চোঙা কেটে ডান দিকের পুকুরের পানি একটি চোঙায় ভরল এবং আরেকটিতে বাম পাশের পুকুরের পানি ভরল।

প্রথমে গিয়ে ডান দিকের পানি মেয়েটির গায়ে ছিটাল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বানর হয়ে গেল। মেয়েটির গলায় রশি বেঁধে প্রেইঙ্যামঃ পথ চলা শুরু করল ।

চলতে চলতে এক বিরাট রাজ্যে এসে পৌঁছাল। সেখানে গিয়ে দেখল যে, তার বন্ধু কোঃমঃ (ধনী লোক) তার সর্বস্ব হারিয়ে রাজার গোলামি করছে।

প্রেইঙ্যামঃ বুঝল যে, কোঃমঃ-এর স্ত্রী রাজকন্যার দোষেই তার এমন অবস্থা।

যখন রাজকন্যার গোসলের সময় হল। তখন রাজদরবারের চাকরানীরা একটা করে কলসি নিয়ে পুকুরে পানি আনতে গেল।

তখন প্রেইঙ্যামঃ (বুদ্ধিমান) লুকিয়ে গিয়ে চাকরানীদের কলসিতে সেই মাঝ পথের ডান পাশের পুকুরের পানি ঢেলে দিল।

সেই পানি নিয়ে যখন রাজকন্যাকে গোসল করানো হল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকন্যা বানর হয়ে গেল এবং গাছের উপর উঠে বসে রইল।

এ খবর পেয়ে রাজা দেখতে এলেন। সত্যি সত্যি তার মেয়ে বানর হয়ে গেছে। তার গলায় সোনার হার ঝুলে আছে।

এতে রাজা দুঃখে-অপমানে রাজদরবার থেকে আর বের হলেন না।

এই সুযোগে প্রেইঙ্যামঃ (বুদ্ধিমান) রাজার কাছে গিয়ে বলল, মহারাজ, আমি অনেক দূর হতে এসেছি।

আমি যত বানর আছে সবগুলি ধরে পালন করি। যদি আপনি আপনার মেয়েটিকে দিয়ে দেন, কারণ আপনার মেয়ে তো বানর হয়ে গেছে।

এরকম বানর মেয়েকে রাখলে আপনার মান-সম্মান থাকবেনা। রাজা ভাবলেন, ঠিক তো বলেছে লোকটা।

তারপর প্রেইড্যামঃ-কে রাজা বললেন, বানরটিকে ধরে নিয়ে যাও। প্রেইঙ্যাম তার বন্ধু কোঃমঃ ও বানর রূপী দুই সুন্দরী মেয়েকে সঙ্গে করে নিজ দেশে ফিরে গেল।

প্রেইঙ্যামঃ তার ঝুলির ভেতর থেকে পানি ভর্তি বাঁশের অপর চোঙা বের করল এবং প্রথমে ঋষিপ-এর বন্দী করা মেয়েটির গায়ে ছিটাল।

সঙ্গে সঙ্গেই সেই বানরটি মানুষ হয়ে গেল। কোঃমঃ (ধনী) আশ্চর্য হল, এই মেয়েটি তো সেই গভীর জঙ্গলে ঘুমিয়ে থাকা সুন্দরী মেয়ে।

তারপর প্রেইঙামঃ দ্বিতীয় বানর অর্থাৎ রাজকন্যার গায়ে সেই পানি ছিটাল। সঙ্গে সঙ্গেই বানর থেকে আবার রাজকন্যা হয়ে গেল।

এতেও কোঃমঃ আশ্চর্য জ্ঞান লাভ করল। প্রেইঙ্যামঃ (বুদ্ধিমান) রাজকন্যার সঙ্গে তার বন্ধু কোঃমঃ-এর বিয়ে দিল। প্রেইঙ্যামঃ নিজে অন্য মেয়েটিকে বিয়ে করল।

তখন প্রেইঙ্যামঃ (বুদ্ধিমান) কোঃমঃ (ধনী লোক)-কে বলল, কি বন্ধু, আমার সঙ্গে বাড়াবাড়ি করেছিলে, এখন বুঝলে কার ক্ষমতা বেশি—- প্রেইঙ্যা (বুদ্ধি) নাকি কোঃ (ধনের)১. এর ক্ষমতা বেশি?

লেখক: অনুপম খিয়াং

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা