লুসাই জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (রৌ চান)

Jumjournal
Last updated Dec 14th, 2019

802

featured image

লুসাই উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী লুসাই সমাজে অদ্যাবধি জুম চাষ তাদের প্রধান পেশা।

১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ নং বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে লুসাই সমাজে স্থাবর সম্পত্তির তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অতীতে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী লুসাই সমাজে সুস্পষ্ট তেমন কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি।

ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য নুতন নুতন জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে লুসাই জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যানকৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হচ্ছে।

লুসাই সমাজভুক্ত একটি পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করায় দায়-দায়িত্ব পালন দ্বারা মুতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়াটা সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

কুকি-চিন ভাষাভাষী মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীভুক্ত লুসাই সমাজ পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে পিতাই হলেন প্রধান। তার সূত্র ধরেই সন্তানদের বংশ গণনা করা হয়।

 

লুসাই উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: লুসাই সমাজভুক্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সমাজের অনুশাসন অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি অর্থাৎ ‘থু রৌ ছিয়াহু’ রেখে মারা যায় সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য।

অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদি পশু ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়।

কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না।

কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়।

তাই উত্তরাধিকারের যোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।

কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

 

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি: তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ নং ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মুলে তিনি মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী লুসাই পরিবারে কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় খরচ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তির দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবী পরিশোধ বা নিষ্পন্ন করার পর নিম্নোক্ত উপায়ে লুসাই সমাজে উত্তরাধিকার রীতির প্রচলন রয়েছেঃ-

চাকমা ও বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী লুসাই সমাজে মৃত ব্যক্তির কনিষ্ঠ পুত্র সন্তানই পিতার সম্পত্তির অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। পরিবারের স্ত্রী ও কন্যা যথাক্রমে স্বামীর ও পিতার দান কিংবা উইলমূলে প্রদত্ত সম্পত্তি অথবা বিবাহ বিচ্ছেদজনিত কারণে প্রাপ্ত স্বামীর সম্পত্তির অধিকারী হয়। পুত্রের অবর্তমানে সহোদর ভাই, ভাইপো উত্তরাধিকারী হয়।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০এর ৪৮ নং বিধিমতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০-এর ৪৮ নং বিধিতে লুসাই সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

খ) লুসাই সমাজের সমাজপতি বা পাড়াপ্রধান পদটি বংশানুক্রমিক হিসেবে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র অগ্রাধিকার পায়, যদিও উক্ত পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমতে স্বীকৃত নয়। এক্ষেত্রে সমাজপতির সিদ্ধান্তই সমাজের নিকট গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকে।

 

লুসাই সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস: লুসাই পরিবারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক নিম্নবর্ণিত শ্রেণী বিন্যাসের ক্ষেত্রে ‘লাল’ বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত বা কার্বারী বা হেডম্যান- এর সামাজিক আদালতের প্রতিকার ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ঃ-

ক) স্ত্রী বলতে সমাজ স্বীকৃত স্ত্রী, সন্তান বলতে ঔরসজাত ও দত্তক সন্তানকে বুঝাবে। মৃতের সংসারে অবস্থানকারী বিধবা স্ত্রী জীবনস্বত্ব ও অবিবাহিত কন্যাগণের বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত মৃতের সম্পত্তি হতে ভরনপোষণের অধিকারী হয়। মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারীকে মৃতের স্ত্রী ও কন্যার অভিভাবক রূপে ভরনপোষণের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয়।

খ) লুসাই পরিবারে মৃতের কোনো পুত্র সন্তান যদি না থাকে সেক্ষেত্রে মৃতের ভ্রাতা/ভ্রাতুস্পুত্র/গোত্রের রক্ত সম্পর্কীয় পুরুষ মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

গ) স্বামী-স্ত্রী: লুসাই পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ না হলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে আমৃত্যু ভরনপোষণলাভের অধিকারী হয়।

ঘ) পিতা-মাতা: মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী যদি থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতামাতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়: লুসাই সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি, পিতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, ভ্রাতুপুত্র উত্তরাধিকারী হয়।

চ) লুসাই পরিবারে মৃতের যদি পুত্র, পিতা, ভাই এবং ভাইপো এ সকলের রক্ত সম্পর্কীয় নাতি কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে জেঠা/কাকা উত্তরাধিকারী হয়।

ছ) লুসাই সমাজে মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পৰ্কীয় কেউ না থাকাবস্থায় ‘লাল’ বা সমাজপতি বা সামাজিক আদালতে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সম্পত্তির পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়।

 

সম্পত্তির ভাগবন্টন:

ক) লুসাই সমাজে মৃত স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রী উত্তরাধিকারী হয় না। তবে মৃতের (মেয়থায়) স্ত্রী তার সন্তানদের সাথে বসবাস করলে তাকে পরিবারের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। বিধবা স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে পূর্ব স্বামীর পরিবারের সকল অধিকার হারায়।

খ) লুসাই সমাজে কন্যা সন্তানেরা পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে প্রাপ্ত স্বামীর সম্পত্তি অথবা পিতৃ পরিবারের দান করা সম্পত্তি বা দ্রব্য তার অধিকারে থাকে।

গ) লুসাই সমাজে পুত্র সন্তানেরা পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে কনিষ্ঠ পুত্র পিতার সম্পত্তি বেশী পায়। কনিষ্ঠ পুত্রের কাছে পিতা-মাতা ভরনপোষণ পায় বলে সম্পত্তির বড় অংশ তার অধিকারে থাকে। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ পুত্র ছাড়া অন্যান্য সন্তানেরা সম্পত্তির সামান্য ভাগ পায় ।

অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতা) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়।

তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয় সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারেনা, সন্তান কেবলমাত্র নিজ মায়ের নামীয় সম্পত্তির (যদি থাকে) উত্তরাধিকারী হয়।

আরো পড়ুন – লুসাই জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (ইনমাক)


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা) ।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা