সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক অধিকার – সজীব চাকমা

Jumjournal
Last updated Dec 14th, 2020

600

featured image

সংস্কৃতির স্বরূপ

আমরা যখন ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড’, ‘সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রসঙ্গের সম্মুখীন হই, তখন আমরা চট করে সাধারণভাবে বুঝে নিই যে, কোন নৃত্য, সঙ্গীত, নাট্যকলা, কৌতুক, আবৃত্তি, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কিত কোন অনুষ্ঠান, কর্মকান্ড বা প্রতিষ্ঠানের কথাই বলা হচ্ছে।

কিন্তু আমরা যখন নির্দিষ্টভাবে ‘সংস্কৃতি’র (culture) কথা বলি তখন তার অর্থ কেবল তাতে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা আরও ব্যাপক রূপ লাভ করে । সে কারণে বিশ্বে সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় অর্থে ‘সংস্কৃতির সংজ্ঞায়ন লক্ষ্য করি ।

বস্তুত সীমাবদ্ধ অর্থে হােক বা ব্যাপক অর্থে হোক মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট বা উদ্ভাবিত বা লালিত বস্তুগত বা ভাবগত সকল উৎপাদনই সংস্কৃতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বলা যেতে পারে, মানব সভ্যতার ভাল-মন্দের সারসংকলনই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষক গােপাল হালদারের অভিমত হচ্ছে, সংস্কৃতি বলিতে শুধু যে ঘরবাড়ি, ধন-দৌলত, যানবাহন বুঝায় তাহাও নয়।… সংস্কৃতি বলিতে মানব-সম্পদও বুঝায়- চিন্তা, কল্পনা, দর্শন, ধ্যান-ধারণা, এইসবও বুঝায়, তাহাও আমরা জানি।

আসলে বাস্তব ও মানসিক সমস্ত কৃতি বা সৃষ্টি লইয়াই সংস্কৃতি- মানুষের জীবন-সংগ্রামের মােট প্রচেষ্টার এই নাম। অপরদিকে যুক্তিবাদী, দার্শনিক ও প্রগতিশীল চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত ড. আহমদ শরীফের লেখায় পাই, ‘সংস্কৃতিকে যদিও ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা যায় না, কোন বস্তুর মত মূর্তিমান দেখা যায় না, তবু মানুষের সমস্ত কর্মকান্ডের মধ্যেই- অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, ব্যবহারিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কর্মকান্ডের মধ্যেই তার সংস্কৃতি নিহিত থাকে ।… সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিস্রুত জীবনচেতনা।… চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শােভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।

তবে এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক, ভারতীয় বিজ্ঞান যুক্তিবাদী সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এবং যুক্তিবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত প্রবীর ঘােষের বক্তব্য আরও সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। তাঁর ‘সংস্কৃতি : সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, সংস্কৃতির মূল উপাদানগুলােকে আমরা প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি। এক : বস্তুগত উপাদান; দুই : অবস্তুগত (অর্থাৎ ভাবগত) উপাদান।

বস্তুগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে মানবগােষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুসমূহ। যেমন- বাসস্থান, গৃহ-সামগ্রী (যার মধ্যে মাদুর, চাটাই, হাতপাখা, কুলাে দাওয়া থেকে ফ্রিজ, ওয়াটার কুলার, এয়ার কুলার, টেলিভিশন, জেনারেটর ইত্যাদি সবই পড়ে), পােশাক, খাদ্যাভ্যাস, শস্য উৎপাদন পদ্ধতি, শিল্প উৎপাদন পদ্ধতি, পথ-ঘাট, যানবাহন, চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি সবকিছুকেই সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান হিসেবে আমরা গ্রহণ করব।

অবস্তুগত উপাদান বলতে আমরা গ্রহণ করব মানুষের চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভূত উপাদানগুলােকে। এর মধ্যে আছে যুক্তিবাদী চিন্তা, মূল্যবােধ, নীতিবােধ, অজানাকে জানার আগ্রহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি।

এরই পাশাপাশি অবস্তুগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, নাটক, চলচিত্র ইত্যাদি নানা শিল্পকলা যার মধ্যে অনেক সময় মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে ভাববাদী অলীক চিন্তা, অন্ধ বিশ্বাস, অন্ধ-সংস্কার, ঈশ্বরতত্ত্ব, তথাকথিত ধর্ম ইত্যাদি।

বলাবাহুল্য, মানব সমাজ নানা জাতিতে, নানা ভাষায়, নানা ভৌগলিক সীমানায়, নানা শ্রেণিতে, আর্থ-সামাজিক বিকাশের নানা পর্যায়ে বিভক্ত। ফলে সংস্কৃতি বলতে কোন জনগােষ্ঠীর বা জাতির স্বতন্ত্র বা জাতীয় সংস্কৃতিকেই উল্লেখ করা হয়। যেমন বলা হয়, ফরাসি সংস্কৃতি, রুশ সংস্কৃতি, বাঙালি সংস্কৃতি, আমাদের ক্ষেত্রে আদিবাসী সংস্কৃতি, জুম্ম সংস্কৃতি কিংবা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সংস্কৃতি ইত্যাদি।

এমনকি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে বলা হয় সামন্তবাদী সংস্কৃতি, পুঁজিবাদী সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি, ধনী শ্রেণির সংস্কৃতি, মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি, শ্রমজীবী শ্রেণির সংস্কৃতি ইত্যাদি।

আবার বলা হয়, কোন সমাজের ভিত্তি বা অবকাঠামাে হল তার অর্থনীতি এবং কোন নির্দিষ্ট সংস্কৃতি হচ্ছে সেই নির্দিষ্ট সমাজের রাজনীতি ও অর্থনীতির ভাবাদর্শগত প্রতিফলন। পরিশেষে এ প্রসঙ্গে বলা যায়, মানুষের যেসব কৃতি বা সৃষ্টি বা গুণাগুণ মানুষকে তার পশুজগত থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছে সেসবই তার সংস্কৃতি এবং যে সব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বা অর্জনসমূহ এক মানবগােষ্ঠীকে অন্য মানবগােষ্ঠী থেকে স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা দান করে সেটাই সেই জাতির বা সমাজের সংস্কৃতি।

বলাবাহুল্য, সংস্কৃতি অনড়, অচল বা অপরিবর্তনীয় নয়; প্রতিনিয়ত এর পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কিন্তু তার বিশেষত্বকে ধ্বংস করে পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়, তা বস্তুত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নয়, কোন না কোন বিশেষ সংস্কৃতিরই ধ্বংসসাধন।

বস্তুজগতের সকল কিছুর মত সংস্কৃতিরও রয়েছে প্রগতিশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধ্বংস ও সৃষ্টির খেলা, ভালাে ও মন্দ এবং তার আপন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যের মধ্যে এ সমস্ত ব্যাপারগুলাে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হতে থাকে।

আবার এক সমাজের সংস্কৃতি অপর সমাজের সংস্কৃতির জন্য পুষ্টি যােগাতে পারে। মাও সেতুং লিখেছেন, নিজস্ব সংস্কৃতির পুষ্টি সাধনের জন্য প্রচুর পরিমাণে বিদেশী প্রগতিশীল সংস্কৃতি গ্রহণ করা উচিত।’

সংস্কৃতির গুরুত্ব

যে কোন ব্যক্তি বা জাতির তার জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষা, সৃজনশীল ও মর্যাদাপূর্ণ বিকাশের জন্য তার অতীয় সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে জনগােষ্ঠীর বা জাতির সংস্কৃতি যত উন্নত বা বৈশিষ্ট্যপর্ণ, সে জাতি তত অগ্রসর বা বৈচিত্র্যপূর্ণ বলে বিবেচিত।

বস্তুত আমরা যখন কোন বিশেষ জাতি বা জাতিসত্তার কথা বলি, তখন তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংস্কৃতির নিরিখেই তা উল্লেখ করি। যেমন আমরা যখন বাঙালি জাতি, জুম্ম জাতির কথা বলি, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, মারমা, ম্রো.. জাতির কথা বলি, তখন তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির নিরিখেই তা বলি। ফলে কোন জাতির বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সংস্কৃতির বিলুপ্তি মানে সেই জাতির জাতীয় অস্তিত্ব বিলুপ্তি ।

সংস্কৃতির এই বিশিষ্টতা যদি না থাকত তাহলে বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকত না। আর বৈচিত্র্য না থাকলে মানব সভ্যতা তথা মানব জাতি কখনােই এত সৃজনশীল, এত সমৃদ্ধ, এত অগ্রগতিশীল হতে পারতাে না।

আজকে সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার অগ্রগতির পশ্চাতেও কেবল কোন একটি বিশেষ জাতির নয়, বরং ক্ষুদ্র-বৃহৎ, অগ্রসর-অনগ্রসর বিভিন্ন জাতির মানুষের কোন না কোন অবদান বা ভূমিকা রেখেছে।

পৃথিবীর অনেক খাদ্যদ্রব্য এবং ওষুধপত্রের আবিষ্কারক আদিবাসী জাতিগােষ্ঠীর জনগণ। জানা যায়, আমরা যে চা, কফি পান করি, চিনি, মসুর ডাল, আলু ইত্যাদি খাই- এসবের প্রথম আবিষ্কারক আদিবাসীরা। বলা হয়, পৃথিবীতে যত ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে তার শতকরা ৭৫ ভাগই এসেছে আদিবাসীদের জ্ঞান থেকে।

বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিভিন্ন শিল্পকলা, পােশাকপরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি সমৃদ্ধকরণের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে এদেশের আদিবাসী জাতিসমূহের কোন না কোন অবদান নিহিত রয়েছে।

সাংস্কৃতিক অধিকার

প্রত্যেক জাতিই তার সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে ও বিকশিত করতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিও তার ব্যতিক্রম নয়। আর প্রত্যেক সংস্কৃতিমান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবােধসম্পন্ন ব্যক্তি বা জাতি নিজের সংস্কৃতির ব্যাপারে যেমন শ্রদ্ধাশীল, তা বিকশিতকরণে যত্নশীল, তেমনি অপর জাতির সংস্কৃতির ব্যাপারেও শ্রদ্ধাশীল এবং যত্নশীল।

কিন্তু কোন রাষ্ট্রে বা সমাজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা মূল্যবােধের অভাব থাকলে এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ নিম্নগামী হলে, সেখানে ভিন্ন কোন সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক অধিকার সংকটের মধ্যে পড়তে বাধ্য হয়। ফলে সেখানে শাসকগােষ্ঠী বা শাসক জাতিগােষ্ঠীর দ্বারা ভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিনিয়ত ভূলুষ্ঠিত হতে থাকে এবং সেই ভিন্ন সংস্কৃতি নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন, আক্রমণ ও আগ্রাসনের শিকার হয়।

পৃথিবীতে এভাবে অনেক জাতির স্বকীয় সংস্কৃতিকে আগ্রাসন ও আঘাত হানার কারণে সেই জাতির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে সেই জাতির অস্তিত্বকেই মুছে দেয়া হয়েছে। এখানে জুম্ম জাতির স্বাতন্ত্রপূর্ণ সংস্কৃতিকে যদি বিলােপ করে দেয়া হয়, তাহলে এখানে জুম্ম জাতি, চাকমা, মারমা জাতি বলে কারও অস্তিত্ব থাকবে না। সেই জাতির মানুষের অস্তিত্ব হয়ত থাকবে অন্য কোন জাতির পরিচয়ে।

‘বিশ্বজনীন মানবাধিকার ঘােষণা’সহ আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি’, ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চুক্তি’, আইএলও’র ‘আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগােষ্ঠী বিষয়ক ১০৭ নং কনভেনশন’, ‘আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ১৬৯ নং কনভেনশন, ২০০৭ সালে প্রণীত আদিবাসী জাতিগােষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘােষণাপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও দলিলে আদিবাসী জাতিগােষ্ঠীসহ সকলের নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রথাগত প্রতিষ্ঠান অক্ষুন্ন রাখা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রথা এবং ঐতিহ্য মােতাবেক তাদের আত্মপরিচয় অথবা সদস্যপদ নির্ধারণের অধিকার এর স্বীকতি দেয়া হয়েছে।

সংস্কৃতি এবং ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ

বলাবাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্মদের স্বকীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশের সাথে তাদের বন ও ভূমির অধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

আদিবাসী জুম্মদের জীবন, জীবিকা ও ঐতিহ্য এখনও অনেকাংশে তার বন, ভমি ও ছড়ার সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এখানে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত আদিবাসী জুম্মদের ভূমির উপর অনন্য সামাজিক/সমষ্টিগত মালিকানা ব্যবস্থা, ঐতিহ্যবাহী চাষ (যেমন জুম চাষ), প্রথাগত তাই ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে জুম্মদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক জীবনধারা।

রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত এসবের অধিকার উপেক্ষা বা লঙ্ঘন করে চলেছে, যার অর্থ জুম্ম সংস্কৃতি ধ্বংসসাধন। এ অঞ্চলে জুম্মদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকার এবং ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার সুরক্ষিত না থাকলে তার সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও গতিধারা বিপন্ন হতে বাধ্য।

ইতােমধ্যে উন্নয়নের নামে ষাট দশকে নির্মিত কাপ্তাই বাঁধের কারণে জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ ও ব্যাপক স্থানান্তরের ফলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্যাপক জাতিগত আগ্রাসন ও জুম্মদের আন্দোলন দমনের নামে ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ফলে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পুনর্বাসিত বাঙালি সেটেলারদের কর্তৃক ব্যাপক ভূমি বেদখল ও নানামুখী আগ্রাসী তৎপরতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জাতীয় অস্তিত্ব, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক অধিকার আজ নানাভাবে বিপন্ন এবং গভীরভাবে সংকটগ্রস্ত।

এছাড়া প্রতিনিয়ত বিজাতীয় ও সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ও অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কবলে পড়ে তুলনামূলকভাবে কম জটিল ও অপ্রস্তুত জুম্ম সংস্কৃতি চরম এক ভারসাম্যহীনতার সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়

গত ৩০ জুন ২০১১ জাতীয় সংসদে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীর মাধ্যমে একদিকে আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে জাতিগত আত্মপরিচয়ের দাবীকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং আদিবাসীদের নিকট অগ্রহণযােগ্য “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গােষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে অসম্মানজনকু, ও বিভ্রান্তিকর পরিচয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে; অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচিতি প্রদান করার মাধ্যমে ভিন্ন ভাষাভাষি ও ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী আদিবাসী জাতিসমূহকেও ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

ফলে পূর্বের মতাে এবারের সংবিধান সংশােধনের সময়েও সংবিধানে অন্য সকল আদিবাসীসহ জুম্মদের কাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারগুলো সম্পূর্নভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।

বস্তুত বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীর মাধ্যমে ভিন্ন ভাষাভাষি, স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারকবাহক এদেশের ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতির মানবাধিকারকেই লংঘন করা হয়েছে।

এছাড়া ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠী (পূর্বে ‘উপজাতীয়) সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট’ নামে প্রতিষ্ঠান থাকলেও এ অঞ্চলের আদিবাসী জুম্ম জাতিসমূহেম বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অতি নগণ্যই বলা যেতে পারে। এ প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত বরাদ্দ, পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও উপযুক্ত পরিকল্পনা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ নং অনুচ্ছেদ-এ ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন..’ কথাটি উল্লেখ থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ক্ষেত্রে তা যেন কথার কথা মাত্র, বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয় না।

বরঞ্চ জুম্মদের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য বিপন্ন করে এমন কর্মকান্ডই যেন দীর্ঘ দিন ধরে সরকার বা প্রশাসনের পৃষ্ঠপােষকতা পেয়ে আসছে। বিভিন্ন স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ এবং এমনকি আগে থেকে প্রচলিত কোন স্থান বা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বা মুছে দিয়ে এই এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত নয় এমন নামই প্রতিষ্ঠার বা প্রচলনের নানা প্রচেষ্ঠার ক্ষেত্রে খােদ সরকারী কর্তৃপক্ষই যেন পৃষ্ঠপােষকতা ও উৎসাহ দিয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে সরকার বা শাসকগােষ্ঠী প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক আইনে ও বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত আদিবাসী মানুষের সাংস্কৃতিক অধিকার লংঘন বা খর্ব করে চলেছে। কেবল রাঙ্গামাটি শহরেও সাম্প্রতিক কালে প্রচলিত ‘সুখীনীলগঞ্জ’, ‘আমানতবাগ’, ‘মােহাম্মদপুর ইত্যাদি ধরনের নানা স্থানের নাম পাওয়া যাবে।

আর সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘রাঙামাত্যা’র রাঙ্গামাটিতে, নান্যাচর’র নানিয়ারচর-এ, মালছড়ি’র মহালছড়িতে, বাঘেইছড়ি’র বাঘাইছড়িতে, হাগারাছড়ি’র খাগড়াছড়িতে, ‘ফালিটাঙ্যা চুক’র পাকিস্তান টিলায় পরিণত হওয়ার উদাহরণ পাওয়া যাবে অসংখ্য। এসব নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া কী হতে পারে? এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত জুম্মদের পরিচয় ও স্মৃতিচিহ্ন কেবল কোন দলিল-পত্রে বা জাদুঘরেই সংরক্ষিত থাকবে।

সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার

কোন জাতির আত্মপরিচয় রক্ষা, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও এর বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে সে জাতির বা জনগােষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একটি অপরিহার্য শর্ত। যে কোন ব্যক্তি বা জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক মানবাধিকার।

বস্তুত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ছাড়া কোন জাতির জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হতে পারে না। সে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার হতে পারে কোন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামাের মধ্যে অথবা কোন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

বাঙালি জাতি যদি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারত বা পাকিস্তানের শাসন-শােষণ থেকে মুক্তি লাভ করতে না পারত কিংবা ভারত যদি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শােষণমুক্ত হতে না পারত তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাঙালি জাতি বা ভারতীয় জনগােষ্ঠী আজ যে পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, সে পর্যায়ে পৌছুনাে সম্ভব হত না।

কেননা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারই কোন ব্যক্তি বা জাতির তার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ, নির্ধারণ ও বিকাশের অধিকার অবাধভাবে নিশ্চিত করে । কিন্তু যে বাঙালি জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সেই বাঙালি জাতির শাসকগােষ্ঠী জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় চরম উদাসীনতা, অবহেলা ও উপেক্ষা করে চলেছে।

জুম্ম সংস্কৃতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও তার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে সহায়ক বিভিন্ন ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

চুক্তির (ক) খন্ডের ১ ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। চুক্তির (ঘ) খন্ডের ১১ ধারায় উল্লেখ করা হয়, ‘উপজাতীয় কষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য সরকার। নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সচেষ্ট থাকিবেন। সরকার উপজাতীয় সংস্কৃতির কর্মকান্ডকে জাতীয় পর্যায় বিকশিত করার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পৃষ্ঠপােষকতা ও সহায়তা প্রদান করিবেন।

এছাড়া জম্মদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষে ভূমি কমিশন এর মাধ্যমে ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তিকরণ, পার্বত চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকরকরণ, অস্থায়ী সকল সেনা, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভােটার তালিকা ও নির্বাচন অনুষ্ঠিতকরণসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে যেগুলাে জুম্ম সংস্কৃতি সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ।

বস্তুত দীর্ঘ সংগ্রাম, অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত অধিকারসমূহ স্বীকৃত বা অর্জিত হয়েছে তা যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে তাতে জন্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি রক্ষণাবেক্ষণ ও বিকশিতকরণের জন্য অবশ্যই উল্লেখযােগ্য অনুকূল বাস্তবতা সৃষ্টি হবে।

কিন্তু বিগত দেড় দশকেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় জুম্ম জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় চরম এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে চুক্তির মধ্য দিয়ে আদিবাসী জুম্মদের বন, ভূমি, ভূখন্ড, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সংস্কৃতির অধিকার যতটুকু স্বীকৃত হয়েছে তা থেকেও আজ তারা বঞ্চিত হয়ে রয়েছে।

তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ দেশে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানব বসতি ও বৈচিত্র্যময় সভ্যতা বিনির্মাণের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের ব্যাপক অবদান থাকা সত্ত্বেও বাঙালি শাসকগােষ্ঠী তার যথাযথ মূল্য বা স্বীকৃতি দিতে নারাজ।

এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চিরতরে জুম্ম সংস্কৃতি ধ্বংসকরণের নানা আয়ােজন বা এই সংস্কৃতিকে কোন একটা সীমিত গন্ডীতে বা বদ্ধ জলাশয়ে আটকে রেখে তা কেবল দর্শনীয় একটি পণ্যে পরিণত করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রীতে পরিণতকরণের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।

জুম্ম জাতিকে বা জুম্ম জাতির সংস্কৃতিকে অবরুদ্ধ, বঞ্চিত বা অবহেলিত রেখে এবং শােষণ-বৈষম্যে নিপতিত করে এই রাষ্ট্র এই সরকার কখনাে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে পারবে না।

তাই আসুন আমরা এমন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলি, এমন গান রচনা করি ও গাই, এমন নৃত্যকলা ও চিত্রকলার চর্চা করি, এমন ভাস্কর্য নির্মাণ করি, এমন কবিতা ও সাহিত্য রচনা করি, এমন মল্যবােধ ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করি, এমন জীবনবােধ ও দর্শন লালন করি, তথা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলি যাতে আমরা অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে, সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি এবং একটি সুন্দর, মানবিক, বিজ্ঞান চেতনা ভিত্তিক, উন্নত ও শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে পারি।

লেখক: সজীব চাকমা।
২৫ মার্চ ২০১৩
sajibchakma2000@yahoo.com

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা